ঘরে কোনো আরশি না থাকলে বোধহয় ভালো হত।মানুষ ওই আরশিতে তাকিয়ে নিজেকে কত সহজেই আরশিনগরের মানুষ করে তোলে । মুখে ভেংচিকাটে,হাসে, ও শরীরটারে কত যত্ন করে দেখে। যেন আয়নার ভেতরের ওই মানুষটা অন্য কেউ,যাকে ছুঁয়া যায় না অথচ ভেতরের সবটা দিয়ে অনুভব করা যায় ।
নয়ন সারাটা দিন নিজের ঘরেই বসে থাকে । খাওয়ার সময় খায়,আর বাকি সময় বই ,কখনো কখনো বাঁশিতে বেসুরের সুর, ইচ্ছে হলে গল্পে হাতপাকায় । এইটাই তার জীবন । এর বাইরে সে কখনো ভাবতে পারে না। যেন একাকিত্ব তাকে গ্রাস করতে আরম্ভ করেছে।
সেদিন ছিল কুয়াশার আকাশ ।এবং হার স্পর্শ শীত। নয়ন কলেজ ক্যান্টিনে সিগারেট ধরিয়ে আঙুলের ফাঁকে রেখে দিয়েছে । তন্ময় ভাবনায় সে মশগুল ।ক্যান্টিনের উত্তরের জানালার লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কলেজটিকে দেখছে ।
দেখতে দেখতে ছয় মাস হয়ে গেল।এর মধ্যে কত মায়া তাকে নিবিড়ভাবে বেঁধে ফেলেছে । মাঠের সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটাকেও আজ বড্ড আপন মনে হয় ।যেন তার সাথে কতকালের আত্মার সম্পর্ক ।
মানুষ এই একটা কাজ খুব সচেতনভাবে করে ,মায়ায় জড়িয়ে ফেলা। আর যেটা পারে না সেটা হল মেনে নেওয়া।
যার পাশে দাঁড়িয়েও কোনদিন মনে হয় নাই তারে একদিন এই মনের ভালো লাগবে ,কিংবা ভালোও বাসবে।
মহাকাশ জুড়ে অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডের ভেতরে এই যে ক্ষুদ্র একটি পৃথিবী এবং তার ভেতরে আরো কয়েকশো কোটি মানুষের অস্তিত্ব।এই সবের মধ্যে দিয়েই কেন জয়াকেই তার ভালো লাগে ও হৃদয়ের গহীন তার স্মরণে এক অসম্ভব মোচর দেয় ? সে এই প্রশ্নের উত্তর জানে না।জয়া কি কোনোদিন নয়নের চোখে চেয়ে বুঝেছিল ভালোবাসার না বলা কথা? নাকি সেও নিঃশব্দ তাকে ভালোবাসে! যে ভালোবাসার শব্দ নেই,অথচ গল্প আছে।শ্বাস নেই অথচ প্রাণ আছে,!
মানুষ বুঝি এমন কইরাই জীবনের সবটা জমিন দিয়া গোপনে ভালোবসতে পারে!অথচ নয়ন ত এমন প্রেমেই দিবানিশি ডুবে আছে!
ভালোবাসা শব্দটা নয়নকে আজকাল দারুন বিস্মিত করে।শুইতে গেলে খাইতে গেলে তারে যেন বলে দেয়,ভালোবাসা বুঝি কবির কল্পনার "চাতক"পাখির মতো?
সে স্বপ্নের ভেতর দিব্যি শুনতে পায়, " ভালোবাসলে মনের সাথে এই দেহও কান্দে,যারে নারীবিহীন থামানো যায় না ।সে চরিত্রহীন হতে চায় দিনের শেষে রাতে ।
পুকুর খনন করলে যেমন জল লাগে,তেমন প্রেম করলে দেহের ক্ষুধার জন্য ভালোবাসার মানুষটাকেও কখনো কখনো লাগে ।"
ক্যান্টিনের জানলা দিয়ে দেখছে জয়া এখানে আসছে । তাকেই দেখলেই সে নিজেকে হারায় ।অসম্ভব জঘন্য অপরাধ বোধ করে । তার অজান্তেই তাকে ভালোবাসছে এই সত্য বাক্যটা সহ্য করতে পারে না ।
জয়া ভেতরে এসে নয়নকে জিজ্ঞেস করল," তুই এখানে !ক্লাস করবি না?
"না ভালো লাগছে না ।"
"কেন কি হয়েছে ?"
নয়ন বলতে পারছে না যে "তোকে দেখার অসুখে আমি অসুখী ।তুই কি বুঝিস না জয়া তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি ।খুব ভালোবাসিরে । "
"এই বুদ্ধু কি চিন্তা করছিস!কবিতা মাথায় ঘুরছে নাকি ?"
"হুম ।আমার অসুখ ।"
"দাঁড়া এখন শুনবো ,একটা কেক কিনে নিই ।"
নয়ন কবিতা বলতে শুরু করলো ,
"আমার অসুখ গাঢ় হয়
তোকে না দেখার অনলে ,
তুই ত বুঝিস আমি অসুখী
তুই কি পারবি ওষুধ হতে,,,?"
খানিকক্ষণ পরে জয়া চলে গেল ।নয়ন আবার একা ।আবার লুকানো সিগারেটে আগুন দিলো ।
নয়ন খুব বুঝেছে,পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অসুখ ভালোবাসার মানুষটিকে ভালো বাসি কথাটা না বলতে পারা ।
সে আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । একলা ঘরে কখন যে চাঁদ আসে সূর্য যায় ,সে এতটুকুও টের পায় না ।
No comments:
Post a Comment