Wednesday, September 19, 2018

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাঙালির জমজমাট জনপ্রিয় লোকবাদ্যযন্ত্র ঢাক
    

পহেলা বৈশাখ হোক,শারদীয় দুর্গোৎসব হোক কিংবা চৈত্রের গাজনের পরবে, বাঙালির উৎসব অনুষ্ঠানকে জমিয়ে রাখে ঢাক । এটি একটি জনপ্রিয় লোকবাদ্যযন্ত্র । বাংলার অন্যান্য জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্রের মতো এই বাদ্যযন্ত্রটিও অতি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক কালে  শুধুমাত্র পুজোর অনুষ্ঠান ও উৎসবকে ছাড়িয়ে অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়েছে । কালের প্রবাহে বহু লোকবাদ্য হারিয়ে গেলেও ঢাক তার শৌর্য গাম্ভীর্যে উত্তোরত্তর যেন আসনটি পাকা করে নিচ্ছে ।

    বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে অতি প্রাচীনকাল থেকে জড়িয়ে আছে । হিন্দুদের দেবদেবীর প্রতিমার হাতে শোভিত উপকরণ হিসেবে  বাদ্যযন্ত্রকে দেখা যায় ।যেমন বিষ্ণুর হাতে শঙ্খ, শিবের হাতে ডমরু ,শ্রীকৃষ্ণের হাতে মুরলি বা বাঁশি  এবং সরস্বতীর হাতে বীণা। এছাড়া দেবী দুর্গাসহ অন্যান্য আরো কয়েকজন দেবদেবীর হাতে বাদ্যযন্ত্র শোভা পায় ৷ মহাদেবের হাতে যে ডমরু শোভা পায় তাই বৃহদাকার ঢাক বা ঢোলের ক্ষুদ্র সংস্করণ । প্রাচীনকালে যুদ্ধ শুরু হতো ডমরুধ্বনির মধ্য দিয়ে এবং যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটত ঢাকের আওয়াজে ।

      মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তার ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের মধ্যে ঐতিহ্যমন্ডিত লোকজ বাদ্যযন্ত্রের ধারাবাহিকতা রয়েছে ।যুগে যুগে সভ্যতার যে ক্রমোন্নয়ন ঘটে তারই প্রভাবে লৌকিক বাদ্যযন্ত্রসমূহ কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে মানুষের ব্যবহারে এসেছে । আদিম মানুষ লৌকিক বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে যেমন আনন্দোল্লাস প্রকাশ করত তেমনি গগনবিদারী  আওয়াজসম্পন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে হিংস্র বন্য পশুদের তাড়ানো এবং বিপক্ষীয় গোষ্ঠীর আক্রমন প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঢাক,দুন্দুভিজাতীয়  লোকবাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করত । সেই থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিশাল ও গম্ভীর আওয়াজ সৃষ্টিকারী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত হয়।

       লৌকিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে বাঙালি জাতির বহু প্রাচীনকাল থেকেই পরিচয় ও সম্পৃক্ততা রয়েছে । সমুদ্রগুপ্তের আমলে খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকে (375-417খ্রি.) চৈনিক পরিব্রাজক ফা- হিয়েন বাংলাদেশ পরিভ্রমণ আসেন।এখানকার প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখে তিনি তার ভ্রমণকাহিনিতে এই দেশকে সঙ্গীত ও নৃত্যের দেশ বলে প্রশংসা করেন।পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রীধর্মপালদেব (781-881)খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকের শেষ দিকে তৈরি করেন পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর মহাবিহার । এই বিহার ধ্বংসাবশেষ এবং প্রাচীনভারতের বৌদ্ধ শাস্ত্র ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র ময়নামতি  (600-100 খ্রি.)র ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শন প্রস্তর ফলক এবং পোড়ামাটির ফলকে নৃত্যরত ও বাদ্যরত মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে । এই চিত্র গুলোতে কাঁসর, করতাল,ডমরু,ডঙ্কা প্রভৃতি আনদ্ধ এবং শিঙা, বাঁশি ,তুবড়ি প্রভৃতি শুষির বাদ্যযন্ত্র লক্ষ করা যায় ৷ বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে জড়িত এইসব বাদ্যযন্ত্র দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রভাবে  স্থান করে নিয়েছে বলে মনে করা হয় । খ্রিস্টিয় নবম একাদশ শতকে রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন গীত,নট,নৃত্য বাদ্যের বর্ণনা রয়েছে ।চর্যাপদের তিনটি পদ মোট সাতটি বাদ্যযন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে । এগুলি হল বীণা, পটহ ,মাদল ,করন্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডমরু ।

      বাঙালিদের অতি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ঢাকের নির্মাণশৈলী সমন্ধে জানা যায় যে, একটি বৃহদাকার কাঠের দুপাশে চামড়া ছাউনি দিয়ে ঢেকে ঢাক তৈরি করা হয় । এর দুদিকে দুটি মুখ থাকে ।  এক একটি মুখের ব্যাস দেড় হাত পরিমান । একদিকের মুখ পুরু চামড়া এবং অন্য মুখ অপেক্ষাকৃত পাতলা চামড়া দিয়ে  ছাওয়া হয়ে থাকে । পুরু চামড়া ছাওয়ার মুখটিতে বাঁশের চটি বা কাঠি দিয়ে ঢাক বাজাতে হয় ।

      বাংলার ঢাকের ও নানা নাম রয়েছে ।ঢাক ,জয়ঢাক, বীরঢাক ইত্যাদি ৷  আওয়াজ ও আকৃতির তারতম্য অনুসারে এই নামকরণ হয়ে থাকে । ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সুর ও ছন্দমূর্ছনা তৈরি করার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই ঢোল ও কাঁশি বাজানোর প্রচলন রয়েছে । ঢাককে প্রাচীনকালে 'ডঙ্কা' বলা হত । কিন্তু সে সময় ডঙ্কা  জালা আকৃতির মাটির পাত্র দিয়ে তৈরি করা হত । সাধারণত পাঁঠা বা ছাগলের চামড়া দিয়ে ঢাক,ঢোল,একতারা, তবলা-বাঁয়া ইত্যাদি বানানো হয় । কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তাতে বেশ পরিমান লবণ ছিটিয়ে সাত আটদিন ভিজিয়ে রাখা হয়। চামড়া থেকে লোম উঠে গেলে ভালো করে পরিষ্কার করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে টান টান করে রোদে শুকানোর পর সেই শুকনো চামড়াকে সাইজ মতো কেটে এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়।

      ঢাকের 'বোল' অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল । কিন্তু তার তাল ও আওয়াজ প্রাণকে ছুঁয়ে যায় এবং এক অদ্ভুত মাদকতা সৃষ্টি করে ৷ বিভিন্ন উৎসব ও তার বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ তালে ঢাক বাজানো হয়। দুর্গোৎসবে যে ঢাক বাজানো হয় সে ক্ষেত্রে দেবীর বোধনে,দেবীর ঘুম ভাঙাতে ,দেবীর পূজাকালীন ,দেবীর আরতিতে এবং সর্বশেষ দেবীর বিসর্জনে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকের বাজনার ভিন্নতা রয়েছে । ইদানিংকালে সেই বাজনায় আর তেমন ভিন্নতা দেখা যায় । তার কারণ ঢাকের বাজনা বংশ পরম্পরা ক্রমে পাওয়া । অভ্যাসের  মাধ্যমে প্রচলিত ৷ তার কোন সংরক্ষণ নেই । তাই কালস্রোতে তা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে । এই ঢাকের 'বোল' মহাদেবের সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করেন ঢাক বাজানোর সঙ্গে বংশ পরম্পরাক্রমে যুক্ত শিল্পীরা । কথিত আছে, বেদোত্তর যুগে পাণিনি তাঁর সমসাময়িক বৈদিক ও সংস্কৃতিক ভাষাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অষ্ঠাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেন ৷ এই নিয়ে প্রচলিত কথা রয়েছে যে , পাণিনি  হিমালয়ে গিয়ে আঠারো দিন গভীর তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন । এর ফলে সন্তুষ্ট হয়ে শিব নৃত্যের ভঙ্গিতে চোদ্দোবার ঢক্কা বা ঢাক বাজান ।প্রতিবার ঢাক বাজানোর সাথে সাথে এক একটি নতুন শব্দ সৃষ্টি হল । প্রতিটি শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি ।
    এখানে উল্লেখ্য যে শিবের নৃত্য ভঙ্গিমার যে মূর্তি তা  নটরাজ নামে পরিচিত ।এই নটরাজ মূর্তি ছন্দ ও তালের প্রতীক । ঢাকের শব্দ ও ছন্দ তালের প্রতীক । শিবের নৃত্যের ফলে বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে সৃষ্ট শব্দগুলোকে পাণিনি চৌদ্দটি  সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেন । এই চৌদ্দটি সূত্র 'শিব সূত্র' বা 'মহেশ্বর সূত্র' নামে পরিচিত । এই সূত্রগুলো এই পাণিনি ব্যাকরণের মূল তত্ত্ব । বলা হয় শিবের নৃত্যের মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দগুলোই ঢাকের 'বোল'।

       বাঙালির কাছে ঢাক এতটাই জনপ্রিয় যে , বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের  নামকরণের সাথে অনেকে ঢাকের সাদৃশ্য খুঁজে পান। ঢাকার নামকরণ নিয়ে একটি কাহিনিও  প্রচলিত রয়েছে । জানা যায় যে , 1608 খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে বজরা নিয়ে এবং রাজপুরুষদের সঙ্গে নিয়ে নদীপথে ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন সেই সময়ে শাসক সুবাদার ইসলাম খান ।  তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার রাজধানী স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন করা । জাহাঙ্গীরের কুশলী  সুবাদার জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাকে পছন্দ করে সেখানে নৌকা ভিড়ালেন । বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বিশাল খালি জায়গা দেখে তিনি এখানেই রাজধানী পত্তনের   সিদ্ধান্ত নিলেন । কিন্তু সঙ্গে অন্যান্য রাজপুরুষও পাইক পেয়াদারা জঙ্গলাকীর্ণ  হওয়ার এই স্থানটি  নির্বাচনে গররাজি হল । কিন্তু সুবাদার সিদ্ধান্তে অনড়। জঙ্গল কোনো সমস্যা নয় তার কাছে । তিনি দেখলেন নদীর পাড়ে কয়েকজন ঢাকী ঢাক বাজিয়ে পূজো করছে । তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন । তাদের বাজনা বাজাতে নির্দেশ দিলেন । এদিকে তিনি সম্রাটের সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে চারদিকে পাঠিয়ে দিলেন  ৷ যতদূর পর্যন্ত ঢাকের আওয়াজ পৌঁছায় ততদূর পর্যন্ত  যাওয়ার নির্দেশ দেন সৈন্যদের । যেখান পর্যন্ত গেলে  ঢাকের আওয়াজ আর শোনা যাবে না সেখানে নিয়ে সম্রাটের নিশান পুঁততে হবে। এভাবেই মুগল বাদশাহর রাজধানীর সীমা নির্ধারিত হয়েছিল । বুড়িগঙ্গা নদীর যে স্থানটিতে  ইসলাম খাঁ বজরা ভিজিয়েছিলেন ,তাঁর নামানুসারে সেই জায়গার নাম হয় ইসলামপুর । আর ঢাকের শব্দে যে শহরের নাম নির্ধারিত হয়েছিল তার নাম রাখা হয় ঢাকা।

       ঢাক বাঙালির সংস্কৃতির এতটাই গভীরে পৌঁছে গিয়েছে যে , ঢাককে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি প্রবাদও বাংলা লোকসাহিত্যে প্রচলিত আছে । যেমন:-
     1.ধর্মের ঢাক বাতাসে     বাজে।
2. ঢাকি সহ বিসর্জন ।
3.নিজের ঢাক নিজে পেটানো/ ঢাক পেটানো ৷
4. ঢাক থুয়ে চন্ডীপাঠ।
5. ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি ।
6. গাজনের নাই ঠিকানা/ ডাক দিয়ে কয় ঢাক বাজা না।
7.  ঢাক ঢাক,গুড়গুড়।
8.  ঢাকে কাঠি দেওয়া ৷
9.ঢাকের বাঁয়া— ইত্যাদি

ঢাকের আওয়াজের তীব্রতার কিঞ্চিৎ সমালোচনাও রয়েছে বাংলা প্রবাদে। এই অর্থবাহী একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ পাওয়া যায় 'ঢক্কানিনাদ' ৷ বাংলায় রয়েছে—
       1.  ঢাকের বাদ্যি থামলে ভালো লাগে ।
ঢাকের আওয়াজ তীব্র হলেও তার মধ্যে যে প্রাণ আছে তার সাথে একাত্ম হয়ে যায় মানুষ । আপাতত কঠিন হলেও ঢাকের বোলকে মানুষ বিভিন্ন শব্দ গুচ্ছের মাধ্যমে সহজ করে নিয়েছে । ঢাকের 'বোল'কে শব্দসাজুয্যে বাঙালি ঘরে যেভাবে উচ্চারিত হয় তার দু একটি চমৎকার নমুনা নিচে তুলে ধরা হয়েছে যেমন:-
   1. ঢেমকুড়া কুড় কুড়
2. চড়াম চড়াম
এছাড়া ছড়ার  ঢং এ ঢাকের  বোলের অনুরূপ শব্দবন্ধ ।
     1. টেট্টে না টেং ,টেট্টে না টেং।
2 ল্যাংটা পটাং, ল্যাংটা  পটাং ইত্যাদি ৷
কিন্তু কথায় বলে -ঢাকের বোল মুখে বলা সহজ কিন্তু হাতে আনা কঠিন । কঠিন হলেও বাঙালির ঘরের একান্ত আপন ঢাক সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে । আগামী দিনে 'ঢাকের তালে কোমর দুলে, খুশিতে ভরে মন' এর মাধ্যমে বাঙালির লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে ৷ এই বিশ্বাসেই আমরা বাঁচি ৷
          

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...