Tuesday, May 7, 2019

উমাশঙ্কর রায়

জীবন থেকে ধার নেওয়া

"কী হলো ? এমন পানসে মুখ করে বসে আছিস কেন ?!" আশেপাশে কাউকে না দেখে রণিত ঠুকলো বিজিতকে।

প্রশ্নটা শুনেই রণিতের দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বিজিত বলল, "ধুস্ , মাথাটা একেবারে বিগড়ে দিল ..."

- কে কী করল ? কী হলো আবার ?
- কী আর হবে ! যাচ্ছিলাম ঐ দিকে। শুনলাম, গলির মোড়ে একজন খুