Friday, April 16, 2021

বিনয় শীল (ধারাবাহিক)

জয় মহারাজের সাথে (পর্ব ১)
                     
গতকালই জয় মহারাজ আমাকে বললো যে-
"কাকু, আগামীকাল অর্থাৎ ১৬ই মার্চ (২০২১) মঙ্গলবার অফিস থেকে ছুটি নিন। সরোবরা নগরী উদয়পুরে যাবো।" 
       অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সম্মত হলাম। না করতে পারিনি। কারণ জয়ের আহ্বানে জাদু আছে। পরদিন সকাল দশটায় আমাদের বের হবার কথা। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হতে হতে এগারোটা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ আমার দেরিতে। এখানেও তার বাত্যায় ঘটেনি। কিন্তু হঠাৎ করে জয় উদয়পুরে যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠলো কেন? ভাবলাম, হয়তো তার হিয়ার মাঝে যে লুকিয়েছিল, যা এতো দিন সে বুঝতে পায়নি, সে হয়তো আজ উঁকি দিয়েছে। প্রকৃতির উঁকি বড় মোহময়। তাতে দূর্ভেদ্য মায়াজাল পাতা থাকে। সেই মায়ামোহে অনন্তকাল ধরে পুরুষেরা সংসারের অচ্ছেদ্য জঞ্জালে আবদ্ধ হয়। এই ভাবে জীবনের পরম্পরা স্রোত আবহমানকাল ধরে আজও প্রবহমান। জয় মহারাজও  বোধ হয় এবার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিষাদ- উল্লাস, আনন্দ-বেদনা ও কূটকচালিতে পূর্ণ সংসার স্রোতে নিজের ময়ূর পঙ্খী জীবন তরী ভাসাতে চলেছে। সে সফল হোক।
       ওহ্ ! যে কথা বলছিলাম, জয়ের মোটরসাইকেলে চেপে রওয়ানা হলাম। ওর মোটরসাইকেলটির হেডলাইটের উপরিভাগে ইংরেজি হরফে দারুন মুসাবিদা করে 'Joy' লেখা আছে। চিনতে অসুবিধা হয় না। বাইক তো নয় যেন একটা বিশ্বস্ত তেজী ঘোড়া। লাল ঘোড়ার মতো দেখতে 'Joy' নামক বাইকটির পিঠে চড়ে নিত্যদিন চলছে জয় মহারাজের জয়যাত্রা। মূলতঃ সে প্রাণপণে সেবা দেয় জয়কে। কতো যে বিপদ আপদ থেকে সে জয়কে এবং সহসঙ্গীকে রক্ষা করেছে তার হিসাব নেই। জয় মহারাজও তার প্রিয় বাইকটিকে বড় আদর করে থাকে। কোনো স্থানের অভিযান শেষে বাড়িতে ফিরলে মহারাজ বড় স্নেহভরে মটরসাইকেলটির সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সে ওর মনের কথা বুঝতে পারে। পরিস্থিতির  মোকাবিলা করতে গিয়ে বাইকটি বরং নিজের ক্ষতি মেনে নেবে, তবুও সওয়ারী জয় মহারাজের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। ঠিক সেই রকমই একটা ঘটনা ঘটে গেল আজকের যাত্রাপথে। যথা সময়ে আসবো সে কথায়।
        ফেনীর উপনদী মনু। নিজ স্বভাব ছন্দে হরিণা বাজারের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে। এমনিতেই মনু শান্ত। শুধুমাত্র বর্ষার লাগামহীন চঞ্চলতায় মনু কখনো কখনো উদ্বেলিত হয়ে উঠে। কিন্তু তাই বলে কাউকে গৃহহীন করেছে বলে জানা নেই। বরঞ্চ বর্ষায় তার স্বল্পকালীন জলোচ্ছ্বাস তুলে দু-কূলের চাষের জমিকে উর্বর করেছে। তারি-ই সৌন্দর্যের উপর চোখের দৃষ্টিচারণা ফুরোতে না ফুরোতেই জয় মহারাজের যন্ত্রযানে আমারা দুজন ছুটে চলেছি। হরিণা বাজার পার হলাম। তারপর একে একে মনু বাজার, সাতচাঁন্দ, কলাছড়া(এই স্থানটির ককবরক নাম 'থাইলিক তৈসা'। থাইলিক মানে কলা। আর তৈসা মানে ছড়া অর্থাৎ ছোট নদী। এই হিসাবে কলাছড়ার ককবরক তর্জমা থাইলিক তৈসা। এপ্রসঙ্গে বললে অন্যায় হবে না যে, বড় নদীকে ককবরক ভাষায় বলে তৈমা), শাকবাড়ী, সাঁচীরামবাড়ী, ঠাকুরছড়া ইত্যাদি ছোট বড় বাজারগুলোকে পেছনে ফেলে আমাদের দুই চাকার যন্ত্রযানটি জোলাইবাড়ীর বাইপাস ধরে এগিয়ে চললো। মাথার উপর সূর্যের মিঠে-কড়া রৌদ্র বিকীরণ। ঘড়ি জানান দিল দিনের অর্ধাংশ চুকিয়ে গেছে। কিন্তু বাইপাসের দু ধারের জীবন কলরব দেখে  মনে হলো কবি অক্ষয় কুমার বড়ালের সেই ভরা গ্রীষ্মের নিঝুম মধ্যাহ্ন কাল এখনও দূরে আছে। আর যদি এসেও পড়ে, তথাপি বর্তমানের জীবন ব্যাস্ততার তাড়না এতো তীব্র যে, নিঝুম মধ্যাহ্নে অলস স্বপ্নজাল রচনার সুযোগ কোথায়।
