Tuesday, February 23, 2021

মনন স্রোতে আপনাকে স্বাগতম || পড়ুন মনন স্রোতের ফেব্রুয়ারী মাসের সংখ্যা।

সম্পাদকীয়

মাতৃভাষা দিবসটি পালন করতে ইউনেসকোর এক ডলারও খরচ লাগবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ নিজেরাই নিজেদের মাতৃভাষার দিন উদযাপন করতে দিনটি হৃদয়ে জায়গা দেবে। অনেক আগে  বাংলাদেশের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সাদেক মহাশয় এমন কথা বলেছিলেন। সত্যি তাই।  এখনও প্রাসঙ্গিক।

মাতৃভাষা শুধু আমাদের নয়। মাতৃভাষা সকলের। মাতৃভাষার বিভিন্নতাই পৃথিবীর ভেতরকার শব্দ।  সকলের মাতৃভাষাকে সম্মান করার সাল হিসাবে মর্যাদা পায় ১৯৯৯। ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, এ মর্যাদা পৃথিবীর সকল ভাষাভাষীর মানুষের জন্য গৌরবের। এ মাস ভাষার জন্য উসর্গকৃত। মনন স্রোত পৃথিবীর সকল মানুষের মায়ের ভাষাকে সম্মান জানাচ্ছে। এ মাসের সংখ্যায় যারা লিখেছেন, সকলকে কৃতজ্ঞতা। সকলের সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করছি।


জয় দেবনাথ
২৩শে ফেব্রুয়ারী, ২০২১ইং

বইমেলা সংখ্যা | মনন স্রোত

Monday, February 22, 2021

জয়দেব দাস

বাসন্তী রঙে

বাসন্তী রঙের শাড়িতে গোলাপী হাতার আবর্তন,
সিল্কি চুলের আড়ালে ভেসে ওঠা উৎফুল্ল তোমার মন।

কোমরে সোনালীবিছা, 
হাতে রঙিন চুড়ি,
পায়ে রক্ত আলতা, হাতে সময়ের ঘড়ি।

হাই হিলসের বদলে, পায়ে ফ্ল্যাট সোলিং জুতো,
মাঠে প্রবেশ করলে, সঙ্গে সখী তিনেক মতো;
ঘন কাজল চোখে, তোমাকে লাগছিলো বেশ,
শুধু তুমি, শুধু তুমি এতেই আমি শেষ।

বাসন্তীর তাঁতে;
হাসিভরা তোমার উজ্জ্বল মুখ,
হার্টবিট বেড়ে যাওয়া আর ভালোবাসার এক অদ্ভুত সুখ।
গোলাপি লিপস্টিকে রঙিন ঠোঁটে, কথা শুনছিলাম ঠিক,
চোখ পরছিলো না তোমার থেকে এদিক ওদিক।

ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায় বলতে ইচ্ছে ছিলো,
কি বলবো কিছুই আসছিলো না, নার্ভাসনেস-এ সব কেটে গেলো।
আবেগের আবেদনে, তুমি যে সাড়া দিলে,
এতেই আমি খুশি, বলবো না হয় দুজনে মিলে, অন্য কোনো দিনে।

তোমার চোখে দেখেছি আমি, অদম্য এক চাওয়া,
ভালোবাসার আঙিনায়, জানি না হবে কি পাওয়া।
সঙ্গে থেকো, সাথে থেকো এই চলার পথে,
সোহাগ দিয়ে বাঁধব মোরা, এই ঘর একসাথে।


মোঃ রুবেল

বর্ণমালা
               
প্রতিটি নীরব রাতে,
বর্ণমালার সাথে  কথোপকথনে--
ভেসে আসে এক বুকভরা বেদনা।
একটি নিস্তব্ধ আকাশের করুণ বর্নণা।
বারুদের বিষাক্ত বায়ু।
কার্তুজ বনাম দীপ্ত কন্ঠের সংঘর্ষ।
তাজা প্রাণের নিথর দেহের একটি শহীদ মিনার ।
উষ্ণ রক্তমাখা রাজপথ।
রফিক,সালাম,জব্বার বরকত'র দীপ্ত কন্ঠে উদ্ভাসিত মাতৃভাষা 'বাংলা চাই।'
তবুও,
বর্ণমালার রাজমুকুটের ভেতরে  পাহাড় প্রমাণ বেদনা পুষেও যখন বর্ণমালা এখনো প্রেমের গান লিখে, কখনও বা প্রতিবাদে সুর মেলায় পাতায় পাতায়।

তখনই আন্দোলিত হৃদয়ের কাছে নতজানু হয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলি...

 এই ভাষা আমার মায়ের।
এই ভাষা রক্তে রাঙানো।
এই ভাষা আমার।

দেবব্রত চক্রবর্তী

এক বুক ভালোবাসা

অজানা পথে হাঁটতে হাঁটতে
কোথায় যে থমকে দাঁড়াই,
কত নুড়িপাথর কুঁড়িয়ে ঘর সাজাই,
পরিত্যাক্ত স্বপ্ন গুলো একত্রে কোলে তুলে
বুকের ভেতর আগলে রাখি।
ও যেন সব কষ্ট সইবার-দায়িত্ব নিয়েছে,
সুখ রাখার জায়গা বানিয়েছে।

অথচ এ বুকে মাথা রেখে কেউ টের ই পাবে না
অত সব সুখ যন্ত্রণা বয়ে যাচ্ছে।
নদীর স্রোতে বালি কনার মতো
নিঃশব্দে চলতে চলতে সমুদ্রে গিয়ে
আনন্দ উল্লাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
বাহ্ রে জীবন; এ ভাবেই তার বয়ে চলা।
জীবনের গতি পথের জটিল সমাধান;
এক বুক ভালোবাসা।

জগন্নাথ বনিক

আজ প্রিয়ার বিয়ে 

বিয়ের সানাই বেজে উঠেছে,
হবে মোর প্রিয়ার বিয়ে।
প্রিয়া আজ নববধূ সেজেছে আলতা পড়ে,
রাঙিয়েছে দুই পায়ে নূপুর দিয়ে।

সখিরা সব এসে গেছে,
প্রিয়ার হলুদ সন্ধ্যায়।
মনের মতো সাজিয়েছে মোর প্রিয়া কে,
 নূপুর পড়াবে দুই পায়ে রাঙিয়ে তুলবে লাল আলতায়।

লাল রঙের বেনারসি পড়েছে প্রিয়া,
চলে যাবে বুঝি শ্বশুরবাড়ি।
আর কি কোনদিন শুনতে পাবো না,
প্রিয়ার রাঙা পায়ের নুপুরের শব্দ গুলি।

রাঙা পায়ের নূপুরের শব্দ শুনে,
ছুটে গেলাম প্রিয়ার কাছে।
চিৎকার করে ডেকেছি প্রিয়া কে,
সারা দেয়নি প্রিয়া আমার ডাকে।

ভালোবাসার দুঃখ বুকে নিয়ে,
মুখে হেসেছি প্রিয়ার কাছে।
ভালো থাকো প্রিয়া সুখে থাকো তুমি,
মনের মতো রাঙিয়ে তুলো তোমার সুন্দর জীবন খানি।

সোমা চক্রবর্তী

মাতৃভাষা

ভাষাটার তুলনা নাই 
ভাষাটার বিকল্প নাই,
শিশু ঘুমন্ত এখনো
ঘুমন্ত মায়ের গর্ভে 
অন্ত নিবিষ্ট ।
এ জীবন ফুটন্ত পুষ্পের ন্যায় কোমল 
সদ্য প্রসূত প্রস্ফুটিত জ্যোতিস্মান।

ভাষাটার তুলনা নাই 
ভাষাটারর বিকল্প নাই, 
মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ
রবি ঠাকুরের বুলি
আধো আধো শিশুর গলায়
স্পষ্ট হয়নি তবুও।
মায়ের মতোই স্নিগ্ধ কোমল
মাতৃভাষার স্বাদ
মায়ের ভাষা  হয়নি কভু, 
কলঙ্কের অপবাদ।

উর্মি সাহা

দশ মাসে আমি
 
এখন তোমার প্রথম মাস
কষ্ট তোমার তেমন নেই,
শক্তি এবার নেই আমার;
ইন্টিলিজেন্ট মস্তিস্কে প্রশ্ন সেই!

দ্বিতীয় মাসে অসুস্থতা--
উষ্ণ শরীরে ক্লান্ত তুমি,
তৃতীয় মাসে আমি যখন একটু বড়ো-,,
মা! তুমি আমায় বোঝো বুঝি?

