Tuesday, October 20, 2020

চন্দন পাল

আন্টির জিৎ

    হীরাপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চুজকামিজপরা  নতুন দিদিমনি এসেছেন ।  বিদ্যার্থীরা দিদিমনিকে 'আন্টি' বলে ডাকে । আন্টি বর্ণমালা, শব্দমালা উচ্চারণের সময় অপ্রচলিত উচ্চারণ করেন।  অদ্ভুত । 

    দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্র 'দিবস' পড়াশোনায় ভাল ।  মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে ও হোমটাস্ক সম্পূর্ণ রাখে । আন্টির উচ্চারণ গুলি যে তার মা'র উচ্চারণের সাথে মিল খায়না, তা সে বুঝতে পারে ।  বাড়িতে গিয়ে মা'কে বলে -"মা নতুন আন্টিটা 'সিড়ি' কে 'সিডি',   'পড়া' কে 'পডা' বলেছে"।  দিবসের মা দিতি ছেলের কথার আমল দেয় না । কিন্তু পরদিন এসে যখন দিবস বলে "মা, আজ আন্টি  'ফোঁটা'কে  'ফোনটা',  'মানুষ'কে 'মানুমস্' বলেছে",  তখন দিতির সন্দেহ হয় । সে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে দিবসের কথাই ঠিক । দ্বিধা ও চিন্তাগ্রস্ত দিতি, তখন দিবসের বাবা 'ধৃতিমান'কে জিজ্ঞেস করলো, আন্টিটা এমন পড়াচ্ছেন কেন গো ? "ছেলেমেয়েরা তো একেবারে গোল্লায় যাবে"। ধৃতিমান না শোনার ভান করে খবর শুনে যাচ্ছিলো । পরদিন দিতি আবার বললো, "তুমি কিছু বলছো না যে !  আজ আন্টি 'ইলিশ' কে 'ইলিতস' আর 'প্রণাম' কে 'প্রমনাম' বলেছে, প্রিন্সিপাল কে জানাতে হবে তো" !  ধৃতিমান এবার দিতির কথার গুরুত্ব দিল। উচ্চারণ গুলি মনযোগ দিয়ে শুনে বলল, দেখো বাংলা বানানে বিদ্যার্থীরা প্রায়ই ি, ী  ড়,ণ,ষ, শ এর স্থানে ভুল করে। আন্টি স্রুতিলিখন পরীক্ষা করতে গিয়ে সেটা বুঝতে পেরেছেন, তাই তাদেরকে শুদ্ধলিখার কৌশল হিসাবে একটু ভিন্ন উচ্চারণ করে বুঝিয়েছেন সিডি মানে 'ড়' হবে, মানুমস মানে 'ষ' হবে। এতে করে  কিছু বানান খুব তারাতাড়ি শুদ্ধ লিখার আত্মবিশ্বাস হবে। আরও দেখবে আন্টি বিদ্যালয়ের বাইরে কিন্তু ঐরকম উচ্চারণ করেন না।

