জীবন থেকে ধার নেওয়া
নিবারণ এমনিতে খুব একটা আসে না আড্ডায়।কিন্তু এলেই বন্ধুদের কপালে পড়তে থাকে একের পর এক ভাঁজ। সেই ভাঁজগুলো সাগরের ঢেউয়ের মতোই যেন ভাসতে থাকে সবার কপালে।
আড্ডায় এলে নিবারণই প্রধান বক্তা হয়ে যায় - নিজগুনে। নিবারণ তখন - না শোনে কোনো বারণ।কোথা থেকে কী-সব উদ্ভট চিন্তা আর বিষয় নিয়ে এসে হাজির হয় সে ! সেদিনও তাই।
নিবারণ এলো। এসেই বিড়িতে একটা সুখটান দিয়ে বলল, বুঝলি - আমাদের জীবনটা না আসলেই একটা আস্ত ঠাট্টা।
পাশেই বসেছিল জীবন।সে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল, কী বললি ? সবাই জীবনকে তখন চেপে ধরে বসিয়ে বলল, 'আহ্ নিবারণ, এসেই শুরু করে দিলি ?! এসব পাগলামি ছাড়্তো।'
নিবারণও দমবার পাত্র নয়।বলল, আমি না, আসলে - তোরাই পাগল।আমি কি আর এই তুচ্ছ জীবনের কথা বলেছি ?
আমি বলছি - আসল জীবনের কথা।
যুগ যুগ ধরে চলে আসছে- আসল আর নকলের খেলা ! এই আসল আর নকলের খেলাটা যারা দেখতে পায় - তারাই তো হয়ে যায় পাগল অনেকের কাছে। তাদের পিঠে ছাপ পড়ে - 'আরেক পাগল।'
মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে পাগল হিসেবে দেখার এই ঠাট্টাটা যে কবে থেকে শুরু হল কে জানে !
এইটুকু বলে নিবারণ এবার সুখটানের শেষ মেজাজে ভরপুর চোখে আকাশের দিকে চেয়ে বলল, জানিস - আমাদের এই সমাজের সমস্যা বা জটিলতাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে গেলে প্রচলিত ঠাট্টাগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন খুব জরুরী। সেটা নিয়েই এখন আমি ব্যস্ত আছি।
অনেক সময় ধরে নিবারণের এমন বকবকানি শুনে আকাশ বলল, এই কন্ট্রাক্টরিটা তোকে কে দিলো শুনি ?
নিবারণ নীচুস্বরে বলল, এই দ্যাখ্ - আকাশ, আমার এই কনসেপ্টটা নিয়ে তোর এই প্রশ্নটাও - আসলে একটা ঠাট্টাই।
না না, এতে তোর কোনো দোষ নেই, বুঝলি। এটাই সমাজের ধারা। এটাই জীবন।
আসলে হাসি-ঠাট্টা ছাড়া জীবন চলে না রে ।এটা সত্য। আর চলে না বলেই - হাসির পেছন পেছন ঠাট্টা লেগেই আছে ! শুধু ঘুরঘুর করছে। যেন প্রেমিক প্রেমিকা তারা।
তাদের প্রেম নিয়ে আবার কেউ কেউ রসিয়ে গল্পও বলছে।এতে কারো কারো বেশ সময় কেটে যাচ্ছে। দুর্বিষহ জীবন- কিছু সময়ের জন্য হলেও - মানে খুঁজে পাচ্ছে।তবে একটা কথা সত্যি - ঠাট্টা কিন্তু তুলনামূলক বিচারে শক্তিধরদেরই একচেটিয়া সম্পত্তি।
শক্তি যাদের আছে- তাদেরই সমাজ স্বীকৃত ঠাট্টার অধিকার আছে। মাঝে মধ্যে দুর্বল বা সরল মানুষেরা ঢুকে পড়ে ভুল করে সেই জমিতে ! তারপর যখন সে বুঝতে পারে - সে নিজেই ঠাট্টার শিকার, তখন লজ্জায় সে মাটিতে মিশে যায়।
স্বয়ং যুধিষ্ঠিরেরও তাই হয়েছিল।কোনো না কোনো ভাবে তিনিও দুর্বল ছিলেন অবশ্যই। তাইতো ঠাট্টার শিকার হয়েছিলেন তিনি।প্রকাশ্য রাজসভায় মহা- মহারথীদের সামনে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ যদি নিয়ম নীতি, চুক্তি বা শর্ত, শাসন বা রাজধর্মের দোহাই দিয়ে হতে পারে - তবে সেই রাষ্ট্রযন্ত্র - ঠাট্টা বৈ আর কী ?!
এমন অনেক হিজিবিজি চিন্তার পর নিবারণের মনে হল, ঠাট্টার সঙ্গে ফাঁকির একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। কেমন এই সম্পর্ক ?
এই সম্পর্কটা ঠিক মানবিক নয়, আবার সামাজিকও নয়। তবে কী - সেই সম্পর্কটা ! বুঝতে পারছে না সে।অনেক তথ্য সে উল্টেপাল্টে দেখছে।কিন্তু কোথায় যে ফাঁকিটা বাসা বেঁধেছে ?! বুঝতে পারছে না।যারা ফসল ফলাচ্ছে - তারাই না খেতে পেয়ে মরছে ! আর যারা ফসল ফলানোর ধারে কাছে নেই, তারাই সেই ফসল খেয়ে 'তা ধিন্' নাচছে !! অদ্ভূত !
যুগ যুগ ধরেই এ যেন এক অধরা রহস্য !! তাইতো যুগে যুগে অন্নহীনদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার এতসব পরিকল্পনা ! এটা কি সত্যিই সৃষ্টিকর্তার নির্মম রসিকতা নয় ?
নিবারণ দেখলো, সর্বশক্তিমান স্রষ্টাও কম খেলছেন না তার সৃষ্টিকে নিয়ে ! একে অবশ্য কেউ কেউ লীলা বলেন।ভিন্ন নামে অবশ্য কিছু যায় আসে না। .... কাজটাই আসল !
সৃষ্টিকর্তা কেন যে - এক দুই তিন -করে করে পঞ্চ-ইন্দ্রিয় সৃষ্টি করলেন ?! একটা ইন্দ্রিয় না দিলে- এমন কী অশুদ্ধ হয়ে যেতো ?!
'স্বাদেন্দ্রিয়টা' না দিলে কত ঝামেলাই যে চুকে যেত ! আর দিলেনই বা যদি, তবে কেন তিনি অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্রটাই প্রয়োগ করলেন না ?
ডিমান্ড অনুযায়ী ঠিক সাপ্লাইটা দিলেন না কেন ?! সৃষ্টিকর্তা এমন শক্তিধর হয়েও ফাঁকিতে ফেলে দিলেন সবাইকে ! দেওয়ার সময় কাত্ করে আরেকটু দিয়ে দিলেই তো হোত। যেখানে রঙ নেই, সেখানে আরেকটু রঙ, কিংবা যেখানে জল নেই, সেখানে আরেকটু জল।কত ভালই না হোত তবে !
নিবারণ এসব নিয়ে ভাবলেও - বলে না তেমন। কারণ সত্যটা যে অনেক সময়ই থাকে অস্পষ্ট। তাছাড়া সত্যটাকে সহজে সবাই - মেনেও নিতে পারে না। কারণ অসত্যের মাঝেই তো চলছে - দৌড় আর ছোটাছুটি !
নিবারণ জানে, জ্ঞানত সে মিথ্যে বলেনি কখনো।কিন্তু মুখে সে মিথ্যে না বললেও কী আর যায় আসে ! কান দিয়েই তো মিথ্যে শুনতে শুনতে সে কালা হয়ে গেছে !
মুখ আর কানের- মাত্র এই তিন ইঞ্চির ব্যবধানে এমন বিপরীত ভূমিকা - নিবারণের কাছে আজ সত্যিই রহস্য !!
চোখ যা দেখে, মাত্র তিন ইঞ্চি দূরে থেকেও মুখ তা বলতে পারে না। কান যা শোনে, মাত্র তিন ইঞ্চির ব্যবধানে থেকেও - চোখ তা সবসময় দেখতে চায় না !
No comments:
Post a Comment