Sunday, October 10, 2021

বিনয় শীল

আগমনী রূপ-নালিশ-আবেদন-আনন্দ
                                                
আসিবে জানি মা শারদ লগনে
তব আগমনী গায় মলয় গগনে
ভেদী শুভ্র কুজ্ঝটিকা
পদ্ম-কাশ-শেফালিকা
সৌরভ ছড়ায় সকল দিকে।।
         আজ আবার তাহা মানসপটে উঁকি দিলো বুঝি। শরৎ আসিয়াছে। মানব হৃদয়ের পরতে পরতে অনাগত আনন্দময়ীর রক্তরাগ রঞ্জিত পদচিহ্ন ফুটিয়া উঠিতেছে। আহাঃ ! প্রকৃতিতে আজ কি আনন্দের প্লাবন। দিকে দিকে কাহার অপূর্ব রূপমাধুরীর অকৃত্রিম বিকাশ। ধান্য ক্ষেত্রের কচি কোমল ঘন সবুজ ডগা গুলিও, কোন ত্রিলোক বিস্তারিনী রূপসীর মলয় তরঙ্গায়িত অঞ্চলের পরশে পুলক প্রকাশ করিতেছে। দিবাকর মহোল্লাসে স্বীয় কিরণ মালায় কাহার আসন উদ্ভাসনে সদা ব্যস্ত। ঐ দেখো, দিগন্ত বিস্তৃত নীল গগনে শুভ্র মেঘপুঞ্জের স্মিত হাস্যে আনাগোনা। টুনটুনি, খঞ্জনি, দোয়েলা, কোয়েলাদের কণ্ঠে কাহার আগমনী সুর বাজিয়া উঠিল। কাহার অঙ্গ-সুবাসে আমোদিত অনিল সোৎসাহে বন-প্রান্তরে ছুটিয়া যাইতেছে। নব মুকুলিত পত্র, নব পাপড়ি প্রসারিত প্রসূন, -কোন দেবাঙ্গিনীর প্রেম পেলবতায় সমাচ্ছন্ন। আকণ্ঠভরা পুষ্করিণীর স্বচ্ছ সলিলে শতদল বিস্তার করিয়া কমল প্রস্ফুটিত। পদ্ম কলিতে আজ কোন গিরি দূহিতার উন্মিলিত নয়নের বিচ্ছুরিত দিব্য আলোর জোয়ারে মৃত্তিকার পৃথ্বিমাতা নব আলোকিতা।

         ওই তো! অরুণরাগে শিশির বিন্দু কনকদ্যূতিতে ঝলমল করা শিউলি ছড়ানো সতেজ শ্যামল তৃণাসন। তাহাতে আজ নিত্য প্রাতে, কোন কল্যানীর চরণ চিহ্ন অনুভূত হইতেছে। আজ কাহার অঙ্গ-জ্যোতির স্বর্ণকণা সাঁঝের আলোকে ছড়াইয়া পড়িল। কে বা কাহারা অমানিশার আকাশ ভরা প্রোজ্জ্বল তারকায় কোন মঙ্গলময়ীর জন্য বরণ ডালা সজ্জিত করিয়া রাখিয়াছে।কিসের নিমিত্ত শরৎ বিধুর অধর চ্যুত কোমল অমৃত জ্যোতির হিল্লোল-কল্লোলে ত্রিলোক প্লাবিত।ভ্রমরের গুঞ্জনে, শৈলবক্ষ-বিগলিতা নির্ঝরিণীর গানে গানে, কোন পরমা নন্দিনীর নূপুর-নিক্বনে দিঙমণ্ডল পরিব্যপ্ত। আজ এতো আনন্দ হইতেছে কেন ? কাহাকে লইয়া প্রকৃতির কোলে উল্লাসের এতো আয়োজন ?

          অকস্মাৎ দেখিলাম, কনক লতার ন্যায় এক বালিকা বামহস্তে পুষ্পপাত্র ধারণ পূর্বক পুষ্পচয়ণ মানসে শিউলি তলে বিরাজিতা। তাহার আলতা রাঙ্গা তুলতুলে পদযুগল শিশির জলে সিক্ত। পষ্পরেণু গন্ধে ভরা শীতল সমীরণ বালিকার অঙ্গ পরশিয়া কৃতার্থ বোধ করিতেছে। সদ্য প্রস্ফুটিতা কুসুমের ন্যায় তাহার অনিন্দ্য-সুন্দর বদনোপরি তরুণ তপনের সুচিক্কণ নবীন রশ্মিচ্ছটা ক্রীড়া করিতেছে। নিশীথ ভঞ্জনকারি বিহঙ্গকূলের আনন্দ কলরবে চতুর্দিক মুখরিত। দিগন্তমুক্ত প্রান্তর থেকে শ্যামল অরণ্যানী অবধি নবালোকাচ্ছাদনে এক অব্যাক্ত প্রেরণায় সঞ্জীবিত। সর্বত্রই যেন মঙ্গল মূরতি উৎকীর্ণ। বালিকার মনে কি জাগিল জানিনা, কিন্তু বোধ করি সে পুষ্পচয়ণ বিস্মৃত হইয়াছে। 

           বিশ্বশিল্পীর অতুলন শিল্প-কীর্তিস্বরূপ তাঁহার দুই নয়নে আনন্দাশ্রু বিগলিত দেখিতে পাইলাম। বহুবিধ ভঙ্গীতে সে তৃপ্ত নয়নে দীপ্তি ভরা প্রকৃতির শোভা অবলোকন করিতেছে। জগতের সকল সৌন্দর্য-খচিত, সেই বালিকার ঈষৎ হাস্যরঞ্জিত ওষ্ঠাধরের মধ্যবর্তী সুন্দর দন্তপঙক্তির অগ্রভাগ হইতে রজতঃদ্যূতি বিকীর্ণমান। কোন ধন্য মেনকা মাতা স্বহস্তে কন্যার গভীর কৃষ্ণ কুন্তলে সস্নেহে বনপুষ্প গাঁথিয়া দিয়া, পশ্চাতে এহেন কন্যারত্নের গমনানন্দ উপভোগে মুগ্ধ হইয়াছেন। সবিস্ময়ে লক্ষ্য করিলাম, হঠাৎ বালিকা মৃদুমন্দ ভাবে স্বর্ণতনু আন্দোলন পূর্বক সুমিষ্ট কণ্ঠে গাহিয়া উঠিল-

 শরৎ তোমায় এমন করে 
কে সাজালো।
তোমার মোহন সুরে বাঁশি 
কে বাজালো।।
শিউলি তোমার চরণ তলে 
কেন হাসে।
তোমার ভোরের হাওয়ায় 
ফুলের গন্ধ ভাসে।।
অঙ্গে তোমার আঁচল কাহার
হাওয়ায় লুটে।
কাশের বনে সবুজ ধানে
মাথা কুটে।।
কানন কূলে হাজার ফুলে
কাহার হাসি।
তোমার শোভার তরে নয়ন
হয় পিয়াসী।।
পুষ্পরাণী বুকে তোমার 
ফুটছে কেন।
তাই না দেখে উন্মাদিনী
পৃথ্বি যেন ।।
জানি জানি তুমি কেন
পাগলপারা।
কি আনন্দে তুমি আজি
আত্মহারা ।।
যার ছোঁয়াতে নাচলো তোমার
হৃদয়পরত্।
সেই আমাকে পেয়ে খুশী
তাই না শরৎ ?

            সেই "আমাকে" ! তবে কি জগজ্জননী আনন্দময়ী ভগবতী দূর্গা বালিকা রূপে অবতীর্ণা? যখন বহু অনুসন্ধানে ব্যার্থ পিপাসিত মৃগ শাবক জননীর প্রতি দৃষ্টি গোচর হওয়া মাত্রই, যেমন করিয়া পরমানন্দে গ্রীবা প্রসারণ পূর্বক দীর্ঘলম্ফনে জননীর স্তনামৃত পান মানসে দ্রুত ছুটিয়া চলে, সেই রূপ বালিকা রূপী মঙ্গলময়ীর চরণে লুটিয়া পড়িবার নিমিত্ত ধাবিত হইয়াছিলাম। কিন্তু দেখিলাম, বালিকা হস্তের পুষ্পপাত্রখানি নিম্নে রাখিয়া, ছায়া মাখা পুষ্পাকীর্ণ বন-বিথীকায় অন্তর্হিতা হইলেন। হয়তো বা গিরি রাজের স্নেহস্বর শুনিয়া, নয়তো বা সোনার দুলালী সর্বমঙ্গলার বিলম্ব দেখিয়া, উদ্বিগ্না মা মেনকার  মমতাপ্লুত কণ্ঠের সুগভীর আহ্বান শ্রবণ করিয়া বালিকা জননীসংকাশে গমন করিয়াছে।

            বালিকা কর্তৃক পরিত্যক্ত পুষ্পপাত্রখানি পরম যত্নসহকারে নিশিতে পতিত শেফালিকা সমেত নানাবিধ বনকুসুমে পূর্ণ করতঃ মায়ের চরনোদ্দেশ্যে নিবেদন পূর্বক মাকে বলিতে লাগিলাম-   *হে জগজ্জননী,* ভক্তিহীনের প্রণাম গ্রহণ করো মা। মাগো, তুমি আজ যতই প্রসূনপাত্র হস্তে ধরিয়া বিস্ময়ে হতবাক হওনা কেন, -এ শুধু তোমার রূপের বৈভব ছাড়া তো আর কিছুই নহে়। ভূমানন্দের অপূর্ব প্রেরণায়- 'আপনি নাচো, আপনি গাহো, আপনি দাও মা করতালি' -এই উদ্দাম ছন্দে গা ভাসিয়ে দিলে চলিবে কেন মা? তুমি তো জানো, এ পৃথিবী আবার দৈত্য-দানবে পরিপূর্ণ হইয়াছে। ওই শুনো তোমার ভক্তজনের ক্রন্দনধ্বনি। আজ তোমার সমীপে সবিস্তারে বলিবো মা। দেশের তৃণমমূলস্তর পর্যন্ত অসুরদের দাপাদাপি ও উৎকট উল্লাসে গগন পূর্ণ হইয়াছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, খাদ্য-সংভরন, সাধারণ প্রসাশন হইতে সমাজ ব্যাবস্থা প্রভৃতিতে রাক্ষস-খোক্কসরা জাঁকিয়া বসিয়াছে। সাধু, মহাত্মা, ভক্ত ইত্যাদি নামেও ভণ্ডতার একশেষ হইয়াছে। সর্বত্রই রাজনীতি নামক বিষাক্ত বায়ুর খলপ্রবাহ। প্রকৃত কর্তব্য কর্মে সীমাহীন ফাঁকি অথচ অন্যায় অধিকার আদায়ের জন্য দানবদের কি উশৃঙ্খলতা, -তা একবার নিজের চোখে দেখে যাও মা। *হে দূর্গতিনাশিনী,* আবার তোমার অস্ত্র ধারণের সময় হইয়াছে। ওই দেখো মা, দেশের শান্ত শ্যামল বনভূমিও নিরাপদ নহে। দানবরা গ্রাম, শহর,নগর,বন্দর সহ সুন্দর বনাঞ্চল গুলিরও দখল লইয়াছে। সেখানে আর শ্রুতিমধুর বিহঙ্গকণ্ঠের কলরব নাই। আছে মনুষ্য রূপী জানোয়ারের অবাধ বিচরণ তৎসঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়ঙ্কর গর্জন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এরা সাঙ্ঘাতিক ভাবে কেবল বাড়িয়াই চলিয়াছে। নারীদেহ গুলো মৃত বা জীবিত হোক, শিশু বা বৃদ্ধা হোক, কিশোরী বা যুবতী হোক ললুপতার হাত থেকে যেন নিস্তার নাই। হানাহানি, রাহাজানি, খুন, জখম, ভদ্রবেশী চৌর্যবৃত্তি এবং কপটতার জমাট রাজত্ব দেখিতে পাইতেছি। একদিকে যেমন যুবসমাজে পোশাকের বাড়াবাড়ি তেমনি অপরদিকে যুবতীদিগের মধ্যে যেন পোষাকের হ্রস্বতার প্রতিযোগিতা শুরু হইয়া গিয়াছে। দিকে দিকে অশুভ শক্তির উল্লম্ফন ও নির্লজ্জতার ছড়াছড়ি। শুচিতা, সত্যবাদীতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদির মতো দৈবীসম্পদ সমূহ আজ যেন বিদ্রুপের বিষয়। তথাকথিত আধুনিকতার নামে কদর্য ও উন্মুক্ত যৌনতা করাল দংষ্ট্রায় মুখ ব্যাদান করতঃ সুকুমার মতি বালক বালিকাদেরও মস্তককে চর্বন করিয়া নিঃশেষ করিতেছে। *হে বরদে,* আজ তুমি ছাড়া সর্বনাশা লম্পট, প্রতারক, স্বার্থান্ধ, গা-জোয়ারি, পিশাচ, পাষণ্ড এবং রাজনৈতিক ধ্বজাধারী রাক্ষসদের বিজয়যাত্রা কে রুখিবে? ওই দৈত্যকূলোদ্ভব দুষ্টু চিন্তা, লোভ, লালসা এবম্প্রকার আরও অগণিত অশুভ বৃত্তিরা দেশের শাসনদণ্ড ও ধনভাণ্ডারের জবরদখল নিয়াছে। এসো এসো মা, সন্তান রক্ষা তরে ঝঞ্জাগতিতে ছুটিয়া আইস। 

         দেখ মা, শহরের মল-মুত্রের পুতিগন্ধে পরিপূর্ণ খানা ডোবা নালার উপরি পাটাতন নির্মান পূর্বক তদুপরি বস্ত্রে, কাষ্ঠে, বাঁশে এবং পরিবেশ দূষণকারী আরও নানাবিধ কৃত্রিম বস্তু দ্বারা নকল মন্দির নির্মাণ করিয়া তাহাতে তোমার মূর্তি বসাইয়া পূজার নামে তোমাকে অপমান করিবার কতো বিচিত্র আয়োজন। কোটি কোটি তোমার জীবন্ত মূরতী দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করিতেছে, অথচ তোমার অপমান যজ্ঞে অগণিত অর্থ ও লক্ষ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিনষ্ট হয়। একে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও আবার গভীর রাতে রঙিন পানীয়ের মাদকতায অনুষ্ঠিত় হয় নরপিশাচ নৃত্য।

           আর বিলম্ব নয় মা। সমর সাজে সজ্জিত হও।  *হে দশপ্রহরণধারিনী,* এ রণক্ষেত্র আজ নীরবে তোমার কঠিন মূরতির ধ্যান করিতেছে। সকল কলুষ মুক্ত কর মা। *হে শুভদে,* তোমার কৃপাদৃষ্টির নয়ন কীরণসম্পাতে এ ঘোর দুর্যোগ কাটাইয়া নবযুগের সূচনা কর মা। সকল অশান্তির কারণ সমূহ সমূলে বিনাশ করতঃ সুহাসে, সত্যে, সমদর্শিতায়, সুন্দরতায় এ নরলোক আবার নন্দনীয় হইয়া উঠুক।

           এত যে অধঃপতন, এত যে তমসা, তবুও কি  দুই-একটি মাতৃপদ-সর্বস্ব ভক্তের পবিত্র গৃহকোণে পরাশক্তি দেবী দুর্গার শারদীয় বোধন হইবে না? ধূপে-দীপে, পুষ্পে-গন্ধে, চারু-চন্দনে, হরিদ্রা আর নবপত্রিকায় দেবীর রাঙা পদে ভক্তের ভক্তি অর্ঘ্য কি নিবেদিত হইবে না? নিশ্চয়ই হইবে। এতো তমিস্রা সত্ত্বেও শারদোৎসবে দেবীর অক্ষয় মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হইবে। তখন আনন্দময়ীর আগমনে কতো অপাপবিদ্ধ বালক-বালিকার চোখে মুখে আনন্দধারার ফোয়ারা উঠিবে। আমিও সেই আনন্দোৎফুল্ল বালক-বালিকাদের কণ্ঠে গাহিতে চাই-

আশ্বিন আসে ওই 
ভাদ্রের পর।
দূর্গার পদধ্বনি 
প্রতি ঘর ঘর।।
জননীর হাসিমুখ
স্নেহে ভরা মন।
রত্নচুড়া পরিহিতা
কাজল নয়ন।।
রক্তিম শাড়ি পরা
আলতা রাঙা পা।
পরমা কল্যানী
আমাদের মা।।
দশহাতে দশ অস্ত্র
অতি সমুজ্জ্বল।
সাজানো সুচিক্কণ
কুঞ্চিত কুন্তল।।
মায়ের সাথে আসে
সিংহ পশুরাজ।
শারদীয় মঙ্গলধ্বনি
প্রতি ঘরে আজ।।
গণপতি লক্ষ্মীদেবী
আর সরস্বতী।
ময়ূরের পিঠে আসবে
দেবসেনাপতি।।
অন্যায় রুখতে কার্তিক
ধরিবে অস্ত্র।
গণপতি সিদ্ধি দাতা
প্রণাম সহস্র।।
কৈলাস হতে দূর্গাদেবী
বাপের বাড়ী আসেন।
পিছু পিছু ভোলানাথ
দেখতে ভালোবাসেন।।
বহুদিন পরে মোদের
মাকে পেয়েছি।
তাঁকে পেয়ে দুঃখরাশি
সব ভুলে গেছি।।
ছোট-বড় সবে মোরা
জননীর সনে।
আনন্দের ফোয়ারা
আমাদের মনে।।
আনন্দ দিয়া মা
রচেছেন খেলা।
মাকে নিয়া ক'টা দিন
মিলনের মেলা।।

       

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...