যাজ্ঞে; চতুর্থ নম্বরে পাড়ি তোমার
এবার নতুন স্বপ্নের বসবাস,
পঞ্চমেতে তোমার স্নেহ-
আর রক্ত-মাংসে আমার শ্বাস।

ষষ্ঠ ধাপে বলছি আমি,নড়ছি আমি,
মা! তোমার ভেতরটা খুব নরম গো,
আমার একটু নড়াচড়ায়--,
তুমি বুঝি অসন্তুষ্ট,তুমি বুঝি রাগো!

সপ্তম মানে কষ্ট তোমার,
আমার স্বপ্ন উড়বো আমি!
সেই আনন্দে উন্মাদ থাকি;
তবুও কষ্ট কান্না স্বরে ভালোবাসো তুমি।

নবম সময় কঠিন বড়ো-ই,
তাও-তো তোমার হাত পাই।
দশমেতে দর্শন তোমার।
পর জন্মেও যেন তোমার গর্ভ পাই।

বিটু মজুমদার

আজ সেই বসন্ত

আকাশের নীল রং, তার মাঝে তোমার ছবি
বাতাসের বাতাসে তোমার ভালবাসা ।
আজ বসন্ত,
ভালবাসার প্রজাপতি উড়ছে ডানা মেলে ।
ফুলে ফুলে মৌমাছি বসেছে আনন্দ করতে ।
পৃথিবী আজ সেজেছে নীল রং এ

তোমার গায়ে জড়ান নীল শাড়ি,
কপালে নীল টিপ ।
আজ বসন্ত,
তাই ভালবাসি
ভালবাসার দিন গুলির থেকে অনেক বেশি ।

মিঠু মল্লিক বৈদ্য

গর্বের একুশ

এসেছিলে দুর্নিবার পথধরে
অগ্নিগর্ভা বাংলার বুকে,
জ্বালিয়ে মশাল রাজপথে
ফিরছে আলয় বিজয়রথে।

ভুবনজোড়া অমর তুমি
প্রতিবাদে অধিকারের দাবী।
লড়েছে তরুণ তরুণী 
লিখেছে গৌরব কাহিনী।

রণদামামা বাজিয়ে বাঙ্গালী 
করেছে আত্মাদরের দাবী।
লাখো প্রাণের আত্মাহুতি
বানিয়েছে তোমায় বিজয়ী।

তুমি শাশ্বত,অবিনাশী
গর্বের একুশে ফেব্রুয়ারি।
রক্ত ঝরানোর ইতিবৃত্তি
লিখেছে রফিক বাহিনী।

দিপিকা রায়

ভ্যালেনটাইন

মূর্ছানো রঙিন পাপড়িগুলো
অসহায় আজ পথের মাঝে। 
প্রেম নিবেদনে সজ্জিত মৃত্যু শয্যা
ছিন্ন, সময়ের মায়াজাল। 
মুখরোচক মিষ্টিসারি, 
বিষ্ফোরক হয়ে ফাটলো বুকে। 
পুতুল খেলার পুতুল ভেবে, 
ভাঙলো আজ বিশ্বাসের পাঁজর। 

মায়ের আঁচল ভেজলো তাই, 
সিঁথি ভরা রঙিন সিঁদুর। 
বিচ্ছিন্ন রাখীর সুতো, 
স্নেহের দ্বারে সন্তানের ডাক। 
সব বিদায় বেলায়
করল আলিঙ্গন মাতৃভূমি। 
চুম্বন করে এই মৃত্তিকার বুকে
উড়িয়ে দিল প্রেমের কাফন। 

সুখের ভিড়ে হাসতে হাসতে, 
বিলীন হলে না জানি
কোন দেশে। 

হয়তো আবার দেখা হবে
কোনো জননীর গর্ভজুড়ে। 
মিশবে তো এই ধুলিকণায়
ওই বয়ফ গুলো পিষবে  আবার, 
তোমার পদ ছায়ায়
তোমার হাতে উড়বে এই তিরঙ্গা। 
গাইবে তো আবার মুক্তির গান, 
কম্পিত করবে আকাশ, 
তোমার জয় ধ্বনিতে আবার
জয়হিন্দ জয়হিন্দ জয়হিন্দ।

সুপর্ণা কর

শিশু

ঘরের শিশু খাবেনা বলে বায়না ধরে।
পথের শিশু খাওয়ার আশায় ভিক্ষা করে।

ঘরের শিশু নতুন পোশাকে সাজে,
আর পথের শিশু ছেঁড়া কাপড় খোঁজে।

ঘরের শিশু ঘুমায় রাজ শয্যায়।
পথের শিশু ঘুমায় মাটির বিছানায়।

শিশু তো দু'জন‌ই বটে, তবে থাকে দুই মেরুতে।

প্রীতম শীল

নই আমি উন্মাদ প্রেমিক

আমি মায়ার জালে তোমায়,
বাঁধতে পারবোনা সখী।
আমি যে রুঢ় ভাষার কবি,
নয় যে আমি দৃঢ় কামুকী।
আমি যে পাষান সমতুল্য,
তোমার প্রেম বিষমিশ্রিত সুধা।
আমি যে উন্মাদ প্রেমিক হতে পারিনা,
নিয়ে প্রেমের কঠিন ক্ষুদা।
তুমি কি ভেবেছিলে আমি বার বার,
ছুটে আসবো তোমার প্রেমের টানে।
আমি বলে যাই প্রিয় তোমার কাছে,
প্রেম চাইলেও যৌবন চাইবোনা তোমার পানে।

সুশান্ত কবিরাজ

নীরবে বাড়ে রোগ

রাত বাড়ে
রোগ বাড়ে ,
প্রতিটি পাখি চায়
দিনশেষে বাসায় ফিরে
কিচির মিচির করতে ।

সঞ্জয় দত্ত

প্রিয় পাখি

তুমি যখন এক পালক
হাসি নিয়ে আসতে,
তখন আমি মুহূর্তেই
নিশ্চল হয়ে যেতাম।

যখন তোমার টানা টানা চোখে 
এক বুক ভালোবাসার আশ্বাস পাই,
তখন আমি আসমুদ্র তৃপ্তির
আলোকপাত তোমার কাছে আনতে বাধ্য হই।

তুমি যখন অন্তরালে
আমি হতাশায় জামিনি-দিবস‌ অপেক্ষা করি।

হাস্য বাক্যের সুরটা 
আজীবন গেঁথে রাখলাম আমার ওই গোলাপ গাছে।
যেখানে তোমার সুরের স্পর্শে উজ্জীবিত হবে নতুন প্রাণ।
হ্যাঁ,আর এটাই আমার আহ্বান।

আক্তার হোসেন

আমরা সবাই এক

সর্বক্ষেত্রে আমরা কেনো করছি বিচ্ছেদ? 
কখন জানি ছিন্ন হবে মানবিকতার অবাধ বাঁধন! 
সে দিন হয়তো আর বেশী দূর নয়।
বিদ্বেষের তপ্ত দহন ক্রমশই ঘনীভূত হয়ে আসছে, 
পৃথিবীর মেল বন্ধনের মাঝে চির ফাটল তৈরী করে দেবে। 


—এই দুশ্চিন্তায় কেটে যায় আমার বিনিদ্র নিদ্রা! 
ছিন্ন ছাড়ার মতো ছুটতে থাকি সকাল সন্ধ্যা।
হাজার অঙ্ক কষেও মিলছে না হিসেব,
কেনো এতো বৈষম্য এতো বিবাদ? 
যাহা হতে উৎপত্তি একদিনতো সেখানেই বিলিন হয়ে যাবো।
সমস্ত অহংকারের অবসান ঘটবে সে দিন, 
যে দিন সমস্ত প্রচেষ্টা ধুলোয় মিশে জর্জরিত হবে,
আমরাতো সবাই এক —
কেনো করছি বিবাদ?

অরিন্দম চক্রবর্তী

বেশ আছি

চারদিকে কত হাহাকার; কিন্তু আমি বেশ আছি। 
শুধু একটু হাল্কা আশায় বাঁচি, এমনিতে বেশই আছি।
হাল্কা দারিদ্রতার ছোঁয়া আছে, সেটা ছাড়া সব ঠিকই আছে।
মাঝে মাঝে মধ্যপ্রদেশটাকে বোকা বানাই, অনেকটা ঐ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো!

