Monday, April 27, 2020

সজীব পাল

সুন্দর ভয় 

দুইজন যুবক একদিন বিকেলে গভীর নির্জন বনে যায়;অদ্ভুত অ্যাডভ্যঞ্চারের জন্য ।অনেকটা সখের অথবা নেশার ।সাথে জলের বোতল,টিফিন বক্সে কয়টা রুটি ও আলু সিদ্ধ এবং নিরাপত্তার জন্য লাইসেন্স করা রিভলভার ।
তারা চণ্ডীরবান জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতে থাকল ।এইদিকে সূর্য ক্রমশ নিস্তেজ আলো বিচ্ছুরিত করছে ।দুইজন যুবক গভীরে প্রবেশ করে প্রথমেই শিয়ালের হাঁক শুনে কিছুটা বিচলিত হলেও ক্রমেই নিজেদের ভেতর উদ্দাম ও বিশ্বাসে শক্তির জোগান দিতে শুরু করে ।

" অলক তুই কি ভয় পাচ্ছিস?"
" ধুর এই কিরকম কথা ! আমরা ত ইচ্ছে করেই এসেছি ভয়ের ভেতর ।একটা কথা কি জানিস পিন্টু,জীবনের প্রকৃত সত্তাকে উপলব্ধি করার জন্য প্রত্যেকটা মানুষকে মৃত্যুর সঙ্গে ঘেঁষে যাওয়া উচিত জীবনে একবার হলেও ।"

" যা বলেছিস।মনে হচ্ছে "full moon " চারিদিক কেমন স্পষ্ট ।"

" সামনের দিকে চল ।ওই ঝোপটার কাছে বসি ।"
পাশেই বিরাট এক জলের লেক।অনেকে বলে এই জলের মাছ নাকি অসম্ভব বড় ।এই জঙ্গলের রহস্য হল ,গভীর রাতে নাকি ওই লেকটার মধ্যে নৌকা ভাসে এবং অদ্ভুত অলৌকিক সুরে গান শোনা যায় ।এবং জঙ্গলে তীব্র বাতাস বয়। আজ থেকে প্রায় এক দেড়শো বছর আগে নাকি এক দুঃসাহসী বৃদ্ধ একা একা এই জঙ্গলে আসে রাতে মাছ ধরার জন্য,তারপর বৃদ্ধই নাকি প্রথম এই নৌকা দেখে ।এবং একটা বইও লেখে "The mystery of the jungle waters"।গতবছর একটা মেলাতে পিন্টু এই বইটি দেখে ঠিক করে ওরাও এই রহস্য ভেদ করবেই ।তাই এখানে আসা ।

ওরা ঝোপের পাশে ক্ষানিক বিশ্রাম করে আবার এগোতে লাগলো ।অসংখ্য কাঁটাঝোপ ।বিরাট বিরাট শাল গাছ ।অলক চারিদিকে টর্চ জ্বেলে এগোচ্ছে ।হঠাৎ অলক পিন্টুকে বলল," ওই দেখ কি গাছ !"

" ছাতিম গাছ "

"হুম,বলত এর বৈজ্ঞানিক নাম কি ?"

"Gelidium amansii, এর ফুলগুলি আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগে ।"

পকেট থেকে মোবাইল বের দেখল অলক ,রাত বেশি হয়নি ,সবে নয়টা দশ ।ওরা লেকটা দেখতে পেলে ।অনেক নিচে। ওরা আছে একটা পাহাড়ে ।চাঁদের আলোয় লেকের জল কেমন চকচক করছে ।তাদের হঠাৎ মনে হল এইরকম একটা স্বচ্ছ জলের এত রহস্য! সুন্দরের যে কলঙ্ক থাকে তা আজ বুঝতে পারছি ।
পিন্টু বলল ," দেখ মনে হয় ওই লেকটা চাঁদকে গিলে ফেলছে ।"
" ভাই তুই যে কবি তা জানি ।এখানে অত্যন্ত বন্ধ রাখ তোর কল্পনা ।"

"আচ্ছা আমি না হয় বন্ধ রাখলাম ,একটা বাজতে এখনো ঢের বাকি ,কি করবি এতক্ষণ?"

