Saturday, December 25, 2021
সম্পাদকীয়
বছরের শেষ সংখ্যা। ভুল, ভ্রান্তি, সংশোধন, সংযোজ প্রতিটি বছরই হয়। এ যাত্রা অনন্তকালের এক শাশ্বত যাত্রা। আমরা উন্নীত হতে হতে উন্নত হই। আমাদের কোনোকিছুর অন্ত নেই।
শেষের শেষদিকে মনন স্রোতের সংখ্যা এটি। ক্ষুদ্র পরিসরে এ আয়োজনের ভুল অনেক ভ্রান্তি কম। এ ছাড়া প্রতিশ্রতি দেওয়ার মতো সম্পাদকের কিছু নেই। মানবতারা জয়ী হোক। মনন স্রোতকে সামাজিক দায়বদ্ধতায় এভাবেই সবাই সহযোগিতা করবন, এই আশা রাখছি। নতুন বছর সবার জীবনে সুখ সমৃদ্ধি ও আনন্দ বয়ে আনুক।
শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা!
বিনম্র
জয় দেবনাথ
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
মনন স্রোত, ত্রিপুরা
Friday, December 24, 2021
সঞ্জয় দত্ত
পরিক্রমণ
প্রতিনিয়ত ঋতুরাজ হেঁসে হেঁসে চলছে,
তাঁর বাহনগুলো ও আমার মন একসাথে হাঁটছে না।
ক্রমশ একাকী হয়ে ভাবছি...
কেন প্রখর তেজ?
কেন বর্ষাবরন অনুষ্ঠান?
কেন এত সাজগোজ?
কেন পূর্বাভাস?
কেন এত কষ্ট!কেন কেঁদে কেঁদে ফেটে পরে ডালিম?
কোকিল কন্ঠি সুরের মুগ্ধতায় কেন হয় চেহারার পরিবর্তন?
আহা!
এরই মাঝে একঝাঁক চিত্রশিল্পী
কতো ছবি এঁকে দিয়ে গেছে আমায়,
এসবের মায়া আমার ক্লান্তিকে মেরে ফেলেছে।
আমি ভীষণভাবে ঋণী তাদের কাছে..
দিপিকা রায়
প্রয়োজন
ক্ষুদার্ত শহরে ঘৃণ্য ডাস্টবিন টা ও
একসময় অমৃত হয়ে ওঠে।
শান্ত শহরে উঁকি দেওয়া
কুড়ি গুলো ছিটানো জঞ্জালে,
স্বপ্ন বুনে।
অভাবের বোঝায় খালি পকেটে,
শুধু লাঞ্ছনার ভিড়।
সুপ্ত চাহিদাগুলো আটকে যায়,
কিছু সময়ের পরিক্রমায়।
বিষন্ন মুখে অবসানের হাসি
ক্ষিদে নিবারনের সামান্য মাত্র।
ভাগ্য বিচারে ললাট রেখা,
হস্তরেখা, ধুলোয় মুছে
আনন্দস্ফুর্তি নর্দমায় বাড়তে থাকে।
শূন্য হস্তে ভিক্ষার ঝুলি,
পান্তায় দিন ফুরায়।
চোখে ঘুম কাটে,
আবারও ভোরের ক্ষুদা নিবারণে।
শুকিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট গাছে,
বাঁচতে চায় কলি গুলো।
অবহেলিত ভিড়ে হাঁটতে চায়,
দিনের শেষে সেই ভালোবাসায়।
সৃজিতা নন্দী
সুখের কোলাহল
একদিন আমার সমস্ত সুখের কোলাহল তোমাকে সঁপে দেব।
বিধ্বংসী ঝড় তৈরি করে দূরত্বের বেড়াজাল,
ফিরে না পাওয়াটা মেনে নিতে হয় সময়ের সাথে সাথে।
শূণ্যতা অধিক কথা বলে।
ভেঙে যাওয়া মানুষের সহ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
আর্তনাদের চিৎকার সে শুনতে পায় না।
একসময়ে সেই মানুষের পূর্ণতা নিজের চোখে দেখি!
পাশে আমি কে মুছে ঘর বেঁধেছে অন্যজনের সাথে।
সরল সুদে হিসেব নিকেশ করে রেখেছি...
একদিন আমার সমস্ত সুখের কোলাহল তোমাকে সঁপে দেব।
পান্থ দাস
পলাশ
ওফ্ আজ আবার সেই সোমবার, আবার সেই একঘেয়েমি জীবন ৷ আমি পলাশ ৷ জীবন ভেলায় ভাসতে ভাসতে অসংখ্য প্রতিকূলতার বাধা অমান্য করে আমি একজন বাধ্য নাবিক ৷ বয়সটা কম হলেও দায়িত্বের ভারটা কম নয় যদিও ৷ কৌশরেই আমার মাথার উপরের বটবৃক্ষটাও আর ছায়া দেয় না ৷ আছি সুখেই তবে, নেই যেন কোন অনুকূলতা ৷ মনের সমুদ্র স্রোত অনবরত উঠা নামা করতেই থাকে ৷
উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্বেও চাকুরি পাওয়ার জন্য এখনো আমি অপেক্ষায় আছি ৷ গৃহশিক্ষকতা করেছি কিছু বছর, তবে মনো সন্তুষ্টি পাইনি খুঁজে ৷ সর্বসন্তুষ্ট পাই একমাত্র মায়ের কাছে আসলে ৷
সত্যিই ২৫ বছর থেকে ৩০ বছর বয়স মানব জীবনের সবচেয়ে অনুভূতিপূর্ণ বয়স, না থাকা যায় সুখে আর না থাকা যায় দুঃখে ৷ অনুভূতিগুলি যেন এখন আর ডানা মেলতে চায় না, সময়ের সাথে সাথে সব অনুভূতি যেন প্রায় নিষ্প্রাণ ৷
ভাগ্যকরে জীবন পথে কিছু মানুষ পেয়েছি, বন্ধু বলে পরিচয় দেইনা তাদের ৷ তাঁরা আসলে বন্ধু রূপে আমার পরিবার ৷ তবে, একাকী ঠিক খেয়া বেয়ে যাচ্ছি হারিয়ে, অনন্য না ভোলা পথের দিশে ৷
মৌসুমি গোয়ালা
পার্বতীয়া তটিনী
পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসে স্রোতস্বিনীরা,
আপন প্রবাহে প্রবাহিণী 'মনু', 'গোমতী',
'ধলাই', 'ফেনী ' কিংবা 'জুরি'।
পার্বত্য ত্রিপুরার অসংখ্য মানুষের নিত্যদিনের
সঙ্গী 'দেও', 'মুহুরী।
কখনও বা উত্তাল তরঙ্গে 'বিজয়' চলেছে সমুজ্জ্বল ধ্বজা বয়ে,
কখনও বা উপনদীর তকমায় তৃপ্ত দূরন্ত 'লঙ্গাই'।
পার্শ্ব সঙ্গিনী সর্পিল পথ ধরে ছুটে চলে 'খোয়াই'।
রাজধানীর মুকুট শতাব্দী প্রাচীন 'হাওড়া'-
সহজ সরল বাহ্যিক আড়ম্বরহীন,
বর্ষারাণীর কোমল সোহাগের নীরব প্রতিক্ষা ক্ষীনকায়ার।
অত:পর কল্লোলিত পর্বতকন্যারা প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ বিমোহিত করে মিশে যায় দয়িতের বুকে।
মোহাজির হুসেইন চৌধুরী
উপেক্ষা
জানিস! এখন আমার জন্য কেউ আর
অপেক্ষা করেনা
আমার যারা --- আগে আমাকে না পেলে
দারুণ মর্মাহত হত তারা
সব 'সময়' হয়ে গেছে
দ্রুত ধাবমান স্রোতস্বিনীর মতো
এখন আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনা
মন খারাপের চিত্র মুখে এঁকে
পাশ কেটে চলে যায়
যেন হাতের নাগালে এলে বিনষ্ট হবে
এক একটি পল মহামুল্যবান।
আমি একা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি
সুনসান রাস্তা একমুঠো ধূলো ছিটিয়ে
ঢেকে রাখে আমার প্রলাপজনিত গান।
গৌতম মজুমদার
ভিক্ষাবৃত্তি
চাইনি কৃষি,চাইনি শিল্প
চাইনি স্বাস্থ্য শিক্ষা,
ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে লয়ে
করছি এখন ভিক্ষা ।
দোরে দোরে ভিক্ষে করে
জুটছেনা আর কিছু,
দারিদ্রতার কড়াল গ্রাসটা
ছুটছে পিছু পিছু।
যার গৃহে যাই বলছে সবাই
"আজকে ফিরে যান",
হাতটা তুলে ঠুকলে কপাল
বুক করে খান খান।
কল কারখানা সবই বন্ধ
নেইকো উৎপাদন,
হন্যে হয়ে ঘুরছে বেকার
চাকরি নেই তেমন।
নেইকো কাজ,নেইকো চাষ
নেইকো ব্যাবসা বানিজ্য,
মুখ খুলে আজ বলছে সবাই
হচ্ছে না আর সহ্য ।
ক্লান্ত দেহে গৃহে ফিরে
হিসেব কষি দিনের,
মিলছেনা আর আগের মত
হচ্ছে পাহাড় ঋণের ।
গঙ্গা সাহা
উপেক্ষা
এখন আর কিছু যায় আসে না,
কে আমায় নিয়ে কি ভাবলো ,
বা কি ভাবছে,
কিংবা কে আমায় গুরুত্ব দিল,
না গুরুত্ব দিলো না।
সে সব আর গায়ে মাখি না।
জীবনটা একান্তই আমার,
আমি কি করবো, কি না করবো,
সেটা একান্তই থাকুক না হয়,
আমার ব্যক্তিগত।
অযথা দুমুখো মানুষের জ্ঞান,
এখন আর সহ্য হয় না।
যাদের মুখে এক আর মনে আরেক।
ওদের কথা শুনলেই কেমন যেন
শরীরে খুব অসস্তি হয়।
তবুও বারংবার মুখোমুখি হতে হয়,
ওই না দেখতে চাওয়া মানুষগুলোরি।
হয়তো এটাই জীবন।
তাইতো এই সব কিছুই উপেক্ষা করে,
এগিয়ে যেতে চাই জীবনের বাকি পথ।
সৈকত মজুমদার
নষ্ট জীবন
আমার অযথা লেখা সব কবিতা
আজ তোমায় উৎসর্গ করলাম
জানি তোমার জীবনে হয়তো
আমার কোনো মূল্য নেই, আর
সব সময় যা চাই তা কখনোই পাই না,
এভাবেই কেটেছে শৈশব থেকে কৈশোর।
তেত্রিশটা বসন্ত পেরিয়ে আজ
আমি একা, একেলা মন
আমার নষ্ট জীবন !!
আলমগীর কবীর
সফলতা যখন বিফল হয়।
হঠাৎ করে কখনো কোনো কিছু পাওয়া যায়না
কিছু পেতে হলে তার পেছনে পরিশ্রম দিতে হয়।
সেই পরিশ্রম অনুযায়ী তুমি কিছু ফলের ভাগীদার হও।
মনে রেখো আজ তুমি যে ফল ভুগ করছো
এটা কখনোই তোমার ছিলনা!
এটা ধারাবাহিক ভাবে আজ তোমার হাতে এসেছে।
তাই তুমি নিজেকে মহান ভাবার কিছু নেই।
হয়তো একদিন সেই একই পক্রিয়ায়
আমিও তোমার থেকে উপরে চলে যেতে পারি।
সফলতায় কখনো শুধু ব্যক্তিগত ভূমিকা থাকেনা।
এর পেছনে তোমার চারপাশে থাকা জরবস্তুুগুলিরও অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে।
তারা চলতে পারেনা, কথা বলতে পারেনা বলে,
তোমার সফলতায় তাদের ভূমিকা নেই ভাবাটা,
তোমার সবচেয়ে বড় বোকামি।
তাই তোমার সফলতার পেছনে যাদের ভূমিকা রয়েছে,
তাদের পাওনাটুকু দিতে পারো বা না পারো-
কিন্তুু কখনো তাদের অবহেলা, বা অপমান করোনা।
সজীব কুমার পাল
স্মৃতির চিঠি
এখন আমার মৃত্যুর মাস চলছে
দীর্ঘ বছর হয় কোনো রোদ্দুরের গন্ধ পাইনি!
বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে জীবন, যে জীবন ছিল আমার।
নীল, তুই কি জানিস
এখন আমি ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন প্রাণী মাত্র?
বন্ধু, মনে আছে
আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমরা শিশু ছিলাম?
আমাদের উঠুন জুড়ে ছিল দোয়েল পাখি ,
সেগুন পাতার ঘর,
ঠাকুরমার শেখানো কাঠাল পাতার কাফ,
এবং মায়ের নামে আমাদের সেই ছোট্ট পুতুল?
মনে আছে তোর নীল,
সেই পতুলটা একদিন খুঁজে না পেয়ে
তুই আর আমি কেমন দিশেহারা হয়েছিলাম?
নীল,
জীবন আমাকে যা দিয়েছে তার ঢের নিয়েছে,
নয়তো আজ দেখ
পতুলটার মতো মা যে কোথায় হারিয়ে গেল!
আমার এখন নিষ্ঠুর মৃত্যুর মাস চলছে নীল, মৃত্যুর মাস।
কৈশোরে শুকনো পাতা সিক্ত করে
যে বসন্ত এসেছিল আমাদের জীবনে,
যে বসন্ত দিয়েছিল উন্মাদনা এবং অশান্তি!
তখন আমরা পেয়েছিলাম তীব্র জঘন্য সুখ।
হ্যাঁ নীল, আমি সেই চঞ্চল বর্ষার কথাই বলছি।
প্রথম তাকে তুই দেখেছিলি মাধবীলতার আড়ালে,
এবং বলেছিলি, 'মেয়েটাকে বেশ মানাবে আমাদের সাথে! '
হ্যাঁ নীল, হ্যাঁ! আমরা এইভাবেই একের ভেতর দুই হারাতাম!
সহজ সরল বালিকাটিও একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল,
তাকে আমরা আর কেউই খুঁজিনি।
এইভাবেই হারাতে হারাতে আমরা বড়ো হলাম ,
বড়ো হতে হতে সব হারালাম।
কিন্তু নীল,
তুই কেন হারালি?
আমার ভাই হারালো, আমার মা হারালো, আমার বাবা হারালো,
শৈশব, কৈশোর সব সব হারালো।
কিন্তু তুই কেন হারালি?
বন্ধু! বন্ধু সে তো আজন্ম সাথী ,
আজ তোর কাছে আমি নেই
কিন্তু আমার কাছে তুই আছিস।
তাইতো গোপনে-নির্জনে লিখছি স্মৃতির চিঠি, স্মৃতির চিঠি।
লিটন শব্দকর
নিবিড়ে ২৯
সাদা চালের গুঁড়োয় কোজাগরী আলপনায়
বকেয়া জাগরণে বহতা স্বত্তার ম্রিয়মাণ নদী
আশ্বিনের ধানের সোনালী রঙ ছুঁয়ে বলেছে
এসো আজ ভাগ করে নিই রোদ শুশ্রূষাটুকু
অপ্রতুল চন্দ্রাভা মাখানো অভিমানের জলে।
তোমার মুঠোফোন আর আমার দুর্গোৎসবে
যখন নদীটির বুকে কোমরে জমেছিল ভ্রান্তি
রিংটোনে জমছিলো আড়চোখ যথেচ্ছাচার,
এখনও আছে নদী শুধু আমরা অন্যরকমই।
অভিজিৎ রায়
মা দুই টাকা দাও
ছোট বেলায় মনে আছে দু টাকার কথা?
স্কুলে যাওয়ার সময় বলতাম
মা দুই টাকা দাও না গো
স্কুলে গেলে আসার সময় লোপ না কেক খাবো।
মা বলতো প্রতিদিন টাকা কোথায় পাবো
তোর বাবা কত কষ্ট করে উপার্জন করছে
আর তুই টাকা নষ্ট করছিস?
