Thursday, December 24, 2020

মনচলি চক্রবর্তী

কুটুসের একদিন 

একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কুটুস গেছে হারিয়ে। বাড়িতে মা ফোন নিয়ে ব্যস্ত, বাবা অফিসে। হঠাৎ কুটুসের মায়ের মনে পড়ে যে কুটুস আসেনি এখনো, চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন উনি। স্কুল কর্তৃপক্ষকে ফোন করলে ওরা জানালো যে কুটুস স্কুল থেকে গাড়িতে যথানিয়মেই এসেছে,নেমেছে সে গন্তব্যস্থলে।তবে কুটুস কোথায় গেলো? 
       কুটুস স্কুলবাসে ঠিকই এসেছে কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে আনমনা হয়ে আরেক পথে পাড়ি দিয়েছে। অজানা অচেনা নিস্তব্ধ সেই পথ, চেনা জানা কেউ নেই। তাও কুটুস হেঁটে চলেছে কিসের এক হাতছানিতে। প্রথমে তার ভয় ভয় লাগছিল, আস্তে আস্তে তার ভারী মনে আনন্দ হতে থাকে। দৌড়ে অনেকটা পথ পার হয়ে যায় সে।দূর থেকে কি দেখেছিল কুটুস? কি দেখে সে এত আনন্দিত? 
       বর্তমান যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত ব্যস্ত আধুনিক সভ্য সমাজে কুটুস যা দেখেনি কখনো, তাই সে আজ দেখেছে,  অনুভব করেছে। অজানা অচেনা পথে সে নূতন আনন্দের ছোঁয়া পেয়েছে। অবাক করেছে তাকে সবুজ সুন্দর প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য।
         সে অনেকটা দূরে চলে এসেছিল শহর থেকে। কুটুস তার অজানা পথের শেষ প্রান্তে একটি ভারী সুন্দর নদী দেখতে পেল। নদীর পাশে ঝিরঝির হাওয়ায় দুলছে কাশবন। তার মনে দোলা দিল সবুজ মাঠ, যেখানে কৃষকেরা কাজ করছে। টলটলে জলভর্তি পুকুর, খেলার মাঠে শিশুদের কোলাহল, গ্রামের ছেলেদের নদীতে জল ছিটিয়ে স্নানের দৃশ্য, বধুদের নদীর ঘাটে কাজ করা, জেলেদের মাছ ধরা, সব তার মনে বয়ে নিয়ে এল কখনো না অনুভব করা এক আশ্চর্য প্রশান্তি। কখনো কি সে পুকুরে এভাবে শাপলা, পদ্মফুল ফুটে থাকতে দেখেছে? মাঠে শিশুদের সাথে কুটুস খেলা করলো, ছুটোছুটি করলো।শৈশবের অনুভূতিগুলোর ছোঁয়া লাগলো তার মনে।নদীতে জেলেদের সাথে নেমে সে মাছ ধরা দেখলো,এমনকি মাছ ধরলো, সেকি আনন্দ তার।জলে লাফালাফি করলো ছেলেদের সাথে  মনের সব দ্বিধা ভুলে।তার স্কুলের দামী ঝকঝকে পোশাক কাদাময় হল, সে তাও খেলা করে যাচ্ছে ওদের সাথে।নদীর ধারে পাখীর কিচিরমিচির,বনফুলের গন্ধ, রাখালের গরুচরানো, কি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, কুটুস তাতে হারিয়ে গেল।মনের সবটুকু উজার করে সে আনন্দটুকু উপভোগ করলো।
        শহরে কর্মব্যস্ততার জীবনে  হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের সুন্দর শৈশব।মা বাবারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, কুটুসের মা বাবাও তার অন্যথা নয়, যেমন তার মা আজ ভুলেই গেছে তাকে স্কুল থেকে আনতে। চার দেয়ালের বাইরেও যে আছে এক অন্যরকম অবাক করা পৃথিবী তা আজ অনেক শিশুরাই জানে না, দেখেনা, অনুভবও করেনা। স্কুলের পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্টের ইঁদুর দৌড়ে,নাচে, গানে আবৃত্তিতে প্রথম হওয়ার তাগিদে ওরা খুবই আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতঃ আজ শিশুরা মা বাবার ইচ্ছাপূরনের যন্ত্রমাত্র।প্রকৃতির বাস্তব শিক্ষায় শিশুরা শিক্ষিত নয়।
      কর্মব্যস্ত আধুনিক যান্ত্রিক সভ্য সমাজে শিশুরা হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমাজে ভবিষ্যতে আর 'মানুষ' থাকবে না, থাকবে যন্ত্রমানব, যা হবে অতীব ঝুঁকিপূর্ন। শিশুদেরকে তাদের নিজের পৃথিবীতে বাঁচতে দিন, তাদের শৈশবকে অনুভব করতে দিন।
       পুলিশ ও স্থানীয় লোকদের সহায়তায় অবশেষে কুটুসকে খুঁজে পায় তার মা বাবা। তার দামী স্কুল ছিল নোংরা, কদাকার তবে তার মুখে ছিল একরাশ হাসি ও আনন্দ।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...