Saturday, November 21, 2020

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী

আজ আশ্বিনের শেষ কার্তিকের শুরু

এই দিনটা বিশেষ ভাবে বিশেষ, বাংলার এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। জানি না বাংলার বাইরেও এইভাবে বিশেষ হয়ে উঠেছে কিনা এই দিন! আমি বারবার বলি আমাদের পুজো , লোকাচার অনুষ্ঠানগুলি গভীর ভাবে যদি দেখি দেখতে পাবো, কি পরিমান কৃষি ভিত্তিক সব। কিভাবে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ।

 যেমন ধরুন ঘট। আমরা  ঘট প্রতিস্থাপন করতে কি দিই ! পঞ্চপল্লব। এখন এই পঞ্চ পল্লব কি কি!
অশ্বথ বট পল্লব
কাঁঠাল বট পল্লব
অশোক বট পল্লব
যজ্ঞ ডুমুরের পাতা
আর আম্র পল্লব।
না পেলে আম্রপল্লব পঞ্চ পাতা বিশিষ্ট । 

তাহলে ঘট প্রতিস্থাপন করতে গেলে আমাদের কি করতে হবে! ঐ সমস্ত গাছ গুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সব গুলি কিন্তু ওষুধি গুণ সম্পন্ন। তেমনি খুঁটি নাটি সব কিছু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যাবে প্রকৃতির আরাধনাই করে চলেছি আমরা যুগের পরে যুগ ধরে। প্রকৃতির অনুদানেই যে সভ্যতা টিকে থাকবে বা থাকছে তার স্পষ্টিকরন অনেক আগেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন।   

এবার আসি আজকের দিনে কি কি হয় তা নিয়ে একটু আলোচনা করি। একেক পরিবারে একেক গ্রামে কি অঞ্চল বেসিসে আজকের দিনটি একেকভাবে পালিত হলেও আনুষঙ্গিক দিক দিয়ে বিচার করলে কিন্ত প্রায় এক। 

আজকের দিনে অনেকেই আশ্বিনের ভাত রেঁধে কার্তিকে খাওয়ার প্রচলন আছে। আজকে রাঁধবে , ঘট বসিয়ে পুজো দেওয়ার পরে ঠাকুর এসে ভাতের হাঁড়ির মুখ কলাপাতা দিয়ে  বাঁধবে। পরের দিন সেই পান্তা ভাত নারিকেল,গুড়, এঁটেল কলা দিয়ে মেখে খাওয়ার নিয়ম। এই নিয়মের সাথে জড়িত আছে অশ্বিনী কুমার দ্বয়ের পূজার কাহিনী। মানে স্বাস্থ্য সচেতনতা। কার্তিক মাসে আবহাওয়ার পরিবর্তন   হয় ।রোগে শোকে ভোগার প্রবণতা অত্যন্ত  বেশি থাকে। সাবধানতা অবলম্বন জরুরী। তার থেকেই এই লোকাচার নয়তো! সাধারনত নোয়াখালী বা চট্টগ্রাম অঞ্চলের  লোকেরাই এই ব্রত করে থাকেন বেশী। 

এছাড়াও অনেকে আজকের দিনে ধোঁয়াধায়ী করে নিরামিষ রাঁধবে তেল ছাড়া। জুমখাসার চালের ভাত রাঁধবে ফেন না গলিয়ে তারপর এর মধ্যে ঢেলে দেবে ঘি । আট আনাজ ফেলে রাঁধবে মটর ডাল বা খেসাড়ির ডাল। কেউ কেউ চালতা ফেলে দেয় সেই ডালে আবার কেউ আস্ত তেঁতুল তারপর ঘি ছড়িয়ে দিয়ে  খাওয়া। আট আনাজে এখন সব ধরনের আনাজই দেয় । নিয়মে   কিন্তু  এমন সব সব্জি যা সচরাচর আমরা খাই না। যেমন শাপলা, কচু, গাটি কচু, মাটির তলার আলু ইত্যাদি এমন সব যা নাকি এখান ওখান থেকে তুলে আনতে হয়। 

ধর্মনগরে দেখেছি আট রকমের সব্জি  ভাগ ভাগ করে নিয়ে সব্জিবালারা বাজারে বসে থাকতেন। ধর্মনগরে  এই দিনে আমার সহায়িকা  যে ভাবেই হোক ঘর থেকে খুঁজে খাজে ঠিক  আট পদের সব্জি বের করে কেটে কুটে তৈরী করে দিত। না তোমাকে আজকে খেতেই হবে #আট_আনাইজের_সব্জি। ধর্মনগরে সাংঘাতিক রকম ভাবে মানে সিলেটি লোকেরা এই #আটআনাইজের_সব্জি  রেঁধে খাওয়ার নিয়ম ।  

আমার মাকেও দেখি নানারকম নিয়ম করেন ।এর মধ্যে একটা হলো চালতা পাতা দিয়ে ঘর নোয়ানো। দুব্বা , গিলা, সর্ষে , মেথি, কাঁচা হলুদ সব একসাথে পাটায় বেটে চালতা পাতার মাঝখানে রেখে কাঠি দিয়ে গেঁথে সিঁদুর ফোটা দিয়ে তুলসি তলায় রেখে তারপর ধূপ ধুনো, শংঙ্খ উলুধ্বনির মাধ্যমে দুয়ারে দুয়ারে গুঁজে রেখে দেন বিকেল হলে ।  এখন চালতার সিজন। এভেলেবল।  চালতার গুরুত্ব বুঝতে হবে। আর বাদবাকি  বাটা জিনিসগুলিও শরীরের জন্য বিশেষ করে ত্বকের জন্য ভীষণ রকমের উপকারী। আবার ও সেই প্রকৃতির পূজাই কিন্তু করছি আমরা। 

তারপর সন্ধ্যা হলে চারিদিকে আলো জ্বেলে দেওয়া হয়।বাড়ি ঘরের কোন অঞ্চলই বাদ থাকে না । চারিদিকে আলোকময় । কেউ কেউ কলার খোলে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালান তো কেউ মোমবাতি আবার গ্রামাঞ্চলে অনেকেই কাঁঠালের সিজনে কাঁঠালের আঠা ছোট ছোট বাঁশে জড়িয়ে রেখে দেন। আজকের দিনে ক্ষেত খামার থেকে ঘরের পেছন অব্দি মশালের মতন জ্বালিয়ে দেন। 

কিসের থেকে এলো এই আগুন বা বাতি জ্বালানোর প্রক্রিয়া! ফসল রক্ষা করার তাগিদ থেকে কি! কার্তিক মাসে পোকা মাঁকড়ের উপদ্রব কিন্তু বেড়ে যায়। পোকামাকড় থেকে বাঁচতে বা ক্ষেতের ফসল রক্ষা করতেই কি!

 আবার অনেকে বলেন অলক্ষ্মী  পুজা। এখানে অলক্ষ্মী মানে কি! অসুখ বিসুখ ! একটা সংসার ছাড়খার করে দিতে পারে রোগ শোকের ভোগান্তি। রোজগারের প্রায় সবটাই শুধু নয় জমি জমা অব্দি সব চলে যায় অনেকের চিকিৎসার খরচ বা ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে । তাই রোগ শোক নামক অলক্ষ্মী কে সন্তুষ্ট কর। মনে করিয়ে দেওয়া যে সাবধান হও রোগ শোক থেকে। অনেকেই কিন্তু কার্তিক মাসকে বলে পেরইত্তা কার্তিক। আবার সেই ওয়েদার চেঞ্জ এর  কনসেপ্ট। আমি শুধু ভাবি কি আধুনিক ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা!   

আজকের দিনে আরেকটা বিশেষ ব্রত করেন মহিলারা তা হল শাশুড়ি মায়ের ব্রত #গাঢ়ই। এখন নামটা ঠিক কি হবে বুঝতে পারছি না। গাড়োই না গাড়ই না গাঢ়ই!
লোকান্তরিত শাশুড়ি মায়ের প্রতি  শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। বা বলা যায় তর্পণ । তৃপ্তি সাধন।

 অতি সাধারণ নয় কিন্তু এই ব্রত! আসুন একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং পরিবার প্রথায় বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে  নারী সবসময়ই পরের ঘর আলো করার জন্য জন্মায়। না না পরিস্থিতি এখনো যে কে সেই তা যতই লাফালাফি করি না কেন আমরা! এইবার এই পারিবারিক সম্পূর্ণতা বহন করে চলে নারী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সম্পূর্ণ  অচেনা অজানা ঘর থেকে এসে বৌমা নামক সম্পর্কের বন্ধনের মাধ্যমে । এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গঠিত হয় শাশুড়ি আর বৌমার মধ্যে।শাশুড়ি এমন এক নারী যিনি  অচেনা অজানা এক পরিবারে এসে তাঁর তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদ, তাঁর নাড়ী ছেঁড়া ধন তুলে দিচ্ছেন সম্পূর্ণ অচেনা অজানা আরেক নারীর হাতে। কত বড় ত্যাগ! এখানে বৌমা মেয়ের মতন কিন্তু মেয়ে নয়। শাশুড়ি মায়ের মতন কিন্তু মা নন। একটা সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধা  মিশ্রিত সম্পর্ক । গাঢ়ই যেন সেই মায়ের ত্যাগ স্বীকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। যে বৌমা হয়তো  নিজেও কোনদিন শাশুড়ি মা হয়ে সেই একই ত্যাগ করে যাবেন পরিবার বাঁচাতে সৃষ্টি বাঁচাতে।   

এটা একটা অনুভব । একটা বৃহত্তর অনুভব। এক নারী অনুভব করছেন শাশুড়ি নামক আরেক পূর্বনারীর লজ্জা, ঘৃণা, দুঃখ, বেদন, সুখ, শোক, অনুতাপ।

 অনুভব করছেন প্রথম ঋতুশ্রাবের যন্ত্রণা, অনুভবিত হচ্ছে সমগ্র নারী সমাজের ঋতুশ্রাবের কষ্ট। অনুভব করছেন প্রথম  যৌন মিলন, প্রথম সন্তান ধারন থেকে প্রথম প্রসব বেদনা, অবশেষে মেনোপজ.. সাথে অনুভব করছেন সেই স্বত্বা বা  সমগ্র নারী জাতির অস্তিত্ব তার নিজের মধ্যে। 
ধারন করছেন সমগ্র নারী জাতির একটু একটু করে  ফুরিয়ে যাওয়া এই বিশ্ব সংসার থেকে আর সবার মতন , অবশেষে  কোথাও থেকে যায় যদি অতৃপ্তি! কি করতে পারি তখন আমি!

গাঢ়ই আমি মনে করি তাই কেবল আচার বিশিষ্ট নয়। এখানে আচার নিমিত্ত মাত্র। এখানে সমগ্র সৃষ্টির আধার কে আরেক সৃষ্টি বা প্রকৃতির স্বীকৃতির মাধ্যমে ধারন ও  শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও। এর চেয়ে আধুনিক আর কি কিছু আছে!! সমগ্রতা কে নিয়ে চলা! এত সাধারণ নয় এই ব্রত। প্রকৃতিকে রক্ষা কর কি নারী রূপে কি গাছপালা, নদ নদী, পুকুর জল রূপে। 

কি উপচার  লাগছে গো এই ব্রত করতে! হালের ও না জালের ও না এমন সব সামগ্রী । এই সময়ে অভাব চারিদিকে। ধান গাছ গর্ভবতী। আর কিছুদিন সময় দাও তাকে পুষ্ট হতে। তাই জুমের চাল। এমন সব সব্জি যা চাষ করে করা হয় না। কচু, গাটি কচু, মেটে আলু, চুবুই ইত্যাদি। অভাব এখন, কিন্তু প্রকৃতি নিজেই সাজিয়ে রেখেছে অভাব মেটানোর সামগ্রী। খুঁজে নিয়ে নাও শুধু। 
কি আশ্চর্য ভাবে প্রকৃতির পূজা করে চলেছেন আরেক প্রকৃতি ।

জল আমাদের জীবন । সেই জলে মাছের চাষ। এই ব্রতে  উঠোনের একপাশে তুলসী গাছের তলায় বা সামনে ছোট্ট পুকুর কেটে   কেউ পুঁটি কেউবা ছোট মাছ ছেড়ে দেয়। এটাই কি বলার চেষ্টা যে, ওরে মাছ গুলোকেও ছেড়ে দে কদিনের জন্য । গর্ভিণী তো সেও! 

পুকুর পাড়ে নদীর ঘাটে অনেক ব্রত করেন মহিলারা। কেন! জলের কাছে মনের কথা বলা! কে শুনবে আর নারীর বেদন ! কে অনুভব করবে!  ঠিক সেরকমই ছেড়ে যাওয়া শাশুড়ি মায়ের সংসারে শাশুড়ি মায়ের কিছু কথা মনে করা, অনুভব ব্যক্ত করা...

একটা সংসারের মূল যে ধারন করে নারী তার মূলেও যে   থাকে আরেক নারীর জীবনভর ত্যাগ, তিতিক্ষা, তপস্যা  সেটা অনুভব করাই তো গাঢ়ই। এভাবেই তো বয়ে চলে মনন স্রোত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ভুলে যাওয়া নয় মনে করা মনে করিয়ে দেওয়া পরবর্তী প্রজন্মকেও....
কত বড় কনসেপ্ট!!
এর চেয়ে আধুনিক আর কি হতে পারে! চিন্তার স্রোতে মননে যদি আধুনিক না হতে পারি তবে কিসে হব! আধুনিক পোশাক আসাক পরে!! দুটো বিদেশি ভাষা বলে! বিদেশি খাবার খেয়ে! না দুটো বিদেশি বই পড়ে!

আমাদের আচার বা লোকাচার পুজো আদি সমস্ত কিছুই সাংঘাতিক রকমের আধুনিক। প্রকৃতির সংগে লিপ্ত। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই যে এই সমস্ত ব্রত, আচারের সৃষ্টি এতে  আর দ্বিমত  থাকতে পারে কি!  

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...