   দিতি, ব্যপারটি বুঝতে পারলো। সে আরও বুঝলো যে আন্টি, ছাত্র ছাত্রী দের জিরো নয় হিরো বানানোর চেষ্টাই করছেন।  আন্টির প্রতি সকলের আকর্ষণ ও সখ্যতা বেড়ে গেলো। 
  সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে আন্টি দেখলো  দূরে একটি বাইক আসছে। তাতে দু'জনের ই মাথায় হেলমেট। আন্টি পত্রিকায় পড়েছিল ছিনতাইবাজরা এমনই হয়। স্বাভাবিক গতিতে  আসে তারপর পথচারীর পাশঘেষে যাওয়ার সময়  ছোঁ মারে। এতে পথচারী ব্যথা পেলো কি রক্তপাত হলো! তাদের কিছু যায় আসে না, কাজ হাসিল করে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলে বা তেমাথায় বাঁক নিয়ে নিলেই বীরপুঙ্গব ।
   খবরটি পড়ার পর থেকেই আন্টি ঠিক করে রেখেছিল তার সাথে যদি তেমন কিছু হয় সে ছেড়ে দেবে না। গয়না না বাঁচিয়ে চোরের জামা ধরবে। কিন্তু ঘটনা যে এক্ষুনি ঘটবে  এবং তার সাথেই ঘটবে কল্পনাতীত। 
   প্রাক্ সন্ধ্যাবেলা, দুচারজন ব্যস্ত লোক যার যার পথে চলছে। আন্টিও সচেতন চলছেন। পেছনে দ্বৈতহেলমেট বাহনটির আওয়াজ আরও কাছে এল, এবার কানের কাছে এলো, ফিরে তাকানোর আগেই গলায় কিসের স্পর্শ অনুভব করলো, আন্টির রক্ত উত্তেজিত হয়ে  উঠলো, পুর্বপরিকল্পনামতো  আন্টির হাত পেছনের আরোহীর জামায় চলে গেল। খামচি দিয়ে ধরা হাত বাইকের গতিতে এগিয়ে গেলো, আঙ্গুলে ব্যথা পাচ্ছিল তবু জামা ছাড়েনি। আন্টি চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তিন-চার হাত গিয়ে আন্টির পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল, ততক্ষণে আরোহী বাইক থেকে পড়ে, কঁকিয়ে উঠলো। জামার টানে  বাইকচালক টাল সামলাতে না পেরে আঁকাবাকা চলতে চলতে হাত বিশেক দূরে গিয়ে পড়লো। দূর্ঘটনা দেখে মানুষ দৌড়ে এলো। চালক বাইকের নিচে, উঠতে সময় লাগবে। আন্টি নিজের টাল সামলে দেখলো আরোহী কোনমতে উঠে  দৌড় দিতে উদ্যত, হাতে সুতার মত কি একটা আছে। আন্টি তার বাঁ হাতটা গলায় লাগিয়ে দেখে 'হার' নেই,! সঙ্গে সঙ্গে দুইলাফ দিয়ে একটা উড়ন্ত লাথি দিল চোরের পিঠে। আরোহী  আবার মুখ থুবরে পড়লো। সবগুলি ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো যে উপস্থিত লোকেরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না।
    তখন আন্টি চিৎকার করে বলে উঠলো 'হার চোর - আমার হার দে'।  আন্টি নিজেই আহত আরোহীর হাত থেকে, তার হারটা টেনে নিল। উপস্থিত লোকের আর বুঝতে বাকি রইলনা ওরা ছিনতাইবাজ । সঙ্গে সঙ্গে দুইবেটারে ধরে প্রসাদ দিতে শুরু করলো। তারপর পুলিশ এলো, ঘটনা শুনলো, আন্টির ঠিকানা নিল আর  ছিনতাইবাজদের পাকড়াও করে হাসপাতাল নিয়ে গেলো। 
   খবরটা চাউর হতেই, এহেন আন্টির বাড়িতে আট-দশ দিন মানুষের খুব আসা যাওয়া। কেউ সাবাশী দিয়ে গেলো কেউ গর্ব বোধ করে গেলো। 

দিতি জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি ক্যারাটে শিখলে কিভাবে! 
আন্টি বললঃ আমাদের নবম শ্রেণিতে একজন মনিপুরী শারীরশিক্ষিকা ছিলেন। তিনি সর্বদা খেলার পাঠ  দিতে দিতে, আমাদের বিপদে মোকাবিলা করার পাঠও দিতেন ।  আমি বেশ কয়েকটা প্যাঁচ শিখে রেখেছিলাম। দিদিমনি শরীর হাল্কা রাখা ও চুজকামিজ পরার পক্ষপাতি ছিলেন ।
উপস্থিত যাদের শরীর ভারী ছিল তাদের নিয়ে একপ্রস্ত রসিকতা ও হাসিঠাট্টা হল। এইভাবে আন্টির দিনগুলি সুখেই কাটছিল। 

