Wednesday, August 8, 2018

সম্রাট পাল

স্বাধীনতা ও বন্টন

জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিটি জীবের অস্তিত্বধারণের প্রথম চাহিদা হলো স্বাধীনতা। স্বাধীন মস্তিষ্কই সুস্থ স্বপ্নের পরিবাহক। উন্মুক্ত চিন্তাভাবনাকারীকে সভ্যতার চারণভূমিতে স্থান দিলে একদিন গোটা মানবজাতি হয়ে উঠবে স্রষ্টার সর্বকালের সেরা সৃষ্টি। সৃষ্টির এই চিরন্তন প্রতিভাকে যদি ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও ক্ষেত্রীয় ব্যবস্থার কৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ করা হয় তবে স্বাধীনতা শব্দটা নিতান্তই আভিধানিক হয়ে পড়ে। সেখান থেকেই মুক্তি পাওয়াকে বলা যায় প্রকৃত স্বাধীনতা। 

 একদিন পৃথিবীতে রাজার শাসন ছিলো, তারপর আসে ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল। দৃশ্যমান সব বন্ধনকে ভেঙ্গে মানুষ আজ নতুন পৃথিবীর সন্ধানে ব্রতী। কিন্তু এর মাঝেও এক অদৃশ্য বন্ধন সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই আমাদের পায়ে পায়ে জড়িয়ে আছে, সেটা হলো সামাজিকতার সংকীর্ণ বন্ধন। জাতি ধর্ম বর্ণের নামে আজও সেই বন্ধনকে অতিক্রম করা যায়নি।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ , ভীমরাও রামজী আম্বেদকর প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সমাজ সংস্কারের স্বার্থে। সফলও হয়েছেন অনেকটা। তাঁদের চলে যাবার পর আরো অনেক রকম সামাজিক ব্যাধির সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে আমাদের সমাজ প্রতিনিয়ত। পরিত্রাণের পথ দেখাতে উপযুক্ত সমাজ সংস্কারকের বড্ড অভাব।

আজকের সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ মানসিক ভাবে কতটা স্বাধীন?  

স্বাধীনতার যে ক্ষেত্রটি নিয়ে আমি আজ আলোচনা করবো, সেটা স্বাধীনতার চিরাচরিত প্রসঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

স্বাধীনতা একাত্তর বছর পরেও, আজকের সমাজে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে সমপরিমাণ স্বাধীন নয়। ব্যতিক্রম যদিও সর্বত্রই বিদ্যমান। জন্মলগ্ন থেকেই শিশুকে নারী পুরুষে আলাদা করে দেওয়া হয়। এটা শেখানো হয় না তুমি মানুষ। তোমার ধর্ম মানবতা। 

শিশুরা বড় ক্লাসে উঠতেই বাবা মা, আত্মীয় পরিজন স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যারিস্টার হবে ছেলে বা মেয়ে। পিঠে বিশাল বইয়ের বোঝা চাপিয়ে শুরু হয় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার গড়ার যুদ্ধ। মায়েরা ছেলে মেয়ের পড়া নিজে আগে ঠোটস্ত করেন। ক'জন বাবা মা জানতে চান ছেলে মেয়ে নিজে কি হতে চায়? এমন বহু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আছেন, তারা যদি শিল্পকলা নিয়ে কাজ করতেন হয়তো অনেকটা বেশি সফল হতেন। যদিও সবক্ষেত্রে বাবা মা দায়ী নয়। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বাধ্য করে বহুক্ষেত্রে। আসলে মনের কাছে আমরা স্বাধীন নই।

পড়াশোনার পর সম্পর্কের ব্যাপারে যদি চোখ বোলাই, সেখানেও আমরা কতটা স্বাধীন? সমাজব্যবস্থার কাছে আমরা পরাধীন নই কি? ক'টা ছেলে অথবা মেয়ে  ভালোবাসার টানে ভিন্নধর্মী মেয়ে বা ছেলের সাথে সংসার করার কথা ভাবতে পারে কিংবা জাতি উপজাতিতেও ক'টা সম্পর্ক হয়? মানবতা নয়, ধর্ম প্রাধান্য পায়। কারণ সমাজের কাছেই আমরা শিখি ছোটবেলা থেকে ভেদাভেদের তারতম্য। সবাই তো মানুষ। কিন্তু একথা সমাজকে কে বোঝাবে? কোন ছেলে অন্য একটা ছেলেকে অথবা মেয়ে মেয়েকে ভালোবাসতেই পারে। ভালোবাসাতে কোন অপরাধ নেই। হোক না সমলৈঙ্গিক। জিনগত ব্যাপারগুলো আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কারো সাহস নেই নিজেদের স্বীকৃতি দেওয়ার মতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপোষ ছাড়া উপায় থাকে না। তারপরেও নিজের কাছে আমরা স্বাধীন?

কিছু মানুষ আছেন যাদের সাহসিকতার মাত্রা অদম্য, তারা অবশ্যই স্বাধীন। ছোট্ট একটা কাহিনী। একটা ছেলে। একটু মেয়েলী প্রকৃতির। বড় হতে হতে নিজেও বুঝতে পারছিল সে ছেলে হতে পারে না। তার হাঁটা চলা কথাবার্তা নিয়ে স্কুল জীবনের শুরু থেকেই ব্যঙ্গ, শিস, হাসাহাসি চলতে থাকে। একটু বড় হওয়ার পর ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে লাগল। ক্লাবের ছেলেরা বাড়ির সামনে এসে টিটকিরি দিচ্ছে। স্কুলে যেতে পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। বাবা মা ভাই বোন সবাই বিরক্ত হয়ে যায় ওর উপর। স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় একটা সময়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিল সমাজের কাছে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। আর যে ব্যাপারটা নিয়ে সবাই ক্ষেপাতো সেটাই সে জয় করবে। হাতের কাজ, রূপচর্চা, এসব শিখতে থাকে নিভৃতে। বাবার সহায়তায় ব্যবসা শুরু করে বিউটিপার্লারের। প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ওর লক্ষ্যে পৌঁছুতে। কিভাবে লক্ষ্যে পৌঁছুতে সে রাস্তা টুকুও অজানা। ঈশ্বরে অসম্ভব বিশ্বাসী সেই ছেলেটি বহিঃরাজ্যে কোন এক মন্দিরে ঘুরতে গিয়ে এক টুরিস্টের সাথে পরিচয় হয়। উনি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিলেন। দীর্ঘ সময়ের অপারেশনের পরে পুর্ণাঙ্গ মেয়ের রূপ পায় সেই ছেলেটি। যিনি সাহায্য করেছিলেন তার সাথেই বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন কিছুদিন বাদে। এক আকাশ বাধা কাটিয়েও মনকে জয় করা যায় যদি ইচ্ছে থাকে।

স্বাধীনতা দিবসে সবাই স্বাধীন হোক ইচ্ছের কাছে। ইচ্ছের কাছে হার মানাটাই পরাধীনতা। নিজের কাছে সবাই স্বাধীন হোক। আনন্দে বাঁচুক গোটা পৃথিবী।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...