Friday, September 21, 2018

Welcome

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

মানুষ চলে তার মনের দ্বারা। মানুষের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা কিংবা সুখ, দুঃখ যাবতীয় অনুভূতি গড়ে উঠে তার মনের উপর ভিত্তি করে । প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যেই শুভ শক্তির বিকাশ সাধিত হলেই সামাজিক শান্তি এবং সমৃদ্ধি সম্ভব। কুসংস্কার দমন সহ শান্তি, অগ্রগতি এবং প্রগতিশীলতার প্রশ্নে সাহিত্যের ভূমিকা বিশাল। সেই উদ্দেশ্যেই মনন স্রোতের আত্মপ্রকাশ। আজকের দিনে পুরো বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় পৌঁছে গেছে। কোনো বার্তা মানুষের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তাই প্রযুক্তিকে বহুমুখী ব্যবহারে মধ্য দিয়ে 'মনন স্রোত'কে খুব কম সময়ের মধ্যে বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া আমরা চাই নতুন প্রজন্মের লেখক লেখিকাদের কাছে মনন স্রোত হয়ে উঠুক আত্মপ্রকাশের এক অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।  এবারের সংখ্যায় শিক্ষক দিবস নিয়ে আলাদা পাতা করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তুু প্রয়োজন মতো শিক্ষক দিবসের লেখা আমরা প্রাপ্ত করতে পারিনি। বাংলাদেশের লেখকদের থেকেও এ মাসে প্রয়োজন মতো লেখা আসেনি সেজন্য 'সোনার বাংলা' এবং 'তিরুনানি' পাতার কবিতাগুলো আমরা এ মাসের জন্য 'মনের জানালা' পাতায় অন্তর্ভুক্ত করেছি। প্রতিমাসে প্রকাশিত হয় বলেই লেখা সংগ্রহের ক্ষেত্রে 'মনন স্রোত'কে বাস্তবিক কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই অল্প সময়ের মধ্যে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভুল ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। যাবতীয় ভুলের দায় আমার একারই। অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটিগুলো পাঠকরা মার্জনা করবেন এই আশা রাখছি।

এই সংখ্যায় রাজ্যের এবং দেশ বিদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক লিখেছেন। অনেক নতুন প্রজন্মের লেখকরাও লিখেছেন।  যারা লিখে মনন স্রোতকে সমৃদ্ধ করার কাজে সহযোগিতা করেছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সবশেষে একটি ই-ম্যাগাজিন হিসেবে মনন স্রোত তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা কামনা করছে।
সকলকে অগ্রীম শারদীয়ার শুভেচ্ছা।

জয় হিন্দ

                                       শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা-সহ
                                           জয় দেবনাথ
                                              সম্পাদক
                                             

Wednesday, September 19, 2018

কল্যাণব্রত বসাক

ফেনী ব্রিজ (৫ম পর্ব)

বাংলাদেশে আটকে পড়া, পাড়া-প্রতিবেশী জানাজানি হওয়া, বাড়িতে বেধড়ক মার খাওয়ার পর একেবারে বিধস্ত। আধ মরার মতো শুয়ে ছিলাম। সারা শরীর ব্যথা করছিলো। এমন সময় আমার সর্বকালের সেরা ত্রাতা ঠাম্মা এসে বসলেন পাশে। আল্লাদে -অভিমানে আরেক প্রস্ত-
ও---- ঠা ম্মা--- গো------
ঝেড়ে কেঁদে-কেটে নিলাম।

ঠাম্মা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই গা'য়ের জ্বালা ঝিমুতে লাগল। হাত বুলতে বুলতে ঠাম্মা বললেন
--- 'আর কোন দিন যাইও না হে দেশে। যে দেশ ছাড়ি আইছি কিল্লাই গেছ হে দেশে।'
আমি বললাম - 'ছাড়ি আইছ মানে?'
--- হেঁ। হে দেশ ছাড়ি আইছি আঁরা(আমরা)
তাইলে বাংলাদেশ আঙ্গো দেশ?
--- হ। আঙ্গো দেশ। আঙ্গো নিজের দেশ আছিল।  অন নাই।  ছাড়ি চলি আইছি জন্মের মতন।
--- কিল্লাই -- কেননে? -- কন সময়?

তারপর ঠাম্মা শুরু করলো সেই ৪৯সাল থেকে। দেশ ভাগ। ভারত-পাকিস্তান। হিন্দু -মুসলমান। দাঙ্গা। রাতের অন্ধকারে পাঁচ বছরের ছেলে কোলে নিয়ে এই ত্রিপুরায় আসা। শরনার্থী। নাগরিক কার্ড। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ। চীন ভারত যুদ্ধ।

জয় বাংলা। মুক্তি ফৌজ। ইন্দিরা-মুজিব। বাংলাদেশ।

ঠাম্মার কাছেই শুনি মা'র/মামাদের বাড়ির কথা। মা, মামারা ৭১ এ প্রথম আসে শরণার্থী হয়ে থাকে শরণার্থী শিবিরে। দেশ যখন বাংলাদেশ হয়ে যায় সবাই গেলেও মা থেকে যায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

--- বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন এক নতুন সকাল আসে আমার জন্য।

এতদিন কেবল রামগড়কেই ভালোবাসতাম। এখন অদেখা বাংলাদেশের জন্যও ভালো লাগা শুরু হলো। কল্পনার রঙে সাজাতাম ফেনীর দক্ষিণে দৌলতপুর গ্রামকে যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে। অভিমান হলো, ক্ষোভ হলো কেন দেশটা দুটো দেশ হলো!  কেন আমি হিন্দু, ওরা মুসলমান!  কেন কেউ দেশে থাকবে,  কেউ পালাবে?
ভীষণ টান অনুভব করি।  কিন্তুু উপায় নেই।

একদিন রাতে  সাব্রুম বাজারে আগুন লেগেছে ভেবে বাবা কাকা সহ দৌড়ে গিয়ে দেখি না, আগুন লেগেছে ওপাড়ে রামগড় বাজারে। প্রচুর মানুষ এতো রাতেও দাঁড়িয়ে আছে নদীর ধারে, কিন্তুু ওপাড়ে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজে সাহায্য করার উপায় নেই।  অথচ ৭১সালের আগে নাকি রামগড় বাজারই ছিলো এ অঞ্চলের মুখ্য বাজার। 'বাংলাদেশ' হয়ে যাওয়ার পর প্রয়োজনের তাগিদে সাব্রুম বাজারের গুরুত্বও বাড়ে।

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাঙালির জমজমাট জনপ্রিয় লোকবাদ্যযন্ত্র ঢাক
    

পহেলা বৈশাখ হোক,শারদীয় দুর্গোৎসব হোক কিংবা চৈত্রের গাজনের পরবে, বাঙালির উৎসব অনুষ্ঠানকে জমিয়ে রাখে ঢাক । এটি একটি জনপ্রিয় লোকবাদ্যযন্ত্র । বাংলার অন্যান্য জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্রের মতো এই বাদ্যযন্ত্রটিও অতি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক কালে  শুধুমাত্র পুজোর অনুষ্ঠান ও উৎসবকে ছাড়িয়ে অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়েছে । কালের প্রবাহে বহু লোকবাদ্য হারিয়ে গেলেও ঢাক তার শৌর্য গাম্ভীর্যে উত্তোরত্তর যেন আসনটি পাকা করে নিচ্ছে ।

    বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে অতি প্রাচীনকাল থেকে জড়িয়ে আছে । হিন্দুদের দেবদেবীর প্রতিমার হাতে শোভিত উপকরণ হিসেবে  বাদ্যযন্ত্রকে দেখা যায় ।যেমন বিষ্ণুর হাতে শঙ্খ, শিবের হাতে ডমরু ,শ্রীকৃষ্ণের হাতে মুরলি বা বাঁশি  এবং সরস্বতীর হাতে বীণা। এছাড়া দেবী দুর্গাসহ অন্যান্য আরো কয়েকজন দেবদেবীর হাতে বাদ্যযন্ত্র শোভা পায় ৷ মহাদেবের হাতে যে ডমরু শোভা পায় তাই বৃহদাকার ঢাক বা ঢোলের ক্ষুদ্র সংস্করণ । প্রাচীনকালে যুদ্ধ শুরু হতো ডমরুধ্বনির মধ্য দিয়ে এবং যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটত ঢাকের আওয়াজে ।

      মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তার ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের মধ্যে ঐতিহ্যমন্ডিত লোকজ বাদ্যযন্ত্রের ধারাবাহিকতা রয়েছে ।যুগে যুগে সভ্যতার যে ক্রমোন্নয়ন ঘটে তারই প্রভাবে লৌকিক বাদ্যযন্ত্রসমূহ কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে মানুষের ব্যবহারে এসেছে । আদিম মানুষ লৌকিক বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে যেমন আনন্দোল্লাস প্রকাশ করত তেমনি গগনবিদারী  আওয়াজসম্পন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে হিংস্র বন্য পশুদের তাড়ানো এবং বিপক্ষীয় গোষ্ঠীর আক্রমন প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঢাক,দুন্দুভিজাতীয়  লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করত । সেই থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিশাল ও গম্ভীর আওয়াজ সৃষ্টিকারী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত হয়।

       লৌকিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে বাঙালি জাতির বহু প্রাচীনকাল থেকেই পরিচয় ও সম্পৃক্ততা রয়েছে । সমুদ্রগুপ্তের আমলে খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকে (375-417খ্রি.) চৈনিক পরিব্রাজক ফা- হিয়েন বাংলাদেশ পরিভ্রমণ আসেন।এখানকার প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখে তিনি তার ভ্রমণকাহিনিতে এই দেশকে সঙ্গীত ও নৃত্যের দেশ বলে প্রশংসা করেন।পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রীধর্মপালদেব (781-881)খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকের শেষ দিকে তৈরি করেন পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর মহাবিহার । এই বিহার ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীনভারতের বৌদ্ধ শাস্ত্র ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র ময়নামতি  (600-100 খ্রি.)র ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন প্রস্তর ফলক এবং পোড়ামাটির ফলকে নৃত্যরত ও বাদ্যরত মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে । এই চিত্র গুলোতে কাঁসর, করতাল,ডমরু,ডঙ্কা প্রভৃতি আনদ্ধ এবং শিঙা, বাঁশি ,তুবড়ি প্রভৃতি শুষির বাদ্যযন্ত্র লক্ষ করা যায় ৷ বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে জড়িত এইসব বাদ্যযন্ত্র দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রভাবে  স্থান করে নিয়েছে বলে মনে করা হয় । খ্রিস্টিয় নবম একাদশ শতকে রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন গীত,নট,নৃত্য বাদ্যের বর্ণনা রয়েছে ।চর্যাপদের তিনটি পদ মোট সাতটি বাদ্যযন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে । এগুলি হল বীণা, পটহ ,মাদল ,করন্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডমরু ।

      বাঙালিদের অতি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ঢাকের নির্মাণশৈলী সমন্ধে জানা যায় যে, একটি বৃহদাকার কাঠের দুপাশে চামড়া ছাউনি দিয়ে ঢেকে ঢাক তৈরি করা হয় । এর দুদিকে দুটি মুখ থাকে ।  এক একটি মুখের ব্যাস দেড় হাত পরিমান । একদিকের মুখ পুরু চামড়া এবং অন্য মুখ অপেক্ষাকৃত পাতলা চামড়া দিয়ে  ছাওয়া হয়ে থাকে । পুরু চামড়া ছাওয়ার মুখটিতে বাঁশের চটি বা কাঠি দিয়ে ঢাক বাজাতে হয় ।

      বাংলার ঢাকের ও নানা নাম রয়েছে ।ঢাক ,জয়ঢাক, বীরঢাক ইত্যাদি ৷  আওয়াজ ও আকৃতির তারতম্য অনুসারে এই নামকরণ হয়ে থাকে । ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সুর ও ছন্দমূর্ছনা তৈরি করার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই ঢোল ও কাঁশি বাজানোর প্রচলন রয়েছে । ঢাককে প্রাচীনকালে 'ডঙ্কা' বলা হত । কিন্তু সে সময় ডঙ্কা  জালা আকৃতির মাটির পাত্র দিয়ে তৈরি করা হত । সাধারণত পাঁঠা বা ছাগলের চামড়া দিয়ে ঢাক,ঢোল,একতারা, তবলা-বাঁয়া ইত্যাদি বানানো হয় । কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তাতে বেশ পরিমান লবণ ছিটিয়ে সাত আটদিন ভিজিয়ে রাখা হয়। চামড়া থেকে লোম উঠে গেলে ভালো করে পরিষ্কার করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে টান টান করে রোদে শুকানোর পর সেই শুকনো চামড়াকে সাইজ মতো কেটে এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়।

      ঢাকের 'বোল' অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল । কিন্তু তার তাল ও আওয়াজ প্রাণকে ছুঁয়ে যায় এবং এক অদ্ভুত মাদকতা সৃষ্টি করে ৷ বিভিন্ন উৎসব ও তার বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ তালে ঢাক বাজানো হয়। দুর্গোৎসবে যে ঢাক বাজানো হয় সে ক্ষেত্রে দেবীর বোধনে,দেবীর ঘুম ভাঙাতে ,দেবীর পূজাকালীন ,দেবীর আরতিতে এবং সর্বশেষ দেবীর বিসর্জনে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকের বাজনার ভিন্নতা রয়েছে । ইদানিংকালে সেই বাজনায় আর তেমন ভিন্নতা দেখা যায় । তার কারণ ঢাকের বাজনা বংশ পরম্পরা ক্রমে পাওয়া । অভ্যাসের  মাধ্যমে প্রচলিত ৷ তার কোন সংরক্ষণ নেই । তাই কালস্রোতে তা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে । এই ঢাকের 'বোল' মহাদেবের সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করেন ঢাক বাজানোর সঙ্গে বংশ পরম্পরাক্রমে যুক্ত শিল্পীরা । কথিত আছে, বেদোত্তর যুগে পাণিনি তাঁর সমসাময়িক বৈদিক ও সংস্কৃতিক ভাষাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অষ্ঠাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেন ৷ এই নিয়ে প্রচলিত কথা রয়েছে যে , পাণিনি  হিমালয়ে গিয়ে আঠারো দিন গভীর তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন । এর ফলে সন্তুষ্ট হয়ে শিব নৃত্যের ভঙ্গিতে চোদ্দোবার ঢক্কা বা ঢাক বাজান ।প্রতিবার ঢাক বাজানোর সাথে সাথে এক একটি নতুন শব্দ সৃষ্টি হল । প্রতিটি শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি ।
    এখানে উল্লেখ্য যে শিবের নৃত্য ভঙ্গিমার যে মূর্তি তা  নটরাজ নামে পরিচিত ।এই নটরাজ মূর্তি ছন্দ ও তালের প্রতীক । ঢাকের শব্দ ও ছন্দ তালের প্রতীক । শিবের নৃত্যের ফলে বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে সৃষ্ট শব্দগুলোকে পাণিনি চৌদ্দটি  সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেন । এই চৌদ্দটি সূত্র 'শিব সূত্র' বা 'মহেশ্বর সূত্র' নামে পরিচিত । এই সূত্রগুলো এই পাণিনি ব্যাকরণের মূল তত্ত্ব । বলা হয় শিবের নৃত্যের মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দগুলোই ঢাকের 'বোল'।

       বাঙালির কাছে ঢাক এতটাই জনপ্রিয় যে , বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের  নামকরণের সাথে অনেকে ঢাকের সাদৃশ্য খুঁজে পান। ঢাকার নামকরণ নিয়ে একটি কাহিনিও  প্রচলিত রয়েছে । জানা যায় যে , 1608 খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে বজরা নিয়ে এবং রাজপুরুষদের সঙ্গে নিয়ে নদীপথে ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন সেই সময়ে শাসক সুবাদার ইসলাম খান ।  তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার রাজধানী স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন করা । জাহাঙ্গীরের কুশলী  সুবাদার জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাকে পছন্দ করে সেখানে নৌকা ভিড়ালেন । বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বিশাল খালি জায়গা দেখে তিনি এখানেই রাজধানী পত্তনের   সিদ্ধান্ত নিলেন । কিন্তু সঙ্গে অন্যান্য রাজপুরুষও পাইক পেয়াদারা জঙ্গলাকীর্ণ  হওয়ার এই স্থানটি  নির্বাচনে গররাজি হল । কিন্তু সুবাদার সিদ্ধান্তে অনড়। জঙ্গল কোনো সমস্যা নয় তার কাছে । তিনি দেখলেন নদীর পাড়ে কয়েকজন ঢাকী ঢাক বাজিয়ে পূজো করছে । তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন । তাদের বাজনা বাজাতে নির্দেশ দিলেন । এদিকে তিনি সম্রাটের সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে চারদিকে পাঠিয়ে দিলেন  ৷ যতদূর পর্যন্ত ঢাকের আওয়াজ পৌঁছায় ততদূর পর্যন্ত  যাওয়ার নির্দেশ দেন সৈন্যদের । যেখান পর্যন্ত গেলে  ঢাকের আওয়াজ আর শোনা যাবে না সেখানে নিয়ে সম্রাটের নিশান পুঁততে হবে। এভাবেই মুগল বাদশাহর রাজধানীর সীমা নির্ধারিত হয়েছিল । বুড়িগঙ্গা নদীর যে স্থানটিতে  ইসলাম খাঁ বজরা ভিজিয়েছিলেন ,তাঁর নামানুসারে সেই জায়গার নাম হয় ইসলামপুর । আর ঢাকের শব্দে যে শহরের নাম নির্ধারিত হয়েছিল তার নাম রাখা হয় ঢাকা।

       ঢাক বাঙালির সংস্কৃতির এতটাই গভীরে পৌঁছে গিয়েছে যে , ঢাককে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি প্রবাদও বাংলা লোকসাহিত্যে প্রচলিত আছে । যেমন:-
     1.ধর্মের ঢাক বাতাসে     বাজে।
2. ঢাকি সহ বিসর্জন ।
3.নিজের ঢাক নিজে পেটানো/ ঢাক পেটানো ৷
4. ঢাক থুয়ে চন্ডীপাঠ।
5. ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি ।
6. গাজনের নাই ঠিকানা/ ডাক দিয়ে কয় ঢাক বাজা না।
7.  ঢাক ঢাক,গুড়গুড়।
8.  ঢাকে কাঠি দেওয়া ৷
9.ঢাকের বাঁয়া— ইত্যাদি

ঢাকের আওয়াজের তীব্রতার কিঞ্চিৎ সমালোচনাও রয়েছে বাংলা প্রবাদে। এই অর্থবাহী একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ পাওয়া যায় 'ঢক্কানিনাদ' ৷ বাংলায় রয়েছে—
       1.  ঢাকের বাদ্যি থামলে ভালো লাগে ।
ঢাকের আওয়াজ তীব্র হলেও তার মধ্যে যে প্রাণ আছে তার সাথে একাত্ম হয়ে যায় মানুষ । আপাতত কঠিন হলেও ঢাকের বোলকে মানুষ বিভিন্ন শব্দ গুচ্ছের মাধ্যমে সহজ করে নিয়েছে । ঢাকের 'বোল'কে শব্দসাজুয্যে বাঙালি ঘরে যেভাবে উচ্চারিত হয় তার দু একটি চমৎকার নমুনা নিচে তুলে ধরা হয়েছে যেমন:-
   1. ঢেমকুড়া কুড় কুড়
2. চড়াম চড়াম
এছাড়া ছড়ার  ঢং এ ঢাকের  বোলের অনুরূপ শব্দবন্ধ ।
     1. টেট্টে না টেং ,টেট্টে না টেং।
2 ল্যাংটা পটাং, ল্যাংটা  পটাং ইত্যাদি ৷
কিন্তু কথায় বলে -ঢাকের বোল মুখে বলা সহজ কিন্তু হাতে আনা কঠিন । কঠিন হলেও বাঙালির ঘরের একান্ত আপন ঢাক সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে । আগামী দিনে 'ঢাকের তালে কোমর দুলে, খুশিতে ভরে মন' এর মাধ্যমে বাঙালির লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে ৷ এই বিশ্বাসেই আমরা বাঁচি ৷
          

সমীর ভাদুড়ী

ভারতীয় দর্শনে গুরূশিষ্য পরম্পরা

ভারতবর্ষ মুনি ঋষির দেশ।আধ্যাত্মিকতাই এর প্রান।সুপ্রাচীন এই দেশ সত্য উপলব্ধির দেশ,সাধনার দেশ।এই মহা্ন সাধকদের দেশ ভারতবরসে্ গুরু শিষ্য পরম্পরা সেই প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবনে গুরুর স্থান একটা অবিসংবাদি কৌলিন্যের স্থান।এমন কোনো ধর্মমত বা ধর্মমপথ ভারতে প্রায় নেই যার গোড়ায় গুরুর প্রয়োজনীয়তা খুব দৃঢ়তার সহিত সমর্থিত হয়নি।অতএব গুরুতত্তে্র আলোচনা একটা অত্যাবশকীয় আলোচনা এতে সন্দেহ নাই।যে শক্তি দ্বারা মানুষ ঈশ্বরের পথ অনুভব ও আস্বাদন লাভ করতে পারে, তাহাই হল গুরুশক্তি।শিষ্য ঠিক ঠিক গুরু বাক্য পালন কালে যে কর্ম শিক্ষালাভ করে এবং নিজ বিশ্বাসে ও ভক্তির দ্বারা কর্মে গুরু শক্তির কৃপা পায়।কর্ম করতে করতে আপনা থেকেই নিরহংকার ও সেবাভাব মনে আসে।তখন পূর্ন মাএায় গুরুর চরনে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় শিষ্য।তখন গুরু শক্তি নিজে থেকেই শিষ্যের উপর বর্ষিত হয়।গুরুশক্তি শিষ্যের ভিতর কর্মের প্রকাশ ঘটায়।আর গুরুর শক্তি নিরবিকল্পে শেষ হয়।এখন প্রশ্ন হল গুরু কে?যিনি অন্ধকার দুর করেন,সংশয় দুর করেন তিনিই গুরু।গুরু অমর,তাঁর মৃত্যু নাই।ব্রহ্মই হল গুরু, সর্বভুতে তিনি বিরাজমান,সর্বএ তাঁর গতি ও স্থিতি।নিঃশ্বাসও প্রশ্বাসরূপে তিনিই আমাদের প্রান রক্ষা করেন।জলরূপে তৃষ্ণা নিবারন করেন,আহার্য্য রূপে ক্ষুধাগ্নি নিরবাপিত করেন।তিনি অখন্ড চৈতণ্য স্বরূপ।সদগুরু নিজেই একটা বিশ্ববিদ্যালয় যার জ্ঞান ভান্ডার থেকে আমরা জ্ঞান অর্জন করি।গুরু হলেন অভয়দাতা,সন্তাহারী,প্রানের প্রান আপনার জন।যতদিন শিষ্য উন্নত সংস্কারের অধিকারী না হবে,ততদিন তাঁকে উন্নত তত্ত দান করা গুরুর দায়িত্ব।গুরুর কাছ থেকে শিষ্যরা যে উদ্দীপনা ও যে প্রেরনা পায় তাকে বিশ্বজগতে ছড়িয়ে দেওয়ার নামই গুরু দক্ষিনা।যতটা স্বার্থ ত্যাগ গুরু আমাদের জন্য করেন ততটা স্বার্থ ত্যাগ আমাদের ও জগৎ কাল্যানের জন্য করতে হবে তবেই গুরু শিক্ষা স্বার্থক।সদ্ গুরু ও সৎশিষ্যের পরস্পরের সম্পর্ক বড় বিচিএ।কখনো এঁরা মাতা-পুএ,কখনো এঁরা ভ্রাতা-ভগ্নি,কখনো এঁরা সখা-সখী, কখনো এঁরা প্রভু-দাস,কখনো অভেদ সত্তা।ভালবাসার যতগুলি বিকাশ আছে সবগুলি ক্রমে ক্রমে এঁদের জীবনে ফোঁটে। সৎ শিষ্য পেয়ে সদ গুরু ভাবেন এমন শিষ্যের আমি যোগ্য নই,শুধু ভাগ্যগুনে পেয়েছি।সদ গুরু পেয়ে শিষ্য ভাবেন এমন গুরুর কৃপা লাভের আমি মোটেই যোগ্য নই,শুধু পূর্ব জন্মার্জিত পুন্যেরফলে লাভ করেছি- “শ্রী গুরু নির্ভরে শ্রীনাম উজ্জ্ব্ল, শ্রীনাম-নির্ভরে বুকে ভরা বল।’’ সৎ শিষ্য মনোময় উপচারে প্রানের আবেগ দিয়ে নিয়ত গুরুপূজা করেন,সদ গুরু শিষ্যকে ভগবানের প্রতিমুর্তি বোধে মনে মনে ভক্তির পুষ্পাঞ্জলি সমর্পন করেন- “ তোমারি কাজে হরি পেয়েছি যারে, তোমারি অবতার ভাবিয়া পায়ে তার প্রনতি করিয়াছি বারে বারে।’’ অনেকে দেখা যায় পিতৃমাতৃ দ্রোহী কিন্ত খুব গুরু ভক্ত,তারা ভন্ড। পিতৃদ্রোহী মাতৃদ্রোহী কার্যত গুরু দ্রোহীই। ধর্ম সনাতন শাশ্বত ও নিত্য।যে সকল আচার ব্যবহার গৌণভাবে মাত্র ধর্ম,এবং গৌণভাবে তারা শাশ্বত সত্যে জীবের অন্তরকে লগ্ন করার চেষটা করে বলে তারাই ধর্ম বলে সামাজে গৃহীত ও পূজিত। এইসব আচার ব্যবহারের মধ্যে যখন proportion and equilibrium এর অভাব ঘটে,তখন আচার ব্যবহারের পরিবর্তন সর্বজনিন ভাবেই প্রয়োজন হয়ে পরে।এরই নাম যুগ ধর্ম।সদ্ গুরু আমাদের দীক্ষা দেন।দীক্ষার মানে হল-rejuvenation of life বা আরো সত্য করে বলতে গেলে দীক্ষা হল-rebirth বা নবজন্ম।no one can take diksha if not inspired within by a zeal for a new life i.e rebirth.ভগবানের প্রকৃত নামে ডুবে যাওয়াই জীবের সবচেয়ে পবিত্র কর্তব্য।ঐ নামকেই দীক্ষা গুরু শিক্ষা গুরু জ্ঞাণ করা উচিত। নাম কত্তে কত্তে পরমাত্মার সেবায় জীবনোৎসরগের একনিষ্ঠ সংকল্প যখন এসে গেল জানতে হবে তখনই দীক্ষা হয়ে গেল।সাধারন বিচারে সাদা চোখে গুরু একজন শিক্ষক ব্যতীত আর কিছু নয় ।তিনি যা শিখেয়ছেন তা আমাদের শিখাচ্ছেন।তিনি যে সব কৌশল আয়ত্ত করেছেন তা অপরের কল্যান হেতু শিখাচ্ছেন।তিনি যে পথে চলেছেন ,সেই পথ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন।কলেজে ইতিহাসে এম.এ ইতিহাস পড়ান,এই দৃস্টিতে যখন গুরু কে দেখি তখন তাঁর প্রনামের মন্ত্র- “অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া। চক্ষুরূন্মীলিতং যেন তাস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ’’ এই অবস্থাতে তাঁর বন্দনা হবে- তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ। শাস্ত্রে কুলগুরুর থেকে দীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ আছে এবং পৈতৃক গুরুর কাছ থেকে ও দীক্ষা নিয়ে সকলে কুলগুরু গ্রহন করেছি বলে মনে করেন।কিন্তু পিতার গুরুর যিনি কন্যা বা পুত্র তিনি বাস্তবিক প্রস্তাবে হয়ত নিজ জীবনে সত্যের জাগরন অনুভব না ও করে থাকতে পারেন।এমন অবস্থাতে শিষ্যের মধুলুব্ধ ভ্রমরের নেয় পর্যটন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।কুলকুন্ডলীনী যাঁর জেগেছে তিনিই কুল গুরু,তিনি আমার পুর্ব পুরুষের গুরু না ও হতে পারেন,এমন কি হয়ত আমার পৈতৃক দাস-বংশে তাঁর জন্ম হতে পারে।কুলকুন্ডলীনী নীচ বংশে ও জাগতে পারে যথা-কবীর,রুহিদাস,স্ত্রী লোকে ও জাগতে পারে যথা-মীরাবাঈ,যমুনাবাঈ,সারদা মা।স্বগুন স্তরে শিষ্য গুরু কে প্রনাম করে- গুরুরবিষ্ণুঃ গুরুরেব মহেশ্বর বলে।নিরগুন স্তরে শিষ্য গুরু প্রনাম করে-গুরুরেব পরং ব্রহ্ম বলে।সগুন স্তরে শিষ্যগুরুকে প্রনাম করে-যস্মাৎ জাতং জগৎ সর্বং যস্মিন্নবে বিলীয়তে,যেন দং ধার্য্যতে চৈব বলে।নিরগুন স্তরে শিষ্য গুরুকে বন্দনা করে-ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞান মূর্তিং দ্বন্দাতীতং প্রভৃতি বলে।গুরু শিষ্যের এই পবিত্র সম্পর্ক আজ ও আমাদের এই মহান ভারতবর্ষে বিদ্যমান। “আমার গুরু তোমার গুরু, রামের গুরু শ্যামের গুরু, সবার গুরু একই গুরু, এই বোধেতেই সাধন শুরূ।’’ গ্রন্থপুঞ্জী-গুরু গীতা , অখন্ডসংহিতা,অমৃত সিন্ধু।

Monday, September 17, 2018

গোবিন্দ ধর

আনুয়াছড়া একটি ছোটনদী

আনুয়ারা বেগম ছড়াজলে পা ডুবিয়ে
প্রিয়সখার বুকে মাথা রেখে
একটু ঘুমাতে চেয়েছিলো।

চারজন নিরক্ষর তার স্বপ্ন কেড়েনিলো
জলের স্রোতের মতো
মিশে গেলো জলে মেয়েটি।

মেয়েটি জলে গুলে গেলো।

Sunday, September 16, 2018

সুস্মিতা রায়

সিলেবাসহীন

হাড় হীম করা এক ব্যস্ত শহরে
আগন্তুক আমি শীতঘুম আওড়াই,
আকাশপথে যে বীভত্স স্তব্ধতা
অক্ষত আমিই একমাত্র সাক্ষী!
পেন্ডুলামের মত দোল খাওয়া হৃদপিন্ডে প্রতিটা ভবিষ্যত সন্দিহান
ডাক্তারী ভাষায়,স্পটলেস হার্ট মানেই
মারাত্মক ফেভারেবল এমনটা নয় ---
অকৃতজ্ঞতা সিলেবাস ছাপিয়ে গেছে বহুদিন
ছাদ তবুও আকাশগঙ্গা মাপে নিজস্ব নিয়মে !

অমিত রুদ্র পাল

স্বপ্নে পরিভ্রমণ

নৈশ ঘুমের বাদে
যাওয়া হল স্বপ্নেরই দেশে,
কাল্পনিক এই স্বদেশে
মন চাঞ্চল্যকর বেশে।

ঘন কুয়াশা চোখের অস্পষ্টতায়,
দেখিলাম রমণীদের
স্বর্ণঘেরা পোষাক গায়।

অজস্র নির্মল উষসী কুঁড়ি ,
প্রেম জোয়ারে ভাসে
নৌক-তরী।

গাছের সবুজ প্রতিপন্ন
স্মৃতিকে করল ছিন্ন ভিন্ন ।
স্বচ্ছ নীলবর্ণের - নম্র ,
জলের সেই নদ
খুঁজে মন আকাশ-প্রপাত।

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...