Tuesday, October 20, 2020

সজীব পাল [ ধারাবাহিক]

সেদিন সে এসেছিল 
(শেষ পর্ব)
 

এক রজনী দিবস কত কোটি বছর ঢেকে দেয় তার মায়ায়।আলোহীন,প্রাণহীন মানুষগুলো ভেসে ওঠে ।ওঠে না কেবল তারাই যারা এক পৃথিবী আলো নিয়ে বুকের গহীনে আমরণ বাসা বেঁধেছে ।তারা এখন একমুখী জীবনের দূরত্ব অতিক্রম করেছে।তারা মিশে গেছে অনন্ত এক সন্ধ্যায় ।সেই সন্ধ্যায় সুখ নেই দুঃখ নেই কষ্ট নেই কেবল নিস্তব্ধতা ।তবুও তারা ভালো থাকুক,ভালো থাকুক নিগুঢ় দেশে উধাও হওয়ার মানুষগুলো।
নীপা এখন পাথরের চেয়েও কঠিন ।এক জীবনে মানুষের যে রূপান্তর,যে পরিবর্তন নিজেকে নিজের প্রিয় করে তুলে সেই পরিবর্তনের চরমে নীপা।তার এখন আর স্থায়ী কোনো যত্নে ঘুমানোর মতো কোনো কোল নেই ।
ঈশ্বর জানেন মেয়েরা কেন এত বাবার প্রিয় বা মেয়ের কাছে বাবা এত আপন ।

তিন মাস হল সৌরাংশ বাবু ইয়লোকে আর নেই ।তার মৃত্যুটা শুধু মৃত্যু নয় ।এই মৃত্যুর সাথে আরো দুইটা মানুষের জীবনের সুখ অস্বাভাবিকভাবে চিরতরে হারিয়ে গেছে ।

জগত জানে কারোর কারোর মৃত্যু কেবল মৃত্যু নয় মৃত্যু মানেই প্রিয় মানুষদের চোখের জলে বেঁচে থাকা।

সেকেরকোট নিউ ইকো পার্কে নীপা বসে আছে ।শরতের নরম কুয়াশা আলতোভাবে ছুঁয়ে আছে ঘাসের স্নিগ্ধ শরীর ।নীপা পায়ের জুতো জোড়া খুলে সেই ঘাসের উপর অদ্ভুত মায়ায় পা দুটো ফেলে রেখেছে ।পাশে বসে আছে রঞ্জিত ।রঞ্জিতের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে ।রঞ্জিত সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছে ।এখনো প্র্যাকটিস শুরু করেনি।তার ইচ্ছে বিয়ের পর কর্মজীবন শুরু করবে ।
রঞ্জিত অনেকক্ষণ ধরে নীপার কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু সাহসে কোলাচ্ছে না।একটা সিগারেট ধরাতে পারলে হতো কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা "নো স্মোকিং"।এইসব লেখার কোনো মানে হয় না ।এগুলো নিছক ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই না।অন্যের ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছায় নাক গলানো স্বাভাব হয়ে গেছে মানুষের।
নীপা এখন কেমন যেন গম্ভীর মুখে থাকে সারাক্ষণ।মাঝে মধ্যে যদিও হাসি দেয় তা হল কৃত্রিম।এই কৃত্রিমতাকে রঞ্জিত বড্ড ভয় পায়।মনে হয় সেও যেন এই হাসির মতোই তার কাছে অপ্রকৃত।
রঞ্জিত অবিচল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,"এত সকাল সকাল এখানে ডাকলে যে কোনো সমস্যা হয়েছে ?"

" সমস্যা হবে কেন ! বাড়িতে এখন আর ভালো লাগে না ।মাও কথা বলে না । "

"তুমিও ত বেশি কথা বলো না ।মাকে যদি সবসময় কথা বলে সুস্থ না রাখো সেও তো একদিন....."

নীপা আবার মুখ ফিরিয়ে চুপ করে গেছে।রঞ্জিত এবার সাহস সঞ্চার করে কাঁধে হাত রাখল ।সে এই প্রথম এতটা কাছ থেকে কোনো নারীর শরীর স্পর্শ করল ।বুকের ভেতর কেমন যেন শব্দ হল ।
নীপা আনমনে বলল," আরো শক্ত করে ধরো ।জানো মনীষের ভালোবাসার স্পর্শ কোনো দিন পাইনি।সেই মানুষটাকে অনেক ভালোবাসতাম ।কিন্তু এই কথাটা তাকে বলার সুযোগ পাইনি কোনোদিন ।"

" এখন সেই কোথায় আছে ?"

" জানি না ।আগে যেখানে থাকতো সেখানে এখন আর থাকে না ।"

" এরপরে আর কোনোদিন দেখা হয়নি তার সাথে ?"

" সেদিন সে এসেছিল,কিন্তু স্বপ্নে না বাস্তবে তা জানি না ।আগের সেই মনীষ ।যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার তুমুল বাসনা ছিল।চারিদিক বিষাদ অন্ধকার।বিছানায় ছটফট করছি ঘুম আসছেনা।কয়দিন ধরে ইনসোমনিয়ার জন্য ঘুমের ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না ।মোবাইলে টাইমটা দেখলাম,রাত প্রায় দুইটা ।কোথাও কোনো শব্দ নেই ।মোবাইলের আলো দিয়ে জগ থেকে জল ঢেলে খেয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি ।জানালা দিয়ে ক্লান্ত রাস্তা গুলো দেখা যায়।ওদের দেখে মনে হল যেন এই ক্লান্ত শ্রান্ত রাস্তাগুলো রাতের বেলাও এদের বিশ্রাম নেই ।এরা স্বার্থহীন যোদ্ধা।এরা অন্ধকারকেও ভরশা দেয় আমরা জেগে আছি ।ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলছে।হঠাৎ দেখলাম একটা লোক রাস্তায় পায়চারি করছে ।চোখের ভ্রমও হতে পারে। নিজেকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে দেখি না এতো ভ্রান্তি নয়।কে এই লোক ! নিশুতি রাতে সে কি করছে এখানে ।একটু পরে সেই লোক আমাকে ডাকলো ।সেই কি স্পষ্ট কণ্ঠ ।বলল 'বাইরে এসো নীপা ।কতদিন তোমাকে দেখি না ।এসো আমরা আজ অন্ধকার পথে হারিয়ে যাই ।'আমার বুকের ভেতর ব্যথা শুরু হল।এই তো মনীষ !সুস্থ সবল আমার সেই মনীষ।আমিও বললাম ,' তোমার সব মনে পড়েছে মনীষ ?'
মনীষ অট্টহাসি দিয়ে বলল,'সব মনে পড়েছে। তুমি আসবে না কাছে?'

" আসবো আগে বলো কিভাবে মনে পড়ল ? সেদিন এইভাবে কেন অবহেলা করলে আমাকে ?কেন বলোনি তুমি অভিনয় করছ ?

" সেদিন আমি সত্যিই অসুস্থ ছিলাম নীপা ।আজ আমি সুস্থ ।মানুষ মৃত্যুর পর আর অসুস্থ থাকে না ।তোমার টানে আজও আমার এই জগত থেকে মুক্তি হয়নি।"

"তুমি মৃত,,,,!

সেই রাতে কী হয়েছে আর জানি না।যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই পড়ে গেছি।


অনেকদিন ধরে বারান্দায় যেখানে সৌরাংশ বাবু বসতেন সেখানে সবিতা বসে না ।এখানে বসলেই লোকটার অস্তিত্ব অনুভব হয়।মনে হয় সেও পাশে বসে কথা বলছে ।মৃত্যুর পরে একদিন সবিতা বারান্দায় বসে আছে ।অতীতের স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে মনে হল স্বামীও তার পাশে বসে ।
সবিতা রান্না সেরে রাতের এঁটো থালা বাসনগুলো ধুতে বসেছে।সে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে চায় কিন্তু সম্ভব হয় না।তার অজান্তেই মন উদাস হয়।
কাজ শেষ করে সোফাতে বসেছে সবিতা।শরীরটা আজ একটু অন্যদিনের চেয়ে ফুরফুরে লাগছে ।ধীরে ধীরে বোধহয় মানুষটার স্মৃতি কালের স্রোতে মিলিয়ে যাচ্ছে ।এই তো জগতের নিয়ম।
কোথাও একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু তার তেমন আত্মীয় নেই ।নেই বলতে আছে যোগাযোগ নেই তেমন।সবিতা ফোনটায় নাম্বার লিস্ট চেক করে মমিতাদের নাম্বার টা পেলো ।মমিতা তার পিসতুতো বোন।গুজরাট থাকে।স্বামীর বিশাল বিজনেস সেখানে।সবিতার অনেক ছোটো ।কলটা রিসিভ করলো একটা শিশু।
" হ্যালো কে বলছেন?"

" তোমার মা আছেন ?"

" মা'মনি তো ঘরে নেই !অফিসে গেছে ।আপনে কে ?মাকে কিছু বলতে হবে ?"

" বাবা তোমার মাকে বলো আগরতলা থেকে সবিতা আন্টি ফোন করেছিল,কেমন !"

"আচ্ছা ঠিক আছে বলব "

কলটা কেটে দিলো ।শরীরটা হঠাৎ কেমন যেন ঝিমুচ্ছে ।সবিতা ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেলো।শ্বাস ভারী হয়ে আসছে ।সে সোফাতেই শুয়ে পড়ল।ঘরে কেউ নেই।মেয়েটাও দুদণ্ড ঘরে থাকে না আজকাল।
এই সময় কাউকে পাশে পেলো বোধহয় শান্তিতে মরা যেতো ।

বিকালে রঞ্জিত আর নীপা ঘরে ফিরল।ঘন আঁধারের মতো ঘর নিস্তব্ধ ।দুজনেরই চোখ গেলো সোফাতে পড়ে থাকা সবিতার দিকে।কাছে গেলো না কেউই।নীপা ভেবেছে ঘুমিয়ে আছে মা।অথচ সে জানলোই না এই ঘুম চিরনিদ্রার ঘুম ।এই ঘুম কারোর ভাঙে না।
রঞ্জিত নীপাকে ঘরে পৌছে দিয়ে চলে গেছে ।নীপাও নিজের চলে গেছে ।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...