Monday, April 27, 2020

দীপক দাস

প্রথম কদম ফুল

আজ ২৯ মার্চ। সকালে করোনাতঙ্কে WhatsApp খুলে অবাক।নূতন  এক নাম্বার  থেকে একটি  চিঠি।"স্বপন আমি মধুমিতা।এই মুহূর্তে  আমি বেলেঘাটা হাসপাতালে। করোনা আক্রান্ত। গত সপ্তাহে  ইটালিতে মেয়ের বাড়িতে  ছিলাম। ওদের  একটা  ঘরোয়া  অনুষ্ঠানে  সবার পীড়াপীড়িতে একটি  নজরুল  গীতি গাইতে হয়। গানটি তোমার প্রিয় ছিল। এখনো নজরুল গীতি  খারাপ গাইনা।গানটি"আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়"।সবার করতালিতে আমি তৃপ্ত। তারপরদিনই কলকাতা আসি।সেখানে  জ্বর,  মাথাব্যাথা।ডাক্তার  দেখানো হয়।আমার ঠাঁই  হয় বেলেঘাটা হাসপাতালে। যেজন্য এ চিঠি  লেখা, বেনীমাধবকে যেমন কিশোরী  মেয়েটি প্রথম দেখেছিল তেমনি তেমনি  মুর্শিদাবাদের এক গ্রামের  এক কিশোরী  মেয়ে কলকাতা থেকে আগত কলেজ  পড়ুয়া যুবককে  দেখে  মুগ্ধ। কিন্তু  সে যে কালো।নজরুল  গীতি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে  এসছিল। স্বর্গ  থেকে  বৃহস্পতি  পুত্র কচ মৃত সঞ্জীবনী  বিদ্যা শিখতে এসেযেমন এক মুহূর্তে  শুক্রাচার্যের  মেয়ে  দেবযানীর  হৃদয়  জয় করে নেয়, তেমনি  তুমি আমার হৃদয়  জয় করে নিলে।দেবযানী যেদিন  কচকে প্রথম  দেখে, সেদিন  ছিল  সকাল।পূর্ব  দিগন্তে  সূর্য  উঠেছে। ভোরের  সেই  মায়াবী  আলো কচ ও দেবযানীর  মুখে  এসে পড়েছে। দুজনাই  মুগ্ধ। তবে দেবযানী সেই মুহূর্তে  ভালোবেসে ফেলে কচকে। মনে আছে তোমার১৯৭১ সালের কোন এক সকালে কয়েকটি  ছেলে নিয়ে খুব  ভোরে বাংলাদেশের  স্বাধীনতা  যুদ্ধে সাহায্যের জন্য চাঁদা তুলতে৷ আমাদের  বাড়ি এসে দাঁড়ালে।আমি পড়ার টেবিল  থেকে বাইরে  এসে ভোরের  সেই মায়াবী  আলোয় তোমাকে  দেখি।আমি হারিয়ে  ফেলি নিজেকে।বাবাকে বললাম  আমি দাদাদের  সাথে  চাঁদা তুলব। বেরিয়ে  এলাম।কিশোরী  আমি।ফ্রক পরী তখনো। তুমি একমাস ছিলে আমাদের  গ্রামে।কতবার দেখা।আমাদের  বাড়িতে  তোমার অবারিত  দ্বার।তুমি আসতে, গানশুনতে, চলে যেতে।আমার মন ভারী হয়ে যেত।আমরা  দুবোন  মা  বাবাকে রাজী করিয়ে তোমার সাথে তোমারি বয়সি এক কাকাকে  নিয়ে সিনেমা  দেখতে যাই বহরমপুরে। সিনেমা  শেষে রিক্সায়  ফিরি।অভাবিত  ভাবে  তুমি  আমি  এক রিকশায় বসি দীর্ঘ  পথ। মুর্শিদাবাদের রাস্তা। রাস্তার দু'ধারে  আমগাছ । কত ইতিহাসের  সাক্ষী এই গাছ  গুলি
কত উত্থান  কত পতন,আমদের এই পথ চলার সাক্ষীও এই গাছগুলো। পাশাপাশি  বসেছি তোমার গায়ের  সাথে আমার গা লাগছে।এক অনাস্বাদিত  পুলকে সদ্য তরুণীর দেহ মন ভরে ওঠে। তুমি কত কথা বললে।আমার মুখটি তোমার চুম্বনে পবিত্র  হয়ে ওঠে। তুমি  ধরা দিলে।
