Sunday, June 21, 2020

মনন স্রোতে আপনাকে স্বাগতম

সম্পাদকীয়

বিংশ শতকের দিশেহারা প্রজন্ম হিসেবে বাবাকে, বাবার অবদানকে শ্রদ্ধা জানানোর একটি দিবস হিসেবে আজ এই মহান দিনে মনন স্রোত প্রকাশ করতে পেরে আমরা তৃপ্ত।

সমগ্র সংখ্যাটির কাজ হয়েছে বাবাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এই সংখ্যা সমৃদ্ধ হয়েছে রাজ্য বহিঃরাজ্য এবং বিদেশের বাঙালি লেখকদের লেখায়। যারা লিখেছেন সকলকে মনন স্রোত কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।

তারুণ্যের পরিচালিত রাজ্যের প্রথম সারির শিল্প সাহিত্য সংস্থা হিসেবে মনন স্রোতকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনে সবাই এভাবে সহযোগীতা করবেন এই প্রত্যাশা রাখছি। আগামী দিনে নতুন ভাবনায় কাজ করার ক্ষেত্রে সকলেই মনন স্রোতের অংশীদার হবেন এই বিশ্বাস রেখে ইতি টানছি। পৃথিবীর সকল বাবাকে উৎসর্গ করা হলো মনন স্রোতের এই সংখ্যা।  

শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা-সহ
জয় দেবনাথ
 সম্পাদক 
মনন স্রোত

ছবিতে মডেল শিল্পী সুমন / ক্যামেরায় পুষ্পেন্দু ঘোষ। রাজ্যের ফটোগ্রাফির এক বিশ্বস্ত নাম THE DIVINE CAPTURE / ফেসবুক সূত্র https://www.facebook.com/107181397587788/posts/146698966969364/

ড. সমীর ভাদুরী

বাবার জন্মদিনে ছেলের শুভেচ্ছাবার্তা
                                                   
    
পঁচিশে বৈশাখ  মানেই বাঙালির কাছে একটা বিশেষ দিন। তেমনি ২৬শে বৈশাখ ও  আমার কাছে খুব সুন্দর বিশেষ একটা দিন ।২৬ শে বৈশাখ আমার বাবুর জন্মদিন ।সবসময় আমরা বাবুর জন্মদিন ইচ্ছে করে বাংলা মাসের তারিখ মেনেই আমাদের মতো করে পালন করি । বাবু সবসময় হাসির ছলে বলে আমি কবি গুরুর থেকে একদিনের ছোট। আমাদের বাড়িতে জন্মদিন মানেই সমবেত উপাসনার মাধ‍্যমে শ্রী শ্রী বাবামণির শ্রীচরনে কুশল প্রার্থনা আর মায়ের হাতের পায়েস।আমার ছোটবেলা থেকেই বন্ধু খুব কম ছিলো কারন আমার বাবুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এখনো বাবুকেই নিজের বন্ধু মনে করি। বাবুর সঙ্গে গল্প করতে বসলে আমার আর কিচ্ছুটি চাইনা দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারবো শুধু গল্প করে কত অজানাকে জানি কত অচেনাকে চিনি। স্কুলে ও যখন পড়তাম বাবু অফিস থেকে আসলেই বাবার সঙ্গে গল্প করবো ভেবে বিকেলের মধ‍্যে পড়াশুনা শেষ করে নিতাম। আরো যখন ছোট ছিলাম বাবার সাইকেল ছাড়া আর অন‍্য কারোর সাইকেলে উঠতে ভয় পেতাম জানতাম বাবা কোনোদিন ফেলে দেবেন না।বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল। বাবার সাইকেলের পেছনে বসে রবিবারে উদয়পুরে বাজার করতে যাওয়া সে এক অন‍্য অনুভূতি, কারন মিষ্টি খাবো। বাবা সবসময় আদর করে বলতেন নসো খাইবা!!! আবার বাবার সাইকেলে করে গানের স্কুল সেরে সন্ধ‍্যাবেলা শিশু উদ‍্যানে ঘুরতে যাওয়া , গোমতীর জলে সাঁতার কাটা, শিশু উৎসবে যাওয়া, দেওয়ালি উৎসবে যাওয়া আর গ্রীষ্মের ছুটিতে ভারত সেবাশ্রমের চারণ দলের সন্ধ‍্যারতি দেখতে যাওয়া এবং সর্বোপরি সাপ্তাহিক সমবেত উপাসনাতে যোগদান সব যেনো আমার কাছে  সুন্দর মুহুর্তসঞ্চয়ন।এই সুখকর স্মৃতিগুলোই এগিয়ে যাওয়ার রসদ আমার জীবনে। পড়াশুনার জন‍্য বাড়ি ছেড়ে বের হওয়ার পর ও আমি কখনো অনুভব করিনি আমি দূরে আছি কারন যখন ই মনে পড়তো ফোনে কথা বলতাম। রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে একটা ফোন আসবেই শুধু বলার জন‍্য  মশারি লাগিয়ে যেনো ঘুমাই সেই কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন‍্য।এখনো এই ফোনের অপেক্ষায় থাকি। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাবু ঘুম থেকে উঠেই সকালবেলা ঠাকুরমাকে প্রণাম করতেন তাই আমি আর দিদি ও সবসময় সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাবু মা কে প্রণাম করি । প্রণাম করার পর বাবু যখন মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করেন সেটা আমার কাছে সারাদিনের রক্ষাকবচ।বাড়ীর বাইরে থাকলে ও ছবিতে যখন প্রণাম করি তখনো সেটা অনুভব করি।  বাবু সবসময় বলে তোমরা ভাইবোন দুজন আমার দুটি হৃদয়। অনেক বছর পর এইবার বাড়িতে আছি বাবুর জন্মদিনে। এটা আমার কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি। বাবু শ্রী শ্রী বাবামনির শ্রীচরনণে প্রার্থনা করি তুমি এভাবেই আমাদের উপর বটবৃক্ষের মতো আশ্রয় হয়ে থাকো। আমাদের বন্ধুত্ব আরো সুখময় আনন্দময় ও মধুর হোক। তুমি ভালো থাকো সুস্থ থাকো  তবেই আমরা ভালো থাকবো। শুভ জন্মদিন বাবু ।

অরিজিৎ মজুমদার

বাবার চুরি


চারিদিক শুধু আজ ঝড়বৃষ্টিতে কম্পমান। 
ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে প্রলয়ংকর আম্ফান।। 
ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট কিছুই রাখেনি বাকি। 
সকলে হলো ছন্নছাড়া মানুষ ,পশুপাখি।
তারই মাঝে প্রতিদিন হয় বাড়িবাড়ি খাবার চুরি। 
এলাকাবাসী রেগে আগুন ধরবে চোরের জারিজুরি।
সকলে মিলে পাহারা দিয়ে ধরলো চোরটাকে। 
লোকটি তার স্ত্রী ছেলে নিয়ে রাস্তার পাশে থাকে। 
শীর্ণকায়া মানুষটিকে আনা হলো পঞ্চায়েতে। 
শাস্তি হবে,ধরা পড়েছে একদম হাতেনা হাতে। 
জলভরা চোখে বলল সে, "চুরি করিনি স্বভাবে"। 
ছেলের কষ্ট সইতে না পেরে করেছি ভীষণ অভাবে।
ঝড়ের কোপে সব হারিয়েছি ক্ষুধায় কাদছে ছেলে। 
বাধ্য হয়ে চুরি করেছি, জানি যাব জেলে। 
মৃত্যু হলে স্বর্গে আমার স্থান দেবেনা বিধাতা। 
ক্ষমা করুন,আমি যে একজন সর্বহারা পিতা।

হামিদুল ইসলাম

বাবা 
           
বাবার সঙ্গে শেষ দেখা 
ফুলেশ্বরী নদীতে 
জাল নিয়ে আমরা মাছ ধরতে গিয়েছিলাম 
মাঝ নদীতে জালের ফাঁসে আটকে যান বাবা 
আর ফিরতে পারেন নি 
আমরা অনাথ হয়ে গেলাম একটি মানুষের জন‍্যে।

পূজো আসলে নতুন জামা কাপড় পরে 
আনন্দে মেতে ওঠে সবাই 
বাবার জীবদ্দশায় আমরা কতোই না আনন্দ করেছি 
আজ সব উল্টো
আমাদের বাড়িতে আনন্দ আসে না কতোকাল 
আমরা অনাথ।

চৈত্রি সংক্রান্তিতে বাবার কাঁধে উঠে মেলায় গেছি কতোবার 
এখন চৈত্র সংক্রান্তি কখন আসে কখন যায় 
বুঝতেই পারি না 
ওইদিন মা বাবার ছবিতে ফুল তুলে প্রণাম করেন 
আমরাও প্রণাম করি বাবাকে 
শ্রদ্ধা ভরে। 

বাবা নেই অথচ বাবা আছেন 
বাবা আছেন হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। 

নিপু দাস

অলিখিত যোদ্ধা

আজ প্রথমবার লিখতে যাচ্ছি নিজ হাতে অলিখিত যোদ্ধার কথা,
মাতৃত্বকে তো সবাই চিনে সবাই বোঝে,পিতৃত্বের কে জানে আসল গাঁথা।
জবজবে ঘামে শরীরী রক্ত ক্ষরন করে সারাদিন,
ভেবো না কোনো জন্মে তার শোধ করা যাবে ঋণ।
মায়ের ছোঁয়া দিয়েছে সে,অলিখিত কষ্ট সব যার,
সে ই আমাদের প্রিয় বাবা বাড়ির মেরুদন্ড সার।
সেবার স্পর্শে আগলে রেখে রোজ কপালে দিয়ে আদর,
মা বলতো তোমার আস্কারা পেয়ে হয়েছে একটা বাঁদর।
জীবন যুদ্ধে যখনই হয়েছি সম্পূর্ণ কাতর,
বাবা!তোমার দেখানো পথেই পেয়েছি নব দিগন্তর।
আঙুল ধরে হাঁটতে শেখা,হোঁচুট খাওয়াও আছে,
যখনই জীবন পথে মুখ থুবড়েছি বাবা তুমিই ছিলে কাছে।
সাহস তুমি,শক্তি তুমি প্রেরনার এক অভিনব সমুদ্র,
বাবা তোমার আর্শিবাদ যেন মাথায় নিয়ে চলতে পারি আমি বহু প্রান্ত।
আবদার মেটানোর চেষ্টায় কতো দিয়েছো নিজের ইচ্ছার বলি,
বাবা আমিও যেনো তোমার দেখানো পথে আজীবন চলি।
জাতির উদ্দেশ‍্যে আমার এই অন্তিম বার্তা,
বাবার দেখানো পথ অনুসরন না করে চললে-শুনতে হবে বহু কথা।
যদি কখনো মনে জাগে কোনো নায়কের প্রতি শ্রদ্ধা,
মনে রেখো তবে বাবার অপর নাম অলিখিত যোদ্ধা।

শিপ্রা দেবনাথ

বাবা 

বিশ্বটাকে প্রথম আমার বাবার চোখেই দেখা, 
বাবার হাতেই হাতেখড়ি আমার!
বাবার হাতটিধরেই আমার প্রথম পথ চলা
যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি আমি,
মাথার উপর পেয়েছি তোমারই ছায়া। 
শৈশবে মা'র কাছে বকুনি খেতাম দুষ্ট ছিলাম বলে, 
আমার চোখে কান্না দেখে বাবা তুমি আসতে চলে। 
বাবা তোমার নেই কোন চাওয়া 
নেই কোন কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা। 
আমাদের খুশিতেই খুশি তুমি, 
এটাই তোমার চাওয়া পাওয়া। 
ক্লান্ত প্রহরে, কাজের অবসরে 
বাবা তোমাকে মনে পড়ে,
মনে পড়ে ছোট্টবেলার অনেক স্মৃতি, 
মনে পড়ে অতীতের অনেক কথা। 
বাবাকে নিয়ে কি আর কবিতা লিখে শেষ করা যায়,
বাবা হলো উপন্যাস স্বরুপ, 
দু-চার লাইনে কি তা প্রকাশ করা যায়।     

অসীম দেববর্মা

অভাগা পিতা

আমি এক অভাগা পিতা
দরিদ্রতা যার নিত্য গীতা! 
প্রাপ্তির হাসি পারিনা ফুটাতে সন্তানের মুখে, 
সারাদিনের ক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে সন্ধ্যায় হাত খালি থাকে। 
দুবেলা দু'মোঠো ভাত 
মুখে তুলে দিতে কাঁপে হাত! 
কিনে দিতে পারি যদি একসেট খেলনা, 
ভেঙে গেলে খেলনাটি জুড়ে দেই খেদের আঠা দিয়ে জুড়ে নতুন বলে করি ছলনা। 
একজোড়া কাপড় কিনে দিলে যতক্ষণ পর্যন্ত রঙ না উঠে
মুখে কাপড়ের নাম না ফুটে, 
ছেলেমেয়েকে কখনো বেড়াতে নিয়ে যাই না 
কোনো কিছু আবদার করলে কিনে দিতে পারবো না। 
প্রাপ্তির আকাশে উড়ন্ত ইচ্ছা পূরণের ঘুড়ি 
সুতা কেটে দেয় কঠোর সত্যের অর্থ কড়ি। 

সজীব পাল - (ধারাবাহিক)

সেদিন সে এসেছিল (১) 


মনীষ অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে দেখলে তার ঘরটা এখন আলো অন্ধকার ।তার মতে আকাশে যখন সূর্য থাকবে তখন স্বাভাবিক নিয়মে হবে দিন।চাঁদের রাতকে বলা হবে রূপাত্রি।অর্থাৎ চাঁদের রুপোলি রাত্রি। আর রাতের অন্ধকারে যখন আলো জ্বালানো হবে তখন তাকে বলা হবে,আলো অন্ধকার ।তার ঘরটা এখন আলো অন্ধকার।বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।এখন ত সংবিধানের মত ধারা হয়েছে, একটু সামান্য ঝড়বৃষ্টি হলেই কারেন্ট চলে যাওয়া ।এখন এমনটাই হয়েছে । বৃষ্টি কমে মাটি শুকিয়ে গেলেও কিন্তু কারেণ্ট আসে না সহজে ।মনীষ চৌকিতে বসে মোমবাতির আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।ঘরের দরজাটা ঘুণে খেয়ে একেবারে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে ।কয়েকদিন আগে মনীষের প্রচন্ড জ্বর আসে ।একা মানুষ,জ্বর হোক আর যাইহোক নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয় ।সে চৌকিতে শুয়ে আছে,কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই জলের পিপাসা।জ্বরের তাড়নায় বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না ।কিন্তু কি আর করা,জ্বরের কাছে পরাজিত হয়ে জল না খেয়ে মরার চেয়ে জল খেয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে মরা অনেক ভালো।কাঁপতে কাঁপতে ওঠতে গিয়ে কয়েকবার বিছানার মধ্যেই পড়ে গেল।কিন্তু তাকে যে জল খেতেই হবে ।উঠলো,কোনো মতে মেঝে পা রাখা মাত্রই সারা শরীরে মুহুর্তেই লোম দাঁড়িয়ে যেন হার্টবিট বেড়ে গেল ।শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো ।ছোট্টঘরেই জলের ফিল্টার,দুইটা প্লাস্টিকের চেয়ার এবং খাওয়ার জায়গা। ফিল্টারটা দরজার কাছে রাখা ছিল।ধীরে ধীরে দরজার কাছে যাওয়া মাত্রই হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে দরজায় ভরসা করতে গেলো।কিন্তু দরজা তার খুঁটি হতে অক্ষম হল ।ঘুণে খাওয়া দরজাটা হাতের আঘাতে অনেকটা ছিদ্র হয়ে গেছে।দরজাটা পাল্টানোর জন্য মালিককে অনেকবার বলা হয়েছে,কিন্তু মালিক কর্ণপাত করলো না।এই ছিদ্রপথে শোঁ শোঁ করে বাতাস এসে মোমবাতির আলোটাকে কাঁপাচ্ছে।মনীষ বসে বসে আলো বাতাসের খেলা দেখছে আগ্রহ নিয়েই।এই যেন এক কঠিন লড়াই।অনবরত বাতাস এসে হামলা করছে,কিন্তু মোমবাতির ছোট্ট আলোর শিখা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার অপ্রাণ চেষ্টা ।এইভাবে চলতে থাকলে আলোটি বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না।ঘড়ির দিকে মনীষ লক্ষ্য করে দেখল রাত বেশি নেই ।সে না উঠলেও পারতো,শুধু শুধু বৃষ্টির মধ্যে মোম জ্বালিয়ে বসে থাকা কোনো দরকার ছিল না।কিন্তু এই অভ্যাস তার বাবার ছিল ।কখন যে তার মধ্যে এই জঘন্য অভ্যাস বসে গেল সে টের পেল না।রাত দুপুরে ঘুম থেকে ওঠা খুবই বিরক্তিকর একটা ব্যাপার।কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল তার কোনো বিরক্তিই লাগছে না।অদ্ভুত ভালো লাগছে ।আচ্ছা মানুষের ভালো লাগাটা কোথায় থেকে সৃষ্টি হয়,মস্তিষ্ক!তবে সবাই যে মন বলে !মন ভালো থাকলে সব শান্তি ।তবে কি মন বলতে মস্তিষ্ককে বোঝাতে চেয়েছেন!মোমবাতি হেরে গেছে,হাওয়া জয়ী।ভেন্টিলেটার দিয়ে নরম আলো ঘরে ঢুকছে।মনীষ এই আলোর একটা নাম খুঁজছে কিন্তু মাথায় আসছে না।এই সময় মানুষের ঘুম খুব গভীর হয়,কিন্তু পাখিরা প্রকৃতির নিয়মে এই সময় জাগে।মনীষ এতক্ষণ বসে ছিল,এইসব ভাবতে ভাবতে বালিশে মাথা লাগতেই চোখ জরিয়ে আসছে ।চেষ্টা করেও মনীষ বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারল না ।

আজ রবিবার মনীষের অফিস নেই ।দুপুরে নীপাদের বাড়ি যাওয়ার কথা ।কিন্তু ভালো লাগছে না ।আবার না গেলে নীপা এসে সারা বাড়ি গরম করে ফেলবে।শেষে বাড়ির মালিক উত্তেজিত হয়ে,মনীষকে বলবে এ-কিরকম মেয়েছেলের সাথে চলেন বলুন ত মশাই?এইরকম ব্যবহার করে কেউ পুরুষ মানুষের সাথে ?নীপা একটু জেদি তবে খারাপ নয়।রসিকও বটে।মনীষ চায় না তার জন্য নীপার সম্পর্কে অন্য কেউ কটু কথা বলুক। এই জন্যে তাকে যেতে হবে ।নীপা তার অফিসের সহকর্মী।মনীষের সাথে প্রথম দিন থেকেই তার খুব ভাব হয় ।নীপার গায়ের রং খুব ফর্সা নয়,কিন্তু মুখের গঠন অসম্ভব সুন্দর।দেখলেই কেমন কাছের কাছের লাগে ,মনে হয় তার সাথে অনেকদিনের পরিচয়।টানা টানা চোখ,ঘন কাজল ভ্রু।তীক্ষ্ণ নাক।মেদহীন সুঠাম দেহ।তার গলার একটু নিচে একটা কালো তিল,অদ্ভুত মানিয়েছে তাকে।তাকে কালো ব্লাউজ এবং হালকা বেগুনি শাড়ি পড়লে সোনালী পরীর মতো লাগে।এই সোনালি পরীরা কারণ ছাড়া অন্ধকার ভালোবাসে।এরা সাদা পরীর শত্রু।মনীষ এই শত্রুতার একটা ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা বের করেছে ।একদিন সাদা পরী এবং সোনালী পরী স্নান করতে নদীতে যায় ।নদীতে তখন হাঁটু জল।কেউই ডুব দিয়ে চুল ভিজাতে পারছে না বলে সবার মনে দুঃখ।তখন আকাশে পূর্ণ চাঁদ,কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড হল এই চাঁদের কোনো জ্যোস্না নেই।সোনালী পরী সাদা পরীকে বলল,এই রাত আমার জন্য নির্ধারিত তোমরা ফিরে যাও ।আমি এখন এই অন্ধকার জ্যোস্নায় বিবস্ত্র হয়ে স্নান করব ।কিন্তু সাদা পরী বলল, এই রাত আমাদের! মেঘছায়ার জন্য চাঁদের জ্যোস্না নদীতে আসতে পারছে না ।এইভাবে অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক করে সাদা পরী সোনালী পরীর গালে থাপ্পড় মেরে পালিয়ে যায়।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে কি নিজেকে খুব ভালো করে কখনো দেখেনি ?দেখলে নিশ্চয়ই অহংকার বাসা বাঁধবে । গলার নিচে তিলটা যে তাকে মানিয়েছে সেটা কি নীপা জানে?এবং সে যে এত রূপবন্ত তা কি জানে না !আর জানে না বলেই বোধহয় মনীষের মতো একটা শান্ত অচঞ্চল ছেলের সাথে সখ্যতা করেছে।মনীষ ঠিক মতো কথাও বলতে পারে না,অন্যের প্রশ্নের উত্তর খুব সংক্ষেপে দেয় ।যেমন তাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে,মনীষ আপনে এই অদ্ভুত রহস্যময় পৃথিবীর সম্বন্ধে কিছু বলুন।তখন সে মনে মনে দীর্ঘ বিস্তারিত চিন্তা করবে,কিন্তু মুখে শুধু বলবে,এই পৃথিবী রহস্যময় তাই এত সুন্দর এবং মানুষ বার বার পৃথিবীতে আসতে চায় ।এর বেশি বললে আমার কথায় রহস্য জাল বুনতে শুরু করবে ।এই বলেই মনীষ একটু মুচকি হাসবে।নীপার ঠোঁটগুলো বেশ আকর্ষণীয় ।চিকন ঠোঁট,হাসি দিলে গালে টোল পড়ে ।দেখতে বেশ লাগে ।একদিন অফিসে দুপুরের লান্স করার সময় এই ঠোঁট নিয়ে মনীষ নীপাকে বলল," নীপা"

" হু"
" তোমাকে একটা কথা বললে খুব রাগ করবে ?রাগ করলে বলব না"

"খুব রাগ করব না,কিন্তু এখন যদি তারাতারি না বলো তাহলে রাগ করব।"

" তোমার ঠোঁট কিন্তু খুব সুন্দর ।বিশেষ করে যখন তুমি হাসো,তখন গালের টোল পড়া,দাঁত এবং ঠোঁট এই তিনটা এক সাথে দেখতে আরো ভালো লাগে।"

নীপা একটু মুচকি হেসে বলল," তুমি বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ঠোঁট দেখতে প্রতিদিন?"

"এ-মা,না না প্রতিদিন কেন দেখবো যখন তোমার সাথে কথা বলি তখন দেখি।তাছাড়া আমি কিন্তু কথাটা এমনি বললাম ।আবার অন্যকিছু ভেবে বসে থেকো না যেন।"
এরপর নীপা যে কথাটা বলল,সেটার জন্য কোনো পুরুষ মানুষ প্রস্তুত থাকে না।নীপা মনীষের দিকে ঝুঁকে বলল,দেখতে যতটা ভালো লাগে ছুঁয়ে দেখতে আরো বেশি।"কথাটা বলে নীপা হা হা হা করে হাসতে লাগলো ।মনীষ তার কথাটায় লজ্জা পেলো।কিন্তু এই লজ্জার জন্য সে আরো লজ্জা পেলো ।সে মেয়ে হয়ে একটা যুবক ছেলের কাছে কথাটা বলতে যখন কুণ্ঠাবোধ করেনি,সে মিছে মিছে কেন লজ্জা পাচ্ছে! সেদিন এই নিয়ে আর কথা হয়নি নীপার সাথে মনীষের।

মনীষ অনেকক্ষণ অটোতে বসে আছে,আরেক জন প্যাসেঞ্জারের জন্য ড্রাইভার অটো ছাড়ছে না ।এতটা পথ একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে গেলে পোষাবে না।মটর স্ট্যান্ড থেকে শিবনগর প্রায় আধা ঘন্টার পথ।ড্রাইভারকে জোর করলেই বিপদ।কথায় কথা বাড়বে ।বলবে ,"ভারা ত দিবেন কুড়ি টাকা!আর এই কুড়ি টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই একটা সংসার চলে না !যদি দুই জনের ভারা দিতে চান তো যেতে পারি! "এইরকম অনেক অভিজ্ঞতা আছে মনীষের।মনীষ ছোট থেকে বড় হয়েছে গ্রামের জল হাওয়া খেয়ে।পড়া শোনার জন্য,কাজের জন্য তাকে অনেক গাড়ি চড়তে হয়েছে। হয়তো এখন চাকরির খাতিরে শহরের বুকে তার বিচরণ।
মনীষের পাশে লাল শালু পড়া একজন সন্ন্যাসী উঠেছে।লম্বা আধপাকা দাঁড়ি,গাঁট্টাগোট্টা শরীর ।দেখে মনে হয় কোনো নির্দিষ্ট আশ্রমে থাকে।কিছু সন্ন্যাসী আছে যাদের শরীরে এক ধরনের অসহ্য গন্ধ থাকে ।অপরিষ্কার পোশাক পরিচ্ছদ ।মনে হয় কতকাল স্নান করে না ।কিন্তু এই সন্ন্যাসীর শরীর ও পোশাক বেশ পরিচ্ছন্ন।মনীষের আবার এইসব সাধু সন্ন্যাসীদের প্রতি যথেষ্ট ভাব ভক্তি।অটো অনেকক্ষণ হল চলছে।সন্ন্যাসীটি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে ।মনীষ সন্ন্যাসীকে জিগ্যেস করল," সাধু বাবা আপনে কোথায় যাবেন?"

সন্ন্যাসীটি তার দিকে ফিরেও তাকাল না ।মনীষ অবাক হল,সাথে লজ্জিতও।সে ভাবলো সন্ন্যাসীটা তার কথা পাত্তা দেয়নি।তখন সে মনে মনে বলল,সন্ন্যাসীরা ত এমন না !ওদের মধ্যে কোনো অহংকার থাকবে না ,ঘৃণা থাকবে না লজ্জা থাকবে না,মায়া থাকবে না,লোভ থাকবে না।এদের শুধু একটাই মন্ত্র হবে,সব জীবের প্রতি প্রেম। এরা একটা মানুষের সাথে যেরকম প্রণয়ী আচরণ করবে,একটা পশুর প্রতিও সে আচরণ করবে । মনীষ আবার ডাক দিলো," এই যে বাবা শুনছেন ?"

সন্ন্যাসীটি বাইরে তাকিয়ে কোনো একটা চিন্তা করছে ,মনীষের দ্বিতীয় ডাকে তার দিকে ফিরে বলল," আমাকে কিছু বললে বাবা?"

"হ আপনাকেই ত বলছি ,কোথায় যাবেন ?"

"আমাদের কি নির্দিষ্ট কোনো যাওয়ার জায়গা আছে বাবা?যেতে যেতে যেখানে সূর্য অস্ত যায় সেখানেই রাত কাটিয়ে নিই।তুমি কোথায় যাবে ?"

"আমার এক বন্ধুর বাসায়,আজ দুপুরে ওখানে নিমন্ত্রণ আছে ।কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হয় কোথাও নির্দিষ্ট থাকেন!"

" তোমার যখন মনে হল,তখন নিশ্চয়ই থাকি ।এমনি এমনি কারোর মনে কোনো কিছু আসে না।কিন্তু কোথায় থাকি তা বলতে পারব না তোমাকে ।"

" কেন?"

"আমার গৃহ দেখতে হলে তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।"এই কথা বলেই গাড়ির মধ্যে বিকট শব্দে হাসলো ।

"আপনার সাথে আপনার গৃহে!" সে বিস্মিত হল। দুঃখিত সাধু বাবা,আমার বন্ধু খুব জেদী ।মধ্যাহ্ন আহারের আগে না গেলে আস্ত রাখবে না ।"

" বন্ধুকে যে দেখছি খুব ভয় পাও? তা তোমার বন্ধু নীপা কি রান্না করছে আজকে ?"

মনীষের বিস্ময়ের আর সীমা রইল না ।সে সন্ন্যাসীর মুখে নীপা নামটা শুনেই চমকে উঠল!তার ভেতরে ধাক্কা লাগল।একজন অপরিচিত লোক নীপার নাম কিভাবে জানল!এই সন্ন্যাসীর আবার অলৌকিক কোনো শক্তি-টক্তি নেই ত !মনীষের মন অস্থির লাগছে ।সন্ন্যাসীর প্রতি কৌতূহল যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে ।সে সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করল," বাবা আপনে নীপার নাম কিভাবে জানলেন?"

" মনে আসল ,তাই বলে দিলাম ।তাছাড়া তোমার বন্ধুর নাম কি নীপা ?"

"হু"

"দেখলে বাবা বললাম না মানুষের মনে এমনি এমনি কোনো কথা আসে না।দেখ ত পৃথিবীতে এত নাম থাকতে এই নামটাই বা কেন আসল!মানুষের সাথে মানুষের এইটাই সংযোগ।যাক,আমি ত সামনে নেমে যাব,তুমি যাবে আমার সাথে?"

" কোথায়?"

কোথায় মানে !আমার গৃহে !"

" এখন না অন্য একদিন দেখা হলে ।"

"আচ্ছা,বেশ তাহলে ।"মনীষ সাধুর যুক্তিকে পুরো বিশ্বাস করতে পারল না।কাকতালীয় ব্যাপার নামের উপর যে হতে পারে,এই প্রথম অভিজ্ঞতা তার।লোকটির কথা যত শুনেছে এবং দেখেছে ততই যেন কৌতুহল বেড়েছে । সন্ন্যাসীটি নেতাজি চোমুহনী নেমে গেছে।নামার সময় মনীষের মাথায় হাত রেখে বলেছে ,আমাদের আবার দেখা হবে ভোলানাথের কৃপায়।মনীষও সঙ্গে সঙ্গে বলেছে ,নিশ্চয়ই । অন্য রাস্তা দিয়ে অটো যাচ্ছে ।মনীষ কখনো এই রাস্তায় আসেনি।সে আরো দুই বার নীপা দের বাড়ি গেছে ,তার স্পষ্ট মনে আছে যাওয়ার পথে 'রূপসী সিনেমা হল'পড়ে ।কিন্তু আজকে তার নামগন্ধও নেই ।হাইওয়ে অবশ্য এই পথেও আছে ।সে অটোর ডান পাশ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে বিরাট বিরাট বিল্ডিং ।কোনোটার মধ্যে ত্রিপলার মতো বড়ো সাইনবোর্ড টাঙানো ।সাইনবোর্ডে মহেন্দ্র সিং ধোনি সিমেন্টের বস্তা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আবার কোনো সাইনবোর্ডে কোটেশনে লেখা,"This life is yours, let's make our life beautiful."তার পাশে একজন অসম্ভব সুন্দর মহীলা ,হাত জোড় করে আছে ।কোনো মডেলিং হবে ।একটু পর পরই জুয়েলারি দোকান ।এই শহরের মতো মানুগুলাও অনেক উন্নত।কিন্তু শহরের রাস্তায় কোনো নতুন আসা ব্যক্তি সুস্থ স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারবে না ।রাস্তার দুধারে,কোথাও মাঝখানে আবর্জনার নোংরা ড্রেইন ।জঘন্য গন্ধ ।গন্ধে যেন ভেতরের সব বেড়িয়ে আসছে ।মনীষ পেছনের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ ঢাকলো ।

(একটি ধারাবাহিক গল্প। প্রতিসংখ্যায় প্রকাশিত হবে।)

প্রনব রুদ্র

বাবা

বাবা শুধুই শব্দ বন্ধ নয় তো
তাঁর মতো কেউ কভু হয়না তো
সে ব্রক্ষ্মান্ডের শীতল বহু ছায়া
অনাথ জানে বিষের কষ্ট কায়া।

কত পরিশ্রম কষ্ট করো হেসে
সন্তানারে আগলে ভালোবেসে
বেদনা শত আড়াল কোরে রেখে
নিজ হাত ভাত খাইয়েছো মেখে।

অমৃত সুধা কি জানি না তো আমি
তোমার বুক ওসব থেকে দামী
জীবনে তোমারই আশীর্বাদ চাই
এর বেশি স্বর্গলোভ আমার নাই।

কবিতা সামন্ত

প্রাণের প্রিয় বাবা
     
     
বাবা হলো প্রাণ আমার,
বট বৃক্ষের ছায়া সবার মাথার।
ছেলেবেলার ঘোড়া ঘোড়া খেলা,
বাবা জীবনের নৌকা ভেলা।
যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম; বাবা
দুটি প্রাণকে সযত্নে রেখেছিলো,
যখন ভূমিষ্ঠ হলাম তার পর থেকেই;
বাবা সারা জীবনের দায়িত্ব নিয়ে নিলো।
কতো আবদার যে বাবার কাছে,
নিজের সমস্ত শখ আল্লাদের কথা 
ভুলে;এক কথায় সব পূর্ণ করেছে।
শত কষ্টের মাঝেও চেষ্টা করেছে
সন্তান যেন ভালো থাকে সুখে থাকে,
ভালোবাসি বলা হয়নি কখনো বাবা তোমাকে।
বাবা আমি তোমার রাজকন্যা,
বিদাইয়ের সময় দেখেছি তোমার চোখে বন্যা।
বাবা থেকো তুমি এবার অনন্ত একটু সুখে,
তোমার কন্যা যে চায় দেখতে হাসি তোমার ও মুখে।

স্নেহাশীষ রায়

জন্মদ

যার ছোঁয়াতে তোমার জন্ম
তিনিই তোমার বাবা,
বাবার মুখে সুখের হাসি
কোথায় তুমি পাবা?
একটুখানি ভাত জোগাড়ে,
কতোই ঘর্মত্যাগ!
দিনের শেষে মুচকি হেসে
ফেরে ভর্তি ব্যাগ।
বাবা তোমায় বাঁচতে শেখায়
কন্টকীর্ণ বসুন্ধরায়,
বাবা তোমায় মানুষ করে
নতুন নতুন স্বপ্নে ভাবায়।
সারাবেলা কাটায় কর্মে
নবীন রঙিন স্বপ্নসুখে,
কতই জ্বালা দিয়েছি মোরা
সহ্য করেছে শক্ত বুকে।
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের
করেন তিনি জোগাড়,
শক্ত বোঝা সংসারেতে
একাই বইছে ভার।
কাঁধে নিয়ে মাইল পেরিয়ে
বাঁচার একটু আশায়,
তোমার খুশি মুখটি পেতে
দেশান্তরে যায়।
পূজো-পার্ব্বণ প্রতিক্ষণ
হাজার প্রকার বায়না,
তোমার হাস্যবদন পেতে
আনে প্রচুর গয়না।
আজকে আমি বুঝতে পারি
বাবা কাহাকে বলে,
আমার স্বপ্ন সফল হতে
সদা দুচোখ মেলে।

বর্ষা দে

বাবা

বাবা, কত দিন,কত মাস কেটে গেল দেখিনা তোমায়!

বাবা, সবাই বলে আর নাকি ফিরবেনা তুমি।
তুমি নাকি আজ ভগবানের সৈনিক।
বাবা, জানো!তুমার সেই ছোট্ট মা টা আজ ৯থেকে১৮ পাতায়।
বাহানা, আবদার ধরা ছেড়ে আজ সে।
নিজের স্বপ্নপূরণের রাস্তায়।
বাবাকে সব কথা আড়াল করলে ও মেয়েদের আসল প্রথম ভালোবাসার পুরুষ বাবা।
যাকে ভালোবাসি বলতে লজ্জা পাই কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসা অফুরন্ত শব্দের পাতায়।
তবে আমার সে ভালোবাসা আজ না প্রকাশিত, না অপ্রকাশিত।
কখনো কখনো তোমায় নিয়ে লিখতে বসি বাবা।
লিখতে পারিনা।
আসলে বাবা এমন একটা শব্দ যা কে নিয়ে লেখা অসম্ভব।
কারণ কোন সে পরিচয় প্রকাশ করব ভেবে পাই না তোমায়!

রূপালী মান্না

বাবা আর নয়
 
বাবা আর নয় , প্লিজ ! ব'লে কান্নায় ভেঙে পড়লো সোহিনী! 

মা - মেয়েটাকে জোড় কোরো না গো , ও যখন চাইছেনা । 
বাবা -কিন্তুু কাবেরী , অনির্বাণ খুব ভালো ছেলে । সোহিনীকে ও সুখে রাখবে । আমার পরে সোহিনীকে যদি কেউ সবথেকে খুশি রাখতে পারে তাহলে সে অনির্বাণ । আমরা আজ আছি কাল নেই । মেয়েটা কি সারাজীবন মুখে হাসি আর বুকে কান্না নিয়ে জীবন কাটাবে ? 
আমি বাবা হয়ে যেটা বুঝি আর তুমি মা হয়ে বোঝনা কাবেরী ? 

মা -  পাঁচটা বছর পেড়িয়ে গেছে কিন্তুু প্রীতমকে আজও এতোটুকু  ভুলতে পারেনি মেয়েটা । ভুলতে পারেনি আট বছরের সাংসারিক জীবন-যন্ত্রনা । 

বাবা -কিন্তুু আমি বাবা হয়ে তো মেয়েটার এই কষ্ট দেখতে পারিনা । সোহিনী মা যে আমার বড্ড আদরের । আর তাছাড়া অনির্বাণ-সোহিনী তো একে অপরকে পছন্দও করে । একসাথে হাসিঠাট্টা করতে করতে স্কুলে যায় । 

সোহিনী - তুমি ভুল ভাবছো বাবা , ওটা নিছকই বন্ধুত্বের হাসি । 

বাবা - কিন্তুু মা .....

সোহিনী - এই ভালোবাসাবাসির দাবা খেলায় আমি ঘুঁটি সাজাতে ব্যর্থ । আমি আর হারতে চাই না । আর নয় বাবা , আর নয় । তোমার কোলই যে আমার নিরাপদ আশ্রয় । 

জনম সাহা

পিতা

সৃষ্টিকূলের সকল জীবের স্রষ্টা, 
মহান বিধাতা,
যার মাধ্যমে আগত এই ধরণীতে, 
সে আমাদের পিতা।

স্রষ্টা আমাদের পালনকর্তা, 
তিনিই জন্মদাতা,
যে আছে দৃশ্যমান 
সে আমাদের পিতা।

পিতামাতার সন্তষ্টির উপরই
ঈশ্বর চরম সন্তষ্ট,
সে পথের দিশাই যেন 
জীবনে আমার হয় অর্পিত।

মা যেমন আপন সবার 
তেমনি আপন পিতা,
উভয়কে ছাড়া হয়না কখনও
জীবনের পরিপূর্ণতা।

রক্তের বাধন সবচেয়ে আপন
এমনি এক বন্ধন, না যায় খন্ডন, 
সবার চেয়ে আপন, থাকবে সারাজীবন,
পিতা পুত্রের বন্ধন, সত্য চিরন্তন।

আমি যেন হতে পারি 
শ্রেষ্ঠ সন্তান,
উজ্জল যেন করতে পারি
তোমার মান সম্মান।

দিপ্সী দে

 বাবা      

আমার চোখের রক্তঝড়া আগুণর চেতনার বহিঃপ্রকাশ 
 
আমার বিদ্রোহী কবিতার আবডালে,
শক্তি ও অনুপ্রেরণার  জীবন রেখা।
জীবন আর্দশের মেরুতে দাড়িয়ে তুমি 
প্রতীয়মান বিজয়ের কেতন।

সুমিত বণিক

বাবাও একদিন খোকন ছিলো
                                       
ও বাবা তুমিও বুঝি একদিন খোকনের মতো অবুঝ আবদার করতে?
ছোট্ট সেই তুমিই তো নাকি ঘুম থেকে উঠে কান্নার হাট বসাতে!