"চল খাওয়া দাওয়া সেরে নিই।"

ওরা খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার বিশ্রাম করতে একটা পরিস্কার জায়গা দেখে বসল।জ্যোস্নাভরা রাত ! এই রাতে কেউ ঘুমানো যায় না ।শুধু জেগে থেকে উপভোগ করা যায় ।ঘন বসতি বা শহরের রাত আর গভীর নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে কত ফারাক ।যে মানুষ এইরকম রাত না দেখে মরে যায় সে প্রকৃতির সৌন্দর্য কিছুই দেখেনি ।প্রতিটা ভয়ের মাঝে একটা করে সুন্দর ও শিক্ষা লুকিয়ে থাকে ।ভয় ভয় শরীরে যখন পরম সুন্দরকে উপলব্ধি করে তখন যে অনুভূতি তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না ।

" অলক ঘুমিয়ে গেলি ?"
কোনো সারা শব্দ না পেয়ে পিন্টু তাকে ধাক্কা দিলো ।সে কটমট করে চোখ মেলে বলল," কি হয়েছে ? চোখ লেগে গেছে একটু ।"

" কয়টা বাজে ?"

ঘরির দিকে চেয়ে দেখল বারোটা কুড়ি । হঠাৎ কেমন চাঁদের আলো ক্ষীণ হয়ে গেছে ।চারিদিকে গভীর নিস্তব্ধতা ।নিচে জলের উপর যেন একটা মাছের লাফ দেওআর শব্দ শুনল ।অলকের একটু ভয় লাগতে শুরু করল।এখন আর সে নিজেকে সাহস দিতে পারছে না ।তাদের মনে হল কেউ একজন পেছন থেকে ওদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে ।উত্তর আকাশের ধ্রুব তারা স্পষ্ট ।ওই তাঁরাটাও যেন কিছু বলতে চাইছে ।কিন্তু নিজের আইন ভেঙে বলতে পারছে না ।মোবাইলের ঘড়িতে একটা বেজেছে ।ওরা নিজেদের চেষ্টা করছে শক্ত রাখার ।লেকের ঠিক শেষ প্রান্ত থেকে উজ্জ্বল একটা নৌকা আসছে ।কোনো মানুষ নেই ।অথচ ওই নৌকার উপর শূন্যে ঝুলছে লন্ঠন ।বইয়ের বর্ণনা মতো সমস্ত জঙ্গলে শিহরিত সেই গান ।সত্যি এই গান এই পৃথিবীর না ।এই জগতের হতে পারে না ।অদ্ভুত সুর ! মেয়েলি কণ্ঠ ।হালকা বাতাস বইছে ।অল্প সময়ের মধ্যে যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল । 
অলক ও পিন্টুর চোখ জুড়িয়ে আসছে ।আহা কি মধুর ভয়ংকর সুর ।ওরা এতক্ষণ বিপদের আশঙ্কায় ভীত ছিল ,কিন্তু এখন কোনো ভয় নেই ।এখন বেঁচে থাকার লড়াই ।ভীষন লড়াই ।আসছে নৌকা খুব নিকটে আসছে ।সুর আরো তীক্ষ্ণ ও গভীর ।কোথা হতে মিষ্টি গন্ধ আসছে ।কেন এই জীবন ! ওরা কতকাল এই হয়েছে পৃথিবীতে এসেছে ।কোনোদিন এমন ক্লান্ত অথচ সুখের ঘুম আসেনি ।
ওদের কোনো কথা নেই ।শুধু ভাবছে : কোথায় থেকে এলো এমন মাঝিহীন নৌকা ।কে গাইছে এমন গান ।আচমকা পিন্টু চিৎকার করে বলছে," বন্ধু করো এই গান !"
গান আরো বাড়ছে ।নৌকা এখন ওদের স্থির ! অদ্ভুত এই রাত ।গভীর ঘুমে ওরা ডুবে যাচ্ছে ।ওদের দেহ ক্রমশ বিবশ হয়ে আসছে ।ওদের এখন কোনো চৈতন্য নেই আর ।

ওই দুই যুবকও বৃদ্ধের মতো এক পৃথিবী রহস্য নিয়ে চলে গেল ।প্রকৃতির এমন অনেক রহস্য যা মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর ।ওরা ভয়ে অনড় থেকে প্রত্যক্ষ করেছে এই ভয়ভীতি রাত।না পৃথিবীতে ভয় বলে কিছু নেই যা আছে তা হল শিক্ষা ।ওরা শিখে গেছে ।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...