Thursday, August 9, 2018

সঞ্জীব দে

আবিন্তা কবির এক মূল্যবোধের নাম
    

        মূল্যবোধ ,সততা ও উদ্দমশীলতার আরেক নাম আবিন্তা কবির । তাঁর পারিবারিক সু-সংস্কৃতি মায়ের শিক্ষা ,সমাজিক অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে তাঁকে আবিন্তা কবির হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আবিন্তা কবির আদর্শ সততা মূল্যবোধ আত্মবিশ্বাসকে অবলম্বন করে একজন সফল ব্যাবসায়ী হতে চেয়েছিলেন।আবিন্তা কবির সর্বদা মানুষের সাহার্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি বিশ্বের প্রচুর সেচ্ছাসেবি সংগঠনের সাথে যুক্ত রেখে দুস্ত অসহায় মানুষের পাশে তাদের বিভিন্নভাবে সাহার্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ।এমনকি অক্সফোড বিশ্ববিদ্যলয়েও সে স্ট্যুডেন্ড কার্যকরি কমিটিতে ছিলেন। বুক অফ লাইফে যে ভাবে মনরোলো মানুষের সেবায় নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলেছেন ঠিক সেই রকম আবিন্তা নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চান।বিশ্বস্ততা বা আস্তা ,সততা এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধের বসবর্তী হয়ে ভাগ্যাহতদের মঙ্গলার্থে জীবনের কিছুটা সময় তিনি ব্যয় করতে চান । তিনি মনে করেন যেই দেশের আলোবাতাস স্পর্শে তিনি বড় হয়েছেন সেই দেশের নাম বাংলাদেশ ।তাই তিনি দেশ ও সমাজের কাছে ঋণী । তাই তারও একটা নৈতিক কর্তব্য আছে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু আগামী প্রজন্মের হাতে দেশের ভবিষ্যত তাই এখন থেকে সবার উচিত আগামী প্রজন্মকে তৈরী করে তোলা। অবিন্তা কবির নিজেকে জানতে চেয়েছেন নিজের কাজের মাধ্যমে। নিজেকে আবিস্কার ও প্রমান করে গেছেন বার বার । মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের অক্সফোড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অবিন্তার স্বপ্ন ছিল- অনেক স্বপ্ন ।  মাতৃ ভক্তি ও টান থেকে এবং পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে তার মনে জন্ম নিল জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি অগাধ টান , এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার একটা বিরাট স্বপ্ন.ঊনিশ  বছরের তরুণী অবিন্তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলেন। অক্সফোডের মিশ্র সংস্কৃতিপ্রতিভাময়ী  অবিন্তাকে আরো বেশি করে দেশাত্মবোধে তাকে তৈরী করতে সহায়ক হয়েছিল।,মা রুবা আহমেদ ও বাবা এহসানুল কবিরের একমাত্র সন্তান অবিন্তার অক্সফোডে থাকাকালীন একটাই লক্ষ্য ছিল ,খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবেন এবং দেশের মানুষের জন্য কিছু করবেন।
       কেউ কি জানতো ঊনিষ বছর চার মাসের একটি ,একটি প্রতিভাবান মূল্যবোধ সম্পন্ন বিবেকের তিনটি অক্ষরের জী-ব- ন থমকে দাঁড়াবে। জীবনের ফুটন্ত সকালবেলায় তিনটি তাজা ফুলের কলি রক্ত স্নাত হবে।ঐ নর পিশাচরা শুধু আবিন্তাকে খুন করে নি ,ওরা খুন করেছে দেশের বিবেক ও মূল্যবোধকে,ওরা শুধু রুবার বুককে ক্ষত বিক্ষত করেনি,ওরা ক্ষত বিক্ষত করেছে বাংলা মায়ের বুককে।।মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে সুশৃঙ্খল পারিবারিক শিক্ষা ও মিশ্র সামাজিক অভিজ্ঞতা তার মনে খুব অল্প বয়সে জন্ম দিল বিশ্ব মানবিকতা বোধ। এই বোধ তাকে অন্যদের তুলনায় আলাদা ভাবে জানতে মোটেই অসুবিধা হয় না। সে মনে করতো আমাদের সকলের উচিত প্রতিদিনের কিছু সময় অসহায় মানুষের জন্য নিজেকে উতর্সগীত করা। মানুষের জন্য দেশের জন্য কিছু করার তীব্র আকাঙ্খা তাকে আমেরিকা থাকা সত্বেও তার মন পড়ে থাকতো স্বদেশের প্রতি। দেশাত্ববোধ কি তা জানতে হলে অবিন্তাকে জানতে হবে বাংলার যুবকদের।

