Wednesday, March 24, 2021

মনন স্রোত | একটি সৃষ্টিশীল মনোজগৎ

সম্পাদকীয়

অতিশয় পরিবর্তনের গাছে ফুলের পর ফল ধরেছে বলে পোকারা সংসার পেতেছে কোমড়ে।

কবিতাঘরে ঢুকে আলো করেছ যারা, তাঁদের কুর্ণিশ। মানুষেরা ভালো নেই। পাগলের মতো সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন যারা তাঁদের ভেতরঘরে কেউ ঢুকে দেখে আসে না আজ। আমরা যা দেখি, তাই বুঝি। এ এক রহস্যসন্ধানী দিন। মনন স্রোতের মার্চের সংখ্যাটি কিছুটা এমনই নির্বাচিত লেখার ক্ষুদ্র সংস্করণ। যারা লিখেছেন সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।

শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা-সহ
   জয় দেবনাথ
সম্পাদক, মনন স্রোত 

আসছে...

দিপিকা রায়

মনে পড়বে আমায়

অজানা ভিড়ে পিপাসার্ত কন্ঠ যখন, 
তপ্ত হবে রোদের শিখায়
ওই তীব্র রোদে
কখনো পড়বে মনে আমায়? 

বইমেলায় হারিয়ে যাওয়া
বইয়ের পাতায় খুঁজে বেড়াবে
আমায় যেদিন, 
মনের গহীনে আঘাতগুলো
ভিজিয়ে দেবে তোমার চোখের পত্রখানি । 
মাটির স্পর্শে একবিন্দু জলে
পাগল হয়ে করবে এলোমেলো, 
তবু আমার আমিটা যে
হারিয়ে যাবে। 

বন্দি ফ্রেমে স্মৃতির চিত্রপটে 
আমায় অনুভব করবে। 
পদতলে মূর্ছিত সবুজ ঘাসগুলো
উঁকি মেরে বলবে তোমায়, 
"সঙ্গহীন বন্ধু করে
একা পথের সাথী হলে"। 
তখন ওই মূর্ছিত ঘাসেই
অধীর হয়ে খুঁজবে আমায়। 

বন্ধুত্বের সাক্ষী সন্ধ্যার এই জ্যোৎস্নায়, 
একাকীত্বের চন্দ্রিমা ঘিরে
খসে যাওয়া একটা তারায়
আমার জন্য একদিন প্রার্থনা করবে। 

এপার ওপার আমার কন্ঠ, 
স্মৃতি হয়ে বাজবে তোমার কর্ণে। 
ঠোঁটের কোণে ওই হাসিটা
ভিজবে তোমার চোখের জলে। 

তখন হয়তো ঠিক মনে পড়বে, 
পড়বে মনে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুগুলোকে।

প্রসেনজিৎ সাহা

বসন্ত এসে গেছে 

বসন্ত এসে গেছে 
ফাগুনের মৃদুমন্দ হাওয়ায় 
বসন্ত এসে গেছে ।
কোকিলের কুহু কুহু কন্ঠস্বরে 
বসন্ত এসে গেছে 
কৃষ্ণচূড়ার লাল রং জানান দিয়েছে 
বসন্ত এসে গেছে ।
কিন্তু আজ ও আমি 
আমার বসন্তের অপেক্ষায়।
অপেক্ষা আমার প্রাণের সখার,
আজ‌ও এই বসন্তে আমি,
বিরহ বেদনা অনুভব করি।
তবুও বলছি বসন্ত এসে গেছে।
এসে গেছে , এসে গেছে,
প্রেমের ঋতু বসন্ত।
এসে গেছে,এসে গেছে,
বসন্ত এসে গেছে ।

প্রসেনজিৎ দে

প্রেমের গল্প ও তুমি

স্ট্রেংথ অ্যাঙ্গেল আঁকার মতো 
তোমার বর্ণনা করা সহজ হলে, 
আমি সম্মানিত হতাম প্রথম পুরষ্কারে। 
পশ্চাদভিমুখে গুছিয়ে রাখা চুলের
অভিমুখে, গাল জড়িয়ে ধৃষ্টতা দেখায় জুলপি।
চোখ বুঝলেই সন্ধ্যা নামবে, আলোই থাক।
একবুক কালো আকাশে তারা যেমন উঠে, 
তেমনি তোমার হাসিতে ঝরে পড়ে মুক্ত। 

অনন্ত অমলিন পদচিহ্ন জুড়ে উঠোন
তোমার আলতা গড়া পায়ের, আর 
নূপুরের ছন্দে গুঞ্জিয়মান সারাটা বাড়ি। 

তুমি ঘুমিয়ে গেলে অবচেতন মনে
এলোমেলো চুল সরিয়ে দেয়,
মেহেন্দির গন্ধে লেপে থাকা হাত। 

আর এভাবেই স্পষ্ট হয়ে উঠে
দিনের প্রতিটা সূর্য;
নতুন প্রেমের গল্প নিয়ে।

সংগীতা শীল

প্রেয়সী

সে এক অপরূপ তরুণী
যার স্বরে আমার হৃদয়ে ঢেউ তোলে,
স্রোতের মাঝে বিনা কারণে
হাসি লেগে থাকে ঠোঁটে।

যে পথে রাত্রি নামে
হাজার তারার জ্যোৎস্নায়
কখনো সোনালী রোদের ঝাঁকে
একগুচ্ছ বিষন্নতা নিয়ে
যন্ত্রনার আগুন নীলে
নানা মানুষের ভিড়ে
রাতের আধারে জোনাকি জ্বলে আর নেভে
সেই চার দেয়ালে বন্দি থাকে।