অনেক সময় মনে হয় যদি ছোট থাকতাম কতনা ভালো হতো,
জীবনের এই কঠিন কঠিন সত্যগুলো আমাকে দেখে ভয় পেত,
কারন তদের আমি খেলার ছলে উড়িয়ে দিতাম।
যদিও এমনটা ভাবার জন্য আমি মনকে একবারও দোষ দিইনা,
শুধু ভাবার সময় একটু মুচকি হেঁসে উড়িয়ে দিই।

তবে পোড়া মনের ভাবনাতে জীবন ধারা থেমে থাকেনা।
সে বাঁধন ছাড়া নদীর মতো আপন বেগে ধেয়ে চলছে,
তার গতিতে প্রতিনিয়ত পিষে যাচ্ছে কিছু মেরুদণ্ড। 
সেই মেরুদণ্ড গুলো অনেক চেষ্টা করছে একটু উঠে দাঁড়াতে, লড়াই করছে প্রতিনিয়ত,
কিন্তু এই চক্রগুহ ভেদ করে কিছু সিকি ছিটকে বেড়িয়ে আসছে,
আর কিছু,মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে চিরতরে।
সেই মেরুদণ্ড গুলির মধ্যে আমারও একটি আছে,
জানি পরিণতি খুবই সন্নিকটে, কিন্তু আমার অজানা, তাই বেশ আছি।
প্রতিটি রাত শেষে শুধু একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়,
আজ কি ঠিক হবে আমার পরিণতি, 
এমনিতে ভালোই আছি।

প্রসেনজিৎ দে

সরীসৃপ বয়স 

তোমার বয়স এখন এক(১),

তোমরা সরীসৃপের মতো হেঁটে যাও
বুকের ওপর,
ভেঙ্গে যায় আমার ২০৬ টি শিকড়।
অদম্য চিৎকার ধূলিসাৎ হয় মাটির জলে।

তারা বড়ো হয়,
তাঁরা ছোট ছিল।
আমি দেখেছি চৌ-রাস্তার মুখে 
শূন্য জনতার ভিড়,
কিছু আশা ও পরিত্যক্ত অনুভূতি।

আমি দেখি 
কারো আর্তনাদ ভিজিয়ে তোলে
সহস্র মায়ের আঁচল।
সমুদ্রের মতো ঢেউরা আসে,
মুছে যায়,
সেই আঁচলের সোহাগ।
রাস্তার মাটি লেপে থাকে 
অশ্রু ভেজা ঘামে।

আমার বয়স এখন ষাট(৬০)!
দম আটকে যায়,
আসে অন্ধকার
ঘন অন্ধকার;
আজ আমিও সরীসৃপ!

লিটন শব্দকর

নীল শার্ট এবং ভালোবাসা
                   
প্রতি সপ্তাহের শেষে কোথাও
শহরবাসী সমুদ্র দেখতে আসে, 
সেখানে নুড়ি পাথর জমাই
আবার বালিতে ভাসিয়ে দিই
এভাবে দিন কাটে ভালো।
বসন্তে অনেক রঙ প্রয়োজন
তাই ঢেউয়ের কথামতো প্রথমে
হৃদের তুলিতে তন্দ্রা মেখে বললাম-
-আঁকো ঘুমনদী।
নীল রঙ জমাট বাঁধলে জানা গেলো
চেনাশোনা ছড়ায় মিশে যেতে
তার মাত্র হাতে গোনা দিন।
সেদিন পাড়াগাঁ থেকে সমুদ্র অনেক দূরে
নীলিমা ভুল করে সমুদ্রশার্টটা ছিড়লো
আমার পরনে রইলো শুধু ভালোবাসা।   

প্রাণেশ দেবনাথ

পিসির পিঠে 
                    

দীর্ঘ ৫ বৎসর আগের কথা । আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তাম তখন একবার পিসিমনির বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার পিসুমশাই নেই, তিনি দাদার বয়স যখন ১২ তখন এই পৃথিবী ছেড়ে দূরের অসীম ওই আকাশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । আমার দাদা এমনিতে একটু দুষ্টু কিন্তু মন থেকে খুব ভালো । যাইহোক  আমার পিসিমনিই আমার দাদাকে এই সুন্দর ভবিষ্যত প্রদান করল পিশুমশাইয়ের অনুপস্থিতিতে । দীর্ঘ ৫ বৎসর আগে আমি যখন পিসিমনির বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন ছিল পৌষ মাস, আর পৌষ মাস মানেই হল বাঙ্গালিদের কাছে পৌষ সংক্রান্তি বা মকরক্রান্তি, আর মকরসংক্রান্তি মানেই হল পিঠের মেলা । আহ্ ...... বলতেই মুখে মিষ্টি রসালো ভাব  চলে এলো । আমি যখন পিসিমনির বাড়িতে যাই তখন দেখলাম পিসিমনি আমি যাওয়ার আগেই বিভিন্ন রকমের পিঠে বানিয়ে বসে আছেন । আমি তাদের বাড়ির প্রধান দরজা পেরোতেই আমাকে দাদা এবং পিসি দুইজনই ঝাপটে ধরলেন । পিসিকে প্রনাম করে ঘরে প্রবেশ করলাম । এরপর পিসি আমাকে বিভিন্ন রকমারি পিঠে খেতে দেয় যা পিসি নিজের হাতে সকাল থেকে বানিয়ে রেখেছেন । সরাই পিঠের সঙ্গে খেজুর রস ....... আহ্, কী স্বাদ । তখন অনুভূতিটা এমন হচ্ছিল যেন আমি সেই খেজুর রসে ডুবে যাচ্চি। পাটি সাপটা, গোকুল পিঠে, পুলি আরো কত রকমারি পিঠে যে পিসি বানিয়েছে তা আমি চিনিও না । খাওয়া শেষ করার পরে দাদা বলল " চল ভাই এখন একটু ঘুরে আসি " । পিসিমনির বাড়ির কাছে একটি মাঠ ছিলো ওইখানে দেখলাম ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে ঘুড়ি উড়ানোর প্রচেষ্টা করছে । দাদা একটু দুষ্টু স্বভাবের আমার সাথে রাস্তা দিয়ে কথা বলতে বলতে কখন যে আঁখ খেতে ঢুকে গেলো আমি টেরও পাইনি । ওই আঁখ খেত থেকে দাদা খানিকের মধ্যে আঁখ তুলে এনে একটি অংশ আমাকে দেয় আর বাকিটা নিজে চিবোতে লাগলো । যখন বেলা ২ টো বাজে তখন হল স্নান করার পালা ।সেখানে গিয়েও দাদার দুষ্টুমীর শেষ নেই । আমি যতবার স্নান করে উঠে আসতে লাগলাম ততবার দাদা আমাকে কাদা দিয়ে ভরিয়ে দিতো । শেষমেষ আমাকে রেহাই দিলো আর নিজেও স্নান সেরে বাড়ির পথে রওনা দিলো । অনেক সময় কাটলো পিসিমনির বাড়িতে এবার নিজের গন্তব্যস্থলে অর্থাৎ নিজের আবাসিক বাসভবনে ফিরে যাওয়ার পালা । ভাত খেয়ে যওয়ার কথা বলল পিসিমনি কিন্তু ওইদিন ছিলো ওইদিনের শেষ বাস যেটা ধরতে না পারলে আমার আর বাড়ি যাওয়া হবে না সেইসঙ্গে আমার আগামীকালকের ক্লাসটাও হারানো হবে, যেটা আমি কোনোমতেই হারাতে চাই না । শেষে বাস আসল এবং আমাকে পিসিমনির সকল মায়া-মমতা ত্যাগ করে নিজের গণ্ডিতে ফিরে আসতেই হল । আজকের এই মকরসংক্রান্তির দিনে আমার আবার কথা গুলো মনে পড়ল। জানিনা দাদার ও পিসিমনির কতটুকু মনে আছে কিন্তু আমার পক্ষে ওইসব ঘটনা ভুলে যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার । বর্তমানে আমি দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠ্যরত এবং দাদাও নাকি টেট পাশ করে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন এবং আমার পিসিমনি ছেলের জন্য মেয়ে খুজতে ব্যস্ত আছেন ।

সুজন দেবনাথ

আহ্ মরি বাংলা ভাষা

'মোদের গর্ব মোদের আশা
আহ্ মরি বাংলা ভাষা।'
কি অপরূপ রূপ মাধুর্যে
রূপসী বাংলা গড়েছেন চাষা।
যে ভাষাতে এতো সুধা
অমৃত ময়ীর স্নিগ্ধ সুর।
মায়ের কথা শুনলে পরে 
সকল ক্লান্তি হয় যে দূর।
মৃত্যুর পরে বাংলার বুকে
মানুষ, যদিওবা হই আবার।
সোনার বাংলা মধুর ভাষায় 
জন্মে আসি যেন বারংবার।
গর্বিত আমি এই ভাষাতে
আমরা মা ডাকি এক সুরে।
শত দুঃখেও মনে শান্তি মেলে
প্রিয় বাংলারই এই মধুপুরে।
জীবনানন্দের পল্লি প্রেমে
এই বাংলাই আমার খাঁটি। 
মরনেও আমি ধন্য হবো মাগো
নিথর অঙ্গে জড়িয়ে তব মাটি।
 

সজীব পাল

প্রেমিকা এবং কবিতা 

এক

এখন তুমি চলে গেলে ভালোই হবে 
জন্মাবধি দুঃখ আমার সাথেই রবে ।

দুই

কবিতার জন্য সংসার ছেড়েছি ছেড়েছি তোমায়,
শুধু বুকের ভেতর দুঃখের সাগর হবে বলেই।

তিন 

এখন আমার অসুখ হলেই তোমায় ভাবি রোজ,
সেই অসুখের হও যদি অ্যান্টিব্যটিক ডোজ!

চার

তোমার কণ্ঠ কি আমার মতোই কাঁপে,
'ভালোবাসি' বলতে গেলেই উঁচু নিচু মাপে?

পাঁচ 

এখন যারা দুঃখ দেয় দুঃখ তাদের আমিও দেবো,
হঠাৎ একদিন মরে গিয়েই ওদের কাঁদিয়ে দেবো।

ছয়

আমার সাথে হাঁটতে পারবে কাঁচের উপর?
যে কাঁচ ভেঙেছ তুমি "পারুলের" মতন!

সাত

তোমার চোখটি লাল হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ব,
যৌবনের ওই উত্তাপটুকু পাবো বলেই।

আট 

যে কবিতা লিখে তাকে তুমি মন দিও?
মনের বদলে কবিতা একটা চেয়ে নিও!

নয়

আমার এখন প্রেমিকা লাগে গভীর রাতে
যার ঠোঁটে চুমু খেলে শিহরণ জাগে !

দশ

তুমি বলবে আমি বলব এইভাবেই হয় না বলা,
'ভালোবাসি প্রিয়তমা ভালোবাসি চন্দ্রমালা।'

টিটু বনিক

জমানো ব‍্যথা 
 
শহস্র ব‍্যথায় আজ মনে পাহাড় জমে 
একাধিক ধ্বনি দিয়ে ও শুধু একখানি প্রতিধ্বনি ভেসে আসে। 
কতকাল পেরিয়ে তবুও অটল ঐই মহীধর 
স্তরে স্তরে জমচ্ছে শৈল, শীর্ষ যেন অটল।
সমতলের টানে যেন কত অশ্রুনদী নেমে আসে।
ভাঙ্গে টুকরো টুকরো  শৈল, তবুও গিরি নিশ্চল- অটল।
তবে ঐই অদূরে 
অনাগত কোনো উল্কাপিন্ডে,
পাহাড়ের চূর্নবিচূর্ন, ভূমি সমতল 
আবার ফিরে আসবে সমতল।

সংগীতা শীল

প্রণয়াকাঙ্ক্ষী

ইচ্ছে মেলে ডাকি তাকে 
মেঘের পালক বেয়ে,
থমকে দাঁড়াই তার স্মৃতিতে
নির্জন প্রেমের রাতে।

আগোছালো প্রেমও নাকি
আকাশ ছোঁয়ার মতো
প্রেম নাকি শব্দগোছা শুধু;
আজো খুঁজি দিশে হারার মতো
আবেগ মোহের জরা হবে হয়তো!

বৃষ্টি ফোঁটায় মন ছন্দতালে 
স্বপ্নের জাল বুনছে আনন্দে
প্রজাপতিরা উড়ে বেড়ায়
অপরূপ ইন্দ্রধনু উঠবে জ্বলে।

চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্না ছড়িয়ে
তার খেয়ালে এসে নাকি
ঘুম উড়িয়ে দিই
ঘুম ভাঙানো পরী বলে
ডাকে আবার মজার ছলে,
ভেবে অবাক হই
তারও মন আছে বুঝি?

মোহাজির হুসেইন চৌধুরী

আলোর ভোর
   
সারারাত একটা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ
সারারাত আচ্ছন্নতায় একটা অস্পষ্ট ঘোর 
চারদিকে বিভূতি মাখানো অসুরের সুর 
কেউ আলো জ্বালাতে রাজি নয় 
কমপক্ষে দেশালাইয়ের কাঠি 
মনের ভেতর কি একটা ভয় 
এভাবে কখনও কী নামানো যাবে 
ঈশ্বরের প্রদত্ত ভোর?  

এখনই দাঁড়িয়ে যাও।  দু'হাতে 
আকাশ উপরে ধরে 
স্ফুলিঙ্গ ছড়াও ঘষে পাথরে পাথরে 
আদিমতা মুছে যাক 
আবার প্রথম যাত্রা শুরু হোক আদমের 
হাওয়ারা খেলতে থাকুক ফুলবাগিচায় 
ভালবাসায় আপ্লুত হোক প্রতিবাদী শব্দেরা
মোহমায়ায়।

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী

উমা এলো ঘরে

আশ্বিনের এক শেষ বিকেলের আলো এসে গলে পড়ল দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে। ঠিকরে  উঠল, প্রতিমার মুখের  উপর পড়ে । আগত কার্তিক শিউলি ভেজা পথ বেয়ে এগিয়ে আসছে ক্রমে। উৎসবের মেজাজ, ছন্দ কোভিড মহামারীতেও যেন থির থির পায়ে কম্পমান। 

তুলির শেষ টান সারা। সুবল পাল  আচ্ছন্ন হয়ে আছেন নিজেই নিজের সৃষ্টির মাঝে। এখনো এক ঘোরের মধ্যেই বিচরণ করে চলেছেন তিনি। এই প্রতিমা যাবে পাঞ্চালী দেববর্মার  বাড়ি। মেডিকেল ডাইরেক্টর। সেই যবে থেকে পুজো শুরু হয়েছে ম্যাডামের বাড়িতে, সুবলের হাতের প্রতিমা ছাড়া  তাঁর হয় না। ষষ্ঠীর দিন এসে  নিয়ে যাবে লোক লস্কর বাজা বাদ্যি সহ। তারপরে গিয়ে হবে মায়ের বোধন।  ধূপে, দ্বীপে ফুল নৈবেদ্যে হবে মায়ের আরাধনা, তিন দিন ধরে। হাজার আলোর রোশনাই গর্জন তেলে পড়ে আরো একবার ঠিকরে উঠবে সেখানে।

   পেটে, পিঠে দলা পাকিয়ে আছে তবুও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সুবল পালের। আজ কতদিন হয়ে গেল ক্ষিদে শব্দটার সাথেই যেন আড়ি দিয়ে বসে  আছেন! বৌ কাজের বাড়ি থেকে ফিরলে আজ না হয় ভালো মন্দ কিছু হবে। উমা আসছে যে।

সেই সে কবে বাংলাদেশ থেকে আর সবার সাথে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুবল আগরতলা। বাপ ঠাকুর্দারা বংশ পরম্পরায় ছিলেন কুমোর। মাটির সাথেই সন্ধি তাদের। একজন থেকে আরেকজনে চলত এই ধারা উত্তোরোত্তর। নিজে হাতে শিখিয়ে দিয়ে যেতেন মৃত্তিকা শিল্প পূর্বোজোরা, উত্তর প্রজন্ম কে। তারপর একদিন হাঁড়ি, কলসি, মাটির পাত্র বানানো ছেড়ে বাবা তাঁর  মূর্তি শিল্পী হয়ে উঠলেন। ডাক আসতে লাগলো বাংলাদেশের বড় বড় জমিদার বাড়ি গুলি থেকে । সুবল তখন ছোট । বাবা সাথে করে নিয়ে যেতেন মূর্তি বানাতে সাহায্য  করার জন্য ।  জমিদার বাড়িতেই তখন দশভূজার মূর্তি তৈরী হত। শেষ না হওয়া অবধি থাকতে হত। অবশেষে অনেক অর্থ, উপঢৌকন সহ বাড়ি ফেরা। নাম ডাক বাড়তে থাকলে, অর্ডার বেশি আসতে লাগলো। তারপর থেকে বাড়ির পাশেই একচালা ঘর করে একসাথে চার পাঁচটা থেকে আট দশটা মূর্তি অবধি বানিয়েছিলেন সুবল পালের বাবা।

 সুবল বাধ্য ছাত্রের মতন বাবার কাছ থেকে হাতে হাতে এগিয়ে দিতে দিতে শিখে নিয়েছিলেন সেই সব নিখুঁত কাজ। নির্দিষ্ট করে তালিম দিতে হয়নি তাকে। সুবল ও তাঁর বাবার মতন নামকরা মূর্তি শিল্পী হয়ে উঠলেন অচিরেই। মূর্তি গড়া পেশার থেকেও নেশা তখন সুবলের। 

 তারপর হঠাত্  যে কি এক অশান্তি শুরু হল বাংলাদেশে, সুবলদের সবাই পাড়া কি পাড়া খালি করে যা আছে তাই নিয়েই পালিয়ে চলে এলেন ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশের চারিদিকে তখন এক ডাক, "আইয়ে আইয়ে।" তাঁদের গ্রামের পুরো কুমোর পাড়াটাই যেন চলে এলো।  যে যেদিকে পারে।  কারোর সাথে যোগাযোগ আছে তো কারোর সাথে নেই। অনেকেই ইন্ডিয়া এসে পেশা পরিবর্তনও করেছেন । কিন্তু সুবলরা রয়ে গেছেন সেই এক পেশাতেই। 

আগরতলা এসে অসুবিধে বিশেষ হয় নি  সুবলদের।মূর্তি বানিয়েই বেশ সংসার চলে গেছে। বারো মাসের তেরো পার্বনের এই দেশে প্রতি মাসেই লেগে থাকে মূর্তির বায়না। দুর্গা পূজায় ক্লাব আর বাড়ি ঘরের পূজার বায়নাও থাকত বেশ। সুবল একটু বয়স কালে বিয়ে সাদি করে এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সংসার পাতেন। বড় সাধ করে মেয়ের নাম রাখেন ,উমা। মা তাঁর গত হয়েছেন কবেই। বাবা  বৃদ্ধ হয়েছেন। রোগ জরায় আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী।

তবে সুবলের ছেলের কখনোই তেমন আগ্রহ ছিল না মূর্তি বানানোর এই পেশায়। এই নিয়ে নিত্য অশান্তি লেগেই থাকতো । সে তখন ব্যাঙ্গালোরের রঙিন গল্পে মশগুল। আশ পাশের  অনেকের ঘর থেকেই যে তখন কুড়ি বাইশ বছরের ছেলেরা পারি জমাচ্ছে ব্যাঙ্গালোর ।কত বড় শহর! স্বপ্নের মতন সাজানো গোছানো। ইয়া বড় বড় হাইরাইজ বিল্ডিং।  যেনো আর একটু হলেই আকাশ ছুঁয়ে  ফেলে। সুবলের ছেলে সঞ্জিতের মতন গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেপুলেদের ও স্বপ্ন তেমনই আকাশ ধরে ফেলার থেকে কম নয়। 

কিন্তু রোজগারের ধান্দায় পড়াশুনা বন্ধ করে  ত্রিপুরা থেকে ছেলেরা   ওখানে গিয়ে হয় ড্রাইভারি করছে নয়তো দারোয়ান। কেউ সখে, আবার কেউ বা পেটের দায়ে । সোজা, সস্তায় টাকা কামাই বড় বড় শহরে। কে পড়ে থাকে নেতাজী পাড়ার মূর্তি বানানোর ঘিঞ্জি কারখানায়! 

কিন্তু  মেয়ে তাঁর মন প্রাণ দিয়ে  মূর্তি গড়তো । মাটি মাখা থেকে খরের গাদায় প্রলেপ লাগানো অবধি। কি নিখুঁত কাপড় পরায় মাকে। মাটির গয়নার ছাঁচে  ছাপ দিয়ে গড়ে তোলে মাটির গয়না। রাঙিয়ে তোলে  একেক ঠাকুরকে একেক রঙে। কখনো সাবেকি মূর্তি ও একটা দুটো গড়েন সুবল। মায়ের তখন অতসি ফুলের মতন  রঙ, তিল ফুলের মতন নাক আর পটল চেরা চোখ। চোখ আঁকাটা সুবল নিজের হাতেই রেখেছেন এখনো। রাখলেও মেয়ের বায়না, শিখবেই সে মা'য়ের চোখ আঁকা। বাবার চোখ আঁকার পরেই তো মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে উঠেন। 

সামনের বিল্ডিংএ আর্ট কলেজের এক দিদিমণি থাকতেন। প্রায় সময়ই এসে বলতেন , "ওরে সুবল এবার মেয়ে টুয়েল্ভ দিলে পরে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দিস।।মেয়ের হাতে জাদু আছে রে জাদু। একজন প্রতিষ্ঠিত ভাস্কর হতে সময় লাগবে না।  সমস্ত গুণ আছে ওর আঙুল গুলোয়। রামকিংকর বেইজের নাম শুনেছিস তো!! "

না শোনেনি এইসব নাম সুবল। সে কি করে শুনবে! সে তো ছাঁচে ফেলে মায়ের মুখ গড়ে। কাঠামোতে খড় লাগায়। মাটির প্রলেপ দিয়ে সেই একই ভাবে গড়ে তোলে অসুরের পেশি, সিংহের নাক চোখ ,ত্রিনয়নী'র তিনটে অলৌকিক নয়ন...
এর বাইরে সে দেখেনি আর কোন জগত্। জগত্ জুড়ে জগতের আভা এসে লাগেনি গতে বাঁধা সেই মূর্তি কারখানায়। সুবল ভাবে, কেবল ভাবে এইসব কি বলে গেলেন গো দিদিমণি!    

এমতাবস্থায় আগরতলা তে বড় বড় ক্লাবের রমরমা বাড়তে থাকে। এক একেকটা ক্লাব যেন পাল্লা দিয়ে  প্রতিযোগিতায় নেমে গেল । শৈল্পিক শৈল্পিক, আধুনিকতা চাই। গতে বাঁধা নয়। আর্ট কলেজের বড় বড় শিল্পীরা, পটু ছেলে মেয়েরা কাজ করে । যেমন প্যান্ডেল, তেমনি মূর্তি। কত বড় বড় মূর্তি একেকটা! বায়না দিয়ে আনতে থাকে ওরা শিল্পী  কুমোরটুলি থেকে নদিয়া, নবদ্বীপ  আরো কত জায়গার। বিশাল বড় বড় মূর্তি সব প্যান্ডেল জুড়ে । চুড়ান্ত পেশাদারিত্ব তাদের মধ্যে । সুবল নিজেই অবাক হয়ে থাকেন। কুশলতা তুঙ্গে তাদের। 

কাজ ছুটতে থাকে সুবলের হাত থেকে। প্রমাদ গুণলেন সুবলের স্ত্রী সুজাতা। সময় থাকতে বিদেয় কর  মেয়েকে ।বিয়ে দিতে তাগাদা দিতে লাগলেন বারংবার। 

অবশেষে পরিস্থিতির কাছে হার মানলেন সুবল। অনিচ্ছা স্বত্বেও জাত চেয়ে , ভাত দেখে পাত্রের কাছে দান করেই দিলেন মেয়েকে। মেয়ে তার কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলো। খোয়াইতে শ্বশুর বাড়ি।শ্বশুর ,শাশুড়ি, ননদ, দেওরে ভরভরন্ত সংসার। একদিকে মেয়ে বিদায় হল আর আরেক দিকে সুবলের সংসারে যেন অলক্ষ্মী এসে বাসা বাঁধলো। সুবলের অর্ডার কমতে কমতে  দুই চারটে । 

কিন্তু  মেয়ে বিয়ে দিয়েও শান্তি কোথায়! অশান্তির আগুনের ছাইচাপা আঁচ লুকিয়ে থাকে না। এসে ছুঁয়েই দিলো মেয়ের বাপের বাড়িতেও। জামাই তার শিলচরে পোস্ট আফিসের পিওন। মন দিয়ে বসে আসে ওখানেই  আরেক মেয়েকে। মা বাবার অমত। তাই প্রায় জোর করেই বিয়ে করানো হয়েছে মা বাবার পছন্দের মেয়েকে। সেই যে সে ফুলশয্যাটুকুও না হবার আগে ঘর ছাড়লো আর এলোই না । সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিছিন্ন করেছে  বাপ মা'য়ের সাথে। আর সদ্য বিয়ে করা বৌ'টার এর সাথেও। অনায়াসে নষ্ট করে দিতে পেরেছে আরেকটা মেয়ে মানুষকে। পারবেই তো মেয়ে মানুষই তো তায় আবার অভাবী ঘরের।  তার আবার জীবন কি!
শাশুড়ি বলেন , ডাইনে ধরেছে আমার ছেলেকে, ডাইনে।

মেয়ে তার কান্নাকাটি করে নিয়ে যাবার জন্য । এ বিয়ে কি আর কোন বিয়ে! এ যেন এক সোনার খাঁচা। এ খাঁচায় প্রিয় মানুষ  ছাড়া কী সুখ! 

