Wednesday, October 10, 2018

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাঙালির জমজমাট জনপ্রিয় লোকবাদ্যযন্ত্র ঢাক (দুই)

                         

গত পর্যায়ে ঢাককে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোকসাংস্কৃতিক বিষয়ের অবতারণা করেছি ৷ এই পর্যায়ে আরও দু একটি বিষয়ের উদাহরণ তুলে ধরে এই আলোচনার সমাপ্তি টানব ৷  
              লোকজীবনের বহুবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের  সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ৷ তার মধ্যে দুর্গাপুজো এবং চৈত্রসংক্রান্তিতে ঢাক বাজানো ছাড়া উৎসব অপূর্ণই থেকে যায় ৷ বিশেষ করে চৈত্রের গাজনে তো ঢাক অপরিহার্য ৷
               বাঙালির এক বিশেষ লোকউৎসব চৈত্রের গাজন ৷ এই গাজন অনুষ্ঠানের মূল পর্বে যাওয়ার আগে কতকগুলো পর্যায় অতিক্রম করে যেতে হয় ৷ গাজন উৎসবের বেশ কয়েকদিন আগে একদল ভক্ত বিশেষ একটি স্থানে জড়ো হয়ে অত্যন্ত সাত্ত্বিক জীবনযাপন করে ৷ পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চৈত্র সংক্রান্তির পূর্বের কয়েকদিন গাজনের সন্ন্যাসী ও ভক্তরা একসঙ্গে অবস্থান করে ৷ নিরামিষ ভোজন, রক্তাম্বর পরিধান, ভূমিশয্যা এবং গাজনের গান গেয়ে গৃহস্থবাড়ি থেকে সংগৃহীত ভিক্ষান্নে কৃচ্ছ্রতার জীবনযাপন করতে হয় তাদের ৷ এই গাজনের দল যখন বাড়ি বাড়ি গাজন গান করে ফিরে তখন তাদের সঙ্গের বাদ্যযন্ত্রের প্রধান উপকরণ থাকে ঢাক ৷ ঢাকের এক বিশেষ ধরণের বাজনার তালে গাজনের গানগুলো গাওয়া হয় ৷ এই গাজনের গানের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথা, শঙ্খের জন্মকথা, সিঁদুরের জন্মকথা, ইত্যাদিও বারোমাসি গান গাওয়া হয় ৷ এই প্রাবন্ধিকের সংগৃহীত অধুনালুপ্ত একটি ঢাকের জন্মকথা এখানে উল্লেখ করা হল ৷

                              শুন শুন ইন্দ্রসভা কইরে নিবেদন
                              ঢাকেরঅ জর্মকথা  অ শুন দিয়া মন ৷
                              সীতারে খুঁজিবারে হনু লঙ্কায় ধাই যায়
                              আমগাছে উঠিয়া হনু চাইরঅ দিগে চায় ৷৷
                              ক্ষুধায় তিষনায় হনু খায় আম্রফল ৷
                              আম্রফল খাইয়া হনু হৈল পাগল ৷৷
                              আম্রফলের বিচ হনু সঙ্গেতে লইল
                              সেই বিচ আনি অযোদ্যায় লাগাইল ৷৷
                              আম্র খাইয়া ভক্তগণে আম্রবিরিক্ক কাটি
                              সেই বিরিক্ক লইয়া গেল কামারের হাটি ৷৷
                              কামারে কাড়ি বানায় লোআর চাক্কি দিয়া
                              ছুতারে ঢাক বানায় কুঁদিয়া কুঁদিয়া ৷৷
                              ডাইনে বাঁয়ে ছাগলের চাম অতি সুশোভন
                              কাডি দিয়া ঢাকের বাড়ি বাঘের গর্জন ৷৷
                              শুন শুন ইন্দ্রসভা শুন দিয়া মন
                              ঢাকের জর্মকথা করিলাম বর্ণন ৷৷

গাজনের দল অর্থাৎ ‘ঢাকি ফিরা’র দলকে কোনো কোনো বর্ষিয়ান গৃহস্থ বেকায়দায় ফেলবার জন্যে বাড়ি়তে ঢাকি নাচের দল গেলে ঢাকের জন্মকথা বলার জন্যে প্রশ্ন করে ৷ গৃহকর্তাও ঢাকির গানের সুরে প্রশ্ন করে ৷ এই জাতীয় সঙ্গীতের লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো যে সবগুলো গানের শুরু ‘শুন শুন ইন্দ্রসভা শুন দিয়া মন’ পদ গেয়েই শুরু হয় ৷ প্রাজ্ঞ গৃহকর্তা প্রশ্ন করেন—
                                        ঢাকি ঢাকি ভাই একটু বইয়া যাও
                                        ঢাকেরঅ জর্মকথা খানিক কইয়া যাও ৷
     আবার অন্যরকম পদও শোনা যায়—
                                         ঢাকি ভাই কিয়ের ঢাক বাজাও
                                         ঢাকেরঅ জর্মকথা একটু বলি যাও ৷৷
     তখন ঢাকির দল উপরের গানটি গেয়ে গৃহকর্তার প্রশ্নের জবাব দেয় ৷ এ ধরনের প্রশ্নোত্তরের ঢংয়ে গাওয়া বেশ কিছু লৌকিক ধাঁধা গাজনের গানে পাওয়া যায় ৷ ধাঁধা লোকসংস্কৃতির বিশেষ উপাদান ৷ গাজনের গান ছাড়াও ঢাককে নিয়ে দু একটি লৌকিক ধাঁধারও সন্ধান পাওয়া যায় ৷ যেমন—
                                      এমন সুন্দর পক্ষী দুধে ভাতে খায় ৷
                                      ছিটকি দিয়া বাড়ি দিলে রাজ্যের দূরে যায় ৷
          সরু কাঠির আঘাতে ঢাকের যে আওয়াজ হয় তা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ায় ৷

           গাজনের ঢাক বাজানোর মধ্যে কিছু লোকবিশ্বাসও প্রচলিত রয়েছে ৷ সেইরকম দুএকটি লোকবিশ্বাসের উদাহরণ এখানে তুলেধরা হল ৷
চৈত্রমাসে গাজনের ঢাকে কাঠি পড়লে শিমূল তুলোর সুপক্ব                                             ফলগুলো পাকে এবং সংগ্রহের উপযুক্ত হয় ৷
চৈত্রমাসে গাজনের গানে ঢাক বাজালে  নতুন বছরে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে ৷
ঝড়-তুফানের সময় ঢাক বাজালে ঝড়ের তান্ডব কমে ৷

       ঢাকের মতো জনপ্রিয় লোকবাদ্যের সঙ্গে এভাবেই বাংলার বহু লোকসাংস্কৃতিক উপাদান গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে ৷ দেখা যায় যে সমস্ত উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত সেগুলো লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ৷ লোকবাদ্য ঢাক তার বিশিষ্ট উদাহরণ ৷

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...