স্বপন,এর পর তুমি চলে গেলে।যোগাযোগ  ক্ষীণ  হতে ক্ষীণ তর হতে হতে একসময় থেমে গেল। জীবনের  প্রয়োজনে  দুজনের  জীবন নূতন খাতে প্রবাহিত  হতে থাকল। বিয়ে হল,পুত্র  কন্যা হল,সব হল।তবুকোথায় যেন অপূর্ণতা  রয়ে গেল।মনে পড়ে জীবনানন্দের  কবিতা -"বধূ শুয়েছিল  পাশে /প্রেম ছিল, আশা ছিল /তবু দেখিল সে কোন ভূত/ ঘুম  ভেঙে  গেল তার"।
দীর্ঘ  জীবনে যখনি একা হয়েছি,তখনি কিশোরী  বেলার সেই  সকালের কথা মনে হয়েছে। মনে পড়ত রিক্সায় আসা সেই  সন্ধ্যাটির কথা।তোমার গায়ের  সৌরভ আমি  যেন আজো টের পাই।গ্রামের আলে তোমার হাত ধরে  হাঁটার  ছবিটি  আজও আমার  কাছে পবিত্রতম মনেহয়। সংসার জীবনকে সন্তুষ্ট  রাখতে গিয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগ  কটা যায়নি  তোমার সাথে।হয়তবা তোমার অবস্থা  ও আমারি মত।আজ এই আসন্ন মৃত্যু  শয্যায় কেবলি তোমাকে  একবার দেখতে ইচ্ছে  করছে।  সম্ভব নয় কী দেখা করা?
৷ ৷৷৷৷৷ মধুমিতা
আমি  অবাক। কত বছর পর কোন এক  অজানা লোক যেন কী এক বার্তা এল।আমি যুগপত্ বিস্মিত  ও শোকস্তব্ধ। স্মৃতির সিঁড়ি  বেয়ে মুহূর্তে সেই  সব নব যৌবনের উন্মোচনের দিনগুলো  এসে ধরা দিল।১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমি City College থেকে বি,কম পার্ট ওয়ান এর  Testপরীক্ষা দিয়ে মুর্শিদাবাদ  আমার এক আত্মীয়  বাড়ি  বেড়াতে  যাই। সেখানে প্রায় একমাস  ছিলাম।সেখানে নজরুল  গীতির সুবাদে মধুমিতার কাছে আসি।কিন্তু  সে ছিল নিতান্ত অপরিনত বয়সের এক ধরনের  অবুঝ  ভালোবাসা। যার পরিনতি কীহবে কেউ জানতামনা।এযেন রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার  গল্পের পোস্টমাস্টারের মত।জীবনের  প্রয়োজনে ছোট্ট  মেয়ে "রতনকে" গ্রামে ফেলে রেখে মাস্টার  মশাইকে  এগিয়ে  যেতে হয়।ভাবে জীবনের  বাঁকে বাঁকে কত রতনের দেখা হবে।
ভাবছি  দেখা করব তার সাথে।তাকে বলব মধুমিতা  তুমি কি রবীন্দ্রনাথের "হঠাৎ  দেখা" পড়নি,যেখানে মেয়েটি  প্রশ্ন করেছিল পূর্বতন প্রেমিককে "আমাদের  গেছে  যেদিন  সবই কী গেছে/কিছুই  কী তার নেই  বাকী "
উত্তর এলো-"রাতের  সব তারই আছে
দিনের  আলোর গভীরে "
মধুমিতা ঝড় থেমে যাবে।তুমি নিরাময় হয়েউঠবে।আমাদের  মধ্যে  নূতন  করে গড়ে উঠবে নূতন এক সম্পর্ক যা জীবনের  আগুনে পুড়ে  শুদ্ধ  ও পবিত্র।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...