Saturday, July 18, 2020

সজীব পাল ( ধারাবাহিক)

সেদিন সে এসেছিল
পর্ব : দুই 

অফিস বন্ধের দিন ঘুম ভাঙতে চায় না সহজে নীপার।কোনো দিন বেলা দশটাও বেজে যায় উঠতে।ঘরিতে নয়টা চল্লিশ বাজে।সে এখনো ঘুমিয়ে আছে।
গতকাল রাতে সবিতাকে নীপা বলে রেখেছে তার অফিসের এক বন্ধু আসবে এবং দুপুরের খাবার খেয়ে যাবে।তাই সবিতা মেয়ের অফিসের সহকর্মী বন্ধু মনীষ আসবে শোনে খুব সকাল সকাল উঠে যায়।
নীপাকে কয়েকবার দরজা থেকে ডাক দিয়ে যায় কিন্তু এখনো ওঠেনি।সবিতা এবার তার ঘরে ঢুকলো।নীপার পড়নের নাইটি একেবারে হাঁটুর উপরে উঠে আছে।কি একটা বিশ্রী ব্যাপার! আজকাল সবাই বাড়িতে নাইটি পড়ে ।কিন্তু একটু বেশি ঢিলেঢালা হওয়ার দরুণ যাদের ঘুম খুব ভারী এবং ঘুমের মধ্যে ঘন ঘন একাত ওকাত করে,তাদের একটু সমস্যা হয় ।সবিতা নাইটিটা টেনে নামিয়ে পিঠে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো,'আচ্ছা কয়টা বাজে তোর খবর আছে!"
নীপা একটু শব্দ করে বলল,' উঁহু '

'কি উঁহু!ওঠ তোর বাবা বসে আছে ।তুই জানস না তোর বাবা ইদানিং তোকে ছাড়া সকালে চা খায় না !যা ওঠ ওঠ।"
সবিতা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সৌরাংশ বাবু ব্যাংকের চাকরি করত।গত মাসে তাকে দুই লক্ষ্য টাকার চুরির অপবাদে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেয়।কিন্তু সৌরাংশ বাবু ব্যাপারটা ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ রাখেননি কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে ছেড়েছেন।দুই লক্ষ কেন সে তার আঠারো বছরে কর্মজীবনে কোনোদিন দুই টাকা এইদিক সেদিক করেনি।তার বিশ্বাস তার সহকর্মীই কেউ তাকে ফাঁসাচ্ছে।এতবড় একটা মিথ্যা অপবাদ তাকে একটুও ভাঙতে পারেনি।মানসিকভাবে এখনো সে যথেষ্ট দৃঢ় আছে।হয়তো অপবাদটা মিথ্যে বলেই।
চাকরিটা যাওয়ার পর থেকে সে পরিবারের সাথেই বেশ দিন কাটাচ্ছে ।

নীপা বাবার সামনে এসে বসল।বারান্দাটা বেশ বড়ো।'ইন্দো-জার্মান' বাঁশের তৈরি চারটে চেয়ার এবং একটি টি টেবিল।সৌরাংশ বাবু মেয়ের দিকে স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন ," এত দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে হবে মা?"

"কেন হবে না বাবা !"

"দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে শরীর ব্যথা হয়।এবং অল্প বয়সে বুড়ি হয়ে যাবি।"

"তোমাকে এইসব কথা কে শেখায় বাবা ?যুক্তি ছাড়া কথা ।আচ্ছা মাকে চা দিতে বলো ।"
চা আগেই রাখা ছিল ।তার চোখে পড়েনি।সৌরাংশ বাবু মৃদু হেসে বললেন,' তোর ঘুম তো এখনো ঠিক মতো কাটেনি মা।যা আরেকটু ঘুমিয়ে আয়।আমি বসি আরেকটু ।নীপা বাবাকে চওড়া গলায় বলল,' বেশি কথা বলছ ত ।এখন দেখবে ঘরে চলে যাবো সত্যি সত্যি।"

বাপ মেয়ের সকালটা এইভাবে রাগ অভিমান দিয়ে শুরু হয়।মানুষ কতটা সরল হলে শিশুর মতো আচরণ করতে পারে এবং কতটা ভালোবাসা থাকলে অভিমান করা যায় তা বোধহয় এই বাপ মেয়ের সম্পর্ক না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।সৌরাংশ বাবু চা-এ চুমুক দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন," আচ্ছা মা তোর অফিসের খবর কী?শুনলাম তোর প্রমোশন হতে পারে ব্যাঙ্গালোর?"

" হতে পারে কিন্তু আমি যাবো না।এত দূরে একা একা থাকতে পারব না।ভাবছি বসকে বলে এইটা মনীষকে পাইয়ে দেবো।"

"আচ্ছা মা তুই কি ছেলেটাকে মন টন দিয়েছিস?আমাকে বল,তাছাড়া তোকেও ত বিয়ে দিতে হবে মা । তোর যদি কোনো পছন্দের ছেলে থাকে তাহলে বলতে পারিস।"

নীপার মুখের হাসি হঠাৎ মলিন হয়ে গেল।মনীষকে কি সে কোনোদিন ভালোবেসে ছিল!তার প্রতি একটু দুর্বলতা কাজ করতো কিন্তু সেটা প্রাণবন্ত নয় ।সেটা নিছক অভ্যাস।দীর্ঘদিন এক সাথে কাজ করার কারণে।কিন্তু বাবার মুখে তার কথা শুনেই বুকটা এমন করল কেন ?তবে কি নিজের অজান্তেই মন নেওয়া দেওয়া হয়ে গেছে ?না এইটা হতে পারে না!মন কি এত সস্তা নাকি।
তার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেছে।নীপা তখন ক্লাস নাইনে পড়ে ।সবাই বলে নাইনে উঠলে নাকি প্রেম প্রেম ফুল ফোটে ।ক্লাসের টপার ছিল অমন।অমন যেমন ব্রিলিয়ান্ট তেমনি চঞ্চল দুরন্ত ।কম বয়সি মেয়েরা এই রকম ছেলেদের প্রতি একটু বেশি আকর্ষণ অনুভব করে।স্কুল ক্যান্টিনে বসে নীপা বান্ধবী পূজাকে বলছিল ," তোর অমনকে কেমন লাগে?"
তখন পূজা বলল,'" তুই কি তাকে ভালোবাসিস ?
তখনও পূজার মুখে এই কথা শুনে আজকের মতো হয়েছিল।নীপা বাবাকে কোনো উত্তর দেয়নি।চা-য়ের কাপ না নামিয়ে টেনে যাচ্ছে।
সৌরাংশ বাবু বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে," মনীষকে আজকে কি খাওয়াবি?"

" কেন বাজার করোনি?"

সৌরাংশ বাবু ক্ষাণিক রসিকতা করে বললেন," তোর বন্ধু আসবে তুই বাজার করবি তুই রাঁধবি।আমার বন্ধু আসলে আমি করতাম।"

"ওহ"সে বাবার রসিকতা বুঝতে পেরে বলল," কিসের মাংস আনলে বলো ।

" খাসির মাংস।আর জাটকা ইলিশ।"

নীপা আর কথা বলল না।রান্না ঘরে চলে গেল মাকে সাহায্য করার জন্য ।

এগারোটার মধ্যে রান্না কমপ্লিট।নীপা স্নান করতে বাথরুমে ঢুকে কিন্তু তোয়ালে নিতে মনে নেই।বাথরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে নিয়ে পুনশ্চ ঢুকলো ।
সকালে মনীষকে যখন ফোন দেয় সে বলেছে এগারো কি বারোটার মধ্যে এসে যাবে।মনীষ নীপাকে শাড়িতে দেখতে খুব পছন্দ করে।তাই সে গোলাপি ডোরাকাটা শাড়ির সাথে মেসিং ব্লাউজ পড়েছে।বেশ মানিয়েছে ।সে নিজেই অনেকক্ষণ আয়নার ভেতরে মানুষটাকে দেখল।কিন্তু ওই আরশিনগরের মানুষটা সে নয়।ওই আরশিনগরের মানুষটার কোনো নিজস্ব পৃথিবী নেই ।মন নেই,ভালোবাসা নেই ।তার কেবল চেয়ে থাকার প্রতিবিম্ব আছে।যাকে ইচ্ছে করলেও এক জনমে ছুঁয়ে দেওয়া যাবে না ।তবুও তার দিকে এইরকম নিষ্পলক চেয়ে থাকার মধ্যে যেন নিজের মনের মানুষটার কথা ভাবার একটা আনন্দ আছে ভালো লাগা আছে।
এইসব কথা ভেবে সে হঠাৎ আঁতকে উঠলো!মনের মানুষ কে তার?
সবিতা পেছন থেকে তাকে ডাক দিলে সে হঠাৎ চমকে উঠে!অকারণেই ।
" কিছু বলবে মা ?"

"কিরে একটা ত বেজে গেল কই ছেলেটা ত এখনো এলো না !আরেকটা ফোন কর ।তোর বাবা সকালেও খায়নি ,কতক্ষণ আর বসে থাকবে ?"

