Tuesday, July 17, 2018

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে


আমাদের দুইদিকে দুই বাস্তব ৷ জন্ম আর মৃত্যু ৷ দুই বিশাল অনিবাৰ্য পিলারের মাঝখান গড়ায় জীবন ৷ জন্মে আমরা আনন্দ করি ৷ মৃত্যুতে আমাদের হাত নেই ৷ মৃত্যু আমরা চাইনা ৷ তবু মৃত্যু আসে ৷ স্বাভাবিক নিয়মে ৷ সময়ে বা অসময়ে ৷  জীবন গড়িয়ে যেতে স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই আমরা ৷ সাধের ঘরবাড়ি ফেলে চার প্রিয়জনের কাঁধে চড়ে আরশিনগর থেকে অরূপনগরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মহড়া দিই প্রতিনিয়ত, প্রতিপল ৷ কখন কালের সেপাই এসে তুলে নিয়ে যাবে মহাকালের রথে ৷ জানিনা ৷ চিনিনা ৷ দেখিনা তাকে ৷ কল্পনা করি তার অনিবার্যতা ৷ তবুও তাকে ঘিরেই সৃজনে মাতে এক সৃষ্টিশীল চেতনা ৷ তার নাম মৃত্যুচেতনা ৷ জন্মচেতনার ক্ষণ যতোটা না দাগ কাটে, মৃত্যুচেতনা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ঘিরে ধরে নশ্বরতাকে ৷ মৃত্যু জীবনের শেষ ঠিকানা হলেও তাকে কবি বলেন অমৃতপাত্র ৷ সেই পরম ৷ মৃত্যুর বক্ষ আলিঙ্গনের জন্যে যেন সারাজীবন বিরহকাতরতায় ভোগে বিবাগি আত্মা ৷ সে কিন্তু জীবনকে ত্যাগ করে নয় ৷ জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ৷ জীবনে জীবন যোগ করে ৷ আত্মজীবন, সহজীবন ও অনাগত জীবনের জন্যে কিছু করেই জীবনের পথচলা ৷ এই কিছু করাটাই হলো কল্যাণ ৷ জীবন ও জগতের কল্যাণ ৷
সময়ে হোক অসময়ে হোক মৃত্যু ঘটানোর সঙ্গে মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে গেলে সেখানে আর মনুষ্যত্ব থাকেনা ৷ পশুত্বে পরিণত হয় ৷ লাথি মারা হয় মানবিকতাকে ৷ মানবাত্মার কবর রচিত হয় সেখানে ৷
     সুকান্ত ৷ সুকান্ত চক্রবর্তী ৷ এক তরতাজা তরুণের নাম ৷  আমার প্রান্তিক শহরের আর দশটা তরুণের মতো জীবনযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক সে ৷ আমার স্নেহভাজন গুণী ছাত্রদের একজন ৷ ওদের পরিবারের সঙ্গেও আমাদের দুই পুরুষের সম্পর্ক ৷ একসময় সুকান্তর বাবা সুবিমল চক্রবর্তী আমার গ্রামের বাড়ি ছোটোখিলের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের ব্যবসা দেখভাল করতেন আর অবসর সময়ে দর্জির কাজ করতেন ৷ আমরা তাঁকে বিমলকাকা বলে ডাকতাম ৷
আমার পিতৃবিয়োগের পর চরম দুর্দিনগুলোতে যৌবনে যখন মা এবং অনুজদের নিয়ে বেকায়দায় পড়ি সেদিন তিনি তাঁর প্রাগুক্ত মালিকের রেশনশপ থেকে চাল দিয়ে আমাদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ৷ তার বাবা সুবিমল চক্রবর্তী দুই ছেলেকে নিয়ে আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে গেছেন ৷ পরিশ্রম করে একটা পরিবারকে দাঁড় করিয়েছিলেন ছোটোখিলে ৷পরে তাঁরা নিজস্ব সমস্যার অজুহাত তুলে তাদের কাজ থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে দেয় ৷ তারপর বিমলকাকা দুই ছেলেকে নিয়ে অকূলে ভাসেন ৷ সাব্রুম বাজারে একটা ছোট্ট ঘরে দর্জির কাজ করে অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করেন ৷ একসময়ে স্ত্রীকেও হারান তিনি ৷ ছেলেদের দায়িত্ব আর দারিদ্র্য দুপাশ দিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে ৷ ছেলেদের যথাসাধ্য শিক্ষিত করে একদিন তিনিও বিদায় নেন ৷