দুই টাকার সাথে আর কিছু দিলে চাল আনতে পারবো
সবাই মিলে একসাথে খেতে পারবো।
দেখ তারপর ও তুই যদি বায়না করস টাকা আমি দেবো
না মা লাগবে না আমরা টাকা সবাই মিলে একসাথে ভাত খাবো
আমি লোপ কেক খাব না মা কিছু বল না বাবাকে ।
এমনিতে মিথ্যা কথা বললাম আমি তোমাকে।
চুখের জল এসে যায় এখন
আজ যখন হাতে অনেক টাকা
কিন্ত মায়ের সেই ভালবাসা টুকু
আজ যেন অনেক ফাঁকা
কথায় কথায় বলে তোর মত ছেলে জন্ম দিয়ে ভুল করেছি
একটা মেয়েকে জন্ম দিয়ে শান্তি পেয়েছি।
আজও বুঝলাম না মা আমার প্রতি কেন এমন ব্যাবহার?
হয়তো বা বড় হয়ে উচিৎ কথা বলতে গিয়ে হচ্ছে আমার প্রতি অবিচার।
এখনো মনে পড়ে সেই স্কুলে যাবার সময় বিস্কুটের কথা
বলতে পারি না কাউকে মা লাগে মনে শুধু ব্যাথা।
তবুও প্রার্থানা করি মা ঠাকুরের কাছে
জীবনের শেষ লগ্নে হলেও যেন নিজের ভুল
চুখে ভাসে।
মিঠুন দেবনাথ
জীবন যেন আলেয়া
অজানা এক সপ্নের ভীরে,
গেছি আমি হারিয়ে।
আলো ভেবে করেছি মস্ত বড় ভূল,
আলেয়ার পিছনে হাত বাড়িয়ে।
কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার,
কোথাও আবার দুঃসপ্নের আনাগোনা।
সপ্ন ভেবে যাকে রেখেছি বুকে আগলে,
অচিরেই দুঃসপ্ন হয়ে করল চুরমার ...
মনের সব প্রিয় ভাবনা।
তরী ভেবে করেছিলাম ভর,
তটিনী পারাবার ত্বরে।
তরী যেন চায় না চলতে,
বাধা হয়ে অজানা বালি চরে।
আশায় আশায় বুক বাঁধি,
হয়ত জীবন চলবে জীবনের শ্রোতে।
প্রতিনিয়ত জীবন করছে জীবনের সাথে খেলা,
উন্মত্ত হয়ে আছে জীবন কে হারাতে।
বিধাতা ও আজ যেন বন্ধ করে আছে দুটি আখি,
ভাগ্যদেবী চলে গেছে অনেক দূর।
বার বার ভাগ্য যে দিতে চায় ফাঁকি।
মরুর বুকে আছি বসে,
যদি হয় এক পশলা বৃষ্টি।
আকাশে চলে সহশ্র মেঘের আনাগোনা,
কিন্তু এক বিন্দু জলকনার উপর ও পরেনী দৃষ্টি।
সময় বদলে যায় সময়ের সাথে,
আমি কিন্তু সেই একই আছি....
নিজেকে বদলানোর কিছুই ছিল না,
এই দুই হাতের রেখাতে।
দুলাল চক্রবর্তী
সাদা কাগজের পাতা
যেদিন আমি চলে যাবো চিরতরে
এ পৃথিবী ছেড়ে
চোখে যদি জল আসে কভু,
হৃদয়টা যদি ভারাক্রান্ত হয়
তাই বেদনার ভিক্ষা ভন্ড নিয়ে যাবো আমি ।
নিঙারিয়া নেবো আমি হৃদয় যন্ত্রনা
মন থেকে মুছে ফেলো সব
অতীতের স্মৃতি।
যে পথে চলতে গিয়ে
হেরে গেছি বারবার !
পান্থশালার দরজা তো বন্ধ অনেক আগেই
দিকভ্রান্ত পথিকটা
শুধু পথ খুঁজে মরছিলো
দু'দণ্ড বিশ্রামের আশায়।
আজ সেই বিশ্রাম পেলো
চিরতরে ধরণীর বুকে।
জাগাতে যেও না তাকে
এই ঘুম আর ভাঙবে না কোনদিন।
কি অছিলায় জাগাবে তারে ?
সে যে আজ চির নিদ্রিত!
অতীতের ডাইরি থেকে ছিঁড়ে ফেলো
সাদা কাগজের এই
দাগ না লাগা পাতাটা।
না লেখা থাকুক শেষ অধ্যায়!
রূপালী মান্না
আলুবীজ
আজ সকাল ১০ টা ৩০ এর দিকে বাড়ির যাবতীয় কাজ সেরে নিয়ে ছাদে বসে আলুবীজ কাটছিলাম।
শশুরমশাই এসে বলে গেলেন - চোখে চোখে কাটবে। চোখে চোখে কথার অর্থ হলো প্রতিটা কল অনুযায়ী পিস পিস করতে।
প্রতিটি চোখে চোখে আলুবীজ কাটতে কাটতে মানুষের জীবনের সাথে এর অসাধারণ মিল পেলাম। কিছু ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে খাতা পেনটা আনলাম। নইলে ভুলে যাবো।
ছোট্ট ছোট্ট আলুবীজগুলোর গা ভর্তি স্বপ্ন অর্থাৎ কল। প্রতিটি কলকে আমি টুকরো টুকরো করে দিচ্ছি যেভাবে একজন মানুষের স্বপ্নকে তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি টুকরো টুকরো করে দেয়। কারণ ফসল ফলাতে গেলে যেমন আলুবীজটাকে টুকরো টুকরো হতে হবে তেমনি স্বপ্নটা পরিপূর্ন করতে গেলে ব্যক্তিকে আঘাতে আঘাতে খাঁটি, পরিশুদ্ধ হতে হয়।
টুকরো আলুবীজগুলো কে নিয়ে চাষী জমিকে চাষযোগ্য করে চাষ করে। আড়াই থেকে তিন মাস জল, সার, চাপান, আগাছানাশক, প্রয়োজনীয় শ্রমিক ব্যয় করে একটা পূর্ণাঙ্গ আলুগাছে পরিণত করে। ঠিক যেরকম আমাদের স্বপ্নের পিছনে আমরা প্রয়োজনীয় শ্রম, অর্থ, সময় দিয়ে থাকি আরকি ! বারবার ভেঙে পরেও যেমন উঠে দাঁড়ায়।
আলুগাছটিতে আলু ধরার ঠিক আগের মুহূর্তে যদি জেদি কোনো নিম্নচাপ এসে তছনছ করে দেয়, তাহলে ?
তাহলে দাদন নিয়ে আলুচাষ করা চাষী অনেক সময় আত্মহত্যা করে , এ খবর আমরা খবরের কাগজে বহুবার পড়েছি ।
একটা আড়াই মাসের ফসলকে কেন্দ্র করে যদি চাষীর জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে , তাহলে সেই ছোট্ট থেকে স্বপ্নবীজ বপন করে আসা ছেলেটার বা মেয়েটার মনের অবস্থা ঠিক কী হয় বুঝতে পারো তোমরা ?
অর্ধেন্দু ভৌমিক
লজ্জা
লজ্জা নিবারণে কাপড় পড়া
হয়তো বা শেখা হয়েছিল কোনদিন
মনে পড়ে না, আজও উলঙ্গ সেজে
নিজেকে সভ্য দাবি করি !
আমার সভ্যতা
উৎরাই পথ কংক্রিট আগলে...
মানুষ হয়ে হৃদয়ে
ছারপোকা পোষ মানি...
বিনয় শীল
প্রজাপতি
প্রজাপতি প্রজাপতি
ফুরফুর করে ইতিউতি
উড়ছো আকাশ কূলে।
চিত্র রাঙ্গা পাখা মেলি
দলে দলে খেলা খেলি
ঘুরছো ফুলে ফুলে।।
লাল নীল হলুদ সাদা
জবা জুঁই টগর গাঁদা
সবার কাছে যাও।
পাপড়ি পরে পা রেখে
পুষ্পরেণু গায়ে মেখে
ফুলের মধু খাও।।
মধু খেয়ে তৃপ্ত মনে
লক্ষ্য এখন অন্য বনে
ছুটছো এঁকে-বেঁকে।
ঝাঁকে ঝাঁকে নামছো আবার
স্বপ্ন শুধু মধু খাবার
পুষ্প কানন দেখে ।।
প্রজাপতি প্রজাপতি
দেখতে বড় কোমলমতি
একটু সঙ্গ দেবে?
রঙিন ডানায় ভর করে
উড়তে ইচ্ছা আকাশ পরে
আমায় সাথে নেবে ?
অভীককুমার দে
এক্কই তালে
ছা-র, ও ছা-র...
যেন্নে যেন্নে শিকাই দিছেন
আন্ডাঅ চিল্লাইছি গলা হাডাই
ব্যেকে মিলি এক্কই তালে,
নঅ বুজি
নঅ হুনি
নঅ জানি
চিল্লাইতে কন হোয়াদ ?
আগে যেই হরেঅ হেই
আজাইর্গ্যা হরিশ্রম...
আরিগ্গা চলকেট দেন থাইকলে,
মিডা কম অইলেই অইবো;
চুইতাম...
আগেরগুন চুইতে চুইতে
এক্কারে মিডা অই গেছিগোই;
হিম্বায় ধরের অন !
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
ত্রিপুরারাজ্যে অতি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি সাধনার ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির তারই একটা উজ্জ্বল উদাহরণ । ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানেও বহু কালীমন্দির রয়েছে এবং নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে আসছে । এক কথায় সারা ত্রিপুরা রাজ্যকেই শক্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজ্যের পিলাক, মাতাবাড়ি, বক্সনগর,এবং ঊনকোটির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লক্ষ্য করলেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।
এ রাজ্যের পাশাপাশি সাব্রুমেও শক্তি চর্চা হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তিক শতাব্দীপ্রাচীন মহকুমা শহর সাব্রুম । তারপরই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা শহর রামগড় । মাঝখানে সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে বয়ে চলেছে ফেনী নদী । সাব্রুম শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ফেনীনদীর পাড়ে রয়েছে প্রাচীন কালীমন্দির । এই মন্দিরটি দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত। খুবই জাগ্রত এই দেবী । সাব্রুমের আপামর জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন । দেবী এখানে 'দক্ষিণাকালী' নামে পূজিতা হয়ে আসছেন । রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম সম্ভবত 'দক্ষিণাকালী' ।স্থানীয় জনগণের কাছে এটাও ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর ন্যায় এক পীঠস্থানের মতো । এই মন্দিরে নিত্য দেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে এই কালীবাড়িতে প্রত্যেক অমাবস্যায় দেবী কালিকার পুজোসহ মেলা ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা-অর্চনাও হয়ে থাকে । বহু বছর যাবত এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে । এককথায় বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার জনগণের গভীর শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন দেবী দৈত্যেশ্বরী কালীমাতা । এই দেবীকে কেন্দ্র করে বহু অলৌকিক কাহিনি সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে । এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে গণেশ চক্রবর্তী, লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন প্রমুখগণসহ আরো অনেকে অনুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ।
দেবী দৈত্যেশ্বরী মন্দির ও তার সৃষ্টিকাল সম্বন্ধে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে । কেউ কেউ বলেন এই পাথরের বিগ্রহটি সাব্রুমের পশ্চিমপ্রান্তের গ্রাম দৌলবাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দৈত্যছরাতে পাওয়া যায় । সেখান থেকে হাতি দিয়ে তুলে এখানে আনা হয় । দৈত্যছরা থেকে পাওয়া যায় বলে এই বিগ্রহের নাম হয়েছে দৈত্যেশ্বরী । আবার একটা অংশের মত হল এই পাথরপ্রতিমাকে সাব্রুম শহরের পূর্বদিকে কিছু দূরের একটি ছরার পাড়ের পাহাড়ের একটি গুহার মধ্যে এই বিগ্রহটি ছিল । সেখান থেকে নৌকাযোগে তুলে এনে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই কাহিনিটিরই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে একদল বলে থাকেন যে, এই বিগ্রহটি শিলাছড়িস্থিত শিলাগুহাথেকে রাজকর্মচারীরা তুলে নৌকা করে এনে এখানে স্থাপন করেন । এই মন্দিরের পাশেই ছিল রাজার তহশিল কাছারি । যা এখনও বর্তমান । যাই হোক, এ সমস্ত কিংবদন্তী বা লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে এই মন্দিরের সৃষ্টির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যোগাযোগ অবশ্যই ছিল ।
এবারে আসা যাক, এই মন্দিরের সৃষ্টির ঐতিহাসিক সূত্রটির সন্ধানে । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসসম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থটির নাম রাজমালা । এই রাজমালার প্রথম লহরের শুরুতে ত্রিপুরার আদিযুগের রাজাদের একটি তালিকা রয়েছে । এই তালিকার পঁয়তাল্লিশতম রাজা হলেন দৈত্য । তাঁর পিতা ছিলেন চিত্ররথ । সুশীলা নাম্নী মহিষীর গর্ভে যথাক্রমে চিত্রায়ুধ, চিত্রযোধি ও দৈত্য নামে তিন রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন । দৈত্যের বড়ো দুইভাইয়ের মৃত্যু হলে দৈত্য রাজা হন । রাজমালা প্রথম লহর ( যযাতি হইতে মহামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ )-এ গ্রন্থারম্ভের পরই দৈত্য খন্ডের শুরুতে রয়েছে―
দ্রুহ্যু বংশে দৈত্য রাজা কিরাত নগর ।
অনেক সহস্র বর্ষ হইল অমর ।।
বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল ।
ত্রিবেগেতে জন্ম নাম ত্রিপুর রাখিল ।।
রাজা দৈত্যের সময়কাল থেকে রাজমালা প্রথম লহরের বর্ণনা শুরু । এই দৈত্য ছিলেন কালিকাদেবীর উপাসক । রাজ্যের প্রবীন গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী তাঁর 'ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ' একদা দৈত্যআশ্রম সন্নিহিত গভীর অরণ্যে ভ্রমণকালে এক মন্দির দেখিলেন । মন্দিরস্থিতা কালিকা দেবীর সশস্ত্র মূর্তি দর্শন করিয়া দৈত্যের মনে ক্ষত্রিয়তেজ জাগিল । দেবীর অর্চনা করিয়া নিষ্ঠার সহিত অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন পারদর্শিতা অর্জন করি এবং মায়ের আ । অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করিয়া এবং মায়ের আশীর্বাদ লইয়া তিনি পিতৃরাজ্যে প্রত্যাবর্তন পূর্বক পাত্র-মিত্র সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন।' এখানে ধারণা করা যায় যে, রাজা দৈত্য অরণ্যস্থিত যে দেবীর অর্চনা করে রাজধানীতে ফিরেছিলেন তিনিই এই দেবী দৈত্যেশ্বরী। এছাড়া মহারাজা রামমাণিক্যের পুত্র রত্নমাণিক্যের (১৬৮২–১৭১২ )দুই মাতুল দৈত্যনারয়ণ ও বলীভীমনারায়ণ নবীন রাজাকে রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন ।বলীভীম নারায়ণ মতাই জোলাইবাড়ি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন । রাজ্যের দক্ষিণ অংশ দেখাশুনা করতেন দৈত্যনারায়ণ । দৈত্যনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর নাম অনুসারে এই দেবীর নাম দৈত্যেশ্বরী হয়েছে বলে মনে করা হয় । বহু বহু প্রাচীনকালে এই সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল অরণ্যসংকুল ছিল । পরবর্তী রাজন্যকুল তাঁদের পূর্বজবংশধরের সাধনাস্থল ও দেবী সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন বলেই পরবর্তী পুরুষেরা তার সন্ধান করে বিগ্রহটি উদ্ধার করেন । অমরমাণিক্যের ( ১৫৭৭–১৫৮৫ )সময়ে এই রাজ্যের দক্ষিণ অংশ মগদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল । তারাও এই দেবীবিগ্রহটি সরিয়ে গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে পারে । অনেকে বলেন মগগণ এই দেবীর পূজা করতেন । এই মন্দিরের ব্যয়নির্বাহসংক্রান্ত হিসাবের একটি পুরানো চিরকূটে চাঁদাদাতা হিসাবে মগ পুরুষ ও নারী ভক্তের নাম পাওয়া যায় । ( তথ্যসূত্র : মন্দিরের প্রথম পুরোহিতের বংশধর তপন চক্রবর্তী, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ) ।