          এদিকে দেখতে না দেখতেই আমরা জোলাইবাড়ি বাজারের উত্তর প্রান্তে অর্ধবৃত্তাকারে বয়ে চলা মুহুরী নদীর কাকলিয়া সেতু (এর সঠিক নাম আমার জানা নেই। তবে এলাকার নামানুসারে সেতুর নাম বেশ প্রচলিত। স্থানীয়রা এ সেতুটিকে কাঁক্কুইল্যা ব্রীজ নামে জানে। বর্তমান সেতুটির পশ্চিম পার্শ্বে দীর্ঘাকৃতির আরেকটি নতুন সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। পুরাতন সেতুটির বয়স হয়েছে তো, তাই। নতুন সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে অত্র এলাকায় জাতীয় সড়কটির বক্রতা অনেকাংশেই কমে যাবে।) পার হয়ে আসলাম। শালবনির মধ্য দিয়ে ৮নং জাতীয় সড়ক চলে গেছে। পুরো বনাঞ্চলটিতে যেন ঋতুরাজ বসন্ত বাঁধা পড়ল। আহা, কি বলবো! প্রতিটি শাল, চামল, জারুল, জাম আরও কতো কতো তরুবরেরা বসন্তরাগে উল্লসিত। প্রায় সকলেরই অঙ্গে নতুন পাতা শোভা পাচ্ছে। প্রতিটি তরুর নবপল্লবিত শাখা প্রশাখা আলো ও বসন্ত হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।  নীলগগনের নিচে সড়কের দুধারে নতুন সাজে সজ্জিত গাছেরা সারি সারি করে দাঁড়ানো।তাদের আবার কারো কারো গায়ে জড়িয়ে আছে একধরনের বনোলতা। ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন। জীবনানন্দ যদি এখানে আসতেন হয়তোবা নাটোরের না লিখে, কাকলিয়ার বনলতা সেন লিখতেন। সেই লতায় লতায় এখানে সেখানে ফুটে আছে সাদা রঙের বনফুল। নতুন মঞ্জুরির ভারে কতগুলো শ্যামল লতা গাছের শাখা বেয়ে নিচের দিকে ঝুলন্ত। গুচ্ছ গুচ্ছ বসন্ত পুষ্পের সমারোহ, তাতে রং বে-রঙের প্রজাপতির আনাগোনা এবং নিরন্তর মধুপ গুঞ্জনে শালবনির শোভাকে দিয়েছে অন্যমাত্রা।
         মনে হলো, বিশ্বনাথের প্রকৃতি মঞ্চে তরুবরেরাও অংশগ্রহণ করছে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায়। সমস্ত বনভূমে নানান জাতের পাখিদের বসন্ত সঙ্গীতের মনোহরা সুর লহরী। এ স্থানের রাস্তাটিকে প্রকৃতি নিত্যই রাতের বেলায় যেন ঝাড়ু দিয়ে রাখে। পুরো বনাঞ্চলের বুকের উপর পরিচ্ছন্ন সড়কটিতে আলো ছায়ার মেলবন্ধনে আঁকা হয়েছে অপূর্ব দৃষ্টি নন্দন আলপনা। আহা কি প্রশান্তি! অজান্তেই মন প্রকৃতির অপরূপ রূপ মাধুরীতে হারিয়ে যায়।
         হঠাৎ করে জয় মহারাজ গতি কমিয়ে তার বাইকটিকে সড়কের কিনারায় থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাইক থেকে নেমে রাস্তা ও বনোভূমের পানে তাকিয়ে আমাকে বলল-
"কাকু, কি সুন্দর না! দাঁড়ান। একটা ছবি তুলব।"
বুঝলাম, জয় বাবাও আমার মতো প্রকৃতির বসন্ত তরঙ্গায়িত রূপসায়রে ডুব দিয়েছে। মহারাজ বলে কথা। যথারিতি দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর মোবাইল ক্যামেরায় ছবি বন্দী করলো। ছবি তুলেই বললো- 
"সেরা ছবি। দুর্দান্ত।"  অবশেষে আমিও প্রকৃতির এমন রূপালয়ে জয় মহারাজের মতো অনিন্দ্য সুন্দর যুবকের ছবি তুলি। 
         এদিকে প্রতিনিয়তই দ্রুত গতিতে ছোটাছুটি করছে নানা ধরনের যানবাহন। সকলেই ছুটে চলেছে জীবনের প্রয়োজনে। দুরন্ত গতিতে ছুটন্ত লোকেরা এখানকার মনোরম শোভা অনুভব করে কিনা জানিনা। আমি গভীরভাবে অনুভব করি, যেমনটা করে আমার জয় বাবা। তাই জীবনের চলার পথে প্রায়শই হা করে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপের দিকে তাকিয়ে থাকি। জীবন তাগিদে হঠাৎ দুজনারই সম্বিৎ ফিরল। এখানে প্রকৃতির মোহে বুঁদ হয়ে বসে থাকলে চলবে কেন। আমাদেরও তো ছুটতে হবে। গন্তব্যের হাতছানিতে আবার শুরু হলো আমাদের পথ চলা।
                      
                     

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...