Saturday, August 11, 2018

ড. সুচরিতা চৌধুরী

মননের অপেক্ষায়

সব প্রাণীরই মন রয়েছে তার নিজের মতো করে।  কিন্তুু মননের ক্ষমতা রয়েছে শুধু মানুষেরই। মানুষ তার মানস সম্পদে এতোই সমৃদ্ধ যে প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অর্জন করতে পেরেছে।  এই অবস্থান মূলত: মানুষের চিন্তা ভাবনা ও যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার স্বাক্ষর। আর, চিন্তা ও যুক্তির কর্মশালা যে মনই, এই বিষয়ে মানুষ মাত্রই একমত হবেন।

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে পঠন পাঠনের লিখিত মাধ্যম ছিলো না। প্রাচীন গ্রীসেও,আমরা জানি প্লেটো এবং তারও আগে সক্রেটিস আলোচনা এবং বক্তৃতার মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জ্ঞানের বিষয় পৌঁছে দিতেন। ভারতীয় দর্শনে আমরা এই তথ্য দেখি যে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে তত্ত্বজ্ঞান অর্জনের কথা বলা হয়েছে। গুরু তথা শিক্ষকের কাছে শোনা বিষয়কে গভীরভাবে চিন্তা ও পর্যালোচনা করাই হলো মনন। এই পর্বে বিষয়টিকে গ্রহন বা বর্জনের একটি পর্ব থাকে। ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাভাবনা, সুষ্ঠু বিচার ও বিবেচনাশক্তি মনন প্রক্রিয়ার অন্যতম শর্ত। মনন ক্রিয়ার জন্য এই কাজের প্রতি সচেতন প্রয়াসও প্রয়োজন। ব্যাক্তির ইচ্ছা এবং বিবেচনা শক্তির মেলবন্ধন না হলে মনন তার কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছতে পারেনা।

মন হলো মানুষের সেই ইন্দ্রিয়,যার সহায়তা ছাড়া তার জীবন সুষ্ঠু ছন্দে বয়ে যেতে পারেনা।  আমরা অভিজ্ঞতায় দেখি যে ,বাইরের অন্য ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকলেও মনোযোগের অভাবে কোনো বিষয় আমাদের ফাঁকি দিয়ে যায়। খুব সাধারণ একটি উদাহরণ নেওয়া যায়,  যেমন - যেকোনো আলোচনা সভায় সব কথা সমানভাবে শুনিনা আমরা, কারণ অন্যমনস্ক হয়ে যাই মাঝে মাঝে। এই অমনোযোগ, অন্যমনস্কতা অথবা মনে না রাখতে পারা অর্থাৎ ভুলে যাওয়া কোনোটাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সাধারণ পর্যায় এই সব-- মানুষের জীবনের।

মন নিয়ে এইসব কথা বলে যে বিষয়ের ভূমিকা তৈরী হলো - তা হলো ,মনের সমস্যা ।

আমাদের মন কম বেশি  ভুল ভাল , ভালো থাকা-মন্দ থাকা মিলিয়ে জীবন ছন্দের মূল কান্ডারীর ভূমিকা পালন করে।কিন্তু  মন যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, ভারসাম্য হারায় -তখন সেই মনের মালিকটি কেমন থাকে? কি অবস্থা হয় তার বর্তমান জীবনযাপনের ?
কি ব্যবস্থা হয় তার ভবিষ্যৎ জীবনের?কি ভূমিকা নিই আমরা সমাজের, পরিবারের অন্য মানুষেরা?  কি ভূমিকা নেওয়া উচিৎ?