এবিষয়ে রাজ্যের বিশিষ্ট কবি লোকসংস্কৃতি গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে,'এ অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ এলাকা ডাকাত বা মগ দস্যুদের আস্তানা ছিল । এই দস্যুদের পূজিতা দেবী হিসাবে 'দৈস্যেশ্বরী' নামকরণ হতে পারে । এই দৈস্যেশ্বরীই রাজপুরুষ কর্তৃক উদ্ধার হওয়ার পর সংস্কৃতায়িত হয়ে 'দৈত্যেশ্বরী' হয়েছে । এছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত বাংলাভাষায় ( নোয়াখালি ) দৈত্যকে দৈস্য উচ্চারণ করা হয় । যেমন, ব্রহ্মদৈত্যকে বলা হয় ব্রহ্মদৈস্য । কাজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দৈত্য শব্দটিই আসছে দেবীর নামকরণে উৎসরূপে ।' (সাব্রুমের দেবী দৈত্যেশ্বরীর ইতিহাস –অশোকানন্দ রায়বর্ধন ) । গবেষণার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভক্তের কাছে নামে কি আসে যায় । মা তো মা । ভক্তের আকুল প্রার্থনার স্থল । তাঁর চরণপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের হৃদয় ।
যতদূর জানা যায়,উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মন্দিরে পূজার্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সাব্রুমের সম্ভ্রান্ত ব্যানার্জী পরিবার ( রাজ্যের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী কালিপদ ব্যানার্জীর পূর্বপুরুষ ) । এই বাড়ির এক কালীভক্ত সদস্য সতীশ ব্যানার্জী এই মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি । এই মাতৃমন্দির ও মাতৃসাধক সতীশ ব্যানার্জীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সাব্রুমে । উনিশ শতকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব সময়কালে সারা বাংলাদেশ জুড়েই মাতৃসাধনার জোয়ার এসেছিল । তার প্রভাব সাব্রুমেও পড়ে ।
সাব্রুম অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ হলেও ভারতভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ( ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯ ) সাব্রুমের জনগণের ওপারের রামগড়ের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি । এখানকার মানুষ রামগড় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেন । রামগড়ের অনেক ব্যবসায়ীর জমিজমাও ছিল এখানে । তাঁরাও ব্যবসাসূত্রে সাব্রুমে অবস্থান করতেন । দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে তাঁদেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল । দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ির প্রথম পুরোহিত চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর পৌত্র বর্তমানে সাব্রুম শহরের বর্ষিয়ান বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাজলক্ষ্মী গেস্ট হাউসের মালিক শ্রীতপন চক্রবর্তী মহোদয়ের কাছে রক্ষিত তাঁর কাকা হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে লেখা তাঁদের বংশপরিচয় থেকে জানা যায় যে, ১৮৮৫ সালে রামগড়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিরীশচন্দ্র দাস অর্থাৎ গিরীশ মহাজন ( সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের সদ্যবিজয়ী জনপ্রতিনিধি দীপক দাস মহোদয়ের ঠাকুরদাদা ) সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজার্চনা করার জন্য তাঁর আদিনিবাস নোয়াখালির আন্ধারমাণিক গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীকে সাব্রুম নিয়ে আসেন । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, সে সময়টা ছিল মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) আমল ।
চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর চার সন্তান । যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রথম সন্তান যোগেন্দ্র চক্রবর্তী ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন তাঁর কর্মস্থল ছিল খোয়াইতে । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী দেশের বাড়ি নোয়াখালির আন্ধারমাণিকে আসাযাওয়া করে পর্যায়ক্রমে এইমন্দিরে পূজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন এই মন্দিরে দেবীর পূজার্চনা করে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ,শনিবার, কার্তিকী অমবস্যার রাত ৪-৩০ মিনিটে সাব্রুমে পরলোক গমন করেন । তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী মায়ের মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পান । দীর্ঘদিন মায়ের সেবার্চনা করার পর ১৯৬২ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন । তারপর কিছুদিন মায়ের মন্দিরে পুজো করেন উপেন্দ্র চক্রবর্তী । এরপর আবার চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মন্দিরের দায়িত্বে আসেন । হরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরে বর্তমান পুরোহিত অজিত চক্রবর্তীর বাবা শিবশংকর চক্র বর্তী দায়িত্বে আসেন । তাঁরাই বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত মায়ের মন্দিরে পুজো করে আসছেন । ( তথ্যসূত্র : সুব্রত চক্রবর্তী, সাব্রুম ) ।
রাজন্য আমলে রাজা বা রাজপুরুষেরা মন্দির সংলগ্ন তহশিলী কাছারিতে খাজনা আদায় বা পুণ্যাহের জন্য এলে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়েই তাঁদের কাজ শুরু করতেন । রাজার আমল থেকে এই পুজো চলে আসছে কিন্তু এই মন্দিরের কোনরকম রাজানুকুল্য বা সরকারি বরাদ্দ আজ অবধি নেই । পুরোহিতদেরও কোনো মাসোহারা বরাদ্দ নেই । একসময়ে মন্দিরের সামনে ও পেছনের সামান্য ভূমিতে খেতকৃষি করে তাঁরা সংসার চালাতেন । মন্দির কমিটি তাঁদের সামান্য মাসোহারা বরাদ্দ করেন । য়ন্দিরটিও ছোট্ট একটি চারচালা ঘর ছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল পুরোহিতের আবাস । আর ভক্তদের দানদক্ষিণায় তাঁদের সংসার চলে । মন্দিরেরও নিজস্ব কোনো স্থায়ী তহবিল নেই । ভক্তবৃন্দের আর্থিক অনুদানে মায়ের মন্দিরের সব ব্যয় নির্বাহ হয় ।
রাজন্য আমল ও তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে দীর্ঘদিন মন্দিরের উত্তরদিকের নাতিউচ্চ টিলাটিতে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । বর্তমানে এটি সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় । তার সামনের পুকুরটি 'কালীপুকুর নামে পরিচিত । মন্দিরের কালিকাবিগ্রহ একখন্ড পাথরবিশেষ । শ্রদ্ধেয় তপন চক্রবর্তী মহোদয় আলাপচারিতায় জানিয়েছেন এই বিগ্রহ মাটির নীচে অনেকখানি প্রোথিত আছে । লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই বিগ্রহ পূর্বে আরো ছোটো ছিল । ধীরে ধীরে বিগ্রহের উচ্চতা বেড়ে বর্তমান আকার নিয়েছে ।
দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িত । একসময় রাস্তাঘাট দুর্গম থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে যেতেন পুজো দেওয়া কিংবা মানত রক্ষার জন্য । পরবর্তীসময়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তার মাধ্যমে যাতায়াত করতেন । কিন্তু যাঁরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল তাঁদের জন্য দৈত্যেশ্বরী মা একমাত্র আশ্রয়স্থল । শক্তিতীর্থভূমি । মা তো জগজ্জননী । ভক্তগণ এখানেই মায়ের চরণে ভক্তি নিবেদন করেন । এই মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিচিত্তে পুজো, মানত করেন । বিয়ের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে এবং বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে বিয়েবাড়ির সবাই এই মন্দিরে এসে প্রণাম করার রেওয়াজ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত । জাগ্রত দৈত্যেশ্বরী মাকে বালিকাবেশে গভীর রাতে মন্দিরচত্বরে পরিভ্রমন করতে দেখেছেন বলে দাবি করেন অনেক ভক্ত । এই মায়ের মন্দিরের খ্যাতি এতদূর বিস্তৃত যে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ্যের বাইরে ও বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে মায়ের দর্শন করতে আসেন ।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলাশাসক থাকাকালীন সময়ে মাণিকলাল গঙ্গোপাধ্যায় মায়ের বাড়ির উন্নয়নের জন্য অর্থবরাদ্দ করেছিলেন । শোনা যায় তিনি মায়ের বিগ্রহের দুই নয়ন স্বর্ণ দিয়ে নির্মান করে দিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই মায়ের মন্দিরের বর্তমান মন্দির ও প্রাঙ্গনের সামনের দিকে অবস্থিত শিবমন্দিরটি ছাড়া লক্ষণযোগ্য তেমন কাজ হয়নি ।
সাব্রুমে ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু নির্মানের পর মহকুমার বাইরে থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ দৈত্যেশ্বরী মন্দির দর্শনের জন্য আসেন । ফলে এই মন্দিরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে । এখানে এসে তাঁরা মন্দির চত্বরে বিশ্রাম করেন ও পুজো দেন । এই সুপ্রাচীন মন্দিরকে ভক্তমন্ডলী ও পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ্যে অতি সত্বরই সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া আবশ্যক ।
Tuesday, November 30, 2021
সম্পাদকীয় প্যানেল
ধর্মীয় বিশ্বায়ন কোনো না কোনোভাবে শিল্পেরও বিশ্বায়ন ঘটায়। সেভাবেই অগোচরে ছড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক সংস্কৃতি। এই স্নিগ্ধ সুন্দর বিষয়কে জানতে পারা এই ডট কমের যুগে এক প্রযুক্তিগত অর্জন। যারা এতে সহযোগিতা করেন তাদের কৃতজ্ঞতা।
মনন স্রোতের এই সংখ্যায় আমরা নির্বাচিত লেখাকেই স্থান দিয়েছি এই ধারণা ছড়ানোর জন্য। যারা লিখেছন, তাঁদের নমস্কার। ভালো থাকুন। সামাজিক কর্মেও মনন স্রোত আপনাদের সহযোগিতা কামনা করে।
ধন্যবাদ। নমস্কার।
শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা সহ
জয় দেবনাথ
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
মনন স্রোত, ত্রিপুরা
দিপিকা রায়
বিষাদ
ভাঙ্গা পুতুলের মতো গড়ছি স্বপ্ন।
একাকীত্বের ভিড় চলছে লোক সঙ্গমে।
হাসি, কান্নার খেলায়,
অংশগ্রহণ এখন সামান্য মাত্র।
খালি মঞ্চে আমার চিৎকার,
প্রতিধ্বনিত হয়ে ,
ঘিরে থাকে মঞ্চের দেওয়াল।
কখনো দ্বেষ - বিদ্বেষে
যানের মতো চালিত জীবনও
থমকে যায় ,
দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক সিগন্যালে।
প্রতিঘাতে নিমজ্জিত আঘাত গুলোও
হারিয়ে যায় ,
উপচে পরা ভিড়ে।
হারিয়ে যায়,
সমুদ্র গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া
ভেজা কাজলও।
তলিয়ে যায় যা কিছু স্থাবর অস্থাবর স্মৃতি!
সৃজিতা নন্দী
নিঃশব্দ ক্ষত
তোমার অসুখের দিনে
বালিশে মাথা রেখে ঘুমাও তুমি।
প্রচন্ড জ্বর তোমার শরীরে...
আমি একাকী দাড়িয়ে সবটা শুধু দেখে যাই।
নিষেধ আছে তোমাকে স্পর্শ করার!
খুন হয়েছে আমার প্রিয় গোলাপ।
তুমি কথা বলো নি...
মায়া যে বড় শিহরণ জাগায়।
সূর্যের গ্লানি মেখে মোহ অস্ত গেছে
অন্য মেয়ে মানুষের চোখের মণি তে
সম্রাট শীল
মনের ভাবনা
গড়ায় বহুদূর
হৃদয় উঠোনের মাঝে।
বার বার উত্তেজনা,
দেয় আনাগোনা
মন খারাপের সাঁজে।।
ভালোবাসার ছোট্ট প্রহর,
জড়িয়ে দেয় আপন শহর
মাতিয়ে রাখে উল্লাসে।
মিষ্টি প্রহরের হঠাৎ ইতি,
হৃদয় গায় বিষাদ গীতি
হঠাৎ করে সেই ক্ষন চোখে এসে ভাসে।।
এমন মিষ্টি ক্ষনিক সুর,
হৃদয়ে গেঁথে প্রচুর
অল্পতে হয় জানা-অজানা।
যদিও হয়েছে সুষ্ঠু বপন,
হতে পারে হঠাৎ চোখের গোপন
থেকে যাবে শুধু মনের ভাবনা।।
অতনু রায় চৌধুরী
এসো কখনো
ভাঙ্গা ঘরের এক ফাঁকে আটকে থাকে
একটা ছেঁড়া কাপড়।
সেই কাপড় ভেদ করে ভোরের আলো
স্পর্শ করে আমার মুখ।
ঠিক সেই মুহূর্তে
আমি ফিরে আসি সেখান থেকে
যেখানে আমার মত করে আমি বাঁচি।
থাকি আমার মনের মানুষের কাছাকাছি।
সেখানে খারাপের মাঝেও শান্তি আছে
আছে এক গভীর বিলাসিতা।
সেটাই আমার স্বপ্নের দেশ।
এসো কখনো তুমিও, হবে তোমার সাথেও কথা।
মিঠু মল্লিক বৈদ্য
রাজপথ
পদভার সইতে সইতে অভ্যস্ত আমি,
অনুভূত প্রতিটি পায়ের স্বণ,
যাচ্ছে কে ক্ষুধার্ত পেটে কাজের খোঁজে-
কে বা আসছে ফিরে আপন নীড়ে
মুক্তির উল্লাসে স্নেহসুধা লয়ে
অনুভব করি নীরব অন্তরে।
শূন্য ঝুলিতে নিদারুণ যাতনায়
ফিরে যে একা,অশ্রু ভেজা চোখে
অনুভব করি তারও পদ ধ্বনি।
একে একে সবে পৌঁছে আপন গন্তব্যে
খানিক বিশ্রামে এলিয়ে দেয় কায়া,
আমি রাজপথ,ক্লান্ত,অবসন্ন তবুও জিরানের নাই অবসর।
একে একে আমি চিনি সকলেরে
অপেক্ষায় প্রহরগুনি বড্ড ভালোবেসে,
সময়ের ডাকে হয়তো বা কেউ
ফেলবে পদচিহ্ন আমার 'পরে
একটি বারের তরে বুঝবে আমারে;
দেখবে ফিরে ;পরমস্নেহে চুমবে ললাট।
দিগন্তব্যাপী শায়িত আমি অনন্তকাল
প্রতীক্ষার আর হল না শেষ,
তবুও আশায় বাঁধি বুক,
হয়তো আসবে কেউ ,স্নেহপরশে
এঁকে যাবে সুখছবি,চুমবে ললাট
একদিন হয়তো অন্য কোনদিন।
পান্থ দাস
কালি
মা তুমি জগতের
ডাকি কালিকে,
ক্রোধে ভষ্মিভূত অশুভ
শক্তি তুমি শিবে ৷
গলায় মুন্ড মালায়
থাকো সু সজ্জিত তুমি,
শান্তি মেলে মনে
যখন যাই মাতা বাড়ি ৷
মহা পিঠ তারা পিঠেও
আছো তুমি,
দক্ষিণেশ্বরের বাতাসেও
আছো তুমি ৷
রক্ত জবায়ই
তোমার পূর্ণতা,
রামকৃষ্ণও সাক্ষী যার
করো দুর তুমিই সব অক্ষমতা ৷
সংগীত শীল
আর্তনাদ
মরনের সাথে মিছিল করেও
মিথ্যার আঁধারে মানবতাবোধটুকু বন্দী কারাগারে,
ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচার,
সাদা কালো ফ্রেমে চিত্রপটে ছবি!
