Tuesday, October 20, 2020

মিঠুন দেবনাথ

একেই কি বলে আত্মনির্ভরতা!


দারুণ রেজাল্ট। চারিদিকে জয়জয়কার।  গ্রামের ছেলে বলে কথা। পাড়াটা কয়েকদিন বেশ উৎসবের মেজাজেই কাটিয়েছে।  হাঁড়ির পর হাঁড়ি রসগোল্লার আগমনী জোয়ারে মানিকের দোকানের হাল খাতাটা বেশ ভারী হয়ে গেলো | তাতে বিপিনের কিছু আসে যায় না , বিপিন ততদিনে নিজেকে বেশ হাল্কা ভাবছিল , কারণ সে যেন অনেক বড় একটা যুদ্ধ জয় করেছে | তার চারিদিকে যত দু'পায়া প্রাণী , যার তার মুখে শুধু বিপিনের সুনাম | গর্বে বিপিনের বুকটা দুই ইঞ্চি এগিয়ে গেল | আর মাত্র বছর কয়েক অপেক্ষা , তারপর ছেলেটা ডাক্তার হলেই শহরে বাড়ি , দামী গাড়ি , নামী চেয়ার , বাহ্... বিপিনের স্বপ্নটা বেশ সাজানো | ঈশ্বর এতদিনে মুখ তুলে তাকিয়েছেন , না হলে সারা ভারতে এত সহস্র মেধাবী ছাত্র থাকা সত্ত্বেও বিপিনের ছেলে প্রথম একশোতে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারত না | 
      তারপর...কে এই বিপিন ? কী তার পরিচিতি ? — বিপিন তেমন মহান কেউ নন | বছর পঞ্চাশের নর্মালি বি.এ পাশ একজন তরুণ | বলা বাহুল্য , বিপিনের তেজ আর উদ্দীপনাই হাফ সেঞ্চুরিতেও বিপিনকে তারুণ্যের তকমা দিয়ে রেখেছে | বছরের পর বছর বিপিনের বাবা-মা ঝান্ডা আর ডান্ডা কাঁধে করে নিয়ে ঘুরলেও গরিবের পার্টি গরিবের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারেনি ! বিপিন একটি বিপিএল কার্ডেরও দাবীদার হতে পারেনি | যাই হোক বত্রিশ বছর বয়সে বিয়েটা করার পর বিপিন ইউনিভার্সিটির দরজায় সিকিউরিটির গার্ড হিসাবে হাতে একটা ডান্ডা নিয়ে দাঁড়িয়েছে | সেই ডান্ডাতে কখনও কুকুর তাড়ায় কখনও মানুষ তাড়ায় | গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সিকিউরিটি গার্ড কম্পানি তাকে মাসিক দশ হাজার টাকা করে দেয় | প্রায় কুড়ি বছর ধরে ঠিক সেভাবেই চলছিল জীবন  | ইউনিভার্সিটির দরজায় বাবুদের সেলুট মারতে মারতে আর বই খাতা ব্যাগ সাথে নানান ছেলে-মেয়েদের আসতে যেতে দেখতে দেখতে নিজের ছেলেটাকেও বই-খাতা ব্যগ কাঁধে সেই দরজায় দেখবে বলে বিপিন কুড়ি বছর ধরে স্বপ্ন জমিয়েছে | অবশেষে ইশ্বর সাধক বিপিনের আর্তনাদ ভগবান শুনেছেন | 
     মনঃস্থির | আর কোনো কথা হবে না , ছেলেটাকে মেডিকেলেই দেবেন | সম্পদ বলতে জমানো টাকা লাখ চারেক , শ্বশুরবাড়ি থেকে হাজার পঞ্চাশেক , আর পৈত্রিক ভিটেভূমি কানি দুয়েক | তবুও ছেলে মেডিকেলে পড়বে , ডাক্তার হবে | যাইহোক সুপরামর্শে বিপিন ছেলেকে ডাক্তারিতে ভর্তি করিয়ে দিল | কিন্তু বর্তমানটা বিপিনের জানা ছিল না | স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে যে আকাশ পাতাল ফারাক সেটা বিপিনের মস্তিষ্কে কখনও ধরা দেয়নি কারণ  নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি তাকে এতটাই স্বপ্নে বিভোর করে দিয়েছে সে বাস্তবের বিন্দু পর্যন্ত অনুভব করতে পারেনি ! যদিও দু'একজন জ্ঞানী মানুষ ডাক্তারির খরচ সম্পর্কে বিপিনকে কিছুটা পূর্বাভাস দিয়েছিল , কিন্তু সেই কথ বিপিনের মস্তিষ্ক তো দূরের কথা অন্তঃকর্ণ পর্যন্তই প্রবেশ করতে পারেনি | 
     ছেলে মেডিকেলে | প্রথম বছরেই খরচ আট লাখ টাকা | ব্যঙ্ক ব্যলেন্স শূন্য ,  শ্বশুরবাড়িও শূন্য , এক কানি জমিও শূন্য ! তবুও ডিপোজিটটা হল | ছেলে ডাক্তা হবে , আর মাত্র পাঁচ বছর |
     দ্বিতীয় বছরে প্রায় দশ লাখ লাগবে | কিন্তু টাকা কই ! ব্যঙ্ক লোন পায়নি , কারণ বিপিনের বাবা ব্যঙ্ক থেকে কৃষি লোন নিয়ে লোন পরিশোধ না করেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে | সেই থেকে ম্যানেজার বাবুর কল্যাণে ব্যঙ্কে লাল দাগ | যদিও বহু কষ্টে নেতাদের হাত-পা ধরে একটা লোন সেংকশান করালো তাও গ্যারেন্টার ছাড়া হচ্ছে না | টাকা অতি দ্রুত জোগাড় করতেই হবে কারণ কর্তৃপক্ষ চাপ দিচ্ছে | টেনশনে বিপিনের রাতে ঘুম হয় না ; কোথায় থেকে জোগাড় করবে এত টাকা ? তাহলে কী বাকী এক কানি জমিটাও ! হ্যাঁ  , তাতে আর কত , না হয় লাখ দু'য়েক | মানুষ তো সুযোগ সন্ধানী , অপরের কষ্টের সময় তাকে দুটো মূল্য বেশি দিয়ে জিনিস কেনার চেয়ে তাকে ঠকিয়ে কমমূল্যে কিনতে পারাকেই শ্রেয় মনে করে | কিছু তেই কিছু হচ্ছে না ! বিপিনের ভগবান বোধহয় নাক ডেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন | হতাশায় বিপিনকে গিলে খাচ্ছে | হটাৎ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন "O পজিটিভের একটি কিডনি চাই , কোনো সহৃদয় ব্যক্তি থাকলে  নিচের ফোন নম্বরে অতিসত্ত্বর যোগাযোগ করুন উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হবে |"
      তাহলে কি সবার অজান্তে এটাই হবে বিপিনের সিদ্ধান্ত ! হ্যাঁ , বিপিন একমাসের জন্য কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে | বাড়িতে বলেছে তার ডিউটি অন্য জায়গায় সিফ্ট হয়েছে | তাহলে... ছেলের কলেজের টাকাটা ?  "হুম , আমার লোন সাকসেস হয়েছে " — এটাই ছিল অপারেশন টেবিলে যাওয়ার পূর্বে বৌ এর প্রতি শেষ কথা ! 
     একমাস পর বিপিন বাড়ি ফিরেছে , আগের থেকে স্বাস্থ্যটা অনেক ভেঙে গেছে | তবুও বিপিনের মুখে হাল্কা নকল হাসি ছিল কেন না ছেলে মেডিকেলে আছে , আর তো মাত্র তিন বছর | তারপর ছেলে ডাক্তার , তখন না হয় বাবার সব সমস্যা সমাধান করে দেবে | মানুষ তো আশাতেই বাঁচে ...
    বিপিনের স্বাস্থ্য ভাঙছে প্রায়ই জ্বর থাকে , শরীর ভালো থাকে না , শরীরের ওজন কমছে , পা গুলো বেশ ফুলে গেছে , চলতে কষ্ট হচ্ছে , একটুতেই বিপিন হাঁফিয়ে যাচ্ছে | হটাৎ বিপিনের মায়ের প্রশ্ন , কী রে বাবা , তোর পেটের ডান পাশে এ লম্বা সেলাইয়ের দাগটা কীসের দাগ রে ? মায়ের কাছে কী আর সন্তান কিছু লুকোতে পারে ! মায়ের হাঁটুতে ঠেস দিয়ে হাউ মাউ করে বিপিন কেঁদে উঠল ! নিমেশেই বাড়িটা যেন মহাশ্মশানে পরিণত হয়েগেল | সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মেজর স্ট্রোক আর বিপিন শয্যাশায়ী | এখানেই ছেলের মেডিকেলের পরিসমাপ্তি ! আজ বাড়িটাই হাসপাতাল | বিপিনের বৌ টা চব্বিশ ঘন্টার নার্স , আর ছেলেটা বাড়ির সামনে ছোট একটা টিনের একচালায় পান দোকান দিয়েছে | দিনভর দশ কাপ চা , দুটো নোনতা হয়ত দশ খিলি পান ...
      তাহলে কী এটাই আত্মনির্ভরতা ! এভাবেই কি আত্মনির্ভর হতে হবে বিপিনের ছেলেদের ?

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...