যে সবুজ নদীর বাঁকে ভাসেনি; নীলজলের পাহাড়ের চুড়া দেখেনি
শামুকের খোঁজে নোনাবালিতে হাঁটেনি,
তবুও স্বপ্নপুরীর মায়াজালে হারিয়ে যায়নি!
যখনই বসন্তের রঙ লেগেছে
দক্ষিণের জানলা খুলে
কথা বলে চাঁদের সাথে
মেঘেদের সাথে একলা দুপুর কাটে।

যদি ঝড় বয়ে যায় দুচোখ জুড়ে
ইঙ্গিত দিও!
কথা দিলাম,
কষ্ট তোমার কুড়িয়ে নেবো সব পরম আদরে।

বর্ষা দে

শ্রম শিশু 

ভগবানের প্রণয় নিষ্পাপ অমূল্য ধন।
দরিদ্র ঘরে জন্ম অভাগা তবে দশ মাস গর্ভে থাকা মায়ের রতন।
মাতা পিতার স্বপ্ন তবে,
স্বপ্নগুলি আজ নিশ্চুপ,
দরিদ্রতার চাপে।
তারপর,
 এরই চাপে কেটে যায় ১থেকে ৬বছর,
আজ সে বছর ৬ এর পাতায়।
দরিদ্রতার চাপে সে আজ পথ চলা শুরু করে রাস্তায়।
পথ চলা কালে সে এদিক ওদিক চায়।
দেখে,
হাজার শিশু তার মত আবার হাজার শিশু কাঁধে ব্যাগ বিদ্যালয়ে যায়।
তারই সমবয়সী একটি শিশু যখন।
তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মত্ত চকলেটের বায়নায়।
সে তখন মত্ত ৫ টাকা রোজগারের ভাবনায়।
সে তা শুনতে পাই, তারও চকলেট খাওয়ার ইচ্ছে জাগে।
কিন্ত ক্ষণিকের মধ্যেই পরিবর্তন করে তার এই ইচ্ছের শহর।
কারণ সে জানে চকলেট নয়।
বাড়িতে তার মাতা পিতা
দুটো ভাত এর অপেক্ষায় গুনছে প্রহর।
ব্যাস্ততার মাঝে মানুষ ছুটছে এদিক ওদিক।
একদিকে যখন শত শিশু ব্যস্ত ।
বিদ্যালয়ের আসা-যাওয়ায়।
ঠিক তখন অপরদিকে শ্রমিক শিশু লোহা পিটায়।

অতনু রায় চৌধুরী

বিশ্বাসী মানুষ

এই পৃথিবীর বুকে নিশ্চুপে হাজারো স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে,
সময় এগিয়ে যায় অপেক্ষার ফাঁকে।
শেষ বেলায় ক্লান্ত হয়ে জীবনের মানে খুঁজে,
কখন কে কীভাবে আঘাত করে সবটাই সে বুঝে।
তবুও সে হাসিমুখে সকলের সাথে চলে,
বিশ্বাসী মানুষ বড্ড কম এই অভিনয়ের শহরে।
মনে মনে সেও জানে,
মানুষ মানুষকেই ক্ষতি করে সুযোগ পেলে।

সুপর্না কর

আকাশ মাঝে 

 ঐ যে দেখো দূরে,
নীল আকাশের মাঝে।
চাঁদনি রাতে আলোর সুরে
লক্ষ তারা সাজে ।
আকাশ ভড়া কালো মেঘ
চলছে দোলে দোলে।
আকাশ মাঝে হাওয়ার বেগ
ভাসছে মেঘের কোলে।
আকাশমাঝে উড়ছে পাখি
বন্দী খাঁচা ছেড়ে ।
এরূপ দৃশ্যে সবার আঁখি,
খুশির জলে ভরে ।
আকাশমাঝে মেঘের ডাকে 
সূর্যি গেলো পাঠে ।
বসলো পাখি ঝাকে ঝাকে,
পদ্মা দিঘির ঘাটে।
পদ্মা দিঘির কালো জলে
পরলো চাঁদের আলো ।
আকাশমাঝে আলোর ছলে
পূর্ণিমা রাত এলো।

রামপ্রসাদ কুন্ডু

নারী তুমি পূজিত

তোমাকে ভালোবাসার নামে মনের কোণে স্থান দিয়েছিলাম তা অগ্রাহ্য করার সাহস 
তুমি কোথায় পেয়েছিলে? 
দিতে তো পারবে না কিছুই 
তবে কেন নিলেনা। 

বড় আশা করে বুকে সাহস নিয়ে 
তোমার হাতে দিয়েছিলাম ভালোবাসার লাল গোলাপ 
ফেরানো ঠিক হয়নি ভালোবাসার ফুল 
দেবীও অর্ঘ্য নিয়ে ফেরায়
দেয় মনের যত আশা, চাওয়া-পাওয়া 
তুমি তো নারী,
মানুষ এত কেন হিংসুক কেন? 
এত কেন বিভেদে সমাজে? 
কোথায় যাই এত মান-অভিমান
 যখন হও লাঞ্চিত..... 
 তবুও হে নারী তুমি পূজিত, ভালোবাসার। 

আলমগীর কবীর

ভালবাসি বাবা 

বাবা, এমন একটা শব্দ,
যে শব্দটার সাথে পৃথিবীর প্রত্যেকটা সন্তানের
একটা গভীর সম্পর্ক থাকে।
হয়তো অনেকের এই সম্পর্কটা
মধুর থেকে মধুরতম হয়ে থাকে।
আবার অনেকে এই সম্পর্কটার কথা ভুলে যায়! 
পৃথিবীর সকল সন্তানদের প্রতিই 
পিতা মাতার অবদান থাকে।
যা, কিছু সংখ্যক সন্তান লোভে পরে ভুলে যায়। 
একদিন ঠিক সেই সন্তানগুলোর 
এ সবকিছুই মনে পড়ে! 
কিন্তুু তখন আর কোনো কাজে আসেনা।
থাকেনা সেই মনে পড়ার কোনো গুরুত্ব।
হারিয়ে যায় যখন সে পিতা মাতা! 
তার সাথে সেইসব দুর্ভাগ্য সন্তানদের 
অনেক সুযোগও হারিয়ে যায়। 
পরে থাকে শুধু বাবা মায়েরই দিয়ে যাওয়া সব অবদান।
ভুলে যায় শুধু সে নাফরমান সন্তানগুলো।
যখন বুঝার আর কোনো মানেই থাকেনা,
তখন বুঝতে পারা যেন "ওলো বনে মুক্তা ছড়ানো"!

লিটন শব্দকর

ধুলোরঙ

এমনও ভেঙেচুরে বসন্ত আসে,
দুপেয়ে মাঠ, মায়াখেলার গলি।
সব ফোলা ফাঁপা মহল থেকে
ভেসে আসে বিকে যাওয়া মুখ-
হাসি ও সাজানো গানের কলি।

পূজা মজুমদার

সাধুবাদ

লিখ দেখ ভিতর নহে,

সেই রূপ অশেষ হয়েন নাই।

কেহ বিদ্যা ডিঙ্গা সম্প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে,পক্ক ভুবন উদরান্ন। ভগ্ন নিরুদ্বেগে।।

যত পরিমানে প্রদর্শনার্থে বশীভূত মানব।

আরম্ভ আস্তে  স্বকীয় দ্বার।

শুনিয়া  আরম্ভ   নতুবা পূর্বে   অরণ্যদান।

সৈকত মজুমদার

কেমন মনে হয়

অনেক দিন পর
আমাদের কথা হয়,
আগে রোজ চ্যাট করতাম
অনেক গভীরতম কথা শেয়ার  
করা দুজনের স্বাভাবিক ছিল। 
এখন আর আগের মতো 
কথা হয় না, শুধু 
একে অপরের স্ট্যাটাস দেখি। 

সেদিন কেমন আছ?
জিজ্ঞাসা করতেই-  
উত্তর ভেসে আসে,
“কেমন মনে হয়..."

কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করি
তারপর অভিমানী উত্তর দিলাম,
দেখে তো মনে হয় খুব সুখী এবং...

কিছু কথা বলার ছিল, কিন্তু বলিনি
আবার অফ লাইন দুজনে। 

টিটু বনিক

জোয়ার -ভাটা

জোয়ার উঠে মোর চিওে
মন প্রাবরন তোমার আসক্তে 
ক্লেশের স্রোতে হৃদয় শূলানি 
সংগুপ্ত চেতনা আজ সন্ধান হয়নি।
অষ্টপ্রহর ধরে লোচনে নেই বিনিন্দ্র
আমি চাই একটু প্রশান্ত 
বিভ্রান্তিকর মনোহারিত্ব আসে যখন ঐই পাড় থেকে 
আমি তখনি-তখন সংগ্রামে নেমে পড়ি।
ভাটা নাহি আমার চিত্তের ইচ্ছাবৃওি 
জোয়ার দেয়না প্রশান্তি
ব‍্যথা আমাই জীবিত করে 
তোমার আকঁশি আমাই দৃঢ় করে 
আমাই অটল করে 
আমাই সক্ষম করে 
আমি  আজীবন নিরন্তর জীবন 
তোমার ভালোবাসার মননের এক আসক্তি।

বিটু মজুমদার

তোমাকে মনে পড়ে

জীবনটা অপূর্ণতার
আঘাতে হোচট খায় বারবার ৷
বিশ্বাস করো প্রিয়তমা তোমাকে ঠিক
ততোটাই ভালবেসেছিলাম, অনেকেই এর
আগে পারেনি কেউ ।
জানি না কতটা নেশায় চূড় হয়ে আছি আমি ৷
হয়তো অ্যালকোহলেও অতটা মাদকতা নেই,
যতটা ছিল তোমার প্রেমে ৷
তুমি আসবে বলে আমার প্রতিটা প্রহর কাটে অপেক্ষায়,
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ লগ্নে, আজ ভীষণ ভীষণ ভাবে
মনে পড়ছে তোমাকে, শুধু
তোমাকে।

সজীব পাল

আলো দিয়েছে অন্ধকার
                            
"দাদা ওই দেখ একটা লোক আসছে, উনাকে জিজ্ঞাসা করি শ্যামল মিত্রের বাড়ি কোনটা? "

"না! তোকে বারন করেছি না রাস্তা ঘাটে বাড়তি কথা বলবি না প্রয়োজন হলে আমি জিজ্ঞেস করব? "

" কিন্তু দাদা  কাউকে জিজ্ঞেস না করলে বাড়িটা খুজেঁ পাবি কিভাবে?"

     আমি আর কোনো কথা বলছি না। চুপচাপ পুবে একটা চিকন পাকা রোড ধরে হাঁটছি ।জায়গাটায় কেমন যেন অদ্ভুত শান্ত স্নিগ্ধ জড়ানো ।আশি কিংবা নব্বই এর দশকের পথ এই একবিংশ শতাব্দীতে ভুলে হয়তো রয়ে গেছে।আধুনিক ধূসর বর্ণ এই পথের শরীর স্পর্শ করতে পারেনি।দুধারে কত বাহারি গাছ বাহাদুর রাজার মত টান টান শিরধারা তুলে দাড়িয়ে আছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ছবি তুললাম, প্রকৃতির  যৌবনের। আহা কত শান্তি এই রূপে! 
আমরা রাধানগর এসেছি। আমাদের এক দূর সম্পর্কের মাসির বাড়ি যাবো। কিন্তু বাড়ি চিনি না। ওরা এখানে আসার পর আমাদের আর আসা হয়নি। মাসির কোনো ছেলে মেয়ে নেই। মেসো চাকরির করেন জেল পুলিশের। মাসি ফোনে বলেছেন সে এখন আছেন সোনামুড়া জেলে। নয়তো মেসোই আমাদের বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে যেতেন। মেসো বড্ড হাস্য রসিক মানুষ। 
মিনিট তিরিশ হাঁটার পর এক জন্য লোককে  বলে মেসোর  বাড়ির ঠিকানাটা জেনেছি। 
মাধুবী মাসি আমাদের দেখে ভেবেছিলাম বিস্মিত হবেন। ছুটেএসে তিন্নিকে কোলে নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে চুমু খাবেন। কিন্তু এর কোনোটাই হলো না। মাসি বারান্দায় হাতলযুক্ত একটা সেকালের কাঠের চেয়ারে বসে পানের বাটা থেকে পান বানাচ্ছে। আমরা উঠানে এসে দাড়াঁতেই এক নজর শহরি দৃষ্টিতে দেখলেন।বললেন, " আয় ঘরে আয়। "
সেই মাসি আর এই মাসিতে হিউজ তফাৎ। বয়সের সাথে বোধহয় অন্যের প্রতি ভালোবাসাটাও ক্ষীণ হয়ে আসে। তখন মানুষ নিজেকে স্নেহ করে, ভালোবাসে। আর এইটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম।

     জায়গাটা সত্যিই অসাধারণ। প্রকৃত গ্রামের গন্ধ পাওয়া যায় এখানকার বাতাসে।বিকালে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পটিলা নামে একটা মাঠে এসেছি। দীর্ঘ বিস্তৃত মাঠ। একপাশে ছোটছোট ছেলেরা ক্রিকেট বল খেলছে।আর নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। এখানকার আঞ্চলিক ভাষাটা বেশ লাগে শুনতে।একজন আরেকজনকে ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, " কিরে কনাই গেছত গৈ? বল এমুই দিই যাগোই যে তুই দেয়র না না কিতা! "
ইচ্ছে করছে এদের সাথে কথা বলি। কিন্তু আমার চিন্তাই সার। যত বকবকানি নিজের সাথেই। মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারি না।অপরিচিত কারোর সাথে সঙ্গে কথা বলার সময় , কোনো শব্দই মস্তিষ্কে থাকে না।নিঃসঙ্গ পাখির মতো নিঃশব্দ হয়ে যাই।

রাতে খেতে বসে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তিন্নিকে কোলে নিয়ে মাসি খাওয়াচ্ছে। মৃদু হেসে বললাম, " মাসি তিন্নি কি সে ছোট্টটি নাকি যে তাকে  বেশ আমোদ করে কোলে বসিয়ে খাবাচ্ছ? "
আমার মাধুবী মাসির হাসিতে জ্যোৎস্নার আলো ঝরে। মাসি যৌবনে কি যে রূপবতী ছিলেন! এখন অবশ্য রূপের কিছু ভাটি পরেছে।কিন্তু সেই মালিন্যহীন স্বচ্ছ হাসিতে বার্ধক্য ছুঁতেই পারেনি। ঠোঁটগুলো অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকিয়ে হাসলো।এবং বলল, " আপনাকেও কি কম খাবাইছি বাপজান!"
খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে প্রায় দশটা বেজে গেছে। গ্রামাঞ্চলে দশটা মানে নিশি রাত।গল্প গুজব ভালোই হল। তিন্নির ঘুমে চোখ টলমল করছে দেখে মাসি তাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে আসে। তারপর বারান্দায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে মাসি যে কথাগুলো বলল, সেই কথাগুলো শুনে রক্তের অদ্ভুত শীতলতায় সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল।আমি যেন মাসির  অন্তর্নিহিত দীর্ঘ একাকিত্ব ও অপেক্ষায় চাপা পড়া কান্নার গোপন শব্দ শুনতে পেলাম। 
মাধুবী মাসি এখানে একাই থাকেন। গত বছর জৈষ্ঠ্য মাসের কথা। প্রচন্ড বৃষ্টি। আকাশের কালো মেঘ সেদিন মাসির কাল হয়ে ঝরেছিল। দুপুর আড়াইটা বাজে। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে একজন অপরিচিত বৃদ্ধ মহিলা বারান্দায় এসে আশ্রয় চাইলো। বয়স ষাট কি বাষট্টি। কুচকে যাওয়া অমসৃণ ত্বক। ধবধবে চুল। ভিজে শরীর মুছার জন্য মাসি তাকে একটা গামছা এনে দেয়। মহিলাটি শরীর মুছতে মুছতে বলল, " তোর স্বামীর নাম শ্যামল মিত্র মা? "

মাসি ক্ষাণিকটা অবাক হলেন। শান্তভাবে উত্তর দিলো, " হ"

" গতকাল যে তোর সাথে ঝগড়া করে তোর স্বামী বাড়ি ছেড়ে গেল এখনও সে ফিরে নি, অথচ একটা খবর পর্যন্ত নিলি না তার! কোথায় আছে সেই এখন?

