Saturday, July 18, 2020

মিঠুন দেবনাথ

২৫শে অাগস্ট

বিকেল চারটেয় কটূক্তি সহ তীব্র ভর্ৎসনা প্রাপ্তি | তারপর একছটাক বিলাতি হজম | দীর্ঘ ছয় ঘন্টা রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে কান্না | এক ফসলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি | সারা অঙ্গে কাদা বালির আস্তরণ | মাঝে জনা চল্লিশেক লোকের আগমন , কেউ দিলো ধমক , কেউ দেখালো পুলিশের ভয় , কেউ দিলো আদর | কেউ আবার বুকে জড়িয়ে চুমো খেল | প্রশ্ন এল "বাবা তোর বাড়ি কোথায় , কাঁদছিস কেন ?" "—আমাদের বাড়িতে যাবি , রাতটা কাটাবি ? তোর বাড়িতে কে আছে ? কীসের জন্য এত কাঁদছিস ? খুব প্রিয় জিনিস হারিয়েছিস বুঝি ?" 
   কান্নার তেজ এতটাই বেশি ছিল যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হৃদয় অস্বীকার করল | 
    অচেনা শহর , অজানা গলি তার সঙ্গে কিছু জলন্ত স্মৃতি | হটাৎ এরই মাঝে তিনজন অল্পচেনা লোক সাইকেল নিয়ে পাশে দাঁড়ালো ; কিন্তু কান্নার আওয়াজ আর আবেগ দুটোই এত বেশি ছিল যে তারাও মতি ভ্রমে বুদ্ধিলোপে পালালো | তারপর আরও কিছু সময় কেটে গেলো | না , আর পাশে কেউ নেই ! একা , খুব একা ! পুরো শহর যেন অন্ধকার | ওই গোটা চল্লিশেক মানুষও ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল | রাত মধ্য , এবার ছেলেটার কান্না থামলো , ছোট্ট কালভার্টের রেলিং এর উপর বসে বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরের দিকে মুখ তুলে হাত জোড় করে ঈশ্বরকে বলল , "হে ঈশ্বর , তোমায় সহস্র প্রণাম , কারণ আমি বেঁচে আছি , হ্যাঁ , আমি বেঁচে আছি | "
    তখন রাত প্রায় বারোটা | হাতের মোবাইলটিতে ১% চার্জ বাকী রয়েছে | সন্ধ্যায় তো অনেক মানুষ পাশে ছিলো কিন্তু তখন আবেগটা এতই তীক্ষ্ণ ছিলো যে কারোর কথাতেই হৃদয় সায় দেয়নি | এখন তো রাত অনেক ভারী , কোথায় যাবে ! কোথায় থাকবে ! এই অচেনা শহরে রাত্রি যাপনের মতো কোনো আখড়া নেই | আবেগ প্রায় কেটে গেলে মনে প্রচন্ড ভয়ের উদয় হয় কারণ তার এক পকেটে কম্পানির দশ হাজার টাকা আরেক পকেটে একটি সোনার আংটি | আংটি টি সে বড় যত্ন করে বানিয়েছিল যে | এগুলো সে বাঁচাতে পারবে তো ? নাকি নিষ্ঠুর শহর এগুলিও ছিনিয়ে নেবে ! 
   না ... না না না আর বসে থাকলে থাকলে চলবে না , সুযোগ পেলেই নিশাচররা কামড়ে খাবে | চলতে হবে , হ্যাঁ , এক্ষুনি চলতে হবে কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই | বিগত প্রায় তিনদিন ধরে শরীরে দানার প্রবেশ নেই | যতটুকু চলছে ওই পানির বলেই চলছে | কাঁপা কাঁপা পায়ে শক্তিহীন দেহে উঠে দাঁড়াতেই মাথা একটি চক্কর মারলো | সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটি বন্ধ করে নিজের মায়ের মুখ খানি মন দর্পণে প্রতিভাসিত হল ; ছেলেটির আপন বলতে কেবল তার মা'ই ছিল | মায়ের ছবি চোখের সামনে ভাসতেই ঈশ্বর যেন পায়ে শক্তি দান করল | হ্যাঁ , এবার চলতে থাকল , মনস্থির করল থাকার জায়গা যদি না পায় তবে সারা রাত চলতে থাকবে | তার দৃঢ় বিশ্বাস মানুষের দুনিয়া নিষ্ঠুর হলেও ঈশ্বরের দুনিয়া নিষ্ঠুর নয় | তিনি যেভাবেই হোক তাঁর বাধ্য সন্তানকে রক্ষা করবেন | ওই শক্তিহীন দেহ আর নিল্চল পা নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হাঁটার পর রাত বারোটায় কালীনগর স্ট্যান্ডের কোনো এক দোকানির বারান্দায় ছেলেটি লুটিয়ে পড়ল ...
    এমন সময় শেষ বারের মতো ফোন কল , "মিঠুন দা , তুমি কোথায় ?" শুধু একটি উত্তর , "আমি কালীনগর স্ট্যান্ডে |" ব্যস , সঙ্গে সঙ্গেই ফোন সুইচ অফ | 
      মিনিট দশেক কেটে গেলো | স্ট্যান্ডের পাহারাদার রাতের কুকুরগুলো ছেলেটিকে একা দেখে ভীষণ ভাবে চেঁচাতে শুরু করল | কুকুরের ভয়ে হাত পা প্রায় অবশ হয়ে আসছিল | এমন সময় দূর থেকে একটি টর্চের আলো ভেসে আসে , বাঁচার জন্য মনে প্রচন্ড জোর আসে , এই তো এই যেন সে জীবনের আলো দেখতো পাচ্ছে ! হে ঈশ্বর , তুমিই সব ... দেখতে দেখতেই সন্ধ্যার সেই তিন জন অল্প চেনা লোক সামনে এসে দাঁড়ালো | তাদের একজন বলে উঠল —
 —দাদা আমাদের ঘরে চল...
—উত্তরে ধ্যান না দিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম " কী রে অর্পন , সে কী বলল ?" উত্তর এল...
— কী আর বলবে সে ! তুমি যখন রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিলে আমি তখন তাকে ফোন করে বললাম , কী রে , দাদা তো রাস্তায় গড়িয়ে কাঁদছে , কী করব ? সে উত্তর দিলো ... "রাস্তায় কোনো গাড়ি নাই , চাপা দিয়া দিতো..."
    উত্তরটি শুনেই বুকটা হু হু করে উঠল ! মনের প্রতি শুধু একটাই প্রশ্ন , কার জন্য এত কিছু ! কেন...
    তারপর ঈশ্বরে ধন্যবাদ দিয়ে আবার হাসি , করজোড়ে প্রার্থনা , ভালো থাকুক , পৃথিবীর সব মানুষ ভালো থাকুক...     
   না , এ কোনো পিতৃ বিয়োগের শোক নয় ; মাতৃ বিয়োগেরও নয় | সন্তান কিংবা ভাই-বোন হারানোরও শোক নয় | বাকীটা না হয় না বলাই থাক।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...