 কিন্তু শ্বশুরবাড়ির মানুষ দিতে নারাজ । এত বড় সংসার! জমি জিরেত ধান চালের কারবার ! এত কাজ করে কে! এমন পেটে ভাতে কামলা  পাওয়া যায় নাকি আজকাল! সুবলের সংসারে তখন কোনমতে যাও কিছু একবেলা জোটে  তো আরেক বেলা নাই। ছেলে কখনো সখনো টাকা পাঠায় তো কখনো না। সুবলের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলে," থাকুক ওখানেই পড়ে ,দুটো ভাত তো দুবেলা করে  মুখে দিতে পারে!"   

পাড়া প্রতিবেশিরা বলেন, ডিভোর্সের কেইস কর খোরপোষ পাবে। কিন্তু সেটা করতেও তো উকিলের টাকার জোগাড় করতে হবে আগে। 

সুবল নির্বাক হয়ে পড়েন। বৌ তার বাসাবাড়ির কাজ নিয়েছেন দুটো। সুবলের আর কোন কাজ  জানা নেই। অনেকেই বলে রিকশ ভাড়া নিতে। কিন্তু সুবলের সেই অভ্যাস কোথায়! নেই। হাত যে তার শিল্পীর! সে হাতে রিকশ টানবেন কি করে! কিন্তু সংসার ও যে আর টানতে পারছেন না সুবল!

এর মধ্যে এলো হতচ্ছাড়া মহামারী কোভিড । চারিদিকে হা হুতাশা। সবাই দিশেহারা! পুজোও অনেক কম এবছরে। মা মনসা আর বিপদনাশিনীর  কিছু মূর্তি বিকেছে ব্যাস ওই পর্যন্তই ।তাও মূর্তি বানানোর খরচের সাথে পেরে উঠা যাচ্ছে না। বাবার ওষুধের খরচ বইবে না নিজের সংসার! ছেলেটা কাজ হারিয়ে ফিরে এলো ঘরে। সারাক্ষণ মোবাইল একটা নিয়ে ঘরেই পড়ে থাকে। 

সেদিন সোনামুড়া থেকে এসেছিলেন নুরুদ্দিন। গোলবাজারের পাইকারি বিক্রেতা। পাওনা টাকা নিতে এসেছিলেন। খুব খুশি! বলছিলেন এবারে বাইরে থেকে ছেলে নাতি  গুলো ফিরে আসাতে বেশ চাষ বাস করেছেন সবাইকে নিয়ে । ফসল নাকি তাঁর উপচে পড়া!

সুবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। কিছু জমি  যদি তারও থাকতো আশপাশে!
মনসা মূর্তি আর বিপদনাশিনী কয়েকটা বিকোতে পেরেছেন এবছর। ব্যাস ঐ পর্যন্তই । 


দুর্গা পূজা ও হবে কি হবে না কে জানে! মল মাস পড়াতে পুজো পিছিয়ে গেছে একমাস ।কোভিডের  যথেষ্ট সতর্কতা চারিদিকে। কত নতুন নতুন নাম আর নিয়ম। লকডাউন, আবার আনলক আবার নতুন করে সব স্বাভাবিক । চারিদিকে কত রকমের ভয়! মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। আজ এর ঘর , কাল ওর ঘর থেকে পজিটিভ পেয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোভিড সেন্টার গুলিতে চোদ্দ দিনের জন্য । 

  হঠাত্ সরকারি ফরমান এলো ছোট মূর্তি করে স্বল্প খরচে সারতে হবে পুজা। কাট ছাট করতে হবে বাজেটে।

এই যখন অবস্থা যে কটা অর্ডার পেত বাড়ি ঘরের সে গুলো ও এবার আর এলো না। শুধু আশায় বুক বেঁধে একটা মূর্তি গড়া শুরু করেছিলেন , পাঞ্চালী দেববর্মণের বাড়ির , সেটাই একটু একটু  করে  গড়ে তুলছেন। 

তেমনি এক শংকিত মারী ভেজা  দিনে হঠাত্  কে বা কারা বাইরে এসে হাঁক পারে,-"সুবলদা আছো নিও!"
কে কে ডাকে! শহরের বড় ক্লাব গুলির একটা বিদ্যাসাগর প্লে সেন্টার  ক্লাবের সেক্রেটারি। 
সুবল অবাক! সেই কবেই তো তারা সুবলের বাড়ির রাস্তা ভুলেছে। এখন কি কারন!
-"এবার আমরার মূর্তি তুমি বানাইবা দাদা । বায়না করতে আইছি। বাইরের থেইক্যা শিল্পী আনা রিস্ক। আর বাজেট ও কম তাই!" 
সুবল যেন চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। পরের দিন আরেক বিখ্যাত  ক্লাব -
পরের দিন আরো দুটো - এইভাবে পরপর দশটা মূর্তির অর্ডার এসে গেলো। সুবল  হতভম্ব! একি লীলা তব মাতেঃ!
  বাইরে থেকে শিল্পীরা আসেনি এবার। সুবলের যেন এক পলকেই  ভাগ্য খুলে গেলো। 
কিন্তু এত মূর্তি! এত মূর্তি  সে এই কদিনে রেডি করবে কি করে! ছেলে তো তার বাবু। হাতও লাগাবে  না। বৌ না হয় এটা সেটা এগিয়ে দেবে। এই পেশায় ওস্তাদ ছেলে পাওয়া অন্ততঃ এই দিনে খুব  মুশকিল এই মূহুর্তে ! ইসস্ যদি উমা থাকতো! বাপ মেয়েতে মিলে এরচে বেশি অর্ডার ও নিতে পারত। 

যেমন ভাবা তেমন কাজ। সুবল শুনলেননা কারোর কথা। খবর পাঠালেন মেয়ের শশুড়বাড়িতে। ওদের কোন ওজর আপত্তিই টিকলো না । স্পষ্ট বলে দিলেন সুবল, মেয়ে ফেরত না দিলে কেইস করে জেলের ভাত খাওয়াবেন ঘর শুদ্ধ সবাইকে।   সুবল মরিয়া! যেভাবেই হোক নিয়েই আসবেন সে উমাকে। এ বছর যেমন তেমন কিছু পয়সা হলে না হয় একটা দোকান দিয়েই বসবেন সামনে। বেশ চলে যাবে বাপ মেয়েতে দোকানদারি করে। সুজাতাকেও আর কাজে পাঠাবেননা। 

না না আর্ট কলেজের দিদিমণির সাথে দেখা করবেন সুবল। কি যেনো বলেছিলেন তিনি! সুবল স্বপ্ন দেখেন মেয়ে তার বড় আর্টিস্ট হয়েছে। কোভিড চলে গেলেও বায়না তার ঠিকই থাকবে।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন দশভুজার দিকে সুবল। হাতের তুলিটা তখনো হাতেই ধরা। চোখে সেই আদ্দিকালের কালো ফ্রেমের চশমা। পাওয়ারটা এবার চেঞ্জ করে নতুন ফ্রেমে বাঁধাতে হবে। মুখে, গায়ের গেঞ্জিটাতে এখানে ওখানে রঙের ছোপ লেগে চিত্র বিচিত্র হয়ে আছে। যেন পোড় খাওয়া চেহারায় বিগত দিনের ইতিহাসের আধুনিক চিত্রকলা। সংকেতে বুঝে নিতে হয় সব। মন তার শক্ত হয়ে উঠছে প্রচন্ড পরিশ্রম করার জন্য। সব গুলি অর্ডার সময় মত দিতে হবে।   

বাইরে একটা অটো থামার আওয়াজ পাওয়া গেল না! মেয়েলি গলায় ডাক,- "মা মা ও মা! বাবা ও বাবা কই তোমরা!" 
শুকনো ফেটে যাওয়া সুবলের ঠোঁটে ফুটে উঠে হাসি। অস্ফুটে দশভুজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠেন, " উমা আইলি!!

বিপ্লব গোস্বামী

সোনার শিক্ষা

বর্ণ  শিখে ছোট্ট সোনা
মায়ের কাছে বসে ;
বাবার কাছে সংখ‍্যা শিখে
সোনা অঙ্ক কষে ।

আমার কাছে বসে সোনা
শিখে মজার ছড়া ;
বাবার কাছে গিয়ে শিখে
শতকিয়ার পড়া।

মায়ের কাছে জানে সোনা
কোথায় কোন দেশ,
বাবার কাছে শিক্ষা পায়
যত সৎ উপদেশ।


কাজী নিনারা বেগম

অতীত

যাত্রা হোক শুরু গহীন অন্তর থেকে,
যেখানে একরাশ ফজিল রেখে।
 মাটিচাপা পড়ে ছিলাম আমি প্রথম শ্রাবণীতে,,
গন্তব্যহীন পথে তুমি কি আমায় চিনতে পেরেছো!
 ফর্মা থেকে বের করে দাও তোমার অনিন্দ্যসুন্দর রুপ।

তোমার হৃদয়ে রক্তাক্ত প্রেম ভালোবাসায় আমারি বুকে,
 বিদ্ধ করেছে বুলেট।
 আবার জেগে উঠেছে দিবানিশিথে!
এক অভিন্ন অভিনেতা তুমি!
 বদলে দিয়েছো ক্যালেন্ডারের দিনগুলো।
এক অবান্তর মহিমা হীন মৃত্যুর স্রোত,
জীবন কে ক্যানভাসে খুঁজেছ কম্প্রোমাইজ গিভ অ্যান্ড টেক পলিসিতে।

মিঠুন দেবনাথ

প্রকৃতির ধারা

কালো মেঘ বৃষ্টি আনে,
গাছ জাগে আপন মনে। 
টপটপ বৃষ্টি পড়ে,
থরথর করে পাতা নড়ে। 
হঠাৎ বাতাস বইতে থাকে,
গাছের পাতা নড়তে থাকে। 
হঠাৎ রোদ,হঠাৎ বৃষ্টি,
দুনিয়াটা এইভাবে সৃষ্টি। 
আসে গ্রীষ্ম,আসে শীত,
ছয়টি ঋতু গায় গীত। 
মুষলধারে বৃষ্টি হলে,
সব নোংরা নিয়ে যায় নদীর জলে। 
আসে ঝড় কালবৈশাখীর বৃষ্টি,
দুমড়ে মুচড়ে মুছেই নতুনের সৃষ্টি। 
আসে দুঃখ,কত রোগ,
প্রাণীরা করে সেটা ভোগ।
বেঁচে আছি যত দিন,
সুখ দুঃখ তত দিন। 

রূপালী মান্না

প্রেম বাঁচুক মনে  
               
রোজ্ ডে তে ,আমি কারো 
জীবন গাছের গোলাপ হয়ে 
ফুটতে পারিনি! 
তবে ,সমাজ পরিবারের 
কাঁটা হয়ে উঠতে পেরেছি ।

চকলেট ডে তে ,পঞ্চাশ পয়সার 
একটা লজেন্সও  আমার কপালে জোটেনি 
তবে ,চকলেটের ছেঁড়া প্যাকেট হয়েও 
জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি, 
মরণের কাছে হার মানিনি ।

টেডি ডে তে , রঙিন ,নরম টেডি আমি চাইনি 
কিন্তু একটা ছেঁড়া কোলবালিশ ও পাইনি ,
যেটা জড়িয়ে ধরে নীরবে -নিভৃতে 
 প্রাণ খুলে কাদঁতে পারি ।
সেটুকু অর্থও  আমার জোটেনি ।

প্রপোজ্ ডে তে ,প্রপোজের ঝড় তো দূরের কথা 
সারাজীবনে একটা পাত্রও  আসেনি ,
যার হাতে তুলে দিয়ে 
মা নিশ্চিন্ত হতে চাইতো ,
শান্তিতে মরতে চাইতো। 

প্রমিজ্ ,হাগ,কিস  নামক শব্দগুলো 
আজও আমার কাছে অজানা 
ভ্যালেন্টাইনের  মানে আমি খুঁজেছি ,
শ্রাবণরাতে ,প্রেমহীন বিদ্যুতের  আঘাত ,
আমিতো নীরবেই সয়েছি ।

বছর পনেরোতে ,যৌবনে পা রাখলেও 
পরের কুড়িটা বসন্তও ,কেটে গেলো নীরবে 
শীতের পাতা ঝড়া আজও থামেনি ,
মন পেখম মেলে আজও  ওড়েনি 
নীল দিগন্তের দেখা আমি পাইনি ।

অ্যাক্সিডেন্টে বাবাকে হারিয়েছি ,
সঙ্গে নিজের পা দুটোও খুইয়েছি ,
জয়েন্ট ফ্যামেলিতে রুগ্ন মাকে 
বোবার মতো খাটতে দেখেছি ,
তবুও ঈশ্বরের দেখা আমি পাইনি ।

'কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ '
ও তো দরদী কবির কল্পনা ,
আমি তো কোনো কাব্য নই 
কালো মুখে ,হরিণ চোখের ভাষা 
পাঠক কেন যত্ন করে পড়বে ?

পাতা ঝড়া শীতে আজও  শুনি 
নীল বসন্তের আগমনী .....
হুইল চেয়ারে বসে আজও  
রঙিন স্বপ্নের জাল বুনি ।

প্রেম আসুক আর নাই আসুক 
আজ ভ্যালেন্টাইন .......
প্রেমহীন জীবনে , প্রেম বাঁচুক মনে 
সুখ সপ্নের টানে ।

নাফিসা খান

বিবস্ত্র

নগ্ন একটি চিত্র মস্তিকে জায়গা করেছে,
আপন ইচ্ছায় বস্ত্র লোপাট কারী কোন
বেপরোয়া নয়,
জীবিকার ভড়ংয়ে বিকিনিতে বাজিমাত
মেকি নক্ষত্রও নয়।

শকাব্দের যন্ত্রণায় দগ্ধ
অবহেলিত,
শোষণের নিপীড়নে স্তনের কাপড় খুলে 
দাহ্য মাটি!
নির্লজ্জ প্রাচীর ভেদ করে পোড়া
শরীরের  হিসাব নিতে রাজপথে!

অনেক শব্দ খরচ করেছি উপস্থাপনায়,
অনেক অর্থের অপচয় গাঁট বেঁধে
আছে পোশাকে,তবুও উলঙ্গ দেহ।
বাবুরা পানশালায় আসে শুধু আয়েস
মেটাতে।
তারা ভালোবাসতে জানে না!
পোড়া হাঁড়ির গন্ধে মদের গ্লাস মজে।

অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট অনেক অভুক্ত
রাত জৈব সারে গলা ডুবিয়ে ছিল,
পাওনাটা বাকি আছে।
কোষাগার আর নয়,এবার দাতা
গ্রহীতার হিসাব বরাবর।
যান্ত্রিক অশ্রু বর্ষণ?
লাঙ্গলের ফালে সঞ্চিত অশ্রু উলঙ্গ
তান্ডবে  উপচে পড়েছে,
নিপাত যাক বাবুদের কাঁচের পৃথিবী।

নবান্ন থেকে ওনাম,ওনাম থেকে বিজু
অত্যাচারীর স্বর্গবাস.
অন্নহীন আউশ
আর নয়,
বয়কট সিম,বয়কট ফোন
বয়কট রাজা তোর বাবু
বিবস্ত্র কলম!

অভিজিৎ রায়

শ্রমিক

আমরা কাজ করি বলে নাম পড়েছে শ্রমিক
নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক
মোদের নিরন্তর পরিশ্রম বানিয়ে দেয় মানুষকে কোটিপতি
আবার আমরাই একজোট হয়ে করতে পারি সবার দুর্গতি!

আরে আমরা যদি কাজ না করি কে দেবে খাদ্যের যোগান?
শত পরিশ্রমের পরও মোরা পাইনা প্রকৃত সন্মান।
ধনী আরো ধনী হয় গরীবের কাধে চরে
বাবুদের অন্যায়, অবিচার সহ্য করি মোরা নির্বিচারে
আমরা ভবি সাবার কথা।
কিন্তু কেউ বুঝেনা মোদের ব্যাথা

পেটের তাগিদে অনেকেই ছেড়েছি বাড়ীঘর
কাজের খুঁজে ঘুরে বেড়াই মোরা দেশ দেশান্তর

অন্যের মুখে হাঁসি ফুটাতে গিয়ে মোরা মাজেমাঝে না খেয়েও থাকি
দুঃখ মোদের কেউ একবারও জিজ্ঞেস করে না কিভাবে বাঁচি

তবুও শত পরিশ্রমের পর করি সবাইকে সন্মান
দেশের সেবায় যেন করতে পারি আত্ম বলিদান।

সনৎ কুমার কুন্ডু

ভালোবাসা দিবসের গল্প

আজকের এই ভালোবাসা দিবসে
কী নিয়ে তোমার সাথে দেখা করব প্রেয়সি? 
ভাবতে ভাবতে ছোট্ট একটা গোলাপ কুঁড়ি
কাঁটা মাড়িয়ে  গাছ থেকে তুলে নিলাম
তোমার সামনে আসতে আসতে কুড়িটা
একটা পূর্ণাঙ্গ গোলাপে পরিণত হলো

চারিদিকে কি সুন্দর ঘ্রাণ বাতাসে বাতাসে ছড়াচ্ছিল,
হৃদয়ের আবেগে কিছু সময় ধরে তাকে
ভালবাসা দিতেই সে আস্তে আস্তে
পড়ন্ত বেলার মত স্তিমিত হয়ে
বিবর্ণ রংয়ে  জীবন সন্ধিক্ষণে....
মুহূর্তে চোখ তুলে দেখি সূর্য অস্তাচলে
চিত্রশিল্পীর তুলিতে মাখানো রংয়ে 
আকাশটা যে রঙিন হয়ে যাবার দৃশ্য
অবলোকন করতে করতে দেখি
তুমি প্রেয়সী!
তোমার চিবুক স্পর্শ করে বললাম
''এতদিন পর তুমি''!
আর এই ভালোবাসা দিবসে?

দিন গড়িয়ে রাতে
প্রস্ফুটিত গোলাপ আর পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে
বিস্ময়ের বার্তা নিয়ে এসেছ তো?? 

সুব্রত রায়

কবিতা                      
                 
কবিতা আমি লিখতে ভালবাসি
লেখার মাঝে নিজে নিজেই হাসি।
আমি কবিতা লেখি আমার মত করে
তুমি আমার কবিতা পড় তোমার মত করে।
কবিতায় ছন্দ আসুক বা না আসুক
কবিতা পড়ার সময় আমার ছবি তোমার চোখে ভাসুক।
কবিতার হল  আমাদের মাঝে দূত
তাইতো তৈরি হল মনন স্রোত।

বিনয় শীল

পলাশে শিমূলে মাতৃভাষার হাসি

প্রায় শিশু সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্মায়,
যা দিয়ে মা তাকে পান করায় অমৃত।
সে পুষ্ট হয়, বিকশিত হয়, 
হেসে খেলে নেচে বেড়ায়।
উত্তরকালে কেউ কেউ জগতভরে-
তা-ই দিয়ে অমৃত বিলায়।
সে চামুচ মাতৃভাষা।
জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে, 
জীবনের সুকঠিন বাঁকে
যে আমার মনে জাগায় স্বর্ণরাঙা আশা,
সে শুধু আমার  মাতৃভাষা।।

মা যদি প্রতিদিন মার্জিত চামুচে-
শিশুর মুখে দেয় মধু,
তবেই শিশুর মন হয় মধুপুঞ্জ।
হৃদয়টা হয় অমৃতকুম্ভ,
চোখে তার শ্বেত-অমৃত জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়।
স্নিগ্ধ কন্ঠে বর্ষিত হয় নব নব শব্দসুধা,
কেউ কেউ তা দিয়ে বিশ্ব প্লাবিত করে,
জগত পরিতৃপ্ত হয়।
জীবনের দূর্গম পথে, জীবনের ঘুর্ণাবর্তে,
মিটিয়ে দেয় যে প্রাণের পাপাসা।
সে শুধু আমার মাতৃভাষা।।

মা যদি চামুচটা অমার্জিত রাখে,
ব্যাবহার না করে যদি সতর্কতার সম্মার্জনী,
তা-ই দিয়ে যদি মা অপেয়-কুপেয় পিয়ায়-
তবে তার বৃদ্ধি অনভিপ্রেত,
বিকাশ তার অবাঞ্ছিত,
কুদৃশ্য ছত্রাকে স্বর্ণচামুচ কলুষিত হয়।
মাতৃভাষা এখানে বিবর্ণা,
সোনার চামুচ এখানে ফ্যাকাশে,
তথাপি আমি বৈশাখী ঝড়ের সাথে-
নৃত্যরত কদাকার মেঘের তলদেশ দিয়ে 
সুন্দর বলাকার দলকে উড়ে যেতে দেখেছি।
প্রতিক্ষণে প্রাণে-মনে দেয় ভালোবাসা,
সে শুধু আমার মাতৃভাষা।।

মাতৃভাষা আজ পিঞ্জরের পাখি,
মাতৃভাষা আজ ছাঁটাই করা শাখী।
তার সহজাত সুর-ছন্দ-কথা,
হারিয়ে যায় অসুন্দর অপচেষ্টায়,
কিংবা গভীর চক্রান্তের বেড়াজালে,
নতুবা বিকৃত রুচিতে
অথবা অশুদ্ধ প্রচলিত নিয়মে।
তাই বুঝি ড্যাডি, মাম্মি ও পাপ্পার ধাক্কায়
স্নেহাদ্র বাবা আর মমতাময়ী মা চরম আহত।
আন্টির উৎপীড়নে কাকী আর মাসি লূপ্তপ্রায়!
আঙ্কেলের অত্যাচার নাই-বা বললাম।
এই তো কিছুদিন হলো-
বাবাকে মৃতপ্রায় করে, 
তার উপর মাথাচাড়া দিলো- 'বাবু' !
হাজার গুলির ঘায়ে মাতৃভাষা রক্তাক্ত।
জানতে, অজান্তে অপমানিতা বহুবার,
কুঞ্চিত নাসিকায় উপেক্ষিতা বারে বারে।
তবুও যখন দেখি রং ধরে শিমূলের ডালে
রাঙা পলাশের ফাঁকে বেজে উঠে-
বসন্তের কুহুঁ-কুহুঁ সুর,
আবিরে রাঙা আকাশ,
আর বসন্ত ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জন তান,
মনে পড়ে যায়, মাতৃভাষার বিজয়ের গান।
বসন্তের দখিনা বানে, 
কোকিলের গানে গানে,
পলাশে শিমূলে একুশের- 
এতো হাসি-হাসা।
সে শুধু আমার, সে শুধু আমার-
সে শুধু আমার মাতৃভাষা।

সুব্রত দেববর্মা

যুদ্ধে কিংবা বুদ্ধে          

হে পুরুষোত্তম
আমাকে আমার থেকে মুক্তি দাও।
দুই ষ্টেশনের মাঝে ঝুলে আছি আমি
বড়মুড়া পাহাড়ের মতন।
কিন্তু এবার সময় এসেছে এক পক্ষ নেওয়ার।
হয় যুদ্ধে কিংবা বুদ্ধে।

আমাকে আমার থেকে মুক্তি দাও।
আমাকে কোনো একদিকে দাঁড়াতেই হবে।
হয়তো হাতে থাকবে যুক্তির খড়গ,
কিংবা ভাববাদের অশেষ মড়ক।

উঠো,জাগো এবার সময় হয়েছে;
হয়তো মগজাস্রে দৌড়বে লেলিন
কিংবা মন্দিরে হবে বিলীন।
একটা পক্ষ এবার তোমাকে নিতেই হবে।

হে আসমুদ্রহিমাচল এবার জড়তা ছাড়ো,
যুদ্ধের দামামা বেজেছে।
হাইফাই সাইরেন এবং পাঞ্চজন্য শঙ্খ
এক সাথে সেজেছে।

সময় আর নেই যে,
একটা পক্ষ তোমাকে নিতেই হবে।
যুদ্ধের একদিকে তোমাকে দাঁড়াতেই হবে।

রামপ্রসাদ কুন্ডু

না স্পর্শে না অনুভবে

তোমাকে ভালবেসে না পাওয়া
তাতে মোটেও আক্ষেপ নেই আমার
জানি স্পর্শহীন ভালবাসা হয়তো
কপালে জোটে না সবার! 

না ছিল স্পর্শ, না ছিল চুম্বন আলিঙ্গন
না ছিল নিষিদ্ধ গলিপথে হাঁটা
দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায় অনেকটা বছর
তবু তোমার সাথে পালন হয়নি সব উৎসব
হয়তো নিয়তির খেলা এটাই! 

না পেলাম তোমাকে, ভেঙেছে দুটি মন
সান্তনা রাখি এই ভেবে যে, 
স্পর্শ আলিঙ্গন চুম্বনে ভালবাসা নেই 
পবিত্র রেখেছিলাম তত বছর তোমাকে 
হয়তো এটাই নিয়তির খেলা!

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...