মাসি বিস্মিত হয়ে বললেন, " আপনে এই খবর কিভাবে জানলেন? কে আপনে? "

বৃদ্ধ মহিলা কোচকানো ঠোঁটে বিজ্ঞের মতো হাসল কিন্তু কিছুই বলল না। সে যেন তার পরিচয় গোপন রাখতে চায়। 
মাসি এই হাসি দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। বৃষ্টির শব্দ গুলো কি অদ্ভুত। মাসি এবার উত্তেজিত হয়ে বললেন, "চুপ করে আছেন কেন! বলুন সে কোথায়? "

মহিলাটি হাসতে হাসতে বৃষ্টির মধ্যেই চলে যাচ্ছে। আর শুধু একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে, "সে আর আসবে না! সে আর আসবে না! সে অনেক দূর চলে গেছে। সেই ঠিকানা পাখি ছাড়া আর কেউ ছাড়া জানে না। "

তারপর কত খোঁজ কত পুলিশ কাচারী করল , কিন্তু কেউ মাসির মনের মানুষটিকে খুজে এনে দিতে পারেনি। পৃথিবীর মতন একটা নারীর শোক কতটা গভীর হলে যে এমন গোপনে কাদঁতে পারে শুধু ঈশ্বর  জানেন। 
আমার মাধুবী মাসি দারুণ অভীমানি নারী। এত বড় ঘটনার কথা কোনো আত্মীয় স্বজনদের কাছে জানায়নি।সে একা এই সমুদ্র যন্ত্রণা ভোগ করছে। মানুষ এমন এক নিষ্ঠুর জাতি,যে তাকে যতবেশি ভালোবাসবে তাকে সে ততই বেশি পোড়াবে। এই পোড়ানো চিতার আগুন;যেন জন্ম জন্মান্তরেও নিভে না।

সকালে আমি আর তিন্নি বাড়ি ফেরার জন্য বাসে বসে আছি। মাসি দাঁড়িয়ে আছে জানলার কাছে। মিনিট কয়েক পরে বাস ছেড়ে দিয়েছে। তিন্নি জানলা দিয়ে মাথা বের করে মাসিকে দেখলো। তারপর আমাকে বলছে. " দাদা মাসি কাঁদছে, দেখ না মাসি কাঁদছে। "
কাঁদুক। এই কান্না তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমার মস্তিষ্কের ভেতর কে যেন অনবরত আওড়াচ্ছে, " এখন  হঠাৎ কান্না এলে জানলা খুলে দিও! /আমার হঠাৎ মৃত্যু হলে জন্মকেই দায় দিও? "

মিঠুন দেবনাথ

প্রকৃতির থেকে শিক্ষা
                                             
পিঁপড়ে ,পিঁপড়ে, পিঁপড়ে ,
পিঁপড়ে শিখিয়েছে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে।
পিঁপড়ে, পিঁপড়ে ,পিঁপড়ে ,
পিঁপড়ে শিখিয়েছে সংগ্রাম করে চলতে। 

পাখি, পাখি, পাখি ,
পাখি শিখিয়েছে একইসঙ্গে চলতে। 
পাখি ,পাখি, পাখি ,
পাখি শিখিয়েছে মন খুলে নাচতে । 

পশু ,পশু ,পশু ,
পশু শেখায় ভালোবাসা বলতে। 
পশু ,পশু ,পশু ,
পশু শেখায় উদ্যম গতিতে চলতে। 

ফুল, ফুল, ফুল ,
ফুল শেখায় ধীরে ধীরে ফুটতে। 
ফুল, ফুল, ফুল ,
ফুল শেখায় আনন্দ ও ভালোবাসায় ছুটতে। 

নদী, নদী, নদী, 
নদী শেখায় অচিন দেশে ঢলতে। 
নদী,নদী, নদী, 
নদী শেখায় আপন বেগে চলতে। 

পাহাড়, পাহাড়, পাহাড় ,
পাহাড় শেখায় উঁচু ,মহান হতে। 
পাহাড়, পাহাড়, পাহাড়, 
পাহাড় শেখায় নিস্তব্ধতায় থাকতে। 

ঝর্ণা, ঝর্ণা, ঝর্ণা ,
ঝর্ণা শেখায় অন্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে। 
ঝর্ণা,ঝর্ণা, ঝর্ণা ,
ঝর্ণা শেখায় পাহাড়ে অসহায় গাছকে বাঁচাতে। 

গাছ, গাছ, গাছ, 
গাছ শেখায় মাথা উঁচু করে বাঁচতে। 
গাছ,গাছ, গাছ ,
গাছ শেখায় স্নিগ্ধ মধুর বাতাসে সাঁজতে ও
গাছ শেখায় প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে। 

চাঁদ, চাঁদ, চাঁদ ,
চাঁদমামা শেখায় মধুর কথা বলতে।
চাঁদ, চাঁদ, চাঁদ, 
চাঁদ শেখায় অন্ধকারে নিমজ্জিত আলো দিতে। 

সূর্য্, সূর্য্,সূর্য্,
সূর্য্ শেখায় সময়ের মূল্য দিতে। 
সূর্য্,সূর্য্ ,সূর্য্,
সূর্য শেখায় আপন তেজে জ্বলতে। 

মানুষ, মানুষ, মানুষ, 
মানুষ শেখায় বৃদ্ধি,সুখ,শান্তি ও ভালোবাসা। 
মানুষ, মানুষ, মানুষ ,
মানুষ শেখায় পৃথিবীর বুকে মানিয়ে চলতে হয়,
মানুষ শেখায় কিভাবে শান্তি ও মুক্তি পেতে হয় ও 
মানুষ শেখায় কিভাবে একতা ও সমতা আনতে হয়।