" ফোন করেছিলাম মা ফোন সুইচ অফ ।মনে হয় চার্জ নেই ।বাবাকে খেয়ে নিতে বলো।আমি মনীষ আসলে খাবো।"

"আচ্ছা দেখি তোর বাবাকে বলে ।"
পেছনের দেয়ালে ওয়ালঘড়িটাতে সময় দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেল ।মোবাইলটা হাতে নিয়ে আবার মনীষের নাম্বারে ফোন দিলো ।কিন্তু এখনো সুইচ অফ ।


রাত নয়টা বেজে গেল মনীষ এখনো আসেনি।নীপা নিজের ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে।পৃথিবীর সবকিছু পলকে যেন মূল্যহীন মনে হচ্ছে!বুকের ভেতর এক করুণ নিশব্দ আর্তনাদ!এই আর্তনাদ কেবল সে শুনতে পাচ্ছে!তার এখন খুব চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে!কিন্তু কেন কাঁদবে!সে কে ?কিন্তু মন মানছে না।তাকে অনেকবার সবিতা এবং সৌরাংশ বাবু বলেছে ভাত খাওয়ার জন্য ।কিন্তু সে খায়নি।মনীষ আসবে রাত হলেও আসবে।অনেকবার ফোন করা হয়েছেকিন্তু এখনো সুইচ অফ বলছে।তবুও তার মন বলছে সে আসবে।
ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে কিন্তু মনীষ আসছে না।মা বাবার সামনে দাঁড়াতে এখন তার খুব লজ্জা লাগছে।বিকাল থেকে সে দরজা বন্ধ করে বসে আছে ঘরে।


মনীষ আজ তিনদিন আসছে না অফিসে।যে বাড়িতে ভাড়া থাকে ওই বাড়ির মালিক প্লাবন বাবুকে অফিস থেকে ফেরার পথে নীপা বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে ," আপনার এখানে যে ভাড়াটিয়া মনীষ সে অনেকদিন অফিসে যায় না ফোনেও পাওয়া যায় না এখানেও নেই আপনে কি জানেন সে এখন কোথায় আছে ?"

" তুমি কে ?"

"আমি উনার সহকর্মী এবং বন্ধুও।আমার নাম নীপাঞ্জনা বর্মন ।"

" গত রোববার তোমাদের বাড়িতে কি ওর নিমন্ত্রণ ছিল ?"

"হ্যা ছিল কিন্তু ও যায়নি।"

" কিন্তু সে তো তোমাদের বাড়ি যাবে বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সকাল সকাল ।কি মুশকিল ছেলেটা গেল কোথায়?"

" আপনার কাছে ওদের গ্রামের বাড়ির নাম্বার বা ঠিকানা আছে ?"

" নাম্বার নেই ,তবে সে একবার বলেছে ওর গ্রামের নাম দুলব নারায়ন।কিন্তু মা এর থেকে বেশি আমি জানি না।"

নীপা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো প্লাবন বাবুর বাড়ি থেকে।একটা মানুষ হঠাৎ করে তো আর ভ্যানিশ হতে পারে না।এখানে কেউ তার আত্মীয় নেই ,যে ওখানে গিয়ে খোঁজ করবে।যদি বাড়িতে না গিয়ে থাকে তাহলে সে কোথায় যাবে !সে এখন কোথায় খুঁজবে তাকে!এতবড় একটা শহরের বুকে সে কোন কোণে আছে,কে জানে তার ঠিকানা ?
এতটা মন খারাপ নীপা র কোনোদিন হয়নি।যেন কতকাল মনীষকে সে দেখে না !বুকের ভেতর এক অদৃশ্য হাহাকার !চোখের মনি কোঠায় কান্নারা এসে ভীর করছে ,কিন্তু বৃষ্টির চেয়ে যে মেঘের আকাশ কঠিন,রুক্ষ এবং ভয়ার্ত তা বোধহয় বুকের গহীন জানে।তবুও কচি বৃক্ষের পাতার মতো মাটি মাংসে ঢাকা যে প্রাণটা দিবানিশি ঘড়ির কাটার মতো টিক টিক করে যাচ্ছে অনবরত,সে কোমল অনিশ্চিত হৃদয় তো মানছে না !সে কাঁদছে!

রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে মনীষের কথা চিন্তা করছে ।যেন পৃথিবীর এখন তার একমাত্র ভাবনা মনীষ।হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠল নীপার।সে তারাতারি ফোন বের দেখলো মা'র নাম্বার ।কলটা রিসিভ করে বলল," বলো মা "

সবিতা গাঢ় কণ্ঠে বলল," তুই কোথায় এখন ?"

"এই ত আসছি ।গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছি।সব ঠিক আছে মা ? তুমি এইভাবে কথা বলছ যে ?"

সবিতা এইবার ফোনে জুরে কেঁদে ফেলে বলল," তুই তারাতারি হাসপাতালে চলে আয় ,তোর বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে।ডাক্তাররা কিছু বলছে না ।আমার ভীষন ভয় করছে মা ,তুই আয়।"

নীপা কোনো কথা না বলে কলটা কেটে একটা অটো ডেকে উঠে গেল,ড্রাইভারকে বলল সিটি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...