অণুরাধা
যাইতে যাইতে নবীনদের কলাবাগান পার হইয়া মন্ডল বাড়ির গৃহ দ্বারে পৌঁছিতে রাতের অমাবস্যা বেশ জটিল হইয়া উঠিল |
সেদিন বিদ্যুৎ ছিল না | বরেনের হাঁক শুনিবা মাত্রই একখানা মাটির কুপি হাতে লইয়া মন্ডল গিন্নি দাওয়ায় বাহির হইল | মন্ডল বাড়ির দাওয়ায় পৌঁছিতেই মন্ডল গিন্নি বরেনের মুখ দেখিয়া প্রবহমান চিন্তার উৎপত্তিস্থল বুঝিবার অবকাশ রহিল না |
মন্ডল গিন্নি গৌরবে বলিয়া উঠিল , সে তো সন্ধ্যার প্রাক্ মুহূর্তেই বাহির হইয়া গিয়াছে ; এখনও গৃহে ফিরে নাই বুঝি ?
মন্ডল গিন্নির মুখের কথা পড়িতে না পড়িতেই বরেনের প্রশ্ন , "সঞ্জয় কই ?"
সঞ্জয় তো গায়েত্রীকে গৃহে পৌঁছাইয়া দিয়া বাজার লইয়া ফিরিবে বলিয়াই একসঙ্গে বাহির হইয়াছিল |
মন্ডল গিন্নির মুখ হইতে সঞ্জয়ের কথাটা শুনিবামাত্রই বরেনের মনে ছোট্ট সন্দেহের দানা বাঁধিল | কেন না বিগত মাস দুয়েক ধরিয়া গায়েত্রী-সঞ্জয়কে লইয়া পাড়ার চায়ের দোকান হইতে আরম্ভ করিয়া প্রায় সমস্ত আবালের মধ্যেই এক প্রকার কানাঘুষি চলিতেছিল | কহিতে কহিতেই কথাটা যেন বারুদ স্ফুলিঙ্গের ন্যায় প্রস্ফুটিত হইয়া ফাটিল | ততদিন কথাটার প্রতি বরেন কিংবা তাহার ধর্মপত্নী কেহই কর্ণপাত করে নাই | তাহাদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাসও জন্মাইলো না যে সঞ্জয়-গায়েত্রীর মধ্যে কোনো প্রকারের প্রেম সম্পর্ক থাকিতে পারে , কেন না উভয়েই নাবালক|
রাত্রি নয়টা পার হইল , উভয় পরিবারের মধ্যেই চিন্তার দানা সূত্র প্রায় চক্রবূহ্যে পড়িয়া শুধু আবর্তিত হইতেছিল | কেহই কোনো সমাধান সূত্র খুঁজিতে পাইলো না , না সঞ্জয় না গায়েত্রী কেহই গৃহে ফিরিল না | নানান প্রাসঙ্গিক অপ্রসাঙ্গিক চিন্তা দুশ্চিন্তায় বরেনের মাথা ফাটিবার উপক্রম ; মোটের উপর একমাত্র কন্যা ! বড়ই আদুরে | ততক্ষণে কথাটা গ্রাম ছড়াইয়া পড়িল | বরেন কিংবা মন্ডল বাড়ির শুভাকাঙ্খীর দল , অষ্টদিক খুঁজিতে লাগিল , যে যাহার যত চেনা আত্মীয় সমস্ত দিকেই জাল বিস্তারিল | মন্ডল পুলিশ ডাকিল |
মধ্য রাত্রি , রাত বারোটা , খবর নিশ্চিহ্ন | বিপুল খবর দিল , কন্যার চিন্তায় বরেনের ধর্মপত্নী বার বার মূর্ছা যাইতে ছিল | এমতাবস্থায় কোনো উপায় না করিতে পাইয়া বরেন টিমটিমে টর্চ লাইট খানি লইয়া ধীরে পদব্রজে একাকী গৃহাভিমুখে রওনা হইল |
টলিতে টলিতে বরেন চলিতেছিল | নানান চিন্তায় মস্তিষ্ক অদ্ভুদ আচরণ করিতে ছিল — "সঞ্জয় কী গায়েত্রীকে নিয়ে পলাইল ? না না , সে অসম্ভব , এমন চিন্তা করাও পাপ হইবে , ওরা ছোট ! নাকি রাস্তায় তাহাদের কোনো হিংস্র কুকুরে ধরিয়াছিল ? নাকি পথ ভুল করিয়া অন্য পথে চলিয়া গিয়াছে ? না না সে কি করিয়া সম্ভব হইবে , মেয়েটা এতবছর যাইতেছে , পথ ভুল করিতেই পারে না , সে অসম্ভব |" এইরূপে নানান চিন্তায় উত্তর প্রত্যু্ত্তরে মস্তিষ্ক অস্থির হইয়া উঠিল|
হাটিতে হাটিতে মন্ডল বাড়ি হইতে অনেকদূর আসিবার পর দেহ আর চলিতে ছিল না | পথ পাশে এক বিরাট বৃক্ষ তলে ধপাস করিয়া বসিয়া পিঠ খানা বৃক্ষে ঠেকাইলো | পিঠ খানা বৃক্ষে ঠেকাইয়া বসিতেই হটাৎ দুই ফোঁটা তাজা রক্ত বরেনের হৃদযন্ত্রের উপর আসিয়া আছাড় খাইল | বরেনের শরীর নিস্তেজ ! খানিক বাদে রক্তবিন্দুটি ডান হস্তের তর্জনি দিয়া অনুভব করিতেই বরেনের শরীর দিয়া যেন হাজার হাজার ভোল্টের বিদ্যুত প্রবাহিত হইয়া গেল ! উপরের দিকে মাথা তুলিবার অনুমতি টুকু পর্যন্ত শিঁড়দাড়া অনুমোদন দিতে পারিল না !
No comments:
Post a Comment