ক্ষমতা যেন চাবুকের ন্যায়;
গোলকের জালে ধূলোময়!
বিষ্ময়কর আগ্নেয়গিরির বুকে
হঠাৎ বিস্ফোরণে মনের অন্তপুর কেঁপে উঠে।
শতাব্দী দেবনাথ
শৈশব
শৈশবে দিন গুলোই কিই না মজার ছিল,
সহজ সরল নিষ্পাপ জীবনের
গন্ডি পেরিয়ে আজ আমরা অদ্ভুত জটিলতায় প্রবেশ করেছি।
ভাবতে অবাক লাগে সেদিন গুলো যেন এক ঘুমন্ত শিশুর নরম ছোঁয়া,
ক্ষনিকের মধ্যেই যেন হারিয়ে গেলো দিনগুলো।
আঁকড়ে ধরে রাখতে ইচ্ছেটা ও যে ব্যর্থতার রূপ নেই,
শুধু জমানো কিছু স্মৃতিতেই ফুটে উঠে।
বর্ষার দিনে কাগজে নৌকা বানিয়ে ভাসানো,
রোদের দিনে কাগজের এরোপ্লেন বানিয়ে আকাশে ওড়ানো,
সে এক আলাদা জীবন।
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তাই ক্ষনিকের জন্য দিন গুলোকে মনে করলে বাস্তব জগৎ কে ভুলে যেন এক খুলে দীপ্ত মান আকাশে বিরাজ করি।।
আহা.. আহা..কোমলতায় ভরা উপভোগ
লিটন শব্দকর
ভোরে-দুই
চাদরের খুঁটে জমাট ভালোবাসার মতোই
খোলা মাঠে অনেক জন্মের কুয়াশার ভীড়,
রাস্তার পাতায় ঝাট পড়বে কিছুক্ষণ বাদে।
এখনও ভবঘুরে গোলাপের সবুজ ডাঁটায়
প্রেমিকের হাতের উষ্ণতাকেই ডেকে যায়
এই কার্ত্তিক মাসে, তিথি তুমি বোঝো ঠিক
ডাহুকের খমকে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠা সংলাপ।
আমলকি পাতার সরু গলিটা হেটে এলেই
লুকিয়ে দেখা করার এমন স্বর্গীয় দুরুদুরু
শুধু ভোরবেলা তোমার হাত ধরা সহজতর।
মোহাজির হুসেইন চৌধুরী
সুখে আছি
সাগরের কথা যত বলি তত দেখিনা
যাপনের সুখের মতো
শুধু গল্প বলা - গল্পচ্ছলে ভাসি সুখে
আমার মেয়েটা তমুক স্কুলে পড়ে
অমুক বিষয়ে বেশ ভাল নম্বর পেয়েছে...
মাঝেমাঝে কথা আসছে
তবে এবয়সে.....! মন ধরছেনা.....
সংসার জটিল.... কচি মন নিয়ে...
ধাত সইতে পারবে তো....
হাতসাফাই জানা জামাইর স্বপ্ন
এসব কিছু সুখের কাহিনী
কল্পনাবিলাস ভাবনা চিন্তা বলতে বলতে
হাঁটতে থাকি বন্ধুদের সাথে
কারো মুখে ফুটে হাসি
কারো কপালে হিংসার ভাঁজ
বুঝি সকলেই সুখে আছি তবে....।
রাহুল দেবনাথ
বাঁকামোর
নিত্য নতুন পথের উপর।
কোন সে বাঁকামোরে।
পথভুলা এ অজানা পথিক।
ঠিকানা খুঁজে বেদনার বালুচরে।
এক যে ছিল, সাহিত্য সারথি।
ভুল ঠিকানার মাঝে।
অতীত খাতায় হিসেবে লিখে।
আধার প্রাতের সাঁঝে।
দিবা ফুড়ালো আকুল আধারে।
যেতে হবে এবার, কোন বাঁকামোরে।
খুঁজে মরে মোর ক্লান্ত চরণ।
নিশিথের এ আধারে।।
গঙ্গা সাহা
পরিচয়
পরিচয় হয়েছিল তোমাতে আমাতে।
সেই সোস্যাল মিডিয়ার হাতটি ধরে।
জানা শোনা হয়েছিল তোমাতে আমাতে।
সেই মেসেঞ্জার এর কথোপকথনে।
দেখেছিলাম তোমাকে প্রথম বারে।
সেই সোস্যাল সাইডের পিকচারেতে।
জানা শোনা পরিচয় হয়ে অবশেষে ,
ধীরে ধীরে ভালোলাগা দুজন দুজনে।
সেই ভালোলাগা ক্রমে ক্রমে,
পরিনত হয়েছিল আমাদের প্রণয়ে।
অবশেষে ছয়মাস অপেক্ষা করিয়ে।
একদিন হঠাৎ সাঁঝের বেলাতে,
এলে তুমি আমারও সমূক্ষে,
সেই এক অচেনা গলির মোড়ে।
চোখে চোখ রেখেছিলাম দুজনে,
সেই দিন সেই প্রথম বারে।
Monday, November 29, 2021
আলমগীর কবীর
ইচ্ছে ছিলো
জীবনে বহু ইচ্ছে ছিলো বর্তমান এলে তলিয়ে যায়
সমুদ্রের ওই অতল গহিনে আর কি তাহা ফিরে পাই।
ইচ্ছে ছিলো মানুষ হবো মানুষ আর আমি হলাম কই
এখন দেখি মানুষের চেয়ে বেশি অমানুষই সর্বত্রই।
মানুষ হওয়ার ইচ্ছেটাকে ধরে আছি শক্ত হাতে
লেগে থাকি আঠার মতো দেখা যাক কি হয় তাতে।
ইচ্ছে ছিলো দরিদ্রতা একদিন জীবন থেকে চলে যাবে ভেবেছিলাম মনের আশা ভালোবাসা সব পূরণ হবে।
দেখেছি কতো বাবা মায়ের জীবন যুদ্ধের কঠিন লড়াই
অভাব থাকা সত্তেও যে পাইনি কভু ঘাটতি মোরা।
স্কুলের পরে বাকি সময় গরু চড়াই মাঠে গিয়ে
কত রকম গ্রাম্য খেলা খেলতাম মোরা লোকালয়ে।
কতো রকম ভাবনা তখন আসতো মনের দড়জা বয়ে
আমিও যদি পড়তে পারতাম দূরের কোনো স্কুলে গিয়ে।
এমন করে ধিরে ধিরে শেষ হইলো স্কুল জীবন
শুরু হইলো পরের ধাপে পড়াশুনার বীজ বপন।
এরই মাঝে কতো রকম ইচ্ছে ছিলো হারিয়ে গেছে
আরো ইচ্ছে জন্ম নিলো এখনো তা বেঁচে আছে।
ইচ্ছে ছিলো ইচ্ছে আছে ইচ্ছে একটাই মানুষ হব
এ ইচ্ছেটাই পূণ্য পেলে জীবনে অনেক শান্তি পাবো।
দুলাল চক্রবর্তী
সাবরুম এর সাংস্কৃতিক জগৎ
সাবরুম এর সাংস্কৃতিক জগতে পথপ্রদর্শক হিসেবে যার নাম করতে হয় তিনি হলেন স্বর্গীয় নিতাই বড়ুয়া। কর্মজীবনে উনি শিক্ষা দপ্তরের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন। আমি যখন সাবরুম জে , বি ,স্কুলে চতুর্থ/পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করি তখন স্কুলে ব্রতচারী নৃত্য শেখানোর জন্য একজন প্রশিক্ষক এসেছিলেন, তার সাথে আমরা নিতাই দার সান্নিধ্য পেয়ে ছিলাম।১৯৬৪/
৬৫ সনের কথা । নিঃসন্তান নিতাই দা শিশুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক জগতে ডুবে থাকতেন। তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের
প্রসার কল্পে ছোটদের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেন। যার নাম "সুর ছন্দ নৃত্য সংস্থা" । সাবরুম শহরের বর্তমানে জেতবন বৌদ্ধবিহারের পাশে
প্রতিষ্ঠানটা স্থাপিত হয় । ধীরে ধীরে শিশুরা এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভর্তি হতে লাগলো। প্রতি বৎসর যেকোনো সরকারি অনুষ্ঠানে এই সংস্থার ঢাক আসতো। নিতাই দা- ও উৎসাহিত হয়ে শিশুদের নিয়ে গান, নৃত্য ও অন্যান্য অনুষ্ঠান করেছেন। জয় করেছেন সাবরুম শহরের আপামর জনসাধারণের মন। লোক - সংস্কৃতির বিভিন্ন নৃত্য তিনি করাতেন। এর মধ্যে প্রধান ছিল ধামাইল নৃত্য ইত্যাদি। কোথায় পোশাক-আশাক,
কোথায় টাকা পয়সা--কিভাবে যে ব্যবস্থা করতেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
উনার সাথে পরবর্তীতে এই সংস্থায় যুক্ত হন স্বর্গীয় অরুন নন্দী। গানের ভালো গলা ছিল। ও মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের গান শেখাতো। নৃত্যের জন্য নিতাই দা নিজেই প্রশিক্ষণ দিতেন। পরে এর পরিসর যখন আরো ব্যাপ্তি লাভ করলো, তখন অনেকেই এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেঁচে আছেন, কেউ মারা গেছেন। বর্তমানে সঠিক দায়িত্ববান ব্যক্তির অভাবে প্রতিষ্ঠানটি অনাদরে আছে।
পাশাপাশি, পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিলেন স্বর্গীয় সুভাষ দাস মহাশয়। কর্মজীবনে উনি শিক্ষা দপ্তরের অধীনে প্রাথমিক স্তরের একজন প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তবলা, গান, নৃত্য এই তিন বিভাগেই সুভাষদা অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বাড়াতে তিনিও স্থাপন করেন "সংগীতা "
নামে একটা স্কুল। সাবরুম এর অনেক ছেলে মেয়েরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে নৃত্য, গীত ও তবলা শিখে সমৃদ্ধ হয়েছে। সরকারি/বেসরকারি বহু অনুষ্ঠানে তার শিল্পীরা অংশ নিয়েছে । তিনি একজন দক্ষ প্রশিক্ষক ছিলেন। সাবরুম এর বাইরেও তিনি সুনামের সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন। প্রতিযোগিতামূলক অনেক অনুষ্ঠানে তার ছাত্র ছাত্রীরা সম্মানিত হয়েছে। সাবরুম এর আনন্দ পাড়ায় তাঁর এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও আরো অনেকেই ছিলেন তাঁদের নাম ও উল্লেখ করতে হয় রঞ্জু রায়চৌধুরী, প্রণব মজুমদার, প্রণব বসাক, সুবীর ভট্টাচার্য--আরো অনেকে ।
এদের মধ্যে অনেকেই আবার যাত্রা/
নাটক ইত্যাদিতেও অংশগ্রহণ করতেন। আজও সেটা ছবির মত চোখের সামনে ভাসছে। এইসব গুণীজনদের দাক্ষিণ্যে
আজ একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এই শহরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃত তত্ত্বাবধায়কের অভাবে এই কর্মকাণ্ড যেন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে।
অভীককুমার দে
হিরণ্যকশিপু
না রাত, না দিন
ঘুমন্ত মানুষ;
শরীরের ভেতর ঢুকে পড়েছিল মৃত্যু সংকেত,
বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে এক মুহূর্তেই !
বারংবার কেঁপে উঠছিল
উপর শরীর থেকে ভেতর শরীর,
শরীরের জন্য শরীর খুঁড়ে দেখছিল-
একটি অদ্ভুত ঘড়ি তখনও চলছিল
টিক-টিক, টিক-টিক...
অতঃপর মানুষের ভেতর ছটফট করছিল
আতঙ্কিত হিরণ্যকশিপু।
Monday, October 11, 2021
সম্পাদকীয়
ঐহিত্য ও স্মৃতি মিশিয়ে আমরা শক্তি আরাধনা করি। জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর সুখ খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণা ও শক্তি আমাদের জরুরী। তুমুল অসময় পৃথিবীর, দেশের। ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাণের গ্রহ পৃথিবী। এর ভেতরই স্বাভাবিক জীবন ধরে রাখার অনুশীলন আমাদের সবচাইতে বেশি জরুরী। এবারের শারদীয়া আমাদের জীবনে এই কল্যাণ বয়ে আনুক এই শুভকামনা।
বাঙালির সবচাইতে বড় আনন্দ উৎসব শারদীয়া। এ আমাদের প্রাণের উৎসব। এই উদ্যেশেই এই উদযাপনেই মনন স্রোতের সৃষ্টিশীল উদ্যোগ উৎসব সংখ্যা। লিখেছেন দেশ ও দেশের বাইরের তরুণ সাহিত্যিকরা। সকলকে কৃতজ্ঞতা ও শারদীয়ার প্রীতি ও নমস্কার। পাঠকমহলে আমি আন্তরিক আমন্ত্রণ জানাই সংখ্যাটি পাঠের জন্য।
হৃদয়পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে উদযাপন করুন এবারের শারদ উৎসব। সকলে ভালো থাকুন। নিরাপদে থাকুন।
শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা-সহ
জয় দেবনাথ
সম্পাদক
মনন স্রোত, ত্রিপুরা।
Sunday, October 10, 2021
কুমার নীলদ্বীপ
বিষ স্বপ্ন
শুধু একটিবার তুমি প্রেমের ভাষায় প্রতিবাদ করে দেখো,
আমি বন্দী কয়েদির মতো কেমন তোমার বাধ্য হই।
হয়তো গর্জে ওঠা সিংহের মতো
তুমিও ছিঁড়ে দিতে পারো আমার
মস্তক থেকে পা পর্যন্ত বেড়ে ওঠা শিরা উপশিরা!
কিন্তু কি হবে তাতে?
অযাচিত কিছু হয়তো রক্ত বয়ে যাবে,
হয়তো মৃত্যু হবে একজন প্রেমিকের!
কিন্তু মনে রেখো-
প্রেমিক মরে গেলে প্রেমও মরে যায়।
তাই-
ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলছি,আমাকে প্রেমাঘাত করো!
যে আঘাত আমাকেও তোমার সমতুল্য করে তুলবে।
তা-ও জানি সত্যিকারের দুঃখ যার রক্তে
তাকে মিথ্যে সুখের দুঃখ দিতে নেই, তাতে ঈশ্বর বিমুখ হন।
দিপিকা রায়
শারদ স্মৃতি
ঢাক আর কাসর শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই মায়ের চিৎকার,
'কি রে উঠবি না নাকি? আজ যে মহাষ্টমী, ভুলে গেছিস। যা তাড়াতাড়ি স্নান সেড়ে নে। পুরোহিত মশাই তো এসে পড়েছেন।
মায়ের কথা শুনে মনে পড়লো, আজ মহাষ্টমী। আমায় আবার অঞ্জলি নিতে হবে। চোখে একঘোর ঘুম কাটিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান সেড়ে, আমার প্রিয় লাল শাড়িটা পরে নিলাম।
আজ সব সাজগোজ কেন যেন ফ্যাকাশে লাগছে।
দুর্গাপূজায় সবাই কত আনন্দ, হৈ হোল্লর করছে। কিন্তু আমার মনটা কেন জানি অস্থির হয়ে আছে। সব আনন্দ গুলো কেমন যেন মনমরা হয়ে পরে আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফোনের রিংটোনটা কানে বেজে উঠলো।
ফোনটা দেখে আমার বুঝতে দেরী হল না এইটা যে অভিকের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এল, 'হ্যালো, রিয়া! '
বললাম হ্যাঁ বলো।
অভিক জানতে চাইলো কেমন আছি? বললাম ভালোই।
অভিক চুপ ছিলো।
জানতে চাইলাম আজ হঠাৎ ফোন করার কারণ! সে বলল, আমাদের ডিভোর্স যে হয়েছে আজ একবছর হল।
অভিকের কথায় আমার উত্তর ছিল, ওঃ এই কথাটা মনে করার জন্যই তোমার ফোন?