  এরমধ্যে একদিন থানার বড়বাবু আন্টিকে অনুরোধ করলো একটু সহযোগীতার জন্য।  ছিনতাইবাজরা যাতে শাস্তি পায় সবাই চায়। আন্টিও চায়, তাই এক বান্ধবী কে নিয়ে থানায় গেলো। প্রশাসনিক কাজ সেরে গ্যালারীর পাশ দিয়ে সাইকেলে বাড়ি ফিরছিল। গ্যালারীর পাঁচ ছটা যুবকের মধ্যে একজন  বলছিল "ঐমেয়েটাই চোর ধরেছিল "।   যদিও কথাটি অস্পষ্ট ভেসে আসছিল। আন্টি বান্ধবী কে বলল "ওদিকে তাকাস না। চালা তারাতাড়ি"।   কিন্তু হঠাৎ একটা যুবক বাইক নিয়ে এসে, আন্টির সাইকেল ঘেষে দাঁড়ালো। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলো "তোমার নাম কিগো "। আন্টি আমল দিল না। সাইকেল পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। এবার ছেলেটি আবার এগিয়ে এসে আরও বেশি পথ আটকে দাঁড়ালো। আন্টি ব্রেক কষলো। বলল আমার নামের আপনার কী দরকার, রাস্তায় কতজনের নাম জিজ্ঞেস করবেন, আদমসুমারীর চাকরি করেন নাকি,,,।  ছেলেটি আর এগুলো না। সে বন্ধু মহলে অপদস্ত হয়ে ঝাল মিটানোর জন্য আন্টির নজরদারি শুরু করলো। 

   একদিন পড়ন্ত বিকেলে আন্টি গৃহশিক্ষকতা সেরে শহরতলীর নির্জন পিচ রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে তিনটি ছেলে বের হয়ে আন্টির পথ আটকালো। এর মধ্যে গ্যালারীর সেই যুবকটিও আছে। ওরা আন্টি কে শিক্ষা দিতে মুখ চেপে ধরে ঝোপের দিকে নিয়ে গেলো। আন্টির জুতা ছিটকে গেলো। শক্ত ডালের খোঁচায় চুজ ছিঁড়ে পায়ে রক্ত বেরোল। আন্টি সুযোগ বুঝে একটি লাথি দিল যা গ্যলারীযুবকের বুকে লাগলো। কিন্তু আত্মরক্ষা বিদ্যায় তিনজনের সাথে কতক্ষণইবা পারা যায়। আন্টি বাঁচাও বলে চিৎকার করে উঠলো। ঠিক সে সময়ে বোডাসসসস,,,, করে বিকট আওয়াজ হয়ে রাস্তার পাশে একটি গাড়ি এসে থামলো। যুবকরা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ঝোপের দিকে পালালো। ছেলেরা পালালো বটে কিন্তু যতটুকু হয়েছে ততটুকুইবা কতজনে সহজ ভাবে মেনে নেবে। আন্টির চোখ বেয়ে জল পড়ছিলো। আন্টি আহত পায়ে, ঝোপের ওপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে, বেরিয়ে এলো। তারপর সাইকেল টা তুলে নিয়ে, বাড়ির দিকে, একটু এগিয়ে যেতে দেখে, একটা জীপগাড়ি চাকা পাল্টাচ্ছে। সম্ভবত চাকা ফেটে যাওয়ায় বিকট আওয়াজ হয়েছিল। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে সব কথা বললো। অভিভাবক রা তাড়াতাড়ি ধৃতিমানের সাথে আলোচনা করলো। তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় অভিযোগ করল। 
   থানা বাবুরা সঙ্গে সঙ্গে  আন্টিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলো, সেখানে কিছু পুলিশ নামিয়ে রেখে আন্টিকে নিয়ে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা করালো।  তারপর নামধাম, সময়,  আরও কিছু তথ্য লিখে আন্টিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিল। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ধস্তাধস্তির চিহ্ন, আন্টির জুতা, ভাঙ্গা চুরি আর একটি মোবাইল পেলো। সম্ভবত আন্টির লাথিতে মোবাইল টি বুকপকেট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মোবাইল সূত্র ধরে অপরাধীর বাড়ি সহজেই পাওয়া গেলো, কিন্তু অপরাধী পলাতক। 