হ্যাঁ,আমি মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের কথা বলছি; আমরা যাদের 'পাগল' বলে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত । রাস্তায় এলোমেলো এইসব মানুষ; বাচ্চারা উত্যক্ত করছে তাকে  -- এই দৃশ্য দেখিনি আমরা --আছি কি এমন কেউ ? ঠিক ক' জন সেই মুহূর্তে একজন মননশীল সত্তা হিসেবে ভূমিকা নিয়েছি? কেউ -ই নিইনি  এই ভূমিকা তা নয় ।  তবে প্রশ্ন করি আসুন , নিজেকে -- আমি কি নিয়েছি আমার ভূমিকা ? এর সৎ উত্তরের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে মানুষের জন্য মানুষের গড়া মননস্রোত,  যেখানে বয়ে চলা হবে নিশ্চিন্ত ঠিকানার উদ্দেশ্যে --অজানায় ভেসে যাওয়া নয় ।

    সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজ হলো মানুষের  পারস্পরিক সম্পর্কের একটি জটিল জাল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে এই জাল জটিল, কিন্তু এ ও উল্লেখ করেছেন যে, এটা সম্পর্কের জাল। সুতরাং  সম্পর্ক-বিহীন নিস্পৃহ, অনাগ্রহী,দর্শক হিসেবে নিজেকে যদি নিরাপদে রাখতে চাই আমরা,তবে সেই ভূমিকা যথার্থ সমাজ সদস্যের নয়। আমাদের দেশে, এখনো যেখানে বিভিন্ন শারীরিক রোগকেই সবক্ষেত্রে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয় নি,সেখানে মানসিক সমস্যাকে খোলা মনে স্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখার সম্ভাবনা প্রত্যাশা করা কঠিন । এই কারনেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের পরিবারের সদস্যরা ও  এই নিয়ে বিব্রতবোধ করেন,যেন এটা তাদের সবারই  অপরাধ ।অথচ কত সত্যি অপরাধ বিনা দ্বিধায় সগর্বে করে চলে মানুষ ---- পাগলকে  হেনস্থা করা,বাড়িতে অথবা প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম ব্যবহার করা, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপচয় করা,সার্বজনীন মিলয়াতনের, অফিস বাড়ির সিঁড়ির কোনে থুথু ফেলা,  রাস্তায় জলের কলের ট্যাপ খুলে নেওয়া-- আরো কত কি'র মতো!  কিন্তুু এভাবে এক লক্ষ্যহীন জীবন চর্চার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা কি সত্যিকারের মননশীলতার ধর্ম থেকে নিজেকে বিচ্যুত করে ফেলছি না?  প্রতিটি মানুষ তার সাধ্যমতো সীমায় দাঁড়িয়েই যদি এইসব অসহায় জীবনগুলোর জন্য কি করা যায় তা ভাবতে শুরু করেন একটু একটু করে, আসবে সেই দিন যখন আমরা রাস্তায় এমন দৃশ্য আর দেখবো না।

একটা মানুষ যখন তার মনের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে,তখন তার মতো অসহায় আর কেউই নয় । বিনা অপরাধে সে অন্যের বিরাগভাজন হয়। তার অসংলগ্ন আচরণ অন্যের কাছে তাকে বিদ্রূপের পাত্র করে তোলে। সব মানুষের কাছে, তাদের মননশীলতার কাছে এই আহ্বান -- দেখিতো একবার আমাদের সবার মিলিত চেষ্টায় মনহারা মানুষদের কাছে যাওয়া যায় কি না!  আমাদের সবার মননস্রোত ধারায় সেইসব মনকে সামিল করে নেওয়া যায় কিনা!  রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শীত, গ্রীষ্ম জুড়ে যাদের পথবাস, তাদের মনে ঘরের স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আমাদের মননের কাছে আমাদেরই ফিরে আসা প্রয়োজন।  মনুষ্যত্ব রয়েছে সেই মননের অপেক্ষায়।

No comments:

Post a Comment

অনুপম রায়

সতেরো বছর পর সতেরো বছর পর কি অবসাদ সেটা ধারণা না থাকাই ভালো। যাদের তুমি রেখে গেছ আমাদের হয়ে, তারা এখন উন্মাদ শহরের এক কোণে বসে শ্বাস নেয়। জ...