তখন অভিক বলে উঠলো, না না, আসলে বড্ড মনে পড়ছিলো তোমায়। আজ তো মহাষ্টমী। তুমি আর আমি একসাথে প্যান্ডেলে গিয়ে অঞ্জলি নিতাম। এরপর সারাদিন আমরা ঘুরতাম, পূজা দেখতাম। তোমার সাথে সাথে আমার অপছন্দ আর তোমার পছন্দের ফুচকাও খেতাম। কতই না মজার ছিল ওইদিন গুলো।
তার কথায় একটু মুচকি হাসি দিয়ে আমি বললাম, থাক না হবে অভিক, এখন ওসব বলে কি হবে? আমাদের সোনার সংসারটা তো তুমি নিজেই শেষ করেছো। আর যার জন্য শেষ করেছো, তাকে নিয়ে ভালো থাকো !
আমার কথা শুনে, একটু ভারি গলায় সে বলল,,
তুমি এই কথা বলছো রিয়া! তুমি তো জানো, যেই মানুষটা কে নিয়ে সংসার করবো বলে, তোমার সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদ করলাম, সেই মানুষটা কখনো আমায় ভালোবাসেনি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এখন যে আমি বড্ড একা। জানো রিয়া মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কোথাও চলে যাই। যেই ঘরে আমাদের প্রথম রাত ছিল, এখন সেই ঘরে আমি পা রাখি না। ওই ঘরের প্রত্যেকটা দেওয়ালে যে তোমার স্মৃতি। আমার নিজের ভুলের কারনে আমি তোমাকে হারিয়েছে। এখন যে আর মেনে নিতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমার বুকটা কেমন জানি করে, হয়তো অসহ্য যন্ত্রণাটা এখন আমার সহ্যের বাইরে। বলো না রিয়া, কি করবো আমি।
আচ্ছা আমরা কি আবার এক হতে পারি না? সামান্য একটা কাগজ আমাদের এত বছরের সম্পর্ক কি ভাঙতে পারে? এই মহাষ্টমীতে আমি তোমাকে সিঁদুর পরিয়ে আবার আমার করে নিতে পারি না?
অভিকের প্রতিটা কথা যেন আমার হৃদয়ে অজানা এক ঝড় সৃষ্টি করলো। অঝোরে বইতে থাকে দু চোখের জল। ইচ্ছে করছিলো অভিককে জড়িয়ে ধরে বলি, অভিক তুমি একা নয়, আমি তো আছি তোমার কাছে। আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।
কিন্তু আমারও যে কিছু করার নেই । সামান্য একটা কাগজে তুমি বেঁধে দিয়েছো, আমার হাত, পা।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে অভিককে কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলাম। ওইদিকে মায়ের মহাষ্টমী পূজা। আর এইদিকে বিচ্ছেদের একহ্রাস যন্ত্রনা আমার হৃদয়টাকে শেষ করে দিচ্ছে।শারদ স্মৃতি
--দিপিকা রায়
ঢাক আর কাসর শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই মায়ের চিৎকার,
'কি রে উঠবি না নাকি? আজ যে মহাষ্টমী, ভুলে গেছিস। যা তাড়াতাড়ি স্নান সেড়ে নে। পুরোহিত মশাই তো এসে পড়েছেন।
মায়ের কথা শুনে মনে পড়লো, আজ মহাষ্টমী। আমায় আবার অঞ্জলি নিতে হবে। চোখে একঘোর ঘুম কাটিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান সেড়ে, আমার প্রিয় লাল শাড়িটা পরে নিলাম।
আজ সব সাজগোজ কেন যেন ফ্যাকাশে লাগছে।
দুর্গাপূজায় সবাই কত আনন্দ, হৈ হোল্লর করছে। কিন্তু আমার মনটা কেন জানি অস্থির হয়ে আছে। সব আনন্দ গুলো কেমন যেন মনমরা হয়ে পরে আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফোনের রিংটোনটা কানে বেজে উঠলো।
ফোনটা দেখে আমার বুঝতে দেরী হল না এইটা যে অভিকের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এল, 'হ্যালো, রিয়া! '
বললাম হ্যাঁ বলো।
অভিক জানতে চাইলো কেমন আছি? বললাম ভালোই।
অভিক চুপ ছিলো।
জানতে চাইলাম আজ হঠাৎ ফোন করার কারণ! সে বলল, আমাদের ডিভোর্স যে হয়েছে আজ একবছর হল।
অভিকের কথায় আমার উত্তর ছিল, ওঃ এই কথাটা মনে করার জন্যই তোমার ফোন?
তখন অভিক বলে উঠলো, না না, আসলে বড্ড মনে পড়ছিলো তোমায়। আজ তো মহাষ্টমী। তুমি আর আমি একসাথে প্যান্ডেলে গিয়ে অঞ্জলি নিতাম। এরপর সারাদিন আমরা ঘুরতাম, পূজা দেখতাম। তোমার সাথে সাথে আমার অপছন্দ আর তোমার পছন্দের ফুচকাও খেতাম। কতই না মজার ছিল ওইদিন গুলো।
তার কথায় একটু মুচকি হাসি দিয়ে আমি বললাম, থাক না হবে অভিক, এখন ওসব বলে কি হবে? আমাদের সোনার সংসারটা তো তুমি নিজেই শেষ করেছো। আর যার জন্য শেষ করেছো, তাকে নিয়ে ভালো থাকো !
আমার কথা শুনে, একটু ভারি গলায় সে বলল,,
তুমি এই কথা বলছো রিয়া! তুমি তো জানো, যেই মানুষটা কে নিয়ে সংসার করবো বলে, তোমার সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদ করলাম, সেই মানুষটা কখনো আমায় ভালোবাসেনি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এখন যে আমি বড্ড একা। জানো রিয়া মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কোথাও চলে যাই। যেই ঘরে আমাদের প্রথম রাত ছিল, এখন সেই ঘরে আমি পা রাখি না। ওই ঘরের প্রত্যেকটা দেওয়ালে যে তোমার স্মৃতি। আমার নিজের ভুলের কারনে আমি তোমাকে হারিয়েছে। এখন যে আর মেনে নিতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমার বুকটা কেমন জানি করে, হয়তো অসহ্য যন্ত্রণাটা এখন আমার সহ্যের বাইরে। বলো না রিয়া, কি করবো আমি।
আচ্ছা আমরা কি আবার এক হতে পারি না? সামান্য একটা কাগজ আমাদের এত বছরের সম্পর্ক কি ভাঙতে পারে? এই মহাষ্টমীতে আমি তোমাকে সিঁদুর পরিয়ে আবার আমার করে নিতে পারি না?
অভিকের প্রতিটা কথা যেন আমার হৃদয়ে অজানা এক ঝড় সৃষ্টি করলো। অঝোরে বইতে থাকে দু চোখের জল। ইচ্ছে করছিলো অভিককে জড়িয়ে ধরে বলি, অভিক তুমি একা নয়, আমি তো আছি তোমার কাছে। আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।
কিন্তু আমারও যে কিছু করার নেই । সামান্য একটা কাগজে তুমি বেঁধে দিয়েছো, আমার হাত, পা।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে অভিককে কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলাম। ওইদিকে মায়ের মহাষ্টমী পূজা। আর এইদিকে বিচ্ছেদের একহ্রাস যন্ত্রনা আমার হৃদয়টাকে শেষ করে দিচ্ছে।
রূপালী মান্না
ভাসে
আমার দ্বারে বৃষ্টি যখন
রোমান্সেতে ভরপুর,
তাদের বসত বন্যায় ভাসে
ছন্নছাড়া, ভাঙচুর।
আমি রাঁধি ডিম খিচুড়ি
স্বাদে গন্ধে আহা !
অসহায়ের আর্তনাদে
কেউ যে করে সেবা।
রাজীব, মিতা, তিতির কাঁদে
স্রোতে ভাসে জামা ,
তাদের মনে প্রশ্ন জাগে
এমন কেন, হয় মা ?
আয়লা যায়, আম্ফান যায়
গুলাব যায় রোষে,
উপকূলের মানুষগুলোর
জীবন জলে ভাসে।
প্রসেনজিৎ সাহা
লক্ষ্মীজন্ম
মন্ডপে মন্ডপে করো কুমারী পূজা।
ঘরে কন্যা সন্তানকে করো অবহেলা।
প্রতি ঘরে লক্ষ্মী রূপী বধূ চাও।
আর কন্যা সন্তান হলে ভ্রূণে ঘুম পাড়াও।
কুমারী পূজায় কন্যা সন্তানকে করো দেবী রূপে আরাধনা।
আর সন্তান কন্যা রূপে জন্ম নিলে তাকে বলো অপয়া।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব নাকি শারদীয়া।
এই সময় ধুমধাম করে নারী জাতির করো আরাধনা।
মাটির দূর্গার প্রতি তিনদিন করো কত আদর।
আর রক্ত মাংসে গড়া দূর্গার করো লজ্জা হরণ।
দূর্গার উগ্র রূপের করো এত প্রশংসা।
আর নারী প্রতিবাদ করলে সে লক্ষ্মীছাড়া।
উর্মি সাহা
মাম্মি নয় মা
এবার না হয়
এরা ভুলে যাক আজকের ডিপ্রেশানের বোঝা।
এবার না হয়
কেটে যাক কোট-সুটে বাবুদের বাবুয়ানা।
এবার না হয়
বেলাশেষে গরিবের পেট ভরুক ইচ্ছে মতো।
এবার না হয়
পৃথিবীটা রঙিন হোক নিখুঁত ক্যানভাসের মতো।
এবার না হয়
রাজকার্যে রাজা হোক প্রতিদিনের সড়ক শিশু।
এবার না হয়
হেসে উঠুক স্বপ্নে গড়া মায়ের রক্তঅশ্রু।
এবার না হয়
মিলন উল্লাস নিয়ে আসুক ভেদ-বৈচিত্র্য।
শিউলির গন্ধে বেঁজে উঠুক সন্ধ্যারতি,
উৎসব আমাদের নব অলংকার আর নবরাত্রি।
মুঠোফোনে বাঁধুক ঢাকের সুর আর হৃদযন্ত্র,
ভোরের হেডলাইন চক্ষুদান আর আগমনীর সূর্য।
কাশবন ভেদে নারীশক্তির আদল অভয়া,
এবার আর মাম্মি নয়, আসছেন মা।
দেবব্রত চক্রবর্তী
আসছে বছর আবার হবে
এ শহর উৎসব মুখর
রাত দিন সব আলোকময়
উষ্ণ আঁচে জ্বালিয়ে রাখি
দশো'স্ত্রে দশভুজা স্বর্ণময়।
ঝর্ণা ধারায় বইছে মোহর
'মা' আসবে প্রতিক্ষায়।
দিন গুনি সবে আসবে কবে
সেই দিনটার অপেক্ষায়।
সপ্তমীতে চক্ষু দানে; অষ্টমীতে
অঞ্জলী আর অন্নভোগে,
নবমীর হোমে শান্ত মনে
দশমীতে বিদায়ী 'মা' বিরহ গানে।
আসবে আবার সেই আশায়
সূখ অশ্রু জলে ভেজায়,
সর্ব মঙ্গল কামনায়
'মা' তোমাকে প্রণাম জানাই।
মিঠু মল্লিক বৈদ্য
প্রাণের দোসর
তোমায় নিয়ে পাড়ি জমাবো পরপারে,
ভবলীলার অন্তে, উড়িয়ে মুক্তির ফানুস
বিলীয়ে যাবো ঐ তারাদের ভিড়ে।
মিশে আছো মনের আঁধার গহীনে
একটু একটু ভালোবাসার ছলে আঁকড়ে ধরেছি
তোমার প্রসারিত ঐ আঁচল খানা।
কখন যে মিশে গেছো শিরা উপশিরায়
টেরও পেলাম না, শত কর্মব্যস্ততায়ও
ভালোবেসে চুম্বন কেটেছি ললাটে।
মনের যত সঞ্চিত আর্তি, অভিযোগ
সঁপেছি তোমার অথৈ সাগরে,
অনুভূত চেতনার বানী শান্ত অবয়বে।
নিদারুণ কাটব্যেও ভালোবেসেছি প্রাণখুলে
মধুরতায় বেসামাল,সৌম্যতায় মুগ্ধতা,
রাতের স্তব্ধতায় অনুভূত স্বপ্নপুরের উর্বশী।
হ্যাঁ কবিতা! তুমিই আমার প্রাণের দোসর,
বেঁচে থাকার অভিলাষ তোমায় ঘিরে,
এপার, পরপার কিংবা অন্যকোন পারে।
গৌতম দাস
রোজ সকালবেলা
হাড় কাঁপানো নির্জন পথে শিশিরাচ্ছন্ন ঘাসে
ছেঁড়া চাদর গায়ে পেটের দায়ে ফুল তুলতে আসে।
এইরুপ দেখে সমাজের আবর্জনারা প্রাণ খুলে হাসে।
হাত বাড়িয়ে দেয় না কেউ সবাই করে ঘেউ ঘেউ।
এই ফুলচোর! দাঁড়া আসছি আসছি বলে দেয় তাড়া।
ফুল হলনা আর বেঁচা মিটবে কি করে পেটের জ্বালা? এইভাবেই কাটে -
শান্ত অনাথ শিশুর রোজ সকালবেলা।
হাড় কাঁপানো নির্জন পথে শিশিরাচ্ছন্ন ঘাসে
ছেঁড়া চাদর গায়ে পেটের দায়ে ফুল তুলতে আসে।
এইরুপ দেখে সমাজের আবর্জনারা প্রাণ খুলে হাসে।
হাত বাড়িয়ে দেয় না কেউ সবাই করে ঘেউ ঘেউ।
এই ফুলচোর! দাঁড়া আসছি আসছি বলে দেয় তাড়া।
ফুল হলনা আর বেঁচা মিটবে কি করে পেটের জ্বালা? এইভাবেই কাটে -
শান্ত অনাথ শিশুর রোজ সকালবেলা।
সাধন নমঃ
তোমায় দিলাম
চাও নি কিছুই
তবুও মনের মধ্যে দীপ্ত বাসনা।
বহু দিবা-রাত্রি যাপন করেছ,মুখ ফুটে বল নি কিছুই।
তবুও আমি তোমায় একটা সকাল দিলাম,
তাতে তুমি সূর্যের রক্তিম আলো দিও।
একটা দুপুর তোমার হাতে দিলাম,
তাতে তুমি রবির প্রখরতা এনো।
একটা শীতল বিকেল দিলাম বধূ,
তুমি তাতে কোকিলের গান বুনো।
সন্ধ্যাটুকু রাখলাম শুধু,কথার আসর বসাবো।
দিনান্তে বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে
তোমার খোঁপায় গুঁজে দেব
একশ আট টা লাল গোলাপ।
গোপনে কইব কথা কপোলের ফাঁকে ফাঁকে,
হৃদয়ে বাজিবে বাঁশি তব ছোঁয়াতে।
আমার শেষ রজনীটুকু দিলাম বধূ
স্বপ্ন এঁকো নানা আদলে।
হিমাদ্রি শিখর পাড়ি দিয়ে
ফিরবো তোমার আঁচলে।
সৈকত মজুমদার
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই
তুমি যে আমায় ভালোবাস অথবা
আমি যে তোমাকে ভালোবাসি;
না আছে আমাদের কোনো সেলফি
আর না আছে কোনো উপহার সামগ্রী।
তবে তোমার সাথে প্রথম আলাপ
আর প্রথম দেখার তিথি মনে আছে,
মনে আছে তোমাকে প্রথম ছোঁয়ার স্মৃতি
মিঠুন দেবনাথ
জীবন যেন আলেয়া
অজানা এক সপ্নের ভীরে,
গেছি আমি হারিয়ে।
আলো ভেবে করেছি মস্ত বড় ভূল,
আলেয়ার পিছনে হাত বাড়িয়ে।
কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার,
কোথাও আবার দুঃসপ্নের আনাগোনা।
সপ্ন ভেবে যাকে রেখেছি বুকে আগলে,
অচিরেই দুঃসপ্ন হয়ে করল চুরমার ...