   পলাতকের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। খবরটা জানাজানি  হতেই ব্যবসায়ীর মানসম্মান ডুবলো, নানা জনের শান্তনা বাক্যগুলি তাঁকে আরও কাটা কাটা দিতে লাগলো। দোকানদারি বন্ধ। কেউকেউ বলাবলি করছিল "ছেলেটা ব্যবসাটাকেও মারলো,  বাপটাকেও মারবে"। পুলিশ অভিযুক্তের খুঁজে বাড়ি আসে, না পেয়ে বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের ঠিকানা নিয়ে চলে যায়। 

 খবরগুলির কিছু কিছু পলাতক অপরাধীর কাছেও পৌঁছতো। 
  এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। জাতীয় উৎসবের দিনে ছিনতাইবাজ ধরার জন্য সাহসিকতার পুরস্কারের জন্য আন্টির নাম ঘোষিত হয়, কিন্তু আন্টি নির্লিপ্ত, নির্বিকার ।  অন্যদিকে পলাতক অভিযুক্তকে অনুশোচনায় ঘিরে ধরে। কম শাস্তিতে সমস্যা সমাধানের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে । শুভাকাঙ্ক্ষীদের শরণাপন্ন হয়ে বলে, উকিল মারফত একটা বিহিত করার জন্য। 
শুভাকাঙ্খীরা উকিলদের কাছে যাওয়ার পর  উকিল বললেনঃ দুটো পথ আছে, এক ক্ষতিপুরণ,  দুই,  ঘরের বৌ করে নেওয়া। 
  বেপরোয়া অপরাধী বিহিতের পরামর্শ শুনে জানালো যে, সে দ্বিতীয় প্রস্তাবে রাজি নয়।
  তখন উকিল বললঃ অপরাধীকে মনে রাখতে হবে, সে রাজি হলেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।  শিক্ষিত সম্ভ্রমী নারীরও বিয়েতে মত থাকতে হবে । আর টাকা দিয়ে সবার সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আইনানুযায়ীই  অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।
অভিযুক্ত  ভেঙে পরে বলল, "আমাকে বাঁচান"। 

   ক্ষতি পূরনের ভাবনা বাদ দিয়ে, উকিলবাবু প্রথমে ধৃতিমানের সাথে যোগাযোগ করলো। তারপর দু তিনবারের চেষ্টায় আন্টির মা-বাবাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি করালো।
অভিবাবকরা বললো শেষ কথা আন্টিই বলবে।
   বিমর্ষতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসা আন্টির সামনে পুরোনো কথা তোলার মত সাহস কেহই পাচ্ছে না।  শেষে সবাই, দিতির শরণাপন্ন হল।
   দিতিও খুব ইতস্তত করছিল। শেষে একদিন  একথা ওকথা বলার পর আন্টিকে পরোক্ষভাবে প্রস্তাবটি পারলো।
   আন্টি বললঃ  আমার বিয়ে হোক বা না হোক, সমস্যা সমাধানের জন্য মানহানিকারককে, আমার উচ্ছল জীবন ধ্বংসকারীকেই সোহাগ করে,  সারাজীবনের জন্য মেনে নেবো !   আমার কি কোন স্বপ্ন-স্বাধীনতা  ছিল না !
আন্টি রাজি হল না।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...