আত্মশ্লাঘা হলেও সত্যি এই সুকান্ত আমার হাতে গড়া ৷  সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক ববিদ্যালয়ের  ছাত্র ছিল ৷ সেময়ে স্কুলের বহু অনুষ্ঠানে সে নীরবে অংশগ্রহণ করে গেছে ৷ তাকে বাদ দিয়ে কোনো অনুষ্ঠানে তবলা বাজানো ভাবাই যেতনা ৷  বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত নিতাই বড়ুয়া প্রতিষ্ঠিত সাব্রুম শহরের 'সুরছন্দ নৃত্য সংস্থা' নামে যে প্রতিষ্ঠানে গান বাজনা শিখত ও পরে শেখাত পনেরো বছর আমি তার সম্পাদক ছিলাম ৷ তার যখন তবলায় উচ্চতর যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজন অনুভব করে আমাকে জানায় তখন আমি উদয়পুর চন্দ্রপুরের তবলা প্রশিক্ষক নিখিল সূত্রধরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই ৷ তিনি তাকে বিনা পারিশ্রমিকে তালিম দিয়েছিলেন তার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ৷
সারাদিন শিখিয়ে খাইয়ে পরিয়ে ফেরার গাড়িভাড়া দিয়ে দিতেন ৷ তার অমায়িক ব্যবহারই সবার মন কেড়ে নিত ৷ সুরছন্দের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত নিতাই বড়ুয়ার পরিবারেরই মেয়ে সঙ্গীতশিল্পী তনুশ্রী বড়ুয়াকে বিয়ে করে ৷ দুজনে মিলে
সুকুমার কলার সঙ্গে জীবিকাকে জড়িয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন অতিক্রমণের স্বপ্নদেখা যুবক সুকান্ত ৷ পিতৃমাতাহীন এই যুবক কোনোরকম অনৈতিক সুযোগ নিয়ে বড়ো হওয়ার ভাবনা ছিলনা তার ৷ শত অভাবেও তার মুখমন্ডলের মায়াময় ঐশ্বরিক হাসিটি ম্লান হতে দেখা যায়নি ৷ যেমন ছিল তবলায় নৈপুণ্য তেমনি ছিল ভরাট আকর্ষক কন্ঠস্বর ৷ শিক্ষিত এই যুবক তবলা বাদন শিক্ষাদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সরকারী বেসরকারী সংস্থার প্রচারমূলক ঘোষণা ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনার মাধ্যমে প্রাপ্ত সামান্য অৰ্থ দিয়েই তার ছোটো সংসারটি প্রতিপালন করত ৷ অপেক্ষা করত তার পাঁচমাসের শিশুসন্তানটির কন্ঠে বাবা ডাক শোনার ৷ চিরদুখি সুকান্তর সে ডাক আর শোনা হলনা ৷ তার পরের নৃশংস ঘটনার সচিত্র বর্ণনা আজ বহুদূর ছড়িয়ে গেছে ৷ সারা বিশ্ব হতবাক হয়ে গেছে এই নৃশংসতায় ৷ সে নারকীয় ঘটনার বিবরণ দিতে আমি পারব না ৷ মানুষের মনের অন্ধকার, কুসংস্কার দূর করার জন্যে, গুজবে কান না দেওয়ার জন্যে,গুজবে কান না দেওয়ার জন্যে শুভবার্তা নিয়ে সুকান্ত গিয়েছিল তার সুকন্ঠে আবেদন জানাতে ৷ দায়িত্ব নিয়েছিল মানুষের বিশ্বাস জাগানোর, শুভচেতনার উজ্জীবন ঘটানোর তার কণ্ঠস্বরের ধ্বনি- প্রতিধ্বনির মাধ্যমে ৷
কিন্তু তার কন্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল মানুষরূপী একদল হিংস্র ঘাতকের পৈশাচিক উল্লাসে ৷ শুধু তাই নয় ৷ বাজারভর্তি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল সে দৃশ্য কাঠপুতুলের মতো ৷  আর একদল সেলফিবাজ, ক্যামেরাবিলাসী আপনমনে ছবি তোলায় ব্যস্ত ৷ ফাইলবগলে নিরস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নিস্ফল হাতজোড় করছে ৷ আরে!  পশুপাখিরাও তো আক্রান্ত হলে ঝাঁক বেঁধে চিৎকার করে ! আমরা কী মানুষ আছি আজ?  সুকান্তর অসহায় মৃত্যু সে প্রশ্নই রেখে গেল ৷ মানুষের নিরাপত্তা আজ শূন্যেরও নীচে নেমে গেছে ৷ আমরা যে কেউ যে কোনদিন খরচ হয়ে যেতে পারি ৷
