Sunday, October 10, 2021

দীপক দাস

দুর্গা পূজার আলোয়- জীবনের নানা পর্যায়


সমগ্র জীবনকে যদি চারটি পর্যায়ে  ভাগ করি তবে এই চার পর্যায়ে  পূজোর আনন্দের  স্বরূপ কেমন তা আজকের বেলা শেষে ফিরে দেখতে ইচ্ছে  করছে।প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ  নিতান্ত শৈশবে পূজোর অনেক আগে থেকেই শরীরে মনে আনন্দধারা জেগে উঠত। আমরা আঁধারমানিক  নামক যে গ্রামটিতে থাকতাম, আমাদের বাড়ীর  খুব কাছেই মূর্তি তৈরী হত।মূর্তির  মাটি আমাদের বাড়ীর পাশের জমি থেকে নেওয়া হত। মাটি নিতে নিতে গর্তগুলি খুব গভীর হয়ে যেত।ছোট বয়সে যেতাম গর্তগুলির গভীরতা দেখতে।ভয় ও পেতাম।সে ভয় আজ ও তাড়া করে স্বপ্নে।অনেকদিন স্বপ্নে দেখেছি আমি গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে যাওয়ার  ভয়ে কাঁদছি। আমার পাশে কেউ নেই।ভোর হলেই ছুটতাম  প্রতিমা কতটুকু হল তা দেখতে।সারাদিনই ছিল এই আনাগোনা। প্রতিদিন একটু একটু করে আমাদের চোখের সামনে মৃণ্ময়ী  মূর্তির  অবয়ব তৈরী হচ্ছে আর আমরা অপলক বিস্ময়ে তা প্রত্যক্ষ  করছি,যে আনন্দ আজ শুধু স্মৃতিপটে লেখা হয়ে আছে। পূজোর সময় এবং সন্ধ্যায় মা বাবার হাত ধরে পূজো প্যান্ডেলে যেতাম, আরতি প্রতিযোগিতা  দেখতাম, কেউ কেউ ছটা বা আটটা ধূপতি নিয়ে আরতি করতো।ঘুমে চোখ জুড়ে এলে মা বাবার হাত ধরে বাড়ী ফিরে আসা, এভাবে চলত পূজোর ক - দিন।
আস্তে আস্তে শৈশব অতিক্রম করে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ  করছি। শুরু হল জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়।এ সময় পৃথিবীর আলোতে বাতাসে আকাশে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুধু আনন্দ আনন্দ আর আনন্দ। যেন আনন্দধারা  বহিছে ভুবনে। বাইরের পৃথিবীতে  পা রাখছি, মা বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের  হাত ধরে চলতে শুরু করেছি। এসময় পূজোর দিনগুলো নানা পরিকল্পনায় ঠাসা থাকত। কোনদিন কখন কোথায় কারা কিভাবে পূজো দেখত বেরুব,  কত পরিকল্পনা! অনেকে একসাথে সাইকেল করে পনের বিশ কিলোমিটার  দূরে পূজো দেখতে যেতাম। সবাই মিলে গেয়ে উঠতাম" ও আকাশ সোনা সোনা/ এ মাটি সবুজ সবুজ/ নূতন রঙের নেশায় হৃদয় রেঙেছে/ আলোর জোয়ারে খুশীর বাঁধ ভেঙেছে।"
 বা গাইতাম " এ পথ যদি না শেেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলতো। এরকম কত গান।
পরবর্তী  সংখ্যায়  সমাপ্য।

পোষাকে চুলের পারিপাট্যে ছিল যত্নের আধিক্য।তখন সাবরুমে পাঁচ সাতটা পূজো হত।বিভিন্ন পূজো প্যান্ডেলে দেখা হত বান্ধবীদের  সাথে। হাত নাড়ানো দু একটা কথা।অপরূপ সে সব মিষ্টি  অনুভূতি।আবার মনে মনে বিশেষ কারো সাথে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় কাটত সারাদিন। সেই বিশেষ একজনের সাথে হয়ত দেখা হয়েছে কিন্তু অব্যক্ত  থেকে গেছে মনের কথা বলা। আসলে এই পর্যায়ে অনেক ভালোলাগা বুদবুদের মত মিলিয়ে যায় সময়ে। বলা যায়না বেশিরভাগ কথাই।বিশেষ করে মনে পড়ে দশমীর দিনের কথা।সাবরুম মেলার মাঠে সব প্রতিমা এসেছে। আরতি প্রতিযোগিতা হচ্ছে,  মাঠের মধ্যে বন্ধুদের  সঙ্গে ঘুরছি।মৃণ্ময়ী মূর্তি দেখতে দেখতে বার বার চোখ খুঁজে ফিরছে ভালোলাগা মানুষটিকে।কখনো চোখাচোখি  কখনও বা দু একটা ইশারা করে কথা ছুঁড়ে দিয়েছি তার উদ্দেশ্যে। না চাইলেও এক সময় শেষ হয় বিসর্জনের অনুষ্ঠান। যৌবনের সেই সব দিনগুলোতে আমরাও প্রতি বছর বিসর্জন দিয়ে আসি আমাদের অসংখ্য  ভালোলাগাকে ভালোবাসাকে।রিক্ত হাতে ঘরে ফিরে আসি।
এরপর শুরু হয় তৃতীয় পর্যায়ের জীবন।চাকরি- বাকরি ঘর সংসার- স্ত্রী - পুত্র - কন্যা নিয়ে নূতন এক জীবন।এ জীবনের দাবী অন্যরকম।জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। স্ত্রী  পুত্র  কন্যাকে খুশী করতে হবে।কারন এদের জড়িয়েই তো জীবন।এ সময়ে পূজোর আনন্দ নূতন রূপে ধরা দেয়। প্রথম দু পর্যায়ে আমি ছিলাম খেলোয়াড়।মাঠে খেলছি।খেলার মধ্য দিয়ে আনন্দ উপভোগ করছি।এই পর্যায়ে আমি দর্শক।এপর্যায়ে পুত্র  কন্যাদের জামা কাপড় পরিয়ে ওদের আনন্দিত মুখ দেখে আমিও আনন্দ উপভোগ করেছি।দুটি ভিন্ন স্বাদের।তবু এতদিন পর্যন্ত জীবনের স্বাদ ছিল।
আজ এসে দাঁড়িয়েছি জীবনের নূতন এক পর্যায়ে।পূজোর দিনগুলোর শুরুতেই কেবলি মনে হচ্ছে শুরুর চারদিন পরেই বিসর্জনের বাজনা বাজবে।সব আনন্দ ছাপিয়ে কানে আসছে কেবলি বিসর্জনের বেদনা।জীবনের অন্য পর্যায় গুলোতে মনে হত, এইতো আবার আসছে পূজো।এখন মনে হয় আর নাও দেখতে পারি আগামী বছরের পূজো
।জীবনের শুরুতে আকাশে বাতাসে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আনন্দধারা  প্রত্যক্ষ  করেছিলাম।আজকের এই গোধূলি লগ্নে সমস্ত বিশ্ব চরাচরকে মনে হচ্ছ আমারি মত বিষাদগ্রস্ত।
তবু অধীর আগ্রহে নাতি নাতনির হাত ধরে অপেক্ষা  করে আছি পূজোর  জন্য।বিসর্জন আমাকে ধরলেও ওদের আমি প্রতিষ্ঠা  করে যাব জীবন চলার পথে।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...