        গুলশান আক্রমণে ঝড়ে যাওয়া সুভাষিত ফুলের শোক এখনো বাংলার বুক থেকে মুছে যায়নি। যত দিন যাচ্ছে তত আরো তাজা আরো সতেজ হচ্ছে তাদের স্মৃতি। তিন বাংলাদেশি ফারাজ, অবিন্তা এবং ইশরাতের জন্য এখনো কাঁদছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি স্মরণ করছে নিহত বিদেশিদের। সাধারণ মানুষের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ঐক্য গড়ে উঠছে।  দুইবছর পেরিয়ে গেছে পৈশাচিকতার। কিন্তু নৃশংসতার ক্ষত এখনো শুকায়নি। তবুও শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে চলছে বাংলার মানুষ। এখনো শোকার্ত বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত গুলশানের সেই রেস্তোরাঁর সামনে ভালোবাসার পুষ্পাঞ্জলি দেয় নিহতদের জন্য,বুকে বুকে প্রজ্জোলিত করে প্রতিবাদের আগুন । রাজধানীর গুলশানের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবির স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দের অংশীদার হতে দেশে ফিরেছিলেন। কিন্তু ঈদের আনন্দনগরীতে মৃত্যুপুরীর ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয় তাদেরই সমবয়সী বিপথগামী কিছু ঘাতক। শুধু বাংলাদেশই নয়, তারা দুজন এবং তাদের আরেক বন্ধু নিহত ভারতীয় তরুণী তারিশি জৈন যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন সেখানেও সহপাঠীরা শোকে কষ্টে স্মরণ করছেন তাদের। ফারাজ আইয়াজ হোসেন ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী লতিফুর রহমানের দৌহিত্র এবং সিমিন হোসেন ও ওয়াকার হোসেনের সন্তান। ১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফারাজের জন্ম। মাত্র ২০ বছরের টগবগে তরুণ ফারাজ মৃত্যুর আগেও বন্ধুত্বের জন্য আত্মত্যাগের অনন্য নজির রেখে গেলেন। যা প্রকাশিত হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসে। গতকাল ছিল ফারাজের কুলখানি। ফারাজের পরিবারের সদস্যরা জানান, আমাদের চোখের সামনে সে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। আমরা দেখেছি কী গভীর মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে জীবনের প্রশস্ত জগতে পা রাখার জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছিল। সে বিদায় নিয়েছে নির্মমতার শিকার হয়ে, কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তেও রেখে গেছে উঁচু নৈতিকতার স্বাক্ষর। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েও বন্ধুদের জন্য তার আত্মত্যাগের গল্প মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশের মানুষের সঙ্গে শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে তার পরিবারও। ফারাজ ছুটিতে বাড়ি আসে। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সবাই মিলে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল তার। নানা লতিফুর রহমান ও নানী শাহনাজ রহমান তাদের ছোট মেয়ে শেজি ও জামাই আরশাদ এবং তাদের দুই পুত্রসন্তান নিয়ে চলে যান। ফারাজের ভাই যারেফের ভিসার বিলম্বের জন্য ফারাজও যায়নি। ফারাজের মা সিমিন বলেছিলেন, ‘তুমি নানার সঙ্গে চলে যাও।’ আগে এ রকম হলেও এবার ফারাজ যেতে চায়নি। মা আর ভাইয়ের সঙ্গে রবিবার যাবে বলে থেকে যায়। শুক্রবার রাতেই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বন্ধুদের নিয়ে খেতে গিয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার নির্মম শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস তথ্য প্রকাশ করেছে যে, ফারাজ হোসেনকে চলে যেতে বললেও তার দুই বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈনকে ছেড়ে চলে যেতে চায়নি। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা ফারাজকে বাংলাদেশি মুসলিম বলে চলে যেতে বললেও সে যায়নি। অবিন্তা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এবং তারিশি ভারতীয় নাগরিক বলে তাদের বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা। ফারাজও তাদের সঙ্গে নৃশংসতার শিকার হয়। এখন এই তরুণ ফারাজ বন্ধুদের প্রতি তার ভালোবাসা, অসীম সাহস আর মানবিক গুণাবলির জন্য দেশে ও বিদেশে নানাভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছাত্ররা যৌথভাবে ফারাজ ও অবিন্তার স্মরণে বড় অনুষ্ঠান করেছে। তারা দুজনই তাদের নিজ নিজ ক্লাসের স্টুডেস্টস অ্যাকটিভিটিস কমিটির (এসএসি) প্রধান ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তিন দেশের পতাকা রেখে সামনে ফুল দিয়ে ও বিভিন্ন মতামত লিখে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত শিক্ষার্থীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানো হয়। ইমোরি ইউনিভার্সিটির জ্যাকসন নামের এক শিক্ষার্থী ফারাজ হোসেন ও অবিন্তাকে স্মরণ করে লিখেছেন, বন্ধুত্বের জন্য ফারাজের আত্মত্যাগ দেখিয়েছে, বন্ধুত্বের বন্ধন কতটা দৃঢ় হতে পারে। ফারাজ হোসেন ও অবিন্তা কবিরের স্মরণ আয়োজন হয় বিভিন্ন স্থানে। ফারাজের পাশাপাশি তার পরিবারের আর একটি বিষয় আমাদের অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার— তাহলো লতিফুর রহমান ও শাহনাজ রহমানের সব শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশেই। দেশের বাইরে তাদের কোনো বিনিয়োগ নেই। দ্বিতীয় কোনো পাসপোর্টও তাদের নেই। তাদের তিন সন্তানের সব এই দেশে। ভবিষ্যৎও এই দেশেই। তাদের বর্তমান তিন নাতির সব স্বপ্ন বাংলাদেশকে ঘিরেই। তাদের সবার কাছে বাংলাদেশ প্রথম, বাংলাদেশই শেষ কথা। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, তার পরিবারের কেউ গানম্যান নিয়ে চলেন না। অবিন্তা কবির (১৮) গুলশানে জঙ্গি হামলায় নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার মাত্র তিনদিন আগে আমেরিকা থেকে দেশে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। থাকতেন মিয়ামীতে। ইমোরি অক্সফোর্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে তার গ্রাজুয়েট হওয়ার কথা ছিল। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবেন বলে ২৭ জুন দেশে আসেন অবিন্তা। ইফতারের পরপরই তিনি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বন্ধু ফারাজ আইয়াজ হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে হলি আর্টিজানে যান। অবিন্তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে দেখা যায়, সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণীটি ছিলেন স্টুডেন্ট আক্টিভিটিজ কমিটির সঙ্গে জড়িত। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও অবিন্তা তার প্রোফাইলে যুক্তরাষ্ট্র না লিখে  বাংলাদেশের নাগরিক উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। অবিন্তা কবিরের দাদা মনজুর মোরশেদ সুপার স্টোর ল্যাভেন্ডারের মালিক। ফারাজ ও অবিন্তার সঙ্গে তাদের আরেক বন্ধু ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের শিক্ষার্থী ভারতীয় তারিশি জৈন নিহত হন। বাংলাদেশের কালচারাল ও করপোরেট জগতের প্রিয় মুখ ইশরাত আখন্দও মর্মান্তিকভাবে নিহত হন গুলশানের জঙ্গি হামলায়। ঘটনার পরদিন ইশরাতের শ্রীলঙ্কা যাওয়ার কথা ছিল। ইশরাতের বৃদ্ধা মা (৮২) বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে এসে আমার সঙ্গে ঈদ করবে বলেও কথা দিয়েছিল মেয়ে। সেই মেয়েকে কবরে দিয়ে এলাম। ৪ জুলাই গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকায় অবস্থিত একটি কবরস্থানে ইশরাত আখন্দের লাশ দাফন করা হয়। তিনি তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) উপদেষ্টা ছিলেন। ইশরাত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। দেশের বৃহত্তম টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনেও এক সময় কাজ করেছেন তিনি।

       কে জানতো এমন এক বিশেষ মূল্যবোধ সম্পন্ন মাত্র ঊনিশ বছরের একটি জীবন স্বদেশে ফেরার তিন দিন পর জীবনের আলো লুন্ঠিত হবে সন্ত্রাসের বিবেক হীন মুখে। হে রাষ্ট্র , রক্ত নয় ফিরিয়ে দাও বিবেক আর মুল্যবোধ আর নৈতিক জীবনের নিরাপত্তা।
        নিমেষে ঝড়ে গেল অবিন্তা সহ তিনটি তাজা মূল্যবান ফুল । দেশ হারালো অবিন্তাদের মতো এক বিশেষ মূল্যবোধ সম্পন্ন মনন শক্তি।

তথ্যসূত্রঃ
১/অবিন্তা কবিরের ডাইরী থেকে, সহযোগিতায় ইমদাদুল হক সূফী।
২/ বাংলাদেশের কয়েকটি পত্রিকা।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...