মনের সব প্রিয় ভাবনা।
তরী ভেবে করেছিলাম ভর,
তটিনী পারাবার ত্বরে।
তরী যেন চায় না চলতে,
বাধা হয়ে অজানা বালি চরে।
আশায় আশায় বুক বাঁধি,
হয়ত জীবন চলবে জীবনের শ্রোতে।
প্রতিনিয়ত জীবন করছে জীবনের সাথে খেলা,
উন্মত্ত হয়ে আছে জীবন কে হারাতে।
বিধাতা ও আজ যেন বন্ধ করে আছে দুটি আখি,
ভাগ্যদেবী চলে গেছে অনেক দূর।
বার বার ভাগ্য যে দিতে চায় ফাঁকি।
মরুর বুকে আছি বসে,
যদি হয় এক পশলা বৃষ্টি।
আকাশে চলে সহশ্র মেঘের আনাগোনা,
কিন্তু এক বিন্দু জলকনার উপর ও পরেনী দৃষ্টি।
সময় বদলে যায় সময়ের সাথে,
আমি কিন্তু সেই একই আছি....
নিজেকে বদলানোর কিছুই ছিল না,
এই দুই হাতের রেখাতে।
অতনু রায় চৌধুরী
পছন্দের জিনিস
চোখ জুড়ে আটকে থাকে পছন্দের জিনিস
এই জিনিস আকাশছোঁয়া,
এই জিনিসে বিলাসীতায় ঘেরা।
এতে বাবার পরিশ্রমের ঘাম দ্বিগুণ হবে,
যদি এই জিনিস আমার করতে চাই
পূজোর কোনো সন্ধ্যায়।
এতে মায়ের শখ হারিয়ে যাবে,
জানি বায়না করলে নিশ্চয়ই এই জিনিসটাই আমার হবে।
তবুও সংসারের বেরাজালে
জীবন যখন থাকে সুখের আশায়।
এই বিলাসবহুল জিনিস থাকে না তখন আর পছন্দের তালিকায়।
মৃণ্ময়ী সরকার
প্রতীক্ষা
বর্ষার কালো মেঘ সরিয়ে
শরতের রোদ্দুর,
বাঙালির মন কষছে হিসেব
প্রতীক্ষা কতদূর।
সিংহ বাহনা দশভুজা দেবী
মহিষাসুর পদতলে,
সাজো সাজো রব উৎসবমুখর
আসবেন ধরাতলে।
আলমগীর কবীর
সে আর আগের মতো নেই
কি অদ্ভুদ এক সমাজব্যবস্থা।
হাওয়া যেনো উল্টো দিকে বইছে।
মানুষগুলি লালসায় আসক্ত হয়ে গেছে।
কেউ কাউকে নিয়ে ভাবার সময় নাই।
বাতাসে বিষাক্ত বায়ু বইছে।
গাছপালা আর আগের মতো ধুলছেনা।
পাখিগুলি আর মানুষের কাছে আসেনা।
তারাও বুঝে গেছে, -
মানুষ পাখিদের পরিবারের কথা ভাবেনা।
একবার ধরতে পারলে আর ছাড়বেনা।
মানুষ রুপি প্রাণীগুলো আজ টাকার লোভে মত্ত
তাদের বৈধ অবৈধ বিচার করার সময় নেই।
তাদের টাকায় তাদের সুখ।
হোক তা অবৈধ উপার্জনের অর্থ।
তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় তুলে।
তাদের চোখের সামনে ঘটে যায় হাজারও অপরাধ।
তখন তাদের সময় থাকেনা।
তারা প্রতিবাদের কন্ঠরুদ্ধ করতে জানে।
শুধু চোখে চোখ রেখে সত্তিটা বলতে জানেনা।
তাদের কাছে ব্যঙ্গ করার মতো
শব্দের অভাব নেই।
তারা শুধু ব্যঙ্গ করতেই জানে।
উৎসাহ দেওয়া তাদের কাছে
এক বিরক্তিকর অধ্যায় মাত্র।
পায়েল সাহা
মায়ের আগমন
কাশ বনেতে দোলা লাগিলো,
মা দূর্গা আসছি বলিলো।
শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে,
চারিদিকে আনন্দ ছড়িয়েছে
শিউলির সুবাসে।
ঢাকে পড়িল কাঠি
পুজো কাটিবে জমজমাটি।
ঢাকের তালে কোমর দোলে,
বাঙালিরা সব তৈরি নৃত্য করিবে বলে।
বাচ্চারা নতুন জামা পড়ে ঠাকুর দেখিতে আত্মহারা।
এই খুশিতে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলে আনন্দে মাতোয়ারা।
সুশান্ত কবিরাজ
কুহেলিকা
আমার স্বপ্নগুলোকে আমি প্রতিদিন ভাঙি
আর প্রতিদিন আবারও গড়ি।
প্রতিদিন কাটি, প্রতিদিন জুড়ি ।
তোমার আসাতে যেমন মনে জোয়ার আসে
তেমনি কখনও তোমার যাওয়া তে
আবার তা বানে ভাসে।
জানি আমার জীবনে তুমি মিথ্যে,তুমি বড়ো কুহেলিকা।
তুমি, কোন সে দূরের অচীন পাখি।
যতই স্বপ্ন দেখি আমি,
জানি একদিন তো দেবেই ফাঁকি।
মিথ্যা আশা'র চাষা আমি,
মিথ্যা ও প্রেম,মিথ্যা আবেগ,
মিথ্যা হবে সকল আশা।
মিথ্যা হবে স্বপ্ন যত, মিথ্যা হবে যত আশা।
তবু,আমি প্রতিদিন কাটি কত আঁকি বুকি,
প্রতিদিন আমি নিই কত ঝুঁকি।
নেশার ঘোরে, থাকো মন জুরে,
তুমি ছাড়া ভাবি আমি ভবঘুরে।
তবুও মনে হয়, তুমি ছাড়া হায় !
কীসের জীবন, বাঁচার বলো আছে কোনো দায় ?
সৃজিতা নন্দী
খিচুড়ি
প্রত্যেক বছরের মত এবছরেও ইঁট ভাঁটা লাগোয়া
দুর্গা পুজোর অষ্টমীর ভোগের তালিকায় আছে
পাঁচ মেশালি খিচুড়ি, চচ্চড়ি।
মা কে ভোগ নিবেদনের পর কমিটির চারজন দাদা
দুই ডেকচি নিয়ে হেটে যাচ্ছে ইঁট ভাঁটার দিকে।
গরম খিচুড়ির ঘ্রাণ...
বাচ্চা থেকে শুরু করে বড়
সবাই আজ ভোগের খিচুড়ি খাবে।
থালা হাতে লাইন করে দাড়িয়েছে ভাঁটার প্রত্যেকটি মানুষ।
এক চিলতে আনন্দ,
জিভে গরম খিচুড়ির স্বাদ...
সম্রাট শীল
রঙ্গিন কাগজ
হোক না তা যেমন তেমন,
ঘাম ও সময় হিসেব কষে দেয়
তার প্রাপ্য দেনা পাওনার পরিমাণ।
সেকেন্ডর কাঁটা ঘূর্ণনে যেমন,
তৈরি করে ঘন্টার হিসেব,
সেই মতো কিছু হিসেব আবার,
ঘামের একেক ফোঁটায় জমতে থাকে।
শুধু দরকার হয় ঘাম শুকোনোর জন্য,
কিছু রঙ্গিন কাগজ।
আর সেই কাগজ বিলিয়ে,
জীবন সাজায় নিজের মতো করে।
গৌতম মজুমদার
এমন একটি গ্রাম আমি চাই
এমন একটি গ্রাম আমি চাই ---
যে গ্রামেতে মন্দির মসজিদ নাই,
আছে শুধু রাম রহিমের বাস
এক সাথেতে নিচ্ছে তারা শ্বাস।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে হিংসা বিদ্বেষ নাই,
পূজা নামাজ পাশাপাশি চলে
সাম্প্রদায়িক বীজটা ফেলে জলে।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে হাসেম গনেশ ভাই,
এক থালাতে খেতে পারে বসে
মুক্ত মাঠে ঘুরতে পারে চষে।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে শান্তি খুঁজে পাই,
সেথায় গিয়ে বাঁধবো সুখের নীড়
নানান রঙের থাকবে পাখির ভীড়।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে থাকবে হাসিটাই,
প্রাণ খুলে সব মনের কথা বলে
এমনি করে জীবনটা যায় চলে ।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে আছে যুবকরাই,
রক্ত দানে সবার আগে থাকে
বুক চিতিয়ে গ্রামকে আগলে রাখে।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে সংহতির অভাব নাই,
বিপদ মাঝে সবাই ছুটে আসে
দাঁড়ায় তাঁরা সবাই সবার পাশে।
এমন একটি গ্রাম আমি চাই---
যে গ্রামেতে প্রাণটা ফিরে পাই,
মিলে মিশে থাকবো মোরা গ্রামে
লেখা হবে সৌভ্রাতৃত্বের নামে।
লিটন শব্দকর
নিবিড়ে ১
থাকি না হয় আমি একটু দিশেহারা,
পলকগুলিকে থাকতে দিয়েছি তাই
কলাপাতায় খিচুড়ির ঘ্রাণের দুপুরে।
তুমি এইটুকু দেখে জেনেছো বলেই
সহজবাড়িতে অর্কিডের পরিচর্যায়
তোমার হাতে অস্তরাগে রঙিন নক্সা।
মোহাজির হুসেইন চৌধুরী
কিছু রঙ একটা তুলি
পেয়ালার আঁশটে গন্ধ
অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে
ভেজানো রঙের কালি বাসি হয়ে
ফ্যাঙাসের ঘরবাড়ি....
আমি দেখছি-- আমরা অনেকেই দেখছি
বহুদিন থেকে
কিন্তু---
আজ হঠাৎ মনে পড়লো ওগুলোকে সরিয়ে নিতে
প্রয়োজন নতুন রঙ নতুন তুলির
এখন নতুনভাবে আঁচড় কাটা যাক
ভ্যানগগের সূত্র ধরে জন্ম নিক
নতুন আলোকচিত্র
সদ্য প্রজন্মরা শিখে নিক
রেলের সুবিন্যস্ত পথে ঘুম চোখে
ক্ষুধার্ত রুটি ফেলে রেখে বাঁচার অধিকার
চিত্রিত হোক দুর্বোধ্য সকল ছবি সরিয়ে দিয়ে
পূর্ণিমার প্রোজ্বল স্বচ্ছ সৌম্য বোধ
আকরিক অক্ষরে লিখা হোক
নারীর বৈশ্যাময় শরীরের প্রতিবাদ
নতুন রঙের কালি আর এক জীবন্ত তুলি
এঁকে দিক কৃষকের ঘামঝরা রক্ত-খুনে মাখা
জমিনের সবাক চিত্র
ফসলের বুকে বাঁকা চাঁদের মতো
হাসি ফুটে উঠুক মুখেমুখে।
মাহমুদ মুকিত
স্মৃতির নোনাজল
সুমিষ্টঘ্রাণে ভরে ওঠে সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার।
নিউরনে নিউরনে অবগাহন করে
অস্তমিত সূর্যের স্বর্গীয় সুখ।
অথবা চিরতার আধ বুক তিক্ত জলে
দ্বীপ খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যায়
আজন্ম সাঁতার না জানা হোমো সেপিয়েন্স।
হোক সে ট্রয় নগরীর ধ্বংস্তুপ
অথবা ফুলেল সজ্জিত রাজ উদ্যান
স্মৃতির অমোঘ সুতোয়
পরতে পরতে গেঁথে রয় জীবনের জয়গান ।
অভিজিৎ রায়
মা দুই টাকা দাও
স্কুলে যাওয়ার সময় বলতাম
মা দুই টাকা দাও না গো
স্কুলে গেলে আসার সময় লোপ না কেক খাবো।
মা বলতো প্রতিদিন টাকা কোথায় পাবো
তোর বাবা কত কষ্ট করে উপার্জন করছে
আর তুই টাকা নষ্ট করছিস?
দুই টাকার সাথে আর কিছু দিলে চাল আনতে পারবো
সবাই মিলে একসাথে খেতে পারবো।
দেখ তারপর ও তুই যদি বায়না করস টাকা আমি দেবো
না মা লাগবে না আমরা টাকা সবাই মিলে একসাথে ভাত খাবো
আমি লোপ কেক খাব না মা কিছু বল না বাবাকে ।
এমনিতে মিথ্যা কথা বললাম আমি তোমাকে।
চুখের জল এসে যায় এখন
আজ যখন হাতে অনেক টাকা
কিন্ত মায়ের সেই ভালবাসা টুকু
আজ যেন অনেক ফাঁকা
কথায় কথায় বলে তোর মত ছেলে জন্ম দিয়ে ভুল করেছি
একটা মেয়েকে জন্ম দিয়ে শান্তি পেয়েছি।
আজও বুঝলাম না মা আমার প্রতি কেন এমন ব্যাবহার?