হা ঈশ্বর, শিক্ষা চেতনা আনে ৷ চেতনা বিপ্লব আনে ৷ আনে কী আসলে? সাবরুমের কলাছড়া কিন্তু অশিক্ষিত এলাকা না ৷ এখানে বহু শিক্ষিত, জ্ঞানী গুণীজন, সমাজের দিশা দেখানোর মতো মানুষজনের বাস ৷ অথচ সবাই অশুভ শক্তির হাতে বন্দী হয়ে গেলেন ৷ নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিলনা কারুরই ৷ ত্রিপুরায় বিজ্ঞান সংগঠনতো কম নেই ৷ কাজকর্মও কম করেননা এইসব সংগঠনের কর্মীরা ৷ সুকান্ত তো অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচারে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে ৷ তাঁদের কেউতো আজ পর্যন্ত রা করলেননা একজন সহযোদ্ধার নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ৷ আমার বহু প্রয়োজনে আমি সুকান্তর সাহায্য পেয়েছি ৷ তার মৃত্যুর দুদিন পরে আমার একসময়ের সহকর্মী বড়দাপ্রতীম দীপক দাস বিকেলবেলা আমাকে ফোন করলেন ৷ আমি তখন সাব্রুম বাজারে ছিলাম ৷ মানুষের গঞ্জনায় কিছু বুঝিনি ৷ উনিও বুঝলেন ব্যাপারটা ৷ একটু পরে দেখা হবে বললেন ৷ আমি বাসায় বাজার পৌঁছে দিয়ে আবার এসে উনার সঙ্গে দেখা করলাম ৷উনি বললেন, সুকান্তর পরিবারের লোক আসবে আমার কাছে পরদিন সকালবেলা ৷ সরকারি আর্থিক সহায়তার জন্যে একটা দরখাস্তের বয়ান লিখে দিতে হবে তাদের ৷ আমি সায় দিলাম কিন্তু কী লিখব আমি ভেবে ঝড়ে তোলপাড় হচ্ছিল আমার অন্তঃকরণ ৷
  পরদিন সকালে আমার বাসায় এল সুকান্তর পরম বন্ধু প্রতিবেশী প্রদীপ চক্রবর্তী এবং তনুশ্রীর ভাই ৷ কী লিখব আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলামনা ৷ বিষন্নতায় আক্রান্ত আমি ৷ একঘর মানুষের সামনে আমি অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি ৷ হাত কাঁপছিল ৷ কলম ধরতে পারছিলামনা ৷ চোখের জলে কাগজ ভিজে যাচ্ছিল ৷ যারা প্রকৃতই চিরদিনের জন্যে কাঁদবে তারা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ৷ অতি কষ্টে দীর্ঘ সময় নিয়ে দরখাস্তটা লিখে দিলাম ৷ তার দুদিন পরে আবার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজকদের  জন্যে দুটি শোকপ্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে দিতে হল ৷ একটি সুকান্তর পরিবারের জন্যে, অন্যটি আমার প্রিয়ভাজন সাব্রুমের আর একজন অকালপ্রয়াত শিল্পী অরুণ নন্দীর পরিবারের জন্যে ৷ কারণ উদ্যোক্তারা ওইদিন একসঙ্গে দুজনের শোকসভার আয়োজন করেছিলেন ৷
আসলে আজ আমরা এতো অসহায় যে হাতে পায়ে শেকলবাঁধা অবস্থায় বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই ৷ আর উত্তরপ্রজন্মের নিধনযজ্ঞের হাড়িকাঠটাও আমাদেরই পুঁতে যেতে হবে ৷ যতোদিন আমরা ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ না হই ৷ যতোদিন সামগ্রিক অর্থে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ না হই ৷ যতোদিন পরিশুদ্ধ চেতনার অধিকারী না হই ৷ আমার মতো অনেকের তো ভাটিবেলা ৷ আমরা  আজ বা কাল চলে গেলে সমাজের তেমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবেনা ৷ কিন্তু যাদের এই সুন্দর পৃথিবীর রূপরসগন্ধস্পর্শ নেবার সময়, তাদের কেন যেতে হবে অসময়ে ৷ অকারণে ৷ নৃশংসতায়, নির্মমভাবে!

(বিশেষ পাতা : সুকান্ত চক্রবর্তী স্মরণে)

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...