কবিতা সাহা

মা

আবির ও তৃষা এখন খুবই খুশি। বহু প্রতীক্ষার পর, শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, তাদের দীর্ঘ সাত বছরের ভালোবাসা গতরাতে পূর্ণতা পেলো। পারিবারিক সমর্থনে সামাজিক রীতিনীতি মেনে, গত রাতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো দুজনে। বাবা মায়ের  একমাত্র মেয়ে তৃষা। ছোট থেকেই অনেক আদর যত্নে বড়ো হয়ে উঠেছে,বলতে গেলে কাজকর্ম কিছুই পারে না সে। তাই শ্বশুর বাড়িতে আসার আগে থেকেই একটু ভয় কাজ করছিল তৃষার মধ্যে। যাইহোক আজ তাদের জীবনের এক বিশেষ দিন, আজ তাদের বৌভাত।তাই মন থেকে সব আশঙ্কা দূর করে,তৃষা ভাতকাপড় অনুষ্ঠান শেষে নিজ ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় স্পৃহা অর্থাৎ তৃষার ননদ দরজায় এসে কড়া নেড়ে বললো— বৌদি তোমাকে মা নীচে যেতে বলেছে। সাথে সাথেই স্পৃহার সঙ্গে নীচে নেমে এলো তৃষা। তৃষাকে ডেকে শাশুড়িমা বললেন—বৌমা আজ তোমাকে রান্না করতে হবে। এই বাড়ির পুরোনো রীতি, বাড়ির নতুন বৌ নিজ হাতে রান্না করে দুপুরে সকলকে খাওয়াবে। এই কথা শুনা মাত্রই তৃষার পেট চিপতে লাগলো,সে যে কিছুই রান্না করতে পারে না। আবার নতুন বৌ মুখের উপর নাও করতে পারছে না । স্পৃহা যদিও তৃষাকে বলেছিল— বৌদি চলো আমি তোমাকে সাহায্য করে দেবো, কিন্তু শাশুড়ি মার কড়া আদেশ অন্যকিছু না হোক, পায়েসটা আজ তৃষাকে একাই রান্না করতে হবে, বাকিগুলো রান্নার মাসি করে দেবে। আশঙ্কিত মনে তৃষা রান্নাঘরে গিয়ে রান্না শুরু করলো এবং এর ঘন্টা দুয়েক পর  পরিবারের সবাই খাওয়ার টেবিলে একত্রিত হলো।আজ নিয়ম মতো নতুন বৌ-এর হাতের পায়েস দিয়েই খাওয়া শুরু করবে সবাই। তৃষাও পায়েস হাতে হাজির, কিন্তু ওর মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করছে, কারণ আজই জীবনে প্রথমবার পায়েস রান্না করেছে তৃষা। যাইহোক একে  একে সবার পাতে তৃষা পায়েস তুলে দেয়। পায়েস প্রথমেই মুখে তুলে নিল আবির, তৃষা তীর্থের কাকের মতো আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কেমন হয়েছে জানার জন্য, কিন্তু আবিরকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না আবিরের মা, আবির বলার আগেই তিনি মুখে দিয়ে বলে উঠলেন বৌমা এ তো অসাধারণ, খুব ভালো খেতে হয়েছে,কিগো আবিরের বাবা, স্পৃহা তোমরাও খাও। তৃষার শ্বশুর মশাইও পায়েস খেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে তৃষাকে বললেন মা তুমি স্বয়ং অন্নপূর্ণা। একথা শুনে তৃষা এবার একটু ভয়মুক্ত হলো। এবার তৃষাও খেতে বসেছে, সবার মতো সেও পায়েস দিয়েই শুরু করবে ভেবে পায়েসের বাটি হাতে নিতেই শ্বশুর মশাই বলে উঠলো— মা আমাকে আর একটু পায়েস দাও।ওনাকে পায়েস দিয়ে,তৃষা খাবে বলে বাটির দিকে হাত বাড়াতেই,শাশুড়িমা টেনে নিয়ে আরো কিছুটা পায়েস খেয়ে নিলো, এখন তৃষা মনে মনে ভাবছে—মা তো মা'ই হয়, নিজে খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, কিন্তু.... শাশুড়িমা!!! যাইহোক আর একটুমাত্র পায়েস বাটিতে পরে আছে,সেটাই তৃষা খাবে ভেবে নিতে গেলে আবির তা চেয়ে বসে। তৃষা এটা অন্তত  বিশ্বাস করতে পারছিল না। আর কেউ না জানুক, আবির তো জানে তৃষা পায়েস খেতে কতটা ভালোবাসে, কিন্তু তারপরও আবির এমনটা করতে পারলো কিভাবে। টলমল চোখে তৃষা অন্য কিছু খেয়ে উঠে পরে। এমন সময় রান্নাঘর ঘোচাতে গিয়ে কাজের মাসি রান্না ঘর থেকে ডেকে বলে- গিন্নিমা টেবিলের উপর রাখা নুনের বয়াম টা কোথায়? এখানেই তো রেখেছিলাম। একটু থতমত খেয়ে আবিরের মা বলতে লাগলো—আরে আস্তে বল ঝুমা আস্তে বল বৌমা শুনতে পাবে। তুই যা, নুনের বয়াম আমি রেখেছি। পর্দার আড়াল থেকে তৃষা একথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে বুঝতে পারে তার সমস্ত ভাবনা ভুল, শাশুড়িরা শুধু শাশুড়ি না, মা-ও হতে পারেন, আমাদের ভাবনা সবসময় ঠিক হয় না, সবাই এক নন। চিনি ভেবে তৃষা এক বয়াম নুন দিয়ে যে পায়েস রান্না করছে কোনো ভাবেই তা খাওয়ার যোগ্য না, তা সত্ত্বেও সকলে কোনো অভিযোগ ছাড়াই, ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সেই পায়েস হাসিমুখে খেয়েছেন।

রূপন মজুমদার

জীবনের ধারাপাত 

দুচোখ খুলেই দেখি,,,
প্রলম্বিত হাহাকারের গুঞ্জন সম্মুখে!
নিত্যদিনের অভ্যাসগুলো ফেরি করে কিছু রঙ।

ফ্যাঁকাসে পোস্টারে ঢেকে রাখি নিজেদের লাশ।
রক্তমাখা পায়ে,পদরেণুর কাছে...
লিপিবদ্ধ হয় বেলাশেষে যত অভিযোগ।

মাঝ পথে দেখি,বাবার মতো কেউ,
হাতের তর্জনী ধরে হাঁটতে শেখায়,
লড়তে শেখায়,সূর্যটা দেখিয়ে বলে;
ওখানেই লুকিয়ে আছে জীবনের সব রঙ!

আর,  হাঁটতে হাঁটতে বলি হয় সেই জীবনের ধারাপাত।

কিন্তু জানা হয় না;
আরও কত যোজন পথ হেঁটে গেলে, 
বন্ধ হবে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ!

নীলাঞ্জনা দেবনাথ

কবিতা

আমি তোমায় ভালোবাসি 
প্রথম প্রেমিকের মতো 
যে মিশে যায় হৃদয়ের অনুভূতির সাথে
রক্তের স্রোতে--

আমি তোমায় ভালোবাসি 
পাখির ডানার মতো
যা তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরে, বহুদূরে

আমি তোমায় ভালোবাসি 
কৃষকের লাঙলের মতো
যাকে ঘিরে তারা স্বপ্ন দেখে নবান্নের

আমি তোমায় ভালোবাসি 
বেকারের চাকরির প্রতিক্ষার মতো
যার কোনো অন্ত নেই, 

আমায় ঘিরে আছো 
পাহাড়ের গায়ে সন্ধ্যের মিশে যাওয়ার মতো
দিগন্ত রেখায় সূর্যের বিলীন হওয়ার মতো।

তোমাতে ডুবে বাঁচতে যাই হাজার বার মরে গিয়েও
তোমায় আমি ভালোবাসি কবিতা... 
তোমায় আমি ভালোবাসি।

দেবাশিস চৌধুরী

চতুর্দশপদী কৈফিয়ত

আমাকে ভুলে যে নগরী সাজসজ্জায় ব্যাস্ত
যুগে যুগে আকুল কন্ঠে তার মঙ্গলগান গাই
তার বাসভবনে অনাহুত অবহেলিত আমি
তবুও বেহায়ার মতো গেছি, কিছুই ভুলি নাই।
জয়ধ্বজার বাঁশের খুঁটি বয়েছে আমার কাঁধ
তার সকল ক্ষয়িষ্ণু সত্ত্বা ছবি হয়ে আছে রাতে
আমি কেবল কীর্তনে ভেসেছি রাধামুখর দিনে
শ্রীদাম সুদাম ধাম বসুধাম সব ছিল উৎপাতে।
তুমি বুঝোনি সেদিন;  তুমি বুঝো না কখনও 
ভেবে দেখেছো, এ রাত নষ্ট দিনের চেয়ে ভালো 
যেখানে গণধর্ষণ হয় গণতন্ত্রের! শুনো তখনও
ভালো ছিল, তোমার ভাষায় আঁধার বলা কালো।
আমি না হয় ভুল ছিলাম--- তুমি দেখোনি কেনো
জোনাকিরা ভীড় করছিলো তাঁড়ালে কেনো বলো।।

দীপক দাস

নারীর অতীত ও ভবিষ্যৎ 

বর্তমান ভারতে যে সমস্যা  মারাত্মক  ব্যাধির আকার নিয়েছে  তা হল নারী  নির্যাতন।এই কাব্য আলেখ্য  সেই সমস্যাকে ছুঁয়ে  দেখবার সামান্য  প্রয়াস। নারী সম্পর্কে  নজরুল  বলছেন 
  "বিশ্বে যা কিছু  মহান সৃষ্টি  চির কল্যাণকর
 অর্ধেক  তার করিয়াছে  নারী,অর্ধেক  তার নর"
অথচ যুগ যুগ ধরে  নারী নির্যাতনের শিকার।রামায়ণ  মহাভারত  ভারতের  দুই  প্রাচীন  মহাকাব্যের কেন্দ্রীয়  দুই  নারী চরিত্রই পুরুষ  কর্তৃক নারী নির্যাতনের চরম দৃষ্টান্ত। একবার  নয় দু-দুবার সীতাকে  অগ্নি পরীক্ষার  মধ্য দিয়ে  সতীত্বের পরীক্ষা দিতে  হয়েছে, তবে রামচন্দ্রের  জন্য  কেন নেই  অগ্নি পরীক্ষার  ব্যবস্থা?দ্বিতীয়বার  অগ্নি পরীক্ষার  জন্য  আহুত  হলেন সীতা।
"উঠে  দাঁড়ালেন  সীতা/তারপর অগ্নি কুন্ড থেকে মুখ  ফিরিয়ে /পিছনে রেখে জনতার কৌতূহল /ব্রাহ্মণদের সর্বজ্ঞ  দৃষ্টিপাত/রাজপুরুষদের চকিত  ব্যস্ততা  আর/ইক্ষাকুতিলক রামচন্দ্রের  উত্কন্ঠা/হেঁটে  এলেন  রাজসভার বাইরে /কৃষ্ণা ধরিত্রীর বুকে কিছুক্ষণ  দাঁড়িয়ে  রইলেন /তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা নারী/সামনে আদিগন্ত মাঠে শস্যের সোনালি  আভা/ওইখানে  তাঁর  জন্মের  পরিচয়/ওই কালো মাটির  বাসার দিকে /এগিয়ে  যান তিনি /দুহাত বাড়িয়ে  মাটি বুকে টানে/মাটির  কন্যাকে"।
তীব্র  অভিমানে  সীতা মাটির  বুকে আশ্রয় নেয়। মহাভারতের কেন্দ্রীয়  নারী চরিত্র  দ্রৌপদীকে রজঃস্বলা  অবস্থায়  টেনে  আনা হয় রাজ সভায়-
  " টেনে  ধরলেন  চুল,দুঃশাসন  এসে/সেই  মেঘবর্ণ   চুল যেখানে  ফাল্গুন মুখ বুজে শুয়েছিল  নরম নিশীথে/কন্দর্প নিন্দিত  কান্তি ভীমসেন এইচুলে খেলা করতেন /এই চুলের  সুগন্ধে স্নায়ু শান্ত রাখতেন  রাজা যুধিষ্ঠির /দুঃশাসন সেই  চুল টানতে  টানতে /এনে প্রকাশ্য সভায় দাঁড় করালেন /এক অসূর্যম্পশ্যা  মহিষীকে"।
তোমরা পুরুষেরা বাঁ হাতে ঠেলে  অন্দরে পাঠাও ডানহাতে  তোমরাই  গা থেকে  কাপড়  টেনে খুলে নাও উন্মুক্ত  বাজারে। 
মধ্যযুগের মনসামঙ্গল  কাব্যের  নায়িকা  বেহুলাকে মনে করুন-কিসের বিনিময়ে  সে ফিরে  পেল তার স্বামীর প্রাণ -শুনুন তার কথা
  " হে দেবতারা/আজ তোমাদের  সামনে এসে দাঁড়িয়েছি এই বলে/ফিরিয়ে  দাও এই শবের প্রাণ / ভিক্ষা  নয়, বিনিময়ে  দেব তোমাদের  যা কাঙ্খিত / বানিজ্যের  শর্তে / তোমরা  দেবে প্রাণ, আমি দেব,আর কিছু  নেই, তাই / আমার যৌবন/ দেবতারা প্রস্তুত হও/এই আমি ছিড়েঁ ফেলছি/আমার স্তনাংশুক /এই ছুঁড়ে  ফেললাম সব আভরণ / আর একবার মুহূর্তের জন্য  অবরুদ্ধ  করো দৃষ্টি / আমি  নগ্ন করলাম আমার   শরীর / আর এই নামিয়ে রাখলাম  মৃতদেহ / ওঠো জেগে ওঠো,মৃত,আমার  স্বভূমি / আমার নতুন জন্মের  আশ্রয় / জাগো লখিন্দর  জাগো"।
বেহুলা তার পরমপ্রিয় পুরুষের  জন্য  পুরুষদের  কাছেই  দিতে হল নারীর  শ্রেষ্ঠতম সম্পদ।
এই নির্যাতনের  ধারাবাহিকতা  আজও বহমান।বাংলাদেশের  একজন লেখিকা শুধু  মেয়েদের অধিকারের  কথা বলতে গিয়ে  দেশ থেকে বিতাড়িত  হয়েছেন।অথচ লেখিকা তসলিমা নাসরিনের  কবিতায়  বাংলাদেশের  প্রতি  অকৃত্রিম  ভালোবাসাই প্রকাশিত হয়েছে। দূর  প্রবাসে রাত্রির  বুকে মাথা রেখে বাংলাদেশের  কথা ভাবতে ভাবতে  কত বিনিদ্র রাত  তার কেটে যাচ্ছে  কে রাখে তার খবর?
"ভাত মাছ নিয়ে  আজকাল  ঘনঘন বসি খাবার টেবিলে /কবজি ডুবিয়ে ডাল নিই মাখি,মাছি  তাড়াবার মতো/ বাঁ হাতখানা মাঝে মাঝে  দুলে ওঠে স্ক্যানডিনেভিয়ার শীত নিয়ন্ত্রিত  ঘরে / পোকা মাকড়ের বংশ ও নেই  তবু কী যেন তাড়াই মনে  মনে / দুঃখ/ মাছের  মলিন  টুকরো  সবজি থালার কিনারের নুন/ আর ঘন ঝোল মাখা ভাত থেকে সরতে চায়না মোটে হাত/ ইচ্ছে করে  সারাদিন ভাত নিয়ে মাখামাখি  করি খাই/ খুব  গোপনে কী  বুঝিনা আমি  কেন সোনার চামচ ফেলে রেখে ভাতের  স্পর্শ  এত চাই/ আসলে  ভাত স্পর্শ  করলে ভাত নয়, হাতের  মুঠোয়  থোকা থোকা বাংলাদেশ  উঠে  আসে"।
সমাজের  শ্রেষ্ঠ  নারীদের যদি  এরূপ শিকার  হতে হয় তাই সাধারণ  অসহায়  নারীদের হাহাকারের শব্দে  বাতাস আজ ভারী হয়ে আছে। দিল্লির নির্ভয়া থেকে  সমগ্র  ভারতে কত নারী প্রতি দিন হারিয়ে  যাচ্ছে  কে দেবে তার পরিসংখ্যান? 
 তাই নারীকে  আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার  নিজেই অর্জন  করতে হবে।  এই সময়ে প্রত্যেক নারীকে  রাজকন্যা  চিত্রাঙ্গদা হয়ে  উঠতে হবে। যে নারী শুধু  লালিত্যের সাধনাই করবে না, বীরত্বের  সধনাও করবে
বিদ্যালয়ে শিক্ষাক্রমে নারীদের জন্য  জুডু, ক্যারাটে বাধ্যতামূলক করতে হবে।নারীদের  নিজেদের  দিকে  তাকানো দরকার।আত্মরক্ষায় যত্নবান হতে হলে শরীরচর্চা  আবশ্যিক  হওয়া চাই। এই বার্তাই  বর্তমান  সময়ে সমগ্র  নারী সমাজের  কাছে  পৌঁছে  দিতে চাই।

অভীককুমার দে

নোয়াখালি কবিতা
'হঁত খোঁজে অন'

হুগের টিলার বাসন্তীর হুত 
যেদিন চাকরি হাইছে
আঁইসতে আঁইসতেই কান্দি দিছে
ছোডঅ হোলার মতঅ,

ক্ষত হঁচি হোক ঝৈত্যো 
মাইনষে দেইখছে--
ওষুদঅ আইনতো হারেনঅ 
টেঁয়াল্লাই...

মা বাপ থুই 
কোনোমুই যাইতো না যে হোলা
হে হোলা, আকাশের কাছে 
হঁত খোঁজে অন !

বাড়ি চিনে না
নিজে নিজে কতা কয়--
'কার চাকরি কনে নিচে
আন্ডারে ত ভাসাই দিছে !'

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...