Tuesday, October 20, 2020

জবা চৌধুরী

পুজোর ভাবনা

আমার পুজোর ভাবনায় চিরকালই ছিল আনন্দ আর অনায়াস। শ্রাবণের শেষে আকাশের নীলটা গাঢ় হলেই, আর সাথে কয়েকটা মিষ্টি স্বপ্নের মতো সাদা মেঘেদের আনাগোনা শুরু হলেই মন ঠিক জানতো-- মায়ের আসার সময় হয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি সেই ভাবনাগুলোকে সাকার করে দিয়ে একদিন হৈ হৈ করে পাড়ার ক্লাবের লোকজন মিলে মাদুর্গাকে এনে পূজো মণ্ডপে বসিয়ে দিতো। চারদিকে তখন শুধুই খুশির রঙ। রোজদিনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে ম্যাজিকের মতো সবার মুখে তখন দেখতাম হাসি।

বড় হতে হতে পুজোর সময় এলেই মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসতো। যে স্বর্গ থেকে মায়ের আসা, সেই স্বর্গটি কোথায়, কতদূর ? তারপর, মাত্র ওই চারটি দিনের জন্য যে বাপের বাড়ি আসা তাঁর, সেই বাপের বাড়িটিই বা কোথায় ? ওই প্রশ্নগুলো যখন মনে আসতো --- বন্ধুদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, সকলেই কনফিউসড আমারই মতো। একদিন আম্মাকে (ঠাকুমা) জিজ্ঞেস করতেই আম্মা শোনালো এক বিশাল কাহিনী। তখন আমার বয়স ওই দশ/বারো। ধর্ম বোঝা তো খুব কঠিন ব্যাপার ছিল সেই বয়সে। শুধু সেই বয়সে বলবো কেনো, এখনো অনেক কিছু বুঝি না। কিন্তু গল্পের কাহিনীটি খুব ভালো লেগে গেছিলো। সবচে' ভালো লেগেছিলো আম্মার বলা শেষ লাইনটি ---"সেই থেকে এভাবেই প্রতি বছর দুর্গামা তাঁর ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে মর্ত্যে, মানে, পৃথিবীতে আসেন।“

সেদিন ওই গল্প শুনতে শুনতে মাথার ভেতর কত প্রশ্ন ডিগবাজি খেলো। শুধু নানা কাহিনীর উপর বিশ্বাস রেখে পৃথিবীময় পূজো হয়ে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে। অবাক হয়ে ভাবলাম আম্মার বিশ্বাসের কথা --- সকলের কথা। জানার ইচ্ছে থাকলেও কোনো প্রশ্ন করলাম না। কেমন যেন মনে হলো উল্টো-পাল্টা প্রশ্ন করলে আম্মার হয়তো মনে কষ্ট হবে। হয়তো বড়োরা কেউই খুশি হবেন না। তাই নিজেকেই থামিয়ে বুঝিয়েছিলাম সারা বছরের অপেক্ষায় থাকা সকলের এতো বড় যে একটা খুশি --- সে নিয়ে প্রশ্ন না-ই বা করলাম।

সবকিছুতেই একটা লজিক্যাল এক্সপ্ল্যানেশন না পেলে আমার মনের ভেতর প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ-ভরা ‘কুরকুরে’র (স্ন্যাক্স) মতো একটা শব্দ বাজতে থাকে। ওই একটা ছোট্ট অশান্তি মতো। তবে একটি দিক নিয়ে ভাবনাটা এক্কেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অর্থাৎ, সেই থেকে কোনো ধর্মীয় কাহিনীর পেছনে আমার কোনো প্রশ্ন নেই।

যাকগে, সেসব হলো ছোটবেলার কথা। তারপর বড় হবার নানা ধাপ পেরিয়ে বিয়ের পর জীবনের প্রয়োজনে পাড়ি দিলাম সুদূর আমেরিকায়। বেশ কয়েক যুগ আমেরিকায় কাটিয়ে আজ যখন 'বার্ধক্যের যৌবনে' এসে পৌঁছেছি, আমার কাছে  পুজো'র সংজ্ঞা --তিথি, নিয়ম কাটিয়ে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে গেছে। বিদেশে আমাদের পুজো মানে দেশের আসল পুজোর দিনগুলোর আশেপাশের কোনো উইকেন্ড, পুজো মানে জাকজমকের সাথে ডেকোরেশন, অঞ্জলি, সাজগোজ, নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকা, ম্যাগাজিন --- আরও কতো কী ! যে যার পছন্দের এরিয়াতে মাস তিনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি আমরা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রতি বছরই নিমেষে যখন পুজোর আনন্দের দিনগুলো চলে যায়। বেশ অনেকটা ভরসা মনে নিয়ে "আসছে বছর আবার হবে" বলতে বলতে মাদুর্গাকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে ফিরি। আমেরিকার ব্যস্ত জীবনে উইকেন্ড-নির্ভর দেশীয় নানা উদযাপন সারা বছর ধরে চলতে থাকলেও, দুর্গাপূজো আমাদের বাঙালিদের কাছে চিরকালই সবচে' বড় উৎসব---সে আমরা যেখানেই থাকি না কেনো !

"আসছে বছর আবার হবে" --নিজেরই বলা এই সেদিনের কথাটি যেন এখনো স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে -- এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস আমাদের পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছে নির্মমভাবে। ২০২০ সালের প্রথমদিক থেকেই পৃথিবীর নানা দেশে শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল।

সব ভালোলাগাকে ছাপিয়ে আজ মন আমার শংকিত। প্রায় দশ মাস হতে চলেছে অসুস্থ পৃথিবীতে শুধুই বয়ে চলেছে হতাশার হাওয়া। অনেকেই আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না সামাজিক দূরত্বের অর্থ। অতি সহজ কথারা আমাদের কাছে যেন দুর্বোধ্য আজ। একগাল বোকা হাসি হেসে বলি, "আমার কিচ্ছুটি হবে না।" সামাজিকতা সেরে ঘরে ফিরে পরিবারের শারীরিকভাবে অসক্ত লোকেদের মধ্যে আমরাই করোনা ভাইরাসটি ছড়াচ্ছি। এভাবেই ইতিরেখা টেনে দিচ্ছি কতো শত জীবনে। যখন আমাদের জীবন কঠিন সংকটের সামনে, তাকে সামলাতে পারি আমরাই --- ঠিক তখনই আমাদের নিজেদের অযোগ্য অশিক্ষিত অবাধ্যতার শিকার হচ্ছি আমরা নিজেরাই।

সঙ্গত কারণেই এবছরের জন্য আমার অজানা-স্বর্গের মা'এর অজানা আসার পথকে নিজের মনেই শেষ ঠিকানা দিচ্ছি।  পৃথিবী আবার সুস্থ হোক।  আমরা আবারও  ঝলমলে সুন্দর শরতে দেবীমা'র পুজো করবো দল বেঁধে। তার আগে এবার পুজোর ভাবনা শুধুই হোক নিজেকে, পরিবারকে আর আমাদের সমাজকে সুস্থ রেখে করোনা ভাইরাসকে হারানোর।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...