Tuesday, April 28, 2020

সিদ্ধার্থ সাহা

লকডাউন

বিছানায় শুয়ে শুয়ে সাদা কাগজে কলমের আঁকিবুঁকি কাটছিল বিহান। মনটা একদম যে শান্ত তা নয়, বরং উদ্বেগের বলি রেখা কপালে দাগ কেটে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল তাতে। কালো স্যান্ডো আর নীল সাদা ছোপ ছোপ এর বাড়মুডা পরে আপাতত বিছানায় শুয়ে কলম চালাচ্ছে বছর ত্রিশের এই যুবক। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু ভালবাসে ছবি আঁকতে। তার ছবি নাকি কথা বলে, এই কথাটা বহুবার শুনেছে অনেকের মুখে। সাদা কাগজে একবার কালির দাগ পরে গেলে, তা আর সাদা থাকে নাকি? বিহানের কাগজে আজকে উঠে এসেছে “করোনা ভাইরাস”......। একটা দুটো নয়, অনেক গুলি করোনা ভাইরাস। শয়ে শয়ে লাখে লাখে তারা দল বেধে ঝাঁপিয়ে পরছে ডানদিকের পৃথিবীতে। বিহান দেখল, পৃথিবীর মানচিত্রটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। একের পর এক শহর গুলি লাল হয়ে যাচ্ছে। অথচ আজ থেকে দিন কতক আগেও পৃথিবী এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না। ছবি আঁকতে আঁকতে বিহান অন্যমনস্ক হয়ে পরে। এই লকডাউনের দিনগুলি এইভাবে কাটানো বড্ড যন্ত্রণার।

বিহানের পাশের ফ্ল্যাটে একজন মধ্যবয়স্ক দাদা থাকেন। খুব দারুন কথা বলেন তিনি। সেই কখন থেকে জানালার সামনে বসে কথা বলে চলেছেন ফোনে। হয়ত প্রেমিকার সাথে! নাহ, প্রেমিকা হবে না। নয়ত এত জোরে জোরে কেউ কথা বলে না। ফোনের অন্য প্রান্তে নিশ্চয়ই কোন বন্ধু বা আত্মীয় গোছের কেউ হবে। যেন কিছু বোঝাচ্ছে ওই মানুষটিকে। বিহান কান পাতে, সতর্ক হয়, যদি কোন নতুন খবর পাওয়া যায়। এভাবে অন্যের ব্যাক্তিগত কথা শোনা ঠিক নয়, কিন্তু উনি তো আড়ালে করছেন না, উনি এমন ভাবে বলছেন যে জানালা ভেদ করে শব্দতরঙ্গরা এদিক ওদিক ভেসে পরছে। সেখান থেকে বিহান যদি একটা দুটো শব্দ কুড়িয়ে নেয় তাতে দোষের কি? 

মধ্যবয়স্ক লোকটি বলছেন, জানো তো এই সময় অনেক রকমের মানুষ দেখতে পাবে, একদল এখন রাজনীতি করবে, বলবে এইটা করা দরকার ছিলো, সেইটা করা দরকার ছিল, অন্যদল ধর্ম ধর্ম করে মাথায় তুলবে। কেউ খুব ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকবে, আবার কেউ, “আমার কিছু হবে না” গোছের ভাবধারা নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবে। কেউ পরিবার প্রিয়জন থেকে অনেক দূরে, ভাবছে কবে আবার তাদের সাথে দেখা হবে। কেউ মন মরা হয়ে মৃত্যর দিন গুনছে, আবার কেউ বা খোশ মেজাজে গল্প করছে, কেউ ছবি আঁকছে, গান করছে, কেউ মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে চিকিৎসা পরিসেবা দিয়ে চলছে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব বলাটাই বোধ হয় এই সময় যথোপযুক্ত......  

এইটুকু বলে থামলেন, সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি। হয়ত অন্যপ্রান্তের মানুষটি কিছু বলছেন, তা শুনছেন মন দিয়ে। বিহান ভাবছে, সে ঠিক কোন দলে পরে? ভয় পাচ্ছে? কান্না পাচ্ছে? নাকি কোথাও না কোথাও মৃত্যুর প্রহর গুনছে? খবরে আক্রান্তের চিত্রলেখাটা ক্রমশ উপরের দিকেই উঠে চলেছে। কিছু অসতর্ক মানুষ ক্রমাগত ছড়িয়ে দিচ্ছে আসে পাশে। সন্দেহ দানা বাধে মনে, এইটা কারোর ষড়যন্ত্র নয়তো? কি জানি ইচ্ছে করেই হয়ত এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে, মানব সভ্যতা ধ্বংসের জন্যে!! ভীষণ গোলমেলে। কি জানি আর মাথা কাজ করছে না বিহানের। সামাজিক মাধ্যমের অ্যাপগুলিতে এত্ত আলোচনা বিহানকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। সে নিজেকে যতটা পারে সবকিছুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে, আজ আর এসব নিয়ে আলোচনা ভাল লাগছে না। 
“দেখো পৃথিবী আর কোনদিন করোনা মুক্ত হবে না”, মধ্যবয়স্ক লোকটির কথায় আবার সতর্ক হয় বিহান। “এই সব ভাইরাস যুগ যুগ ধরেই তো ছিল। কলেরা প্লেগের মত। সেইগুলি যখন এসেছে সমাজের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক। অনেক বছরের গবেষণায় টীকা বেড়িয়েছে। মানুষ এখন সেসব রোগে আর মরে না। এইটিও কোন নতুন ভাইরাস নয়, কিন্তু এর মধ্যে জীনগত কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট যুক্ত হয়ে তা এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সাথে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে যতদিন না অব্দি এর টীকা আবিষ্কার হয়। এইসময় হা হুতাশ করলে আদতে এর থেকে কোন মুক্তি মিলবে না। দেখো ঔষধ যখন তৈরি হয় তখন তাতেও একটা সমাপ্তির দিন দেওয়া থাকে। আবার নতুন ঔষধও তৈরি হয়। এটি তো একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। যতদিন পৃথিবীর প্রয়োজন হবে এর উৎপাদন হবে। যখন হবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষও একটি সমাপ্তি দিন নিয়েই আসে পৃথিবীতে। যেতে তো সবাইকেই হবে। অমর কে বলো? তাই মৃত্যু ভয় রেখো না, কিন্তু সতর্ক থাকো, নির্দেশাবলী সব মেনে চলো। পৃথিবীকে এইবার তার হিসেব টা বুঝে নিতে দাও। এখন মার্চ মাস শেষ তার ক্লোজিংএর কাজ চলছে” এই টুকু বলে উনি হা হা হা করে হেসে উঠেন। বিহানও মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। বিহান ভাবে, পাড়ার চায়ের দোকানগুলি কবে থেকে বন্ধ। সেইগুলি খোলা থাকলে এতদিনে করোনা ভাইরাসের টীকা আবিষ্কার হয়ে যেত!! পাশের ফ্ল্যাটের লোকটি আবার বলতে থাকে, “এই কটা দিন আমি কি করছি জানো? সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার যা রোজকার নামচা থাকে, প্রাণায়াম, যোগব্যায়াম ইত্যাদি করে, ঘরের কাজে লেগে পরছি। কাজের মাসিকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি অনেকদিন হল। সপ্তাহে একদিন বাজার করছি, ভিড়ের জায়গা এড়িয়ে চলছি। দুপুরের দিকে একটু খবর টা দেখছি, আর সন্ধ্যের দিকেও। একটু খবরটা রাখতে নয়। নয়ত আবার বেপরোয়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর দেখে মনটা বিচলিত করা কিংবা রাতে শুতে যাবার আগে এইসব খবর দেখা মনকে অশান্ত করে দেবে। এখন মনকে শান্ত রাখা, খুশি রাখা একান্ত জরুরি। বাগানের গাছগুলির সাথে সময় কাটাচ্ছি। মাঝে মাঝে তাদের সাথে কথা বলি। আর পুরোনো বন্ধু যারা আছে, প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন যাদের সাথে অনেকদিন কথা হয়না, একটু কথা বলে নিচ্ছি সময় করে। এই যে দীর্ঘ এতটা সময়, নিজেকে একটু ডুব মেরে দেখছি, এতটা বছর কি ভাল করলাম, কি খারাপ করলাম। মাঝে কোনদিন অফিসের কাজ থাকলে অবশ্য বেড়ুতে হচ্ছে, আমাদের তো এখন রোস্টার ডিউটি চলছে। এছাড়া যতটা সম্ভব ঘরেই থাকা”। 

বিহান ছবি আঁকা শেষ করে চমকে উঠে, একি তার খাতার করোনা ভাইরাস গুলি কোথায় গেল? এইখানে তো একটি সুন্দর সকালের ছবি, কত্ত গাছ, নদীর জল আর পাখী। হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজোড়া কপোতকপোতী। বসন্তের লালচে হলুদ পাতাগুলি ঝড়ে নতুন কচি সবুজ পাতা গজিয়েছে। তারা কথা বলে চলেছে, এক অন্য বসন্তের না বলা অনেক কথা। বিহান আর বিরক্ত করতে চায় না তাদের। তোরা খানিকটা কথা বল, সবুজের নিঃশ্বাসে ফুসফুসে ভরে উঠুক নতুন অক্সিজেন। 

বিহান মুঠোফোন তুলে ভিডিও কল করে মুনকে। জানিস মুন, আমাদের আবার দেখা হবে। আমি দেখলাম করোনা ভাইরাস গুলি সব মরে গেছে। তুই আর আমি হাটছি ওই সবুজ বাগানটায়। মুন, একটা কথা রাখবি আজ? অনেকদিন ভায়োলিন টা হাতে নিসনি। তুই একটু বাজা না, বড্ড শুনতে ইচ্ছে করছে। আমি ডায়েরীর পাতা থেকে ওই কবিটা আজ আবার পড়ব- 

“..... কেন ভালবাস আমায়? 
ভালবাসি, ভালবাসি, তাহার আবার কারণ হয় নাকি?"

No comments:

Post a Comment

অনুপম রায়

সতেরো বছর পর সতেরো বছর পর কি অবসাদ সেটা ধারণা না থাকাই ভালো। যাদের তুমি রেখে গেছ আমাদের হয়ে, তারা এখন উন্মাদ শহরের এক কোণে বসে শ্বাস নেয়। জ...