Saturday, July 18, 2020

অভীককুমার দে

এক মৃত্যু ছায়ার মুখোমুখি


তখন আমি গ্রামীণ ব্যাংকের চুক্তিবদ্ধ কর্মচারী। গ্রামীণ শ্রমিকদের সরকার নিয়ন্ত্রিত শ্রম দিবসের প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদানের কাজ করি। সেদিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়েছি আদিপুর পঞ্চায়েতের উদ্দেশ্যে। দূরত্বের কারণে টাকাপয়সা নিয়ে একা যাওয়ার সাহস যোগাতে পারতাম না। তাই, সহকর্মী সম্রাটকে সাথে নিয়েই রওনা হলাম। সেই পথে ঐদিন আমাদের প্রথম যাতায়াত নয়। 

কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার দুপাশে যেখান থেকে গভীর জঙ্গল শুরু হয়, সেখান থেকেই আমার বরাবর গা ভার হতে থাকে। সেদিনও মানসিক অবস্থা একই রকম। মাঝে প্রায় সাত কিমি রাস্তা বাড়িঘর শূন্য। নিস্তব্ধ পথ। 

আমার মোটর সাইকেলটি চালাচ্ছিল সম্রাট। ব্যাগ ভর্তি টাকা ও যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে পেছনে বসেছিলাম আমি। আনুমানিক চার সাড়ে চার কিমি রাস্তা অতিক্রমের পর একটা বিকট শব্দ কানে এলো। মুহুর্তেই টলতে শুরু করলো মোটর সাইকেল। চিৎকার করে সম্রাট বলে উঠল-- 'অভীক, আমি বাম হাতটা লাড়াইতাম পারতাছি না।' সামনের দিকে ঝুঁকে দেখলাম, ওর বাঁ হাতের কনুই বেয়ে রক্ত গড়িয়ে প্যান্ট ভিজে যাচ্ছিল। 

হাতটি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় খটখট করে কিছুদূর গিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন। কোনোরকমে সাইকেলের স্ট্যান্ড দিয়ে রাস্তায় বসে পড়েছে সম্রাট। ডান হাত দিয়ে চেপে ধরলেও গলগল করে রক্ত ঝরছিল। হতভম্ব আমি, কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 

মিনিট খানেকের মধ্যেই একজন লোক ডানপাশের টিলা থেকে দ্রুত নেমে আসে। হাতে একটি দেশি বন্দুক। গায়ে মিলিটারির মত পোশাক। কাঠের মত কঠিন শরীর। চোখে উগ্র দৃষ্টি। সামনে এসেই বন্দুক তাক করে ধরলো আমার বুকে। মুহুর্তের জন্য একবার মায়ের মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। এক অদ্ভুত মৃত্যুর ছায়া শরীরকে মাটির সাথে ঠেসে ধরছিল। আমি তখন নিরেট পাথরের মতোই ! মৃত্যুকালীন যাপনের অনুভূতি আমাকে অস্থিরতা থেকে স্থির করে ফেলছিল ধীরে ধীরে। ততক্ষণে জীবনের ভাবনা সব হারিয়ে ফেলেছি। আচমকা এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিলো টাকার ব্যাগ এবং বন্দুকের নলে ধাক্কা দিয়ে বলল-- 'যা, ভাগ'। 

বেঁচে থাকার একবিন্দু ক্ষীণ আলো বুকের কোথাও কামড় দিতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। লক্ষ্য করলাম, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সম্রাট। চোখের সামনে এক অদ্ভুত অন্ধকার নেমে এসেছে আমাদের। গলা শুকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। তবুও, এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, আমরা বোধহয় বেঁচে যাবো। বাঁচতেই হবে আমাদের। রক্তাক্ত সম্রাটকে টেনে তুলে ছুটতে লাগলাম তৈনানীর দিকে। শরীর ভারি হয়ে উঠেছে। প্রাণপণে দৌড়াতে চেষ্টা করলেও ভারি পা টেনে নিয়ে যেতে পারছিলাম না। 

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...