ঝরে পড়তো তোমার এই দুই চোখ থেকে কম দামী জল।
এখনতো দেখি না বাবা আর কোনো আবদার পরিপূর্ণ না হওয়ার জল।
শুনেনা এখন আর কেউ তোমার হাউমাউ কান্নার শব্দ ।
খুব পরিবর্তন করে নিয়েছ তুমি নিজেকে ।।
বাবাদেরকে বুঝি এইভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে হয়।
সত্যি করে বলো তো বাবা ইচ্ছে করে না এখন আর কিছু আবদার করতে ? 
নাকি আমার আবদারের পূর্ণতা ঘটাতে তোমার মাটি চাপা দাও ।
বলো না বাবা কালকে আমি বাবা হলে আমিও বুঝি আর আবদার করতে পারবো না ।।

অভিজিৎ রায়

প্রিয় বাবা 


বাবা আমি গর্বিত তোমার সন্তান হতে পেরে।
কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠি তোমাকে আগলে ধরে।
তুমি আমাদের পরিবারের  মনে সাহস যোগিয়ে গেছো
তুমিই সময়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শিখিয়েছ।
তুমিই আমার উন্নত চিন্তন শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছ,
আবার তুমিই আমাদের  নিঃস্বার্থে সব  দিয়ে গেছো।

ছিড়া  হাওয়াই চপ্পল পরে জীবন কাটিয়ে দিলে,
ছোট থেকেই আজঅব্ধি হামেশাই সাপোর্ট করে গেলে।

সেই জীবন যুদ্ধে যতবারই আমি হেরে যাচ্ছিলাম,
তোমাকে দেখেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে শিখলাম।

ধন্য আমি বাবা তোমার ঘরে জন্মাতে পেরে,
এমন বাবা যেন হয় প্রতি ঘরে ঘরে।
তোমার আদর মায়া মমতা যেন ভুলিনা কভু,
তুমিই আমার জাগ্রত ভগবান তুমিই আমার প্রভু।

রুবেল হোসেন

প্রিয় বাবা
               
তুমি আছো বলে লুপ্ত বীজের আজ উদ্ভাবনা, 
তুমি আছো বলে পিতৃত্বের সোহাগের আজ স্নেহ পাওনা। 
তুমি আছো বলে এই কোকিল কন্ঠে বাবা নামটি ডাকা,
তুমি আছো বলে বাবা হয়ে আমায় জড়িয়ে রাখা। 
তুমি আছো বলে হোঁচট খেলে খাবলে ধরা, 
তুমি আছো বলে ছেলেবেলা শেখানো অ, আ ছড়া। 
তুমি আছো বলে শ্যামল ধানের শস্য ডাঙা, 
তুমি আছো বলে মার রক্তানো সিঁথির সিঁদুরে রাঙা। তুমি আছো বলে আমাদের সুখ দুঃখে আগলে রাখা,
তুমি আছো বলে হাসি ঠাট্টাতে উড়িয়ে দিই বহু টাকা। 
তুমি আছো বলে আকাশ জুড়ানো বিশালাকার ছাতা,
তুমি আছো বলে স্বপ্ন পূরণের মস্ত বড় পাতা। 

বাবা, এই সভ্য সমাজে তুমিই শ্রেষ্ঠ গুরু,
আমার জীবনের প্রথম পথ চলা সেই তোমার হাতেই শুরু।
আমি তোমায় হারিয়ে ফেলতে চাই না,
তাই তো তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবি না। 
বিধাতা আসুক আমি লড়তেও রাজী,
এই জন্মে স্বর্গে যাওয়ার তুমিই বক্ষ মাঝি।

সুনন্দা দাস

 বাবা

তুমি সদা ব্যাস্ত,
তুমি সদা ক্লান্ত,
কিন্তু মুখে ক্লান্তির রেশটুকু নেই।

তুমি সদা ক্রুদ্ধ ,
তুমি সদা কঠোর,
মনে দুঃখ
কিন্তু চোখে জলের ঝলকটুকু নেই।

তুমি সদা সাহসী,
তুমি আমার পথপ্রদর্শক।
সাথে থাকো তুমি,
যখন বিপদে পাশে কেও নেই।

তুমিই আমার বট,
তুমিই আমার ছএছায়া।
পাশে আছো তুমি,
তাই ভয়টি আমার নেই।

প্রীতম শীল

রাজপুত্র

সকাল সকাল মানুষটা আমায় ডাক দিলো একটু কাজে সাহায্য করতে। আমি পারবোনা বলেই আমার দায়িত্ব শেষ করলাম। আটটায় ঘুম থেকে উঠে দেখি গরুর ঘাস কাটা আর রেশন আনা দুটো কাজ কমপ্লিট।  নয়টায় আমি ব্রেকফাস্ট করি, মানুষটা ততক্ষনে কাজে চলে গেছে। ৫ টায় আমি যখন মাঠ থেকে খেলে ফিরি। লোকটা ৩০০ টাকা নিয়ে ফিরেছে। পড়ার টেবিলে বসে বান্ধবীকে ছবি পাঠাই, আজ সারাদিনের কাজের। রেশন আনলাম, গরুর ঘাস কাটা আরও নানাহ।  তাই তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি।  পরিচিতিতে আমি চাষা কিংবা শ্রমিকের ছেলে হলেও আমি আমার বাবার কাছে রাজপুত্রের মতো।

" বটবৃক্ষ ছায়াতলে শীতল যেমন শরীর,
 বাবার আশ্রয়ে জীবনে নেই পরিশ্রম।
আজ তুমি বাবা হয়েছো,আর তোমার বাবা--
এক রাশ ব্যাথা নিয়ে পড়ে আছে বৃদ্ধাশ্রম"! 

দীপিকা রায়

বাবার ছায়া
               
দেখেছো আমায় হাসতে তুমি
দেখেছো আমায় কাঁদতে, 
ছায়া হয়ে ঘিরেছো আমায়, 
ঘিরেছো আমায় ওই হাজার লোকের ভিড়ে। 

অচেনা পথের আলো হয়ে
শিখিয়েছো হাঁটতে আমায়
তোমার ঘাম রসে সোনায় সোহাগা করে
ফকিরের খাতায় লিখিয়েছো তোমার নাম। 

পাথরগুলো বিঁধত বাবা
তোমার জুতোর ফোঁকর দিয়ে
তবু দোকানের দামী জুতোজোড়া
পরে থাকে আমার পায়ে। 

অভাবের ওই সংসারে তুমি
দেখাওনি কোনোদিন কোনো অভাব আমায়, 
দামী ব্র্যান্ডের আইফোন দিয়ে
তোমার ওই ভাঙা ফোনে বসিয়েছো ভাগ। 

এত কষ্ট বাবা, লুকিয়ে রাখো
তোমার হাসি মুখে, 
ক্ষিধের জ্বালায়, ক্ষিধে ভুলে যাও
আমার মুখে অন্ন দিয়ে। 

ভুলব না বাবা কোনোদিন
তোমার এই অবদান, 
তোমার চরণ স্পর্শে আজও জানাই
শতকোটি প্রণাম

গৌতম মজুমদার

অকৃপণ বাবা  

বাবা তুমি ভোরের আলো 
ঘুম ভাঙানোর গান , 
হাত বাড়িয়ে চলতে শেখা 
সবই প্রানের টান । 

পড়তে বসলে স্বপ্ন দেখাতে 
আদর করতে কত , 
খেলার সময় ঘোড়া সাজতে 
ছুটতে অবিরত । 

আছাড় খেয়ে পড়তাম যখন 
আসতে তুমি ছুটে , 
স্নেহের পরশ পেলে তোমার 
ব্যাথা যেতো টুটে । 

দামী পোশাক নেইকো তোমার 
নেইকো ভালো জুতো , 
কোন কিছু কিনতে বললেই 
ধরতে তুমি ছুতো । 

তোমার খাবার তুলে দিতে 
আমার মুখের মাঝে , 
কত উপোষ থাকতে তুমি 
সকাল দুপুর সাঁঝে । 

কোন কিছু বায়না করলে 
কষ্ট  হতো দিতে , 
বুঝতে তুমি দাওনি মোকে 
অভাব সংসারেতে । 

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে 
করতে মাঠে চাষ , 
কষ্ট তুমি দাওনি বুঝতে 
চলতো বারো মাস । 

যে টুকু আজ চলতে শিখছি 
শুধু তোমার জন্য , 
তোমার মতো বাবা পেয়ে 
সত্যি আমি ধন্য ।

প্রশান্ত লস্কর

পিতৃদেব
                     
মাতার সুধায় পিতার ক্ষুধায় লভিনু জনম
দেখেছি বিচিত্রময় পৃথিবী।
মায়ের কোলে হামাগুড়ি  দিয়ে বেড়ে উঠেছি,
পিতার কাছে রেখেছি মোর সকল দাবি।।।
গরীব পরিবারে জন্মেছিলাম
কিন্তু বুঝিনি গরীব মানে কী?
আমাদের ছোট রাজপরিবারে
রাজপুত্র হয়ে দিন কাটিয়েছি।।
বছর ঘুরে বারে বারে আসে অনেক মেলা,
রাজা আমার হাতটি ধরে মেলায় নিয়ে যায়।
রকমারী খেলনা পেতে ইচ্ছে জাগে মনে,
রাজা আমার বিনা শর্তে ইচ্ছেতে দেয় সায়।।
অবুঝ বালক কিছু বুঝিনাকো,
ছুটি এদিক ওদিক।
রাজা আমার হাত ধরে বলে,
জীবনের পথটি রাখবে ঠিক।।
রাজা আমার নয়কো কাল্পিক ঈশ্বর,
নয়কো রাজ‍্যপিতা।
তিনি আমার পালক পোষক,
তিনি জন্মদাতা।।
শতকষ্ট করে পিতা চালান পরিবার,
পরিবারের সকল বোঝা মাথার উপর তাঁঁর।
ভোর হলে যে কাজে যান ফিরেন সন্ধ‍্যাবেলা,
কষ্টগুলো লুকিয়ে রেখে করেন হাসি খেলা।
পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই তপস‍্যা।
আস্তিক হই আর নাস্তিক আমি,
দেব জ্ঞানে তারাই ভরসা।।
এই রঙের দুনিয়ায় আমার চাওয়ার কিছু নাই।
পিতা মাতা সাথে থাকলে ভাবনা কিছু নাই।।

সংগীতা শীল

বাবার কাছে চিঠি

তুমি আমার নতুন ভোরের আলো।
রোজকার লড়াইয়ের শক্তি ; তোমার উৎসাহে আমায় প্রেরণা জোগায়। 

ছোটোবেলায় যখন হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেতাম তুমিই তো পিঠে নিয়ে বেড়াতে, মাঝপথে থেমে গেলে বলতো 
 'জীবনের সিড়ি এখনো বহুদূর'
 বুঝতাম না কঠিন সব কথা।

জানো বাবা!
আজ কন্টকাকীর্ণ দূর্গম পথ অতিক্রম করতে ক্লান্তির ছায়া নেমে আসে; তোমার রহস্যময় বাণীগুলো মনে দোলা দেয়; বলেছিলে সমস্ত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে লক্ষ স্থির রেখে একা সৈনিক হয়ে জীবনের সাথে লড়তে হবে। আজও হৃদয়ে গেঁথে রেখেছি প্রতিটি কথা। 

ওরা সবাই আমায় নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, মাঝে মাঝে খুব ভয় করে। না, তাদের জন্য নয়...
বাবা তুমি আমার সাথে থাকবে তো?
দিশা দেখাতে
জীবনরথের সারথী হয়ে!

প্রাপ্তি মুখোপাধ্যায়

বুড়োবসন্ত 


জমিদারবাড়ি তবু ,অসহায় মামাবাড়ি বাস,
বাবাকে যে হারিয়েছে,মা'র পেটে যখন আটমাস।

পকেটে চার-আনা আর টিউশন বাসিরুটি-চা,
বাস ছেড়ে ফুটপাথ--খিদেটাই পথখরচা।

বয়ে গেছে বসন্ত,এল গেল কত বেনোজল
আলগোছে বেঁচে থাকা--এ নীতিই শেষ সম্বল।

একটু রঙিন জামা দুধ-চায়ে মিষ্টিটা বেশ--
জর্দাপানের পর,একটিপ নস্য-আবেশ।

ব্যথাময় বীথিকার ফুরিয়েছে অনেকটা পথ--
শালগ্রাম শিলা বুকে কীজানি কী করছে শপথ।

বলে,/"সাড়ে তিন হাত মাটি,এইটুকু শেষ ঠাঁই চাই--
কী যে এল,কী যে গেল,ফেলে যাব বাকি সবটাই।"

"বাবা" কী বা কতবড়--এ মানুষ জানেও নি তা;
বাবা, তুমি তারও বেশি,যতখানি হওয়ার কথা!

কাউচার খান

বাবা এক যোদ্ধা


যেদিন আমি ছোট্ট ছিলাম, যুবক ছিলেন বাবা।
সে দিনটি আসবে ফিরে,যায় কি তা আজ ভাবা?

বাবা তোমার কাছেই প্রথম আমার হাঁটতে শেখা আর প্রথম বাবা বলে ডাকা। 
সেই ছোটবেলায় সারাটি দিন কাটতো যে, জড়িয়ে তোমার গলা।

বাবার হাতেই হাতেখড়ি আমার প্রথম পড়া-লেখা,
বিশ্বটাকে প্রথম আমার বাবার চোখেই দেখা। 

আজকে বাবার চুল পেকেছে গ্রাস করেছে জরা,
তবুও বুঝি বাবা থাকলেই লাগে ভুবন ভরা। 

যুদ্ধ ক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে লড়াই করলে যদি হয় সে যোদ্ধা। 
তাহলে জেনে রাখো, আমার বাবাও অস্ত্রবিহীন রোজ লড়ে , 
তাই আমার কাছে বাবা সবচেয়ে বড় বীরযোদ্ধা। 

বাবা তুমি শুধু যোদ্ধা নয় তুমি যে দেবতা তুল্য,
জীবন আমার সার্থক হল বাবা তোমারি জন্য। 

সংগীতা দেব

বাবার জন্য

বিশাল নীল আকাশের বুকে পাখি যেমন উড়তে ভয় করেনা, তেমনি বাবা নামের মানুষটা আছে বলেই  হয়তো জীবনটাকে আমরাও এতোটা ভয় করিনা।'বাবা'দুটি মাত্র শব্দ। কিন্তু জীবনে এই মানুষটির প্রয়োজন কোনো ভাবে 
কোনো পরিস্থিতিতেই ফুরাবে না!বাবা,তোমার অবদান গুলো আকাশের চাইতেও অসীম।তুমি আছো বলেই আমার পৃথিবীটা এতো সুন্দর!

আমাদের জন্য এতো কিছু করো।অনেক সময় না চাইতেই কত কিছু পাই।আচ্ছা বাবা তোমার কিচ্ছু চাইনা?সবসময় আমাদের প্রয়োজনটাই জেনে এসেছো।আমাদের দিয়েই যেন তুমি তৃপ্তি পাও।বাবারা বুঝি এইরকমই হয়!নিজের ইচ্ছা গুলির কথা ভুলে সন্তানের ইচ্ছে পূরণেই যেন তোমার মুখে হাসি ফুটে।

মাথার উপর বাবা নামে মানুষটার ছায়া আছে বলেই, জীবনের পথগুলো এতোটা মসৃন।ছোটবেলার সব আবদারের ঠিকানা তুমি ছিলে।বড় হওয়ার পর কঠিন সময়ে ভরসার হাত বাড়াতে।পরিশ্রম, ক্লান্তি,কষ্টের পর ও হাসি মুখে বাড়ি ফিরতে।বাবা তুমি আমার প্রথম পরিচয়। তুমি আমার আদর্শ।

কোনোদিন হয়তো সেইভাবে বলা হয়নি,বাবা তুমি অনেক ভালো।খুব ভালোবাসি তোমায়,আরো আরো অনেক কথা যা শব্দে বলে অক্ষরে লেখে প্রকাশ করতে পারবোনা।তবুও যেন শেষ হলো না তোমার জন্য বলা কথা।এই ভালোবাসার নিবিড় সম্পর্কটা বয়েই চলবে ঝর্ণার মতো।অপ্রকাশিত অনুভূতি একটি মেয়ের জন্য তার 'বাবা'।

অভিজিৎ পাল

বাবা

'বাবা', শব্দটি দুই অক্ষরের হলেও লুকিয়ে আছে হাজারো আবেগ, হাজারো অনুভূতি।
বাবা মানেই মাথার উপর বড় একটা ছাতা,আর পায়ের নিচের শক্ত মাটি টা।বাবা মানেই পেছন থেকে সাহস দিয়ে বলা, "ঘাবড়ে যাসনা ,আমি আছিতো"।
বাবা মানেই সংসারের সবচেয়ে বেশি খাটা লোকটা,বাবা মানেই নিজের সব স্বপ্নকে পাথর চাপা দিয়ে ছেলে মেয়ের চাহিদা পূরন করা।
বাবা মানেই ছেঁড়া জুতো আর এক সেট সার্ট-পেন্ট পরেই প্রতিবারের পূজো কাটিয়ে দেওয়া লোকটা,
 বাবা মানেই আদর ,শাসন ,ছোট বেলায় বাজারে নিয়ে গিয়ে চকলেট খাওয়ানো কিংবা কাঁধে নিয়ে পূজো দেখানো।
বাবা মানেই সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে মেয়ের বিয়ে  দেওয়া।বাবা মানেই সমস্ত ঝর তুফানে সংসারকে আগলে রাখা।

তাই সকলের কাছে অনুরোধ ,বার্ধক্যে  কোন বাবার কিংবা মায়ের শেষ ঠিকানা যেন 'বৃদ্ধাশ্রম' না হয়।           
        

গৌতম দাস

আমার নিঃশ্বাসে বাবা
                       

অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রাণময় স্বর্গ হল বাবা।

সন্তানের ইচ্ছাপূরণে সহ্য করে বাঘের থাবা।
ডাল, ভাতের খোঁজে নানা কষ্টকে বুকে পোষে।
হাসিতে উড়িয়ে দেয় দুঃখ, কেউ যেন না বুঝে।

নিজ ইচ্ছা অনিচ্ছা মুক্ত চিত্তে দেয় বিসর্জন।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ করে উপার্জন।
পরিশ্রমী,সত্য নিষ্ঠা হলেও জীবন চলে-
এই উপদেশ দেয় সুধাময় কথার ছলে।

স্বাচ্ছন্দে কাটিয়ে ফেলি অর্ধেকটা জীবন।
বিনামূল্যে খাবার পাই বাবার হোটেলটাই এমন।বাবা আমার অন্ধকার পথের জীবন্ত মশাল।
ভদ্রসমাজে আজও-
বৃদ্ধ জন্মদাতা সন্তান কর্তৃক নির্যাতনের সংখ্যা গুনে।
আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পাঠাবো না বৃদ্ধাশ্রমের বনে।

অতনু রায় চৌধুরী

বাবাকেই পাশে পাই 

ক্লান্ত মনে হ্লাকা হেসে 
যখন বাড়ি ফিরে বেলা শেষে ।
বুঝতে দেয়নি আজও কিছু 
বাবা আগলে রাখে ভালবেসে ।
এই জীবন পথে চলতে চলতে
 যখন হেরে যায় ।
আমার দুঃসময়ে আমি 
আমার বাবাকেই পাশে পাই ।
আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য বাবা নিঃশব্দে খাটে 
গ্রীষ্ম বর্ষা বারো মাসই মাঠে কিংবা ঘাটে ।
আমার সাফল্যতে বাবা প্রাণ খুলে হাসে 
সত্যি বাবা আমায় বড্ড ভালোবাসে ।
বাবার ইচ্ছে গুলো হারিয়ে যায় 
আমার আবদারের ভিড়ে ।
বাবার যত ভালো থাকা 
সব আমায় ঘিরে ।
না ভুলতে পারব না 
বাবার আত্মত্যাগের কথা ।
বাবাকে খুশি রাখতে না পারলে 
হবে আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা ।

অনুপম দেব

সাহেবের বাপ

মানুষটি হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিলো

কাঁধে করে কতো না ঘুরিয়েছিলো,

বড় হয়ে বেটা সুটে-বুটে সাহেব হবে 
এমনি একটা স্বপ্ন দেখেছিলো।
কাঁধে কোদাল নিয়ে সকালে বের হলে
সন্ধ্যা রাতে বাড়ি আসতো,
এমনি করে সারা জীবন 
সুখ বিষাদে কাঁটিয়ে দিলো।
বৃদ্ধ বয়সে সেবা সুখ জুটবে
এটাই তো একটা আশা ছিলো।
মানুষটির স্বপ্ন সত্যি হলো
সাহেব বেটার বাপ হলো,
কঠিন দুনিয়ায় লড়াই করে
মানুষটি আজ বৃদ্ধ আর অসুস্থ,
সাহেব বেটার কাছে ঔষধ চাইলো
ক্ষিপ্ত স্বরে খেদিয়ে দিলো।
অসুস্থতায় সেই বৃদ্ধ মানুষটি 
একটু ছেলে মানুষী করতো,
বাপের ঘৃণ্যতা আসে বেটার
 তাই পাগল বলে চালিয়ে দিলো।

যে না থাকলে সর্বহারা হতো
সেই সাহেব বাপকে বাড়িছাড়া করলো।

রূপাঞ্জনা মজুমদার

বাবা

বাবা, যার হাত ধরে জীবনে প্রথম
স্কুলে পা রাখা।
যে শিখিয়েছে জীবনের পথে,
বারবার হোঁচট খাওয়া সত্তেও
আবার কিভাবে উঠে দাড়াঁতে হয়।
সন্তানের জীবনের জন্য ভয়টা তাদেরও হয়-
তবে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র দেওয়ার পিছে
সেই ভয়টা চাপা ই পড়ে রয়।
বাবা,যে শেখায় "জীবনটা কিন্তু এত সহজ নয়"।
বরং বোঝায়"বাস্তবতা, সে তো চরম কঠিন হয়"।
এক কথায়, পৃথিবীটাকে বাবার চোখেই দেখা।
তার ভালোবাসার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েই,

স্বপ্নের পথ খোঁজা।
বাবার কাছে শিখেছি -
বিফলতা মানেই থমকে যাওয়া নয়,বরং এগিয়ে চলার এক প্রতিশ্রুতি।
তবে চারদিক সামলাতে সামলাতে ,
ক্লান্ত তিনিও হন ।
না, প্রকাশ করেন না কখনই,
তাইতো ,বাবারা বাবা ই হয়।

প্রণব দাস

হাঁটি হাঁটি পা পা
                       
সেদিন পড়ন্ত বিকেল। সু-ট্রাকসুট পড়ে আমি রেডি মাঠে যাব বলে। সেদিন এক্সারসাইজ করতে করতে সু-এর লোয়ার পার্টটা ছুটে গিয়েছিল। ভাবলাম আর কয়েকটা দিন এভাবেই চালিয়ে দেবো তারপর না হয় বাবাকে বলবো। মাঠের উদ্দেশ্যে চলছিলাম। পেছন থেকে ডাক আসে 'অভি'। ফিরে তাকাই বাবা ডাক দিয়েছে। কাছে যেতেই,
-'সেদিন দেখলাম তোর জুতোটা ছিড়ে গিয়েছে,তাই কাজ সেরে আসার পথে নিয়ে আসলাম। দেখতো পছন্দ হয়েছে কিনা।'
আমার হাতে নতুন সু-গুলো তুলে দেয়। কেন জানিনা গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।ভালোবাসার অশ্রু।মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে একাকী ঘরে বসে আমি অতীতের দিকে ছুটছিলাম।সেই অতীত ছোট্টবেলায় যখন বাবা হাতে হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে বলছিল,'হাঁটি হাঁটি পা পা'।

জয় দেবনাথ

শালকপুত্র 

দক্ষিণের ছেলেরা রেগে গেলে বাবাকে বলে 'শালার পুত!'
.
শালারপুত অর্থাৎ শালকপুত্র। শালার ছেলে কোনো গালি হতে পারে না। এটাকে গালি ভাবলে সেটা বোঝাপড়ার সীমাবদ্ধতা! শালারপুত মানে রহস্যময় একটা স্নিগ্ধ সম্পর্কের নাম। ম্যাচিউর সন্তান ছাড়া কেউ বাবাকে শালারপুত বলতে পারে না! তাছাড়া বাবাকে শালারপুত বললে বাবা কখনো রাগ হয় না, বেশীরভাগ সময়ই বাবা খুশি হয়। সেই খুশি দেখায় না। দুঃখের মতো খুশি লুকানোও একটি বাবা বৈশিষ্ট্য! 
.
ক'দিন আগে আমার শ্রদ্ধার আইনজীবি রাখাল মজুমদারের শ্বশুর মুড়ায় সন্ধ্যাবেলায় বসে আড্ডা মারছি। ভদ্রলোক যখন কথা বলেন, কিভাবে যেন মানুষের মনোযোগ নিয়ে যান নিজের দিকে। কথার মাঝে উনি বললেন 'সাউথের ছেলেরা চেইত্তা গেলে বাবারে শালারপুত ডাকে, তুমি জানো?' আমি হাসলাম। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। মুখে কিছু বললাম না!
.
শালারপুত মূলত স্ত্রীর ভাইপো। শালার পুত শব্দে বিন্দুমাত্র রাগ নেই, আছে একটা স্নিগ্ধ অভিমান, আদর। মশকড়া করার একরাশ অধিকারবোধ। হুটহাট কাউকে শালারপুত বলে গালি দিতেও হিংসা হয়, কারণ এই শব্দটা শুধু বাবার জন্য তুলে রাখা! সন্তান বড় হলে বাবারা ক্রমশঃ ছেলে হয়ে যায়। বয়সের ভারে মাঝে মাঝে বাবারা ঔষধ খেতে ভুলে যান, বিশ্রামের সময় কাজে চলে যান, অসুস্থতার কথা চেপে যাওয়া, জাতীয় কাজ করে ফেলেন, তখন সন্তানরা রাগ করে। বাবাকে বলে শালারপুত।
.
শালারপুত মানে আমি তোমাকে কেয়ার করি বাবা। আমি তোমার ভালো চাই। তোমায় খুব আদর করি। তোমার প্রতি আমি তীব্র অধিকার অনুভব করছি বাবা।
.
শালারপুত বলছি মানে বলতে চাইছি "আমি বড় হয়ে গেছি বাবা, তুমি আর একা কত করবে? আমিও তোমার সাথে আছি এখন।" 
.
কবি বলেছেন 'ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুদের অন্তরে।' 
অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের ভেতরে একেকটি শালারপুত ঘুমিয়ে থাকে। বাবার উর্বরতা শুকিয়ে যাওয়ার আগেই সে ঘুম থেকে উঠে হাল ধরে। এটা প্রকৃতির নিয়ম।
.
আমরা সেই প্রজন্ম বাবাদের চামড়া উঠা হাত কখনো নিজের মুখে ঘসে দেখা হয়নি! বাবার সাথে কোনো বিশেষ দিনে কোলাকুলি করা হয়নি! মধ্যবিত্ত বাবার জীবনদর্শনেও 'বাবা দিবস' বলে উদযাপিত একটা দিন আছে সেটা কখনো বাবাকে জানানো হয়নি! প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যা পড়লেন সেটা কোনো কথা নয়, বাবাকে অন্যভাবে ভাবতে গিয়ে মনের কিছু ভাবনা। শালারপুত মানে একটা আদরের ডাক। এতে মিশে থাকে বাবার প্রতি গ্রামীণ সন্তানের নির্ভেজাল ভালোবাসা, কেয়ার। পৃথিবীর সকল শালারপুতের চরণে জয় কুর্ণিশ জানাচ্ছে। ভালোবাসায় ছড়িয়ে পড়ুক চেতন থেকে সাগরে।

তনুজা রায়

  বাবা 

বাবা,মরেও জানি বেঁচে রব তোমার মাঝে আবার,
তুমি শুধু বেসে ছিলে ভালো নিঃস্বাথে আমায়।
বাবা, তুমি কাছে আসলে মনে হয় আমার,
এক গুচ্ছ শান্ত মেঘের  ছুয়ে দিতে আসছে আমায়।

 বাবা,আমি থাকি যখন তোমার পাশে,
 মনে হয় নেই কোন দুঃখ,নেই কোন আপ্রাপ্তি,
 নেই  কোন দুঃস্বপ্নের পৈশাচিকের  ভয়,
  আছে শুধু নুতন কুসুম ফোঁটা জয়।

বাবা,তোমায় দেখলে মনে হয় আমার কোন -
'কালে' যোগী! ধ‍্যানে নিষাদ প্রশান্ত  তরুতল।
বাবা  তুমি  জীবন  যুদ্ধে হেরে মতৃপ্রায় হয়ে,
আশা প্রদীপ জ্বেলে রেখেছ সদা আমার মনে।

বাবা,আমি চাইনা ঐশ্বর্য,চাই রাজপ্রাসাদের মন,
কন্ঠরোধ হয়ে যাবে যখন, বাজে শেষ সুর।
তবু জেনে রাখবে নিভৃতে  রহে যাব-
তোমার মনে স্বপ্ন দেখার ঘরে! বিজয়াদশমী হয়ে।

বাবা,আমি পেয়েছি শুধুই ভালো বাসা তোমার হয়ে,
মরেও বেঁচে রব আমি তোমার  মাঝের আবার!