হয়তো বা বড় হয়ে উচিৎ কথা বলতে গিয়ে হচ্ছে আমার প্রতি অবিচার।
এখনো মনে পড়ে সেই স্কুলে যাবার সময় বিস্কুটের কথা
বলতে পারি না কাউকে মা লাগে মনে শুধু ব্যাথা।
তবুও প্রার্থানা করি মা ঠাকুরের কাছে
জীবনের শেষ লগ্নে হলেও যেন নিজের ভুল
চুখে ভাসে।
মোঃ রুবেল
না
না,
সদ্য প্রসব হওয়া গোলাপটা,
তোমাকে প্রেম নিবেদনের জন্য নয়।
ভালোবাসা কতটা সুন্দর ও স্নিগ্ধ তার প্রতীক।
গাছটা তোমাকে ভালোবেসে লাগিয়েছিলাম।
পরিচর্যা করেছিলাম প্রেমিকার মতো।
আমার কাছে লাল গোলাপটা তুমি।
একান্তই তুমি।
তুমি যখন অভিমানকে আপন করে দূরে থাকো।
তখন আমি একটু একটু করে গোলাপটার কাছে যাই।
ছুঁয়ে দেখি। তোমায় অনুভব করি কাছে। খুব কাছে।
এই গোলাপটা আমার।
একান্তই আমার।
দুলাল চক্রবর্তী
আগমনীর সুর
" মাতার কন্ঠে শেফালী মাল্য
গন্ধে ভরিছে অবনী,
জলহারা মেঘ আঁচলে খচিত
শুভ্র যেন সে নবনী।"
শিউলি ফোটার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি জানান দেয় শরৎকাল এসে গেছে। সুনীল আকাশ টা সাদা সাদা স্তূপাকারে মেঘ
ধেয়ে চলে এদিক ওদিকে। নদীর ধারে ধারে সাদা সাদা কাশফুল অনাবিল আনন্দে যেন এদিক থেকে ওদিকে ঢলে পড়ে। মাদকতা এনে দেয় ওদের গায়ে গায়ে। গাভী দল প্রাণ খুলে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। যেন একান্ত মুক্তমনা, রাখালিয়ার প্রাণ কারা সুরে বাজে বাঁশি।
প্রকৃতির রূপে আসে ঋতু রানী শরতের
মোহময়ী ছাপ। প্রতিটি বাঙালির মনে
আনন্দে ভর ধরে না। মা আসছেন! বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের সারা। শরতের রাতের মোহময়ী নীল আকাশ।
রাতে যখন পূর্ণিমা চাঁদের রূপালী আলো পড়ে--আকাশটা যেন নীলের ছটা ছিটকে ছিটকে ছাড়ে । মাঝে মাঝে সাদা তুলার পানশী যেন এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়।
শরতের পূর্ণিমার চাঁদের দুর্লভ আলো বড় মন কেড়ে নেয়। রাতে শিশির সিক্ত হয় শেফালী গুলো প্রাণভরা মনকাড়া গন্ধ ছড়ায়। আহ, কি দারুণ প্রাণ কারা সুগন্ধ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভোর হতেই ঝরে পড়ে নিচে। চলে যায় দেবতার পায়ে। সযতনে ফুলগুলি তুলেনিই।
দূর দেশের প্রবাসীরা ছুটে আসে আপনজনের কাছে মায়ের রাতুল চরণে ভক্তি অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য। বাংলার বুকে দুর্গাপূজার অনুভূতি ও আনন্দই আলাদা। সারাবাংলা বুকে যেন মনে হয়--
" স্থলে- জলে আর গগনে গগনে,
বাঁশি বাজে যেন মধুর লগনে। " এই পুণ্য লগনে বেজে ওঠে মায়ের মঙ্গল শঙ্খ। অপরূপা জননী যেন দুহাত ভরে আশীর্বাদের ডালি নিয়ে আসে বাংলার বুকে! প্রাণের আবেগে, উৎসবের আনন্দে বাংলার ঘরে ঘরে মহাসমারোহ চলে । পূজার কটা দিন যেন কোনো বিধিনিষেধ মানে না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মন। সারাটা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বাঙালিরা মাতৃ বন্দনার জন্য।
অভীককুমার দে
জলমিছিলের স্রোত
অনন্ত তপস্বী মাটি। মাটির হৃদয় পাঠ করতে করতে কেউ মাটিকে অনুভব করে, কেউ করতে পারে না। যারা অনুভব করতে পারে, মাটির সন্তান ওরা। ওরা মাটিবুক ভেদ করে শূন্য বুকেও মেলে ধরতে জানে ফসলের নদী। এই নদী আগামীর জীবন। এই নদীজল দৃষ্টির আলো। অন্ধকারের পথ পথিকের হৃদয় খোঁজার রশ্মি জোগায়। এই নদীপথ সমূহ সুখের, জীবনসুর। যদিও শূন্যে মাথা রেখেই মাটির নাড়ি আঁকড়ে ঝুলে থাকে, তবুও বুকের সেতার বেজে উঠলে বাতাসের কানে যৌবনের গান। তারপর সবুজ নদীটি রোদ মাখে, মায়াবী দেখায়। সোনালী রঙের অলংকার পড়ে পায়ে পায়ে হেঁটে গেলে জীবনের জলকথা। শিহরিত বয়স আরো উতলা হয়, তানপুরা ছন্দ যখন স্রোতের মতো, এগিয়ে যায় শরীর থেকে শরীরে।
কিছু মানুষ, দিনের পর দিন বিকশিত শরীর দেখে স্বপ্ন সাজায়। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয় জীবন। জীবিকার কষ্টপাড়া পেরিয়েও এই মানুষ নিজের জন্য বাঁচে না। বাঁচবার চেষ্টা করতে করতে কেবল বাঁচিয়ে রেখেই মরে যায়। যতদিন বেঁচে থাকে আল থেকে আলে ঘুরে ঘুরে আগলে রাখে জমি।
জমি ফসলের জন্য, মাটির সংগঠিত আয়োজন। লালন করতে করতে লালনের মতো নির্ভেজাল তপস্বীর তপস্যাঘর। ঘরের সাথে ঘর যেমন, জমির সাথে জমি। বুকে বুক লাগিয়ে সুখের পত্রিকামাঠ। এখানে ফসলের মেলা বসাবে বলে সেই মানুষগুলো কাঁচি হাতে, কোদাল হাতে আজন্ম চাষা। ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে চায় বলেই স্বপ্ন বোনে। ফেরি করে স্বপ্নসময়।
একটু একটু বড় হয় নদীটি। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে সোনালী সুখের রথ। এই রথে যিনি রাজা দুধের শিশু। বুকে সূর্যের তাপ শুষে হামাগুড়ি দেয় ভেতর ঘরে। শক্ত হয় শরীর। বেড়ে উঠতে উঠতে একদিন পূর্ণতায় ভরে ওঠে। এই পূর্ণতা মাটির আদর। মায়ের বুকের দুধের মতো প্রাণীজ শিশুর শক্তি জোগায়। এমন সুখভাবনায় চাষির কপালে ধ্যানবিন্দু আলোকিত হয়।
যেই আলো পথ দেখানোর জন্য, সেই আলোকেই নিভিয়ে দিতে চায় পরগাছার দল। ফসল ধ্বংসকারী আবহ তৈরী করে সাময়িক বেঁচে থাকে ধ্বংসস্তুপের উপর। এরা জীবনের জীবাণু আর পোকামাকড়। ফলন্ত জমির বুকে আক্রমণ করে স্বপ্নের সবুজকেই দিশেহারা করে দেয়। আবার এরা কখনো কখনো মেঠো ইঁদুরের মতো, ভয়ঙ্কর। কষ্টের জল যখন নদীস্বপ্নে ঝর্ণার মতো ঝরে, ঠিক তখনই ভেঙে দেয় সমারোহ। চাষির কপালের মাটি ক্ষত হয়। গোড়া থেকে কেটে ফসলের স্বপ্নকেই তছনছ করে দেয়। প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে পড়ে থাকে মাটি। বোকার মতো চেয়ে থাকে নিঃস্ব জমি। বোবার মতো চেয়ে থাকে চাষি।
এই যন্ত্রণা, এই বোকা অনুভব, এই বোবা চোখ শূন্যকেও ভারি করে তোলে। এক অদ্ভুত ভয়াবহ চুপ সময় অচল করে পদক্ষেপ। সেই এক শিহরণ জাগানো ভাষা। বুক থেকে মস্তিষ্ক পথে চোখ ভাসিয়ে নেমে আসে নিঃশব্দ ব্যথা। নদীর জন্যই কেবল অবিশ্বাস্য রূপান্তর।
অভীক বলে, হিমালয় কখনও জলশূন্য হতে পারে না। নদী তার জেগে উঠতে জানে। দুর্বার গতিতে নেমে আসতে পারে জলমিছিলের স্রোত। এই গতিপ্রবাহের সামনে কোনও বাঁধ চিরস্থায়ী নয়। নদী তার উচ্ছ্বাসে ভেঙে, গুড়িয়ে, উড়িয়ে দেবে সব বাধা।
দীপক দাস
দুর্গা পূজার আলোয়- জীবনের নানা পর্যায়
সমগ্র জীবনকে যদি চারটি পর্যায়ে ভাগ করি তবে এই চার পর্যায়ে পূজোর আনন্দের স্বরূপ কেমন তা আজকের বেলা শেষে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করছে।প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ নিতান্ত শৈশবে পূজোর অনেক আগে থেকেই শরীরে মনে আনন্দধারা জেগে উঠত। আমরা আঁধারমানিক নামক যে গ্রামটিতে থাকতাম, আমাদের বাড়ীর খুব কাছেই মূর্তি তৈরী হত।মূর্তির মাটি আমাদের বাড়ীর পাশের জমি থেকে নেওয়া হত। মাটি নিতে নিতে গর্তগুলি খুব গভীর হয়ে যেত।ছোট বয়সে যেতাম গর্তগুলির গভীরতা দেখতে।ভয় ও পেতাম।সে ভয় আজ ও তাড়া করে স্বপ্নে।অনেকদিন স্বপ্নে দেখেছি আমি গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়ে কাঁদছি। আমার পাশে কেউ নেই।ভোর হলেই ছুটতাম প্রতিমা কতটুকু হল তা দেখতে।সারাদিনই ছিল এই আনাগোনা। প্রতিদিন একটু একটু করে আমাদের চোখের সামনে মৃণ্ময়ী মূর্তির অবয়ব তৈরী হচ্ছে আর আমরা অপলক বিস্ময়ে তা প্রত্যক্ষ করছি,যে আনন্দ আজ শুধু স্মৃতিপটে লেখা হয়ে আছে। পূজোর সময় এবং সন্ধ্যায় মা বাবার হাত ধরে পূজো প্যান্ডেলে যেতাম, আরতি প্রতিযোগিতা দেখতাম, কেউ কেউ ছটা বা আটটা ধূপতি নিয়ে আরতি করতো।ঘুমে চোখ জুড়ে এলে মা বাবার হাত ধরে বাড়ী ফিরে আসা, এভাবে চলত পূজোর ক - দিন।
আস্তে আস্তে শৈশব অতিক্রম করে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ করছি। শুরু হল জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়।এ সময় পৃথিবীর আলোতে বাতাসে আকাশে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুধু আনন্দ আনন্দ আর আনন্দ। যেন আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। বাইরের পৃথিবীতে পা রাখছি, মা বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের হাত ধরে চলতে শুরু করেছি। এসময় পূজোর দিনগুলো নানা পরিকল্পনায় ঠাসা থাকত। কোনদিন কখন কোথায় কারা কিভাবে পূজো দেখত বেরুব, কত পরিকল্পনা! অনেকে একসাথে সাইকেল করে পনের বিশ কিলোমিটার দূরে পূজো দেখতে যেতাম। সবাই মিলে গেয়ে উঠতাম" ও আকাশ সোনা সোনা/ এ মাটি সবুজ সবুজ/ নূতন রঙের নেশায় হৃদয় রেঙেছে/ আলোর জোয়ারে খুশীর বাঁধ ভেঙেছে।"
বা গাইতাম " এ পথ যদি না শেেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলতো। এরকম কত গান।
পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য।
পোষাকে চুলের পারিপাট্যে ছিল যত্নের আধিক্য।তখন সাবরুমে পাঁচ সাতটা পূজো হত।বিভিন্ন পূজো প্যান্ডেলে দেখা হত বান্ধবীদের সাথে। হাত নাড়ানো দু একটা কথা।অপরূপ সে সব মিষ্টি অনুভূতি।আবার মনে মনে বিশেষ কারো সাথে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় কাটত সারাদিন। সেই বিশেষ একজনের সাথে হয়ত দেখা হয়েছে কিন্তু অব্যক্ত থেকে গেছে মনের কথা বলা। আসলে এই পর্যায়ে অনেক ভালোলাগা বুদবুদের মত মিলিয়ে যায় সময়ে। বলা যায়না বেশিরভাগ কথাই।বিশেষ করে মনে পড়ে দশমীর দিনের কথা।সাবরুম মেলার মাঠে সব প্রতিমা এসেছে। আরতি প্রতিযোগিতা হচ্ছে, মাঠের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরছি।মৃণ্ময়ী মূর্তি দেখতে দেখতে বার বার চোখ খুঁজে ফিরছে ভালোলাগা মানুষটিকে।কখনো চোখাচোখি কখনও বা দু একটা ইশারা করে কথা ছুঁড়ে দিয়েছি তার উদ্দেশ্যে। না চাইলেও এক সময় শেষ হয় বিসর্জনের অনুষ্ঠান। যৌবনের সেই সব দিনগুলোতে আমরাও প্রতি বছর বিসর্জন দিয়ে আসি আমাদের অসংখ্য ভালোলাগাকে ভালোবাসাকে।রিক্ত হাতে ঘরে ফিরে আসি।
এরপর শুরু হয় তৃতীয় পর্যায়ের জীবন।চাকরি- বাকরি ঘর সংসার- স্ত্রী - পুত্র - কন্যা নিয়ে নূতন এক জীবন।এ জীবনের দাবী অন্যরকম।জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। স্ত্রী পুত্র কন্যাকে খুশী করতে হবে।কারন এদের জড়িয়েই তো জীবন।এ সময়ে পূজোর আনন্দ নূতন রূপে ধরা দেয়। প্রথম দু পর্যায়ে আমি ছিলাম খেলোয়াড়।মাঠে খেলছি।খেলার মধ্য দিয়ে আনন্দ উপভোগ করছি।এই পর্যায়ে আমি দর্শক।এপর্যায়ে পুত্র কন্যাদের জামা কাপড় পরিয়ে ওদের আনন্দিত মুখ দেখে আমিও আনন্দ উপভোগ করেছি।দুটি ভিন্ন স্বাদের।তবু এতদিন পর্যন্ত জীবনের স্বাদ ছিল।
আজ এসে দাঁড়িয়েছি জীবনের নূতন এক পর্যায়ে।পূজোর দিনগুলোর শুরুতেই কেবলি মনে হচ্ছে শুরুর চারদিন পরেই বিসর্জনের বাজনা বাজবে।সব আনন্দ ছাপিয়ে কানে আসছে কেবলি বিসর্জনের বেদনা।জীবনের অন্য পর্যায় গুলোতে মনে হত, এইতো আবার আসছে পূজো।এখন মনে হয় আর নাও দেখতে পারি আগামী বছরের পূজো
।জীবনের শুরুতে আকাশে বাতাসে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আনন্দধারা প্রত্যক্ষ করেছিলাম।আজকের এই গোধূলি লগ্নে সমস্ত বিশ্ব চরাচরকে মনে হচ্ছ আমারি মত বিষাদগ্রস্ত।
তবু অধীর আগ্রহে নাতি নাতনির হাত ধরে অপেক্ষা করে আছি পূজোর জন্য।বিসর্জন আমাকে ধরলেও ওদের আমি প্রতিষ্ঠা করে যাব জীবন চলার পথে।
বিনয় শীল
আগমনী রূপ-নালিশ-আবেদন-আনন্দ
আসিবে জানি মা শারদ লগনে
তব আগমনী গায় মলয় গগনে
ভেদী শুভ্র কুজ্ঝটিকা
পদ্ম-কাশ-শেফালিকা
সৌরভ ছড়ায় সকল দিকে।।
আজ আবার তাহা মানসপটে উঁকি দিলো বুঝি। শরৎ আসিয়াছে। মানব হৃদয়ের পরতে পরতে অনাগত আনন্দময়ীর রক্তরাগ রঞ্জিত পদচিহ্ন ফুটিয়া উঠিতেছে। আহাঃ ! প্রকৃতিতে আজ কি আনন্দের প্লাবন। দিকে দিকে কাহার অপূর্ব রূপমাধুরীর অকৃত্রিম বিকাশ। ধান্য ক্ষেত্রের কচি কোমল ঘন সবুজ ডগা গুলিও, কোন ত্রিলোক বিস্তারিনী রূপসীর মলয় তরঙ্গায়িত অঞ্চলের পরশে পুলক প্রকাশ করিতেছে। দিবাকর মহোল্লাসে স্বীয় কিরণ মালায় কাহার আসন উদ্ভাসনে সদা ব্যস্ত। ঐ দেখো, দিগন্ত বিস্তৃত নীল গগনে শুভ্র মেঘপুঞ্জের স্মিত হাস্যে আনাগোনা। টুনটুনি, খঞ্জনি, দোয়েলা, কোয়েলাদের কণ্ঠে কাহার আগমনী সুর বাজিয়া উঠিল। কাহার অঙ্গ-সুবাসে আমোদিত অনিল সোৎসাহে বন-প্রান্তরে ছুটিয়া যাইতেছে। নব মুকুলিত পত্র, নব পাপড়ি প্রসারিত প্রসূন, -কোন দেবাঙ্গিনীর প্রেম পেলবতায় সমাচ্ছন্ন। আকণ্ঠভরা পুষ্করিণীর স্বচ্ছ সলিলে শতদল বিস্তার করিয়া কমল প্রস্ফুটিত। পদ্ম কলিতে আজ কোন গিরি দূহিতার উন্মিলিত নয়নের বিচ্ছুরিত দিব্য আলোর জোয়ারে মৃত্তিকার পৃথ্বিমাতা নব আলোকিতা।
ওই তো! অরুণরাগে শিশির বিন্দু কনকদ্যূতিতে ঝলমল করা শিউলি ছড়ানো সতেজ শ্যামল তৃণাসন। তাহাতে আজ নিত্য প্রাতে, কোন কল্যানীর চরণ চিহ্ন অনুভূত হইতেছে। আজ কাহার অঙ্গ-জ্যোতির স্বর্ণকণা সাঁঝের আলোকে ছড়াইয়া পড়িল। কে বা কাহারা অমানিশার আকাশ ভরা প্রোজ্জ্বল তারকায় কোন মঙ্গলময়ীর জন্য বরণ ডালা সজ্জিত করিয়া রাখিয়াছে।কিসের নিমিত্ত শরৎ বিধুর অধর চ্যুত কোমল অমৃত জ্যোতির হিল্লোল-কল্লোলে ত্রিলোক প্লাবিত।ভ্রমরের গুঞ্জনে, শৈলবক্ষ-বিগলিতা নির্ঝরিণীর গানে গানে, কোন পরমা নন্দিনীর নূপুর-নিক্বনে দিঙমণ্ডল পরিব্যপ্ত। আজ এতো আনন্দ হইতেছে কেন ? কাহাকে লইয়া প্রকৃতির কোলে উল্লাসের এতো আয়োজন ?
অকস্মাৎ দেখিলাম, কনক লতার ন্যায় এক বালিকা বামহস্তে পুষ্পপাত্র ধারণ পূর্বক পুষ্পচয়ণ মানসে শিউলি তলে বিরাজিতা। তাহার আলতা রাঙ্গা তুলতুলে পদযুগল শিশির জলে সিক্ত। পষ্পরেণু গন্ধে ভরা শীতল সমীরণ বালিকার অঙ্গ পরশিয়া কৃতার্থ বোধ করিতেছে। সদ্য প্রস্ফুটিতা কুসুমের ন্যায় তাহার অনিন্দ্য-সুন্দর বদনোপরি তরুণ তপনের সুচিক্কণ নবীন রশ্মিচ্ছটা ক্রীড়া করিতেছে। নিশীথ ভঞ্জনকারি বিহঙ্গকূলের আনন্দ কলরবে চতুর্দিক মুখরিত। দিগন্তমুক্ত প্রান্তর থেকে শ্যামল অরণ্যানী অবধি নবালোকাচ্ছাদনে এক অব্যাক্ত প্রেরণায় সঞ্জীবিত। সর্বত্রই যেন মঙ্গল মূরতি উৎকীর্ণ। বালিকার মনে কি জাগিল জানিনা, কিন্তু বোধ করি সে পুষ্পচয়ণ বিস্মৃত হইয়াছে।
বিশ্বশিল্পীর অতুলন শিল্প-কীর্তিস্বরূপ তাঁহার দুই নয়নে আনন্দাশ্রু বিগলিত দেখিতে পাইলাম। বহুবিধ ভঙ্গীতে সে তৃপ্ত নয়নে দীপ্তি ভরা প্রকৃতির শোভা অবলোকন করিতেছে। জগতের সকল সৌন্দর্য-খচিত, সেই বালিকার ঈষৎ হাস্যরঞ্জিত ওষ্ঠাধরের মধ্যবর্তী সুন্দর দন্তপঙক্তির অগ্রভাগ হইতে রজতঃদ্যূতি বিকীর্ণমান। কোন ধন্য মেনকা মাতা স্বহস্তে কন্যার গভীর কৃষ্ণ কুন্তলে সস্নেহে বনপুষ্প গাঁথিয়া দিয়া, পশ্চাতে এহেন কন্যারত্নের গমনানন্দ উপভোগে মুগ্ধ হইয়াছেন। সবিস্ময়ে লক্ষ্য করিলাম, হঠাৎ বালিকা মৃদুমন্দ ভাবে স্বর্ণতনু আন্দোলন পূর্বক সুমিষ্ট কণ্ঠে গাহিয়া উঠিল-
শরৎ তোমায় এমন করে
কে সাজালো।
তোমার মোহন সুরে বাঁশি
কে বাজালো।।
শিউলি তোমার চরণ তলে
কেন হাসে।
তোমার ভোরের হাওয়ায়
ফুলের গন্ধ ভাসে।।
অঙ্গে তোমার আঁচল কাহার
হাওয়ায় লুটে।
কাশের বনে সবুজ ধানে
মাথা কুটে।।
কানন কূলে হাজার ফুলে
কাহার হাসি।
তোমার শোভার তরে নয়ন
হয় পিয়াসী।।
পুষ্পরাণী বুকে তোমার
ফুটছে কেন।
তাই না দেখে উন্মাদিনী
পৃথ্বি যেন ।।
জানি জানি তুমি কেন
পাগলপারা।
কি আনন্দে তুমি আজি
আত্মহারা ।।
যার ছোঁয়াতে নাচলো তোমার
হৃদয়পরত্।
সেই আমাকে পেয়ে খুশী
তাই না শরৎ ?
সেই "আমাকে" ! তবে কি জগজ্জননী আনন্দময়ী ভগবতী দূর্গা বালিকা রূপে অবতীর্ণা? যখন বহু অনুসন্ধানে ব্যার্থ পিপাসিত মৃগ শাবক জননীর প্রতি দৃষ্টি গোচর হওয়া মাত্রই, যেমন করিয়া পরমানন্দে গ্রীবা প্রসারণ পূর্বক দীর্ঘলম্ফনে জননীর স্তনামৃত পান মানসে দ্রুত ছুটিয়া চলে, সেই রূপ বালিকা রূপী মঙ্গলময়ীর চরণে লুটিয়া পড়িবার নিমিত্ত ধাবিত হইয়াছিলাম। কিন্তু দেখিলাম, বালিকা হস্তের পুষ্পপাত্রখানি নিম্নে রাখিয়া, ছায়া মাখা পুষ্পাকীর্ণ বন-বিথীকায় অন্তর্হিতা হইলেন। হয়তো বা গিরি রাজের স্নেহস্বর শুনিয়া, নয়তো বা সোনার দুলালী সর্বমঙ্গলার বিলম্ব দেখিয়া, উদ্বিগ্না মা মেনকার মমতাপ্লুত কণ্ঠের সুগভীর আহ্বান শ্রবণ করিয়া বালিকা জননীসংকাশে গমন করিয়াছে।
বালিকা কর্তৃক পরিত্যক্ত পুষ্পপাত্রখানি পরম যত্নসহকারে নিশিতে পতিত শেফালিকা সমেত নানাবিধ বনকুসুমে পূর্ণ করতঃ মায়ের চরনোদ্দেশ্যে নিবেদন পূর্বক মাকে বলিতে লাগিলাম- *হে জগজ্জননী,* ভক্তিহীনের প্রণাম গ্রহণ করো মা। মাগো, তুমি আজ যতই প্রসূনপাত্র হস্তে ধরিয়া বিস্ময়ে হতবাক হওনা কেন, -এ শুধু তোমার রূপের বৈভব ছাড়া তো আর কিছুই নহে়। ভূমানন্দের অপূর্ব প্রেরণায়- 'আপনি নাচো, আপনি গাহো, আপনি দাও মা করতালি' -এই উদ্দাম ছন্দে গা ভাসিয়ে দিলে চলিবে কেন মা? তুমি তো জানো, এ পৃথিবী আবার দৈত্য-দানবে পরিপূর্ণ হইয়াছে। ওই শুনো তোমার ভক্তজনের ক্রন্দনধ্বনি। আজ তোমার সমীপে সবিস্তারে বলিবো মা। দেশের তৃণমমূলস্তর পর্যন্ত অসুরদের দাপাদাপি ও উৎকট উল্লাসে গগন পূর্ণ হইয়াছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, খাদ্য-সংভরন, সাধারণ প্রসাশন হইতে সমাজ ব্যাবস্থা প্রভৃতিতে রাক্ষস-খোক্কসরা জাঁকিয়া বসিয়াছে। সাধু, মহাত্মা, ভক্ত ইত্যাদি নামেও ভণ্ডতার একশেষ হইয়াছে। সর্বত্রই রাজনীতি নামক বিষাক্ত বায়ুর খলপ্রবাহ। প্রকৃত কর্তব্য কর্মে সীমাহীন ফাঁকি অথচ অন্যায় অধিকার আদায়ের জন্য দানবদের কি উশৃঙ্খলতা, -তা একবার নিজের চোখে দেখে যাও মা। *হে দূর্গতিনাশিনী,* আবার তোমার অস্ত্র ধারণের সময় হইয়াছে। ওই দেখো মা, দেশের শান্ত শ্যামল বনভূমিও নিরাপদ নহে। দানবরা গ্রাম, শহর,নগর,বন্দর সহ সুন্দর বনাঞ্চল গুলিরও দখল লইয়াছে। সেখানে আর শ্রুতিমধুর বিহঙ্গকণ্ঠের কলরব নাই। আছে মনুষ্য রূপী জানোয়ারের অবাধ বিচরণ তৎসঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়ঙ্কর গর্জন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এরা সাঙ্ঘাতিক ভাবে কেবল বাড়িয়াই চলিয়াছে। নারীদেহ গুলো মৃত বা জীবিত হোক, শিশু বা বৃদ্ধা হোক, কিশোরী বা যুবতী হোক ললুপতার হাত থেকে যেন নিস্তার নাই। হানাহানি, রাহাজানি, খুন, জখম, ভদ্রবেশী চৌর্যবৃত্তি এবং কপটতার জমাট রাজত্ব দেখিতে পাইতেছি। একদিকে যেমন যুবসমাজে পোশাকের বাড়াবাড়ি তেমনি অপরদিকে যুবতীদিগের মধ্যে যেন পোষাকের হ্রস্বতার প্রতিযোগিতা শুরু হইয়া গিয়াছে। দিকে দিকে অশুভ শক্তির উল্লম্ফন ও নির্লজ্জতার ছড়াছড়ি। শুচিতা, সত্যবাদীতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদির মতো দৈবীসম্পদ সমূহ আজ যেন বিদ্রুপের বিষয়। তথাকথিত আধুনিকতার নামে কদর্য ও উন্মুক্ত যৌনতা করাল দংষ্ট্রায় মুখ ব্যাদান করতঃ সুকুমার মতি বালক বালিকাদেরও মস্তককে চর্বন করিয়া নিঃশেষ করিতেছে। *হে বরদে,* আজ তুমি ছাড়া সর্বনাশা লম্পট, প্রতারক, স্বার্থান্ধ, গা-জোয়ারি, পিশাচ, পাষণ্ড এবং রাজনৈতিক ধ্বজাধারী রাক্ষসদের বিজয়যাত্রা কে রুখিবে? ওই দৈত্যকূলোদ্ভব দুষ্টু চিন্তা, লোভ, লালসা এবম্প্রকার আরও অগণিত অশুভ বৃত্তিরা দেশের শাসনদণ্ড ও ধনভাণ্ডারের জবরদখল নিয়াছে। এসো এসো মা, সন্তান রক্ষা তরে ঝঞ্জাগতিতে ছুটিয়া আইস।
দেখ মা, শহরের মল-মুত্রের পুতিগন্ধে পরিপূর্ণ খানা ডোবা নালার উপরি পাটাতন নির্মান পূর্বক তদুপরি বস্ত্রে, কাষ্ঠে, বাঁশে এবং পরিবেশ দূষণকারী আরও নানাবিধ কৃত্রিম বস্তু দ্বারা নকল মন্দির নির্মাণ করিয়া তাহাতে তোমার মূর্তি বসাইয়া পূজার নামে তোমাকে অপমান করিবার কতো বিচিত্র আয়োজন। কোটি কোটি তোমার জীবন্ত মূরতী দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করিতেছে, অথচ তোমার অপমান যজ্ঞে অগণিত অর্থ ও লক্ষ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিনষ্ট হয়। একে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও আবার গভীর রাতে রঙিন পানীয়ের মাদকতায অনুষ্ঠিত় হয় নরপিশাচ নৃত্য।
আর বিলম্ব নয় মা। সমর সাজে সজ্জিত হও। *হে দশপ্রহরণধারিনী,* এ রণক্ষেত্র আজ নীরবে তোমার কঠিন মূরতির ধ্যান করিতেছে। সকল কলুষ মুক্ত কর মা। *হে শুভদে,* তোমার কৃপাদৃষ্টির নয়ন কীরণসম্পাতে এ ঘোর দুর্যোগ কাটাইয়া নবযুগের সূচনা কর মা। সকল অশান্তির কারণ সমূহ সমূলে বিনাশ করতঃ সুহাসে, সত্যে, সমদর্শিতায়, সুন্দরতায় এ নরলোক আবার নন্দনীয় হইয়া উঠুক।
এত যে অধঃপতন, এত যে তমসা, তবুও কি দুই-একটি মাতৃপদ-সর্বস্ব ভক্তের পবিত্র গৃহকোণে পরাশক্তি দেবী দুর্গার শারদীয় বোধন হইবে না? ধূপে-দীপে, পুষ্পে-গন্ধে, চারু-চন্দনে, হরিদ্রা আর নবপত্রিকায় দেবীর রাঙা পদে ভক্তের ভক্তি অর্ঘ্য কি নিবেদিত হইবে না? নিশ্চয়ই হইবে। এতো তমিস্রা সত্ত্বেও শারদোৎসবে দেবীর অক্ষয় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হইবে। তখন আনন্দময়ীর আগমনে কতো অপাপবিদ্ধ বালক-বালিকার চোখে মুখে আনন্দধারার ফোয়ারা উঠিবে। আমিও সেই আনন্দোৎফুল্ল বালক-বালিকাদের কণ্ঠে গাহিতে চাই-
আশ্বিন আসে ওই
ভাদ্রের পর।
দূর্গার পদধ্বনি
প্রতি ঘর ঘর।।
জননীর হাসিমুখ
স্নেহে ভরা মন।
রত্নচুড়া পরিহিতা
কাজল নয়ন।।
রক্তিম শাড়ি পরা
আলতা রাঙা পা।
পরমা কল্যানী
আমাদের মা।।
দশহাতে দশ অস্ত্র
অতি সমুজ্জ্বল।
সাজানো সুচিক্কণ
কুঞ্চিত কুন্তল।।
মায়ের সাথে আসে
সিংহ পশুরাজ।
শারদীয় মঙ্গলধ্বনি
প্রতি ঘরে আজ।।
গণপতি লক্ষ্মীদেবী
আর সরস্বতী।
ময়ূরের পিঠে আসবে
দেবসেনাপতি।।
অন্যায় রুখতে কার্তিক
ধরিবে অস্ত্র।
গণপতি সিদ্ধি দাতা
প্রণাম সহস্র।।
কৈলাস হতে দূর্গাদেবী
বাপের বাড়ী আসেন।
পিছু পিছু ভোলানাথ
দেখতে ভালোবাসেন।।
বহুদিন পরে মোদের
মাকে পেয়েছি।
তাঁকে পেয়ে দুঃখরাশি
সব ভুলে গেছি।।
ছোট-বড় সবে মোরা
জননীর সনে।
আনন্দের ফোয়ারা
আমাদের মনে।।
আনন্দ দিয়া মা
রচেছেন খেলা।
মাকে নিয়া ক'টা দিন
মিলনের মেলা।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
উর্মি সাহা
মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...
-
আজ আশ্বিনের শেষ কার্তিকের শুরু এই দিনটা বিশেষ ভাবে বিশেষ, বাংলার এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। জানি না বাংলার বাইরেও এইভাবে বিশেষ হয়ে উঠেছে কিন...
-
মূক ফেনীর মুখর পাঁচালি একটি বহুল প্রচারিত বাংলা প্রবাদ ‘ভাগের মা গঙ্গা পায়না’ ৷ প্রবাদটির মধ্য দিয়ে মায়ের অসহায়ত্বের যন্ত্রণাটিই ব্যক্ত হয়ে...