সমীরণ বিশ্বাস

শ্রমিক 

ওই যে জোৎস্না রাত্রির শেষের প্রভাতে,
কাজের ব্যাগ হাতে নিয়ে চলাতে 
ছেঁড়া শার্ট আর ছেঁড়া লুঙ্গি পড়া 
বাড়ি ফিরো হয়ে আধমরা।
সন্তানের মুখে তুলে দিতে অন্ন,
চাকর বলে হতে হয় গন্য 
তবুও তুমি ক্ষান্ত থাকোনা পরিশ্রমের ভারে 
দু-দন্ড বুকভরা হাসি দেখার তরে।
তুমি শ্রমিক, অশান্ত পথের পথিক,
মাথার ঘাম পায়ে পরে, পরে চারিদিক
ঘামতো নয় যেন রক্ত 
ছেঁড়া জুতা পায়ে চলায় তুমি বেদানার্ত।
ধৈর্য্য তোমার অসীম,অপার,
হাসি জোগাবার জন্য, হাসি মুখে কর্মে যেতে হয় বারবার 
কপালে জুটে তোমার পান্তাভাত আর পেঁয়াজ 
তবুও তুমি কোনো কিছুতে না রাখো লাজ।
তুমি শ্রমিক,বিশ্ব কারিগর,
তবুও সভ্য সমাজ বোঝেনা তোমার মর্ম।

সঞ্জয় দত্ত

পিতৃদেব
              
ভগবান তুমি দিয়েছ কি?
খোলা আকশের নীচে
দাঁড়িয়ে আছে সেই অক্লান্তের পথিক,
তুমিই শ্রেষ্ট,তুমিই বীর।

তুমি ছাড়া শান্ত এই বিশ্বভূমি
হয়েছ তুমি আবার কখনো করুণাময়ী।
অনেক দায়িত্ব নিয়ে কীভাবে
পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখ তুমি?

আমার এই স্বপ্ননীড়ে
চাই তোমায় বারে বার,
কেউ কি চাই যে
তোমাকে হারাবার!

তুমিই পারবে আমার
ওই বিশ্বপ্রকৃতির নতুন রূপ দান করতে,
তোমারই কোমল স্পর্শে
জাগরিত হবে কত নতুন প্রাণ।

হে বীর, তুমিই অসীম
শোধিতে পারবোনা তোমার ওই ঋণ,
তোমায় জানাই সহস্র প্রণাম
তোমারই পদতলে দাও একটু স্থান।

জয়ন্ত শীল

ছাউনি 

আমি পকেট থেকে পরে যাওয়ার পর 
রাতের বুক কেঁপে উঠলো। 
যেসব স্বপ্নরা মিলিয়ে গেছে 
তারা আর জাগেনি, 
মাঝরাতে বাবাকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারিনি বলে 
রাস্তায় পা আটকে যায়। 

সমভূমিরা ক্রমশ ডানা মেলে উড়ে আসে...
এইভেবে আমি খাতা কিনে লিখলাম - 
" মা নামক ঘরে, বাবা নামক ছাউনি..."

এরপর আর কিছু লিখতে পারিনি। 
ছুরির স্তব্ধ যাতায়াত! 
বিশাল নিস্তব্ধ! 
নিঃশব্দ!

জয়ীতা লস্কর

বহুরূপী বাবা

বাবাকে নিয়ে আমার কলম চলে না
বাবাকে আমি বর্ননা করতে জানি না।
প্রকান্ড কাষ্ঠ বৃক্ষ ছাড়া  স্বর্নলতা হতে দেয়নি,
বাবা আমায় আত্মনির্ভরতা ছারা কিচ্ছু শেখায়নি।
বিশ বছরের পরেও আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভুলেনি,
বাবা আমার স্বপ্ন ভাঙ্গতে দেননি।
বুঝিনা অঙ্ক তাও বকেন,
বাবা আমার অঙ্ক নিয়ে দিনে চার ঘন্টা যদ্ধ করেন।
একবারের ফোন  দশবারে না  পেলে সারাবাড়ি মাথায় ঘোরেন
বাবা আমায় বড্ড বেশি জ্বালাতন করেন।
না রাজকুমারীর গল্প নয়,ইতিহাসের কঠিন পাতার বর্ননা করেন,
বাবা আমার মধ‍্যে তিলে তিলে মুল‍্যবোধ তৈরী করেন।
 বাহিরে শক্ত আর ভিতরে বিরক্ত ধারন করেন,
বাবা আমায় দশ মাসের পরও ধারন করেন।
নতুন রাধুনির সকল আবিস্কার সহ‍্য করেন,
বাবা আমার জন্যে নিজেকে প্রয়োগশালায় পরিনত করেন।
রোজ ভোর পাচটায় এসে গলার প‍্যাঁচানো তারটা খুলেন,
বাবা আমার অজান্তেই আমার খেয়াল রাখেন।
বাইরের প্রত‍্যেকটি প্রস্তরভূমির সাথে পরিচয় করান,
বাবা আমায় জীবনের পথ দেখান।
আলতো গম্ভীর গলায় মিষ্টি সুরে 'মা' বলে ডাকেন,
বাবা আমায় বড্ড ভীষন ভালোবাসেন। 

অভ্রজিৎ দেবনাথ

বাবার জন্য লেখা

মা চাকরিসূত্রে দিনের বেলা বাড়িতে না থাকায় সিংহভাগ সময় কেটেছে বাবার ছায়াচলে। একটু বড় হলে হাত ধরে স্কুলে যাওয়া বাবার সাথেই।
মায়ের মতো অনেক ভালবাসলেও, প্রকাশ করতে না ভালোবাসি বলে।আগে হয়তো বুঝিনি, ভালো লাগত না অসময়ে বকাঝকা। এখন পড়ার খাতিরে বাড়ি থেকে দূরে থাকি তাই.....

আমরা চোখে আজও ভাসে, আমায় হোস্টেলে ছেড়ে আসার দিন তোমার চোখে ছিল জল। যে ছেলেটা একা থাকেনি সেই ছেলের সময়মতো খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তোমার চিন্তা হয়। সন্ধ্যায় ফোন তুলতে দেরি হলে দেখতে পাই তোমার ঝুরিভরা মিস্ কল। জীবনের ভেঙে পড়ার মুহূর্তে আমার সোজা থাকার রহস্য তুমি।

সোমা চক্রবর্তী

বিশ্ব পিতা

সুন্দর সকাল বেড়ে উঠা হল শুরু পথ চলার
পিতার দেওয়া মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলার।

বলতেন উনি সৎপথ আর সত্য কথায় যত বাঁধা আসবে,
তত বাঁধার পরেই যে এক সুন্দর সকাল আসবে।

আদর স্নেহ ও শাসনে আমি হয়েছি বড়ো,
তাই তো উনার অনুসরণে হয়েছি জ্বড়ো।

ছোট বেলা বুঝিনি কদর এই সংসারের মায়া
বড়ো হয়েছি এখনো দীক্ষিত উনার ছায়ায়।

আগলে রেখেছেন সারা জীবন হৃদয়ের মাঝে
বুঝিনী কভু দুঃখ নতুন আঙ্গিনার সাঁঝে।

এতটা সময় পেড়িয়ে তিনি হঠাৎ চলে গেলেন,
সময়ের যে ব্যথা এখন যন্ত্রনায় ভরিয়ে দিলেন।

উনিই জগৎ উনিই ভগৎ উনিই সংসারের পিতা,
আজ বুঝেছি বিশ্ব জগৎ, তিনিই বিশ্ব পিতা।

দেবব্রত চক্রবর্তী

তোমার ভালোবাসায়

মনে পরে তোমার কথা,
খুব মনে পরে;

যখন কোথাও যাওয়ার সময় 
কেউ বলে না কোথায় যাস্ , তাড়াতাড়ি ফিরিস বাড়িতে।

সকাল,বিকাল ভাত খাওয়ার সময় যখন
কেউ ডাক দেয় না
তখন মনে পরে! তোমায়।

আজ তুমি নেই 
আমি বড়ো একা
আমার স্বপ্ন বিলাস,আনন্দ উল্লাস হাঁরিয়ে গেল।
তোমার অকালে চলে যাওয়ায়,

তুমি আজ স্মৃতিতে মিশে গেছো।
এখনও তোমার উপস্থিতি,স্পর্শ অনুভব করি;
তোমার স্মৃতিতে।

তোমার শ্বাষন আদর আমার বায়না আর,ভালোবাসা হাঁরিয়ে ফেলেছি খুব কম সময়েই।
হয়তো তোমার সাথে অবহেলায় কাঁটানো দিনগুলো জীবনের শেষ পর্যন্ত কাঁদাবে ,
সৃষ্টির নিয়মে শেষটা অনেক কষ্টের,
অনুভুতি গুলি জমিয়ে রাখলাম; মনের গহনে।
তোমার ভালোবাসায়।

উর্মি সাহা

বাবার পরিচয়

হালখাতার নিম্নগতি সাথে
আমার আবদারের হিসেব,,
দুই মিলে এক অবাধ্য বিজ্ঞান।
তপ্ত দুপুরে কনফারেন্স চলে;
বাবার মাথা বয়ে ঝরা ঘামের ফোটায়--,
আর ইকোনমিক গণনায়।
চাহিদা হোক একটা কিংবা পাঁচটার!
রক্তকরবী বলো না কেনো---,
''কি দরকার এতোটার''??
সংঘ জুড়ে কিংবদন্তি হয়েছে প্রচুর জন,,,
তুবুও হাজার জনে---
তুমি আমার কিংবদন্তি একজন।।
আমার গল্পে তুমি আমার নায়ক,
আমার কাব্যে বাবা তুমি-ই আমার সহায়ক,,
আমার বিরহে বন্ধু তুমি-ই শ্রেষ্ঠ;;
ভয়-সংকোচে বাবা-ই আমার বটবৃক্ষ।
শৈশবের কন্ঠ ভাঙা অস্পষ্ট শব্দ আর-
বর্তমানের বাস্তব মেশানো বাক্য উচ্চারণে,
অবলম্বন একমাত্র তুমি।
যান্ত্রিক জীবনেও উত্তম পুরুষ---
মাত্র তুমি-ই আমি জানি।
পরিচয় আমার সামান্যখানি!!
পরিচিতি দিলে তোমারই শুভ্র নামে,
তোমার শার্ট এর গন্ধে-,
তোমার হাতের বাষ্পে।
শহর জুড়ে আমি কেবল,এক অবলম্বী নারী,
তবুও তোমার চিলেকোঠায় আমি সাহসী।
তোমার পরিচয়ে আমিই তোমার রাজকন্যা,,
বাবা তোমারই জন্যে আমি বিশ্ব শ্রেষ্ঠা।

মন্দিরা শীল

অন্বেষা

থাকে অনেক ছোট্ট শিশু
দেখতে ভারি মিষ্টি
সুন্দর এই পৃথিবীতে 
কি অপরূপ সৃষ্টি।

খিলখিলিয়ে হাসে তারা 
মিষ্টি মধুর সুরে, 
নাচে, গানে মেতে থাকে 
অন্বেষা হোম জুড়ে।

প্রাণবন্ত ওই বাচ্চাগুলোর  
মনে ভীষন কষ্ট,
কেন ভগবান করলে তুমি
ওদের ছেলেবেলা নষ্ট?

আকাশ নামের ছেলেটার সাথে
কথা বললাম যেই,
ও বলল আমার সবই আছে   
মা বাবা তো নেই।

কেউ তো বলে সৎ মা নাকি 
দেয়নি ঘরে থাকতে,
ইচ্ছে করে প্রায়সময়ই 
মা মা বলে ডাকতে।

কেউ তো বলে বাবার শোকে 
মা যে পাগল হল,
বেরিয়ে গেল পথে ঘাটে 
আমার কি দোষ ছিল বল?

বলার কিছু ছিলনা আমার 
ভাষা হারিয়ে ছিলাম,,
শুধু আদর করে ওদের আমি
বুকে জড়িয়ে নিলাম।

দুলাল চক্রবর্তী

আমি শুধু একা


নিয়তি আমার!
কোথায় নেবে টেনে?
এক রাশ আলোর মাঝেও
আমার জগৎ তমসাচ্ছন্ন।
ফিরে আর তাকাতে চাইনা
হে অন্ধ অতীত।

দু্র্বিসহ যন্ত্রণার মাঝে
সমস্ত মন ছিন্ন ভিন্ন;
প্রলেপ দেবো কোথায়?
কোন সুখস্মৃতি--সে তো
বিদায়ী অতিথি!
বকুলের গন্ধে আর কখনো
বন্যা হবেনা।
শ্মশানের আশ পাশে
কটা আধপোড়া কাঠ;
ছাই পড়ে আছে চিহ্ন হিসাবে।
শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা ভাঙছে
কটা শিয়ালের ডাকে!

জোৎস্না আসেনা আমার জন্য
পদচিহ্ন থাকেনা কোন
এক পথিকের।
খোলা জানলাটা ধরে
দাঁড়িয়ে আছি আমি একা!

পিনাকী ভৌমিক মুন

বাবু

তোমার  কাছ থেকেই
প্রথম চলতে শেখা, এই পথ জীবনের।
জীবনের প্রথম পদক্ষেপ তুমি।

ক্ষিদে, খাবার, কথা তিন শব্দে তুমি,
গ্রীষ্মযাতন রক্ষাপ্রভু মায়ের মতো ভূমি।
.
নিজের অভাব, আমার স্বভাব
মিলিয়ে নিতে জানো
আজ তোমায় বলছি বাবা
যদি তুমি শোনো!

সংসারের এই আস্ত জাহাজ
তোমার বুকে চলে
জল নেই তবু ঢেউ শোনা যায়
তুমি সাগর বলে। 

ভেঙে পড়ায় তোমার মতো উঠতে আমি জানি
সাহসী ভাবার অবলম্বন তুমিই ছিলে মানি!

বাবা একটা কথা বলি?
এই যে লোকে আজকে শুধু বাবার কথাই চলে
আমার কেন কষ্ট হয় আজ তোমার কথা বলে?
মা'ই আমার বাবা আজ, তুমি দূরে দূরে
এক জীবনে বাবাহারা আমই ভবঘুরে।
যেথায় তুমি যেমনি থাকো
যদি মনে পড়ে
মনে রেখো রাগ নেই আজ
শ্রদ্ধার ফুল ঝড়ে! 

ভাশ্বতী হান্দাল

বাবা তোমায়

শ্রী চরণেষু বাবা,
কেমন আছ তুমি? সংসারের চাপে অনেক দিন তোমার কোনো খোঁজ নিতে পারিনি.. আসলে হয়তো সংসারের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেয়েছি , তবে জানো এড়িয়ে যেতে চাইলে ও এড়িয়ে যেতে পারিনি, খুব রাগ হয়েছিল তোমার ওপর যখন তুমি আমার পড়া শেষ হওয়ার আগেই আমাকে বিয়ে দিয়ে ছিলে, আসলে তখন বুঝতে পারি নি তোমার অবস্থা টা.. 
হয়তো বুঝতে চাই ও নি, তাই পাহাড় প্রমাণ অভিমান নিয়েই চলে গিয়েছিলাম স্বামীর ঘরে।
তবে তোমাকে আজকাল খুব মনে পড়ে, আগের জমানো অভিমান গুলো যেন সময়ের স্রোতে মিয়ানো, তবে এত বছরের জমে থাকা প্রশ্ন গুলোর উত্তর আজ আবারো জানতে চাই! 
তোমার রাজত্বে রাজকুমারী হতে চাইনি কোনো দিন, তবে কেন রাজকুমারী করে রেখেছিলে বাবা? 
আমি তো এক যোদ্ধার মেয়ে হতে চেয়েছিলাম
যে রোজ দু বেলা দু মুঠো ভাত জোগাড় এর জন্য লড়াই চালিয়ে যায় আমি সেই যোদ্ধার মেয়ে হতে চেয়েছি, 
কিন্তু তুমি তোমার যুদ্ধে আমাকে  সৈনিক হিসেবে নিতেই চাওনি
আমি কি এতটাই অযোগ্য ছিলাম? 
অনেক বার জানতে চেয়েছি তবে উত্তর পাইনি 
যদি উত্তর দিতে তবে হয়তো পায়ের তলার মাটি আরো অনেক শক্ত হয়ে যেত সেদিন... 
তোমাকে বুঝতে পারি নি বাবা কেমন মানুষ তুমি? 
নাকি সব বাবারাই এমন? 
যে তার মেয়ে কে রাজকুমারী করে রাখতে চায়? 
জানো বাবা আমার মেয়ে যখন অফিস থেকে ফেরার পর তার বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে, সারাদিনের কাজের পর যখন তুমি দু প্যাকেট চিঁড়ে ভাজা কিংবা দুটো ফল নিয়ে আসতে তখন আমারা দুই ভাইবোন ও এমনি করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম মনে আছে তোমার বাবা? 
তোমার কাছে যখন ছিলাম তখন কোনোদিন তোমাকে বলিনি যে কথাটা আজ বলছি 
ভীষণ ভালোবাসি তোমায় বাবা... 
ভালো থেকো আর পারলে আমার অপরিণত অভিমান ক্ষমা করো। 
            ইতি
     তোমার মেয়ে 
            মেঘ

ড. রঞ্জিত দে

পিতৃদিবস
              
"পিতা  স্বর্গ ,পিতা ধর্ম ,পিতাহি পরমং তপঃ"----- পিতা স্বর্গ পিতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অনুভব, ধর্ম, এই বিশ্বাস এই অনুভূতি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রের নানা জায়গা বর্ণিত হয়েছে । পিতার আদেশে নচিকেতা অম্লান বদনে যমদ্বারে গমন করেন । গুরুদেব অগ্যস্ত  মুনির আদেশে পরাক্রমশালী  বিন্ধ্য আজো নত মস্তকে গুরুর পুন; আদেশের অপেক্ষা করছে। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন - "পিতার ভবনে" 

সন্তানকে পরিবার তথা সমাজের প্রতিষ্ঠিত পুনরায় জন্য পিতৃদেব অশেষ চেষ্টা ও শ্রম সাধন করেন ।কিংবদন্তি বলছে- "পুনার্থে ক্রিয়াকে ভাবা'। পুরানো অনেক চিন্তা এখনও বিতর্কিত, কিন্তু সন্তানকে সুস্থ  জ্ঞানী করার জন্য পিতা তার অর্জিত ধন ব্যয় করেন । লোক ভয়,লোক লজ্জা ত্যাগ দিয়ে পরিশ্রম করেন । সমস্ত পৃথিবীপৃথিবীটা জুড়ে একদা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল। কিন্তু কালপ্রবাহে এই সমাজ ক্রমশ; পুরুষ প্রধান সমাজে রূপ লাভ করতে থাকে। সম্ভবত আমাদের পুরানো যা ছিল তারই ছবি বহন করে থাকে; সন্তানের বড় হওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকার গুরুত্ব তুলনাহীন । কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে শিশুর জীবনে পিতা ও মাতা উভয়ের ভূমিকা খুব জরুরী বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা অপেক্ষা গৃহস্থলীতে পটু হওয়ার গুরুত্ব মায়েরা অধিকতর মনে করেন। সে ক্ষেত্রে পিতার উদারতা মেয়েদের এই গণ্ডী থেকে বের করার চেষ্টায় বা উদ্যোগে খুব  প্রয়োজন হয় । 

  হেমন্ত কুমার দে --- আমার পিতৃদেব আমাদের লেখাপড়া ও স্বাস্থ্য রক্ষায় খুব যত্নবান ছিলেন। তাঁর হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিলে যা আমাকে প্রভাবিত করে। তিনি একটা স্টাইলে লিখতেন।তাঁর হাতের লেখা কাগজ আমার কাছে সংরক্ষণে এখনও আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রাক্কালে পঞ্চাশের মন্বন্তরের সংকটাপন্ন অনেকের মতো আমার পিতা বার্মা মুল্লুকে যা ত্রিপুরা রাজ্যে আসার পূর্বে ও পরে তিনি লিখতেন। কিন্তু তাতে যে টাকা পয়সা পেতেন তা ঘর চালানো যেত না। 
 
আমার লেখা পড়ার জন্য বাবা যত্নবান হলেও তিনি সেই সময় দীর্ঘদিন জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েন । ফলে সংসার অচল হয়ে পড়ে । প্রচন্ড আর্থিক সংকটের ফলে, সাবরুমের শ্রদ্ধেয় জগদীশ দে-র বাড়ীতে লজিং এ থেকে পড়তে হয়। কলেজে পড়া কালীন ও লজিং এর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হয়। বাবা প্রায় শেষ দশ বছর রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি বই পড়তেন । শেষ বয়সে শারীরিক ভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। সামান্য, শারীরিক কষ্ট নিবারণের জন্য হাসপাতালে এনেছিলেন। পরিচিত ডাক্তারবাবু ভালো চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে নেন। কিন্তু দুঃখের হলেও সপ্তাহে আশি বৎসর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান । পিতৃদেবের শেষ বয়সে তাঁর আদেশে এবং আমার নৈতিক বোধ থেকে ছোট ভাই এর বি.এ (অনার্স)পাশ বা চাকুরী পর্যন্ত সার্বিক দায়িত্ব বহন করেছি। যা পিতৃদিবসে উচ্চারণ করতে পেরে ভালো লাগছে । আজকে সকল পিতাকে প্রণাম জানাই।

বিনয় শীল

পিতা

যিনি সূর্যের মতো নিরন্তর
নিজেকে পুড়িয়ে-
সন্তানকে করে আলোকিত,
যিনি সন্তানের কল্যাণ চিন্তায় 
পাহাড়ের মতো ধ্যানমগ্ন,
যার বক্ষ মোক্ষিত 
রক্তের ঝর্নাধারায়
সন্তান প্রাণ সঞ্জীবিত,
তিনি পিতা।

পিতা নিজ হাতেই
নিজেকে জ্বালিয়ে
সৃষ্টি করে নেয় পুত্রের জন্য
অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহ।
তারি-ই ছোঁয়ায় 
পুত্র বিবর্ধিত।
পিতৃ স্নেহের 
বিপুল প্রাণ ফোয়ারার-
অমোঘ সুর স্রোতে
মাতোয়ারা হয়ে কতো দিন 
ঘুমিয়ে পড়েছি পিতার বিশাল বক্ষে।

পিতার অসীম ত্যাগের 
গভীর যজ্ঞ কুণ্ড থেকে
আমার প্রকাশ।
তাঁর আত্মার অংশ আমি।
কিসে হবে আমার সুখ,
কিসে যাবে সকল দুখ্
পিতা এ চিন্তার-
জীবন্ত মূর্ত বিগ্রহ ।
হয়তো কল্প বৃক্ষের অপর নাম- পিতা।

পিতার কঠোরতা, 
সে তো ঘনীভূত মধু ।
যতই কঠিন হোকনা কেন,
অলক্ষ্যে সন্তানের জন্য প্রবাহিত হয়
বিগলিত স্নেহের 
চিরন্তন মধুময় ধারা ।

সন্তানের জীবন বেদীতে
নিজের সুখকে, 
নীরবে নির্মমভাবে 
বলি দেওয়ার
মানত করার নাম-  'পিতা'।

এই তো পিতা !
পিতৃদেব !
যিনি বিগত দেহ হওয়ার পরেও, স্বপ্ন যোগে 
সন্তানকে দেখা দেয়।
অজ্ঞাত অসীম পথে মহা যাত্রার আগে
জানালার পাশে দাঁড়ায়।
মুখে গভীর বিয়োগ ব্যথার ছাপ ।
আহা, অসীমান্তিকের দিগন্তে
চির বিলীন হয়ে যাওয়ার মূহুর্তে
সন্তানকে আরেকটিবার দেখতে আসে।
নিঃশব্দে জানায় 
শুভকামনা।
ছল্ ছল্  করা 
জলভরা চোখে 
ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অতল বিয়োগান্তক আবহে- 
শুধু সন্তানের প্রতি 
নৈশব্দিক চাহনি।

তার পর হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গে, সাথে স্বপ্ন ভাঙ্গে
কোন অজান্তে পিতা মিলায় অদৃশ্যের গাঙ্গে ।।

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

'বাবা' শব্দে পিতৃতর্পণ

'পিতা' একটি দুঅক্ষরের শব্দ ৷ এই শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার সৃষ্টিকথা ৷ আমাকে যিনি পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলেছেন ৷ আমাকে যিনি বিশ্বসংসার চিনিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি ঝড়বাদলাদিনে বিপর্যয়ে প্রাকৃতিক রোষ থেকে রক্ষা করেছেন ৷ আমাকে যিনি সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করার মতো সাহস জুগিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি সফল জনক হিসেবে উত্তরণের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিয়েছেন তিনিই আমার পিতা ৷ ঠিক এমনই কিছু ব্যক্তিগত পরিবর্তন কিংবা সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়েই হয়ে
 ওঠেন প্রত্যেক পিতা ৷ প্রত্যেকের কাছেই
 প্রত্যেকের পিতা এক বিশাল মহীরুহ ৷
 এক নির্ভরতার স্থল ৷ নিরাপত্তার জায়গা
 ৷ বিশ্বাসের ভূমি ৷ এক সুবিশাল ছায়াতরু
 ৷ সেকারণেই পিতাকে বসানো হয়েছে
 শ্রেষ্ঠতম সম্মানিত স্থানে ৷ সংস্কৃত শ্লোকে
 আছে—

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতাঃ

   একারণেই জগৎসভার নিয়ন্তাকে, বিশ্বস্রষ্টাকে বলা হয় 'পরমপিতা' ৷ বলা হয় 'এক পিতা হতে সবার উৎপত্তি' ৷ ধর্মীয় ক্ষেত্রেও গুরুকে পিতার আসনে বসানো হয় ৷ তিনিও পিতার সমতুল্য ৷ শিষ্য-শিষ্যাগণ তাঁর সন্তানসম ৷

      একসময় যে অর্থে পিতা শব্দটি ব্যবহৃত হত কালক্রমে তাই পরিবর্তিত হয়ে 'বাবা' শব্দে বাংলাভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে ৷ সংস্কৃত 'বপ্তা' শব্দের অর্থ হল যে বপন করে ৷ এটি একটি বিশেষণ পদ ৷ এই 'বপ্তা' থেকে ধ্বনিতাত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ( বপ্তা> বপ্পা> বাপা> বাপু> বাবু> বাবা)  'বাবা' শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে ৷ সংস্কৃত ও হিন্দিতে 'বাপু' পিতা, সন্তান, মান্য ও সম্ভ্রান্ত অর্থে ব্যবহৃত হয় বাবু( বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ—রবীন্দ্রনাথ)  ৷ প্রাচীনবাংলায় যখন বৌদ্ধচর্চার প্রাধান্য ছিল তখন 'বপা' শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় ৷ প্রাচীন বৌদ্ধ দোঁহা ও গান, আদি বাংলাভাষার মান্য নিদর্শন চর্যাপদে পাই—'সরহ ভণই বপা উজকট ভইলা' ৷—চর্যা-৩২/৫ ৷ বাংলাদেশে মুসললমান রাজত্বের আগে 'বাপু' শব্দটির প্রচলন ছিল ৷ 'শুন বাপু চাষার বেটা'—খনা ৷ আবার মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে দেখি—'সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিত্তল/ঘষিয়া মাজিয়া বাপা কইরাছ উজ্জ্বল' ৷—কবিকংকন মুকুন্দরামচক্রবর্তী
-চন্ডীমঙ্গল ৷ পরবর্তীসময়ে মুসলমান রাজত্বকাল থেকে ফারসি 'বাবা' শব্দটি বাংলা শব্দভান্ডারে স্থান করে নেয় ৷তখন থেকে পিতা অর্থেই 'বাবা' শব্দটির বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে ৷

   বাংলার উপভাষাগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে অঞ্চলবিশেষে শব্দটি বাবা> বা'> বাবাজি> বা'জি> বাবু> বাউ> বাপ> বাপন ইত্যাদি নানাভাবে উচ্চারিত হয় ৷
ছোটোদের প্রাচীন খেলার ছড়াতে পাওয়া যায়—'আপন বাপন চৌকি চাপন/এই পুলাডা চকি চোর' ( চকি-খাটিয়া) ৷ সংস্কৃত প্রবাদে যেমন বলা হয়—'যৎ বীর্য তৎ পরাক্রম' তেমনি চট্টগ্রামী বাংলায় একটি সুন্দর প্রবাদ আছে—ভুঁইঅর গুণে রোয়া/বাফর গুণে ফুয়া' ৷ আবার কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ হালকা রসিকতায় দিনযাপনের বেদনার কথা প্রকাশ করেন—'বাপে পুতে ডাইক্কা ভাই/কুনুমতে দিন কাডাই' বলে ৷ যশস্বী সন্তানের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়—'বাপের নাম রাখছে' তেমনি কলংকিত সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়—'বাপের নাম ডুবাইছে' ৷ 'বাপ কা বেটা সিপাইকা ঘোড়া/কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া'—এই হিন্দি কহাবৎটি বাংলাতেও সম্পূর্ণ বা আংশিক ব্যবহার করা হয় কিংবা বলা হয়—'বাপের পুত' ৷ বেওয়ারিশ সন্তানের বিশেষণ হয়—'বাপে তাড়ানো মায় খ্যাদানো' ৷ সন্তানের প্রতি যত্ন, স্নেহ ও দায়িত্ববোধের সুন্দর নিদর্শন পাওয়া যায় 
একটি নোয়াখালি প্রবাদে—'হিম্বার লাই মাডিৎ রাখি ন/ উউনের লাই মাথাৎ রাখি ন' ৷( পিঁপড়ে ঘিরে ধরবে বলে মাটিতে রাখিনি ৷ উকুনে কামড়াবে বলে মাথায়ও রাখিনি) ৷ একটি গ্রাম্য শোলোকেও প্রকারান্তরে 'বাপ' শব্দটি এসেছে—'বাপে নাহি জন্ম দিল, জন্ম দিল পরে/ যখন পুতে জন্ম নিল মা ছিলনা ঘরে' ৷ (কুশ-রামায়ণের চরিত্র) ৷

  বাংলা লোকসাহিত্যের মতো প্রাচীন বাংলাসাহিত্যেও 'বাবা' এসেছেন নানাভাবে ৷ এর মধ্যে মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র ও রামায়ণের দশরথ চরিত্রদুটি কাহিনির পটপরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল ৷ মহাভারতের রক্তক্ষয়ী, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধটিও সংঘটিত হয়েছে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রস্নেহের কারণে ৷ তিনি আক্ষেপও করেছেন, 'অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে' ৷ রামায়ণে পিতা দশরথের একটি সিদ্ধান্তের কারণে জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে সিংহাসনে আরোহনের পরিবর্তে চোদ্দো বছর বনবাসে কাটাতে হয় ৷ আর পুত্রবিরহাতুর দশরথকেও মৃত্যুশয্যায় শয়ন করতে হয় ৷ এরকম আরও ছোটোখাটো পিতৃচরিত্র দুই মহাকাব্যে রয়েছে ৷ রামায়ণ এবং মহাভারতে তো পিতাপুত্রের মধ্যে যুদ্ধের ঘটনাও রয়েছে রাম ও লবকুশ এবং অর্জুন ও বভ্রূবাহনের মধ্যে ৷ শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তে জানি নৃশংস কংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে সদ্যোজাত কৃষ্ণকে ঝড়জলের মধ্যে 'বসুদেব রাখি আইল নন্দের মন্দিরে৷ নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে' ৷ মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যে শিবকে দেখি কোনোরকম পিতৃদায়িত্ব তিনি পালন করেননা ৷ গাঁজা ভাং সেবন করেন ৷ শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান ৷ বাবা ভোলানাথ ৷ অন্নদামঙ্গলে দেখি ঈশ্বরী পাটনি বলছেন— আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে ৷ কী সহজ সরল প্রার্থনা সন্তানের জন্যে ৷

ঐতিহাসিক কাহিনি অধ্যয়ন করলে আমরা দেখি মুঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন যখন অসুস্থ হন তখন সমস্ত হেকিম-বদ্যিরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলেননা ৷ তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল ৷ তখন পিতা বাবর তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনকে তাঁর জীবনের বিনিময়ে বাঁচানোর জন্যে ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন ৷ তারপর ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন ৷ কিন্তু সম্রাট বাবর আর বেশিদিন বাঁচেননি ৷ 'মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোনো ক্ষয়,/ পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়' ৷ কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর 'জীবন বিনিময়' কবিতায় মর্মস্পর্শী ভাষায় এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন ৷ আধুনিককালের অর্থাৎ এই সময়ের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবি শঙ্খ ঘোষও তাঁর জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এক আর্ত পিতার অবস্থান থেকে এই ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বাবরের প্রার্থনা' ৷ 'বাবরের প্রার্থনা' কবিতাটির রচনাকাল ১৯৭৪ সাল ৷ 'কবিতার প্রাকমুহূর্ত' গ্রন্থে কবি উল্লেখ করেছেন—কবিকন্যা কিছুদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন ৷ দিন দিন তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ৷ সেসময়ে একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তিনি নির্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে পায়চারি করছিলেন ৷ হঠাৎ তার মনে পড়ে ঐতিহাসিক ঘটনাটি ৷ এই ঐতিহাসিক তথ্যকেই কবি এক নবতর তাৎপর্যে মন্ডিত করেন কবিতাটি ৷ এই শিরোনাম ব্যবহার করে আরো কিছু কবিতাসহ একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন ৷ 'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থটির জন্যে তিনি ১৯৭৭সালে আকাদেমি পুরস্কার পান ৷ ঐতিহাসিক চরিত্র বাবর মানবিক গুণে একজন যথার্থ পিতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান ৷ শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায়ও পরমপিতার কাছে প্রার্থনা করেন—

          আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
          জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?
          ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
          আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক ৷
              (বাবরের প্রার্থনা-শঙ্খ ঘোষ)

    রবীন্দ্রনাথঠাকুরের একটি অসাধারণ ছোটোগল্প 'কাবুলিওয়ালা' ৷ এই গল্পের প্রধান চরিত্র রহমত ৷ রহমত তার দেশের মাটিতে রেখে আসা শিশুকন্যাটির স্মৃতিচিহ্নকে বুকের মধ্যে ধারণ করে কোলকাতা শহরের পথে পথে পণ্য ফিরি করে ৷ রবীন্দ্রনাথ রহমতের পিতৃহৃদয়ের বেদনাকে উন্মোচিত করেছেন এই গল্পে—' কাগজের উপর একটি ছোটো হাতের ছাপ ৷ ফটোগ্রাফ নহে ৷ খানিকটা ভুষা মাখাইয়া কাগজের উপর তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে ৷ কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে—যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশু হস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধা সঞ্চয় করিয়া রাখে' ৷ এছাড়া একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায় মনিবের শিশুসন্তানটি জলে ডুবে যাওয়ার প্রেক্ষিতে অপরাধবোধ থেকে নিজের সন্তানকে তুলে দেওয়ার পেছনে আপন সন্তানের সুখৈশ্বর্যের ছদ্ম আকাঙ্ক্ষাটিই রয়ে গিয়েছিল এক দরিদ্র পিতার মনে ৷ তারই নিদর্শন পাই রবীন্দ্রনাথের আর একটি ছোটোগল্প 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা'য় ৷ আসলে বাবা শুধুমাত্র একটি শব্দ নয় ৷ মানবিকতার, মনুষ্যত্বের এক প্রতীক বাবা ৷ বাবার ভূমিকাই মুখ্য থাকে সন্তানের জীবনগঠনে ৷ বাবার মানবিক গুণগুলো সন্তান অনুকরণ করে ৷ শ্রেষ্ঠ বাবাই গড়ে তুলতে পারেন একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান ৷

আমরা এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি ৷ কঠিন পরীক্ষারও ৷  আজকের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূষিত বাতাস ঢুকে গেছে ৷ হিংসা, স্বার্থপরতা, লোভ, হানাহানি বেড়ে গেছে সমাজে ৷ মানুষের অন্তর্নিহিত সুকুমার বৃত্তিগুলো আজ অন্তর্হিত ৷ মায়া, মমতা, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা যেন আজ সুদূর আকাশের নীহারিকা ৷ মানুষের মানবিক গুণগুলো আজ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে ৷ বহু পিতার মধ্যে আজ পিতৃত্বের গুণগুলি খুঁজে পাওয়া দুস্কর ৷ ক্ষুদ্র স্বার্থ, ক্ষুদ্র মোহ আর ক্ষণিক সুখের হাতছানিতে আজ তারা নিমেষেই ভুলে যাচ্ছে পিতৃকর্তব্য ৷ বিশ্বায়নের ফলে পণ্যসংস্কৃতির আগ্রাসনে ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, শৃঙ্খলা ৷ পিতার পাশাপাশি সন্তানেরও যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে বাবা মায়ের জন্যে ৷ কিন্তু তাও আজ অবহেলিত ৷ বার্ধক্যে এসে সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসহায় বাবা ৷ ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সন্তান নিতে পারছেনা বাবার শেষের দিনগুলোর দায়িত্ব ৷ সর্বোপরি এই করোনাক্লিষ্ট সময়ে দূরপ্রান্তে জীবিকার দাগিদে ব্যস্ত হয়ে এবং লকডাউনে আটকা পড়া সন্তান যেমন নিতে পারছেনা প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তেমনি আবার কোনো কুলাঙ্গার ও পাষন্ড সন্তান এই লকডাউনের মধ্যেই বৃদ্ধ বাবাকে গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসছে ৷ আমরা জানিনা এই অমানিশা থেকে পরিত্রাণ কবে ঘটবে আবার ৷ এই সময়ে সন্তানের লালনবঞ্চিত অসহায় পিতার হাহাকার ধ্বনিত হয় নচিকেতার জনপ্রিয় একটি গানে—

   ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
    মস্ত ফ্ল্যাটে যায়না দেখা এপার ওপার
    নানানরকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
    সবচাইতে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি
    ছেলে আমার-আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
    আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম ৷
—একেবারে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে সমকালের অসহায় পিতার যন্ত্রণার দিনলিপি ৷ সারাজীবন দায়িত্ব পালন করে শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয় বাবার ৷
   এই অসহায়তা এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাবা কিন্তু বাবাই ৷ সন্তানের কল্যাণই প্রতিটি পিতার একমাত্র কাম্য ৷ মুঘল সম্রাট শাহজাহান এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু হল পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ ৷ পিতার জীবদ্দশায় এর চেয়ে বিড়ম্বনা আর কিছু হয়না ৷ আর কিছু নয় ৷ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও প্রতিটি বাবা উচ্চারণ করেন—

    এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
    চাঁদ ডাকে  :  আয় আয় আয়
    এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
    চিতাকাঠ ডাকে  :  আয় আয়

    যেতে পারি
    যে-কোনো দিকে চলে যেতে পারি
    কিন্তু কেন যাবো?

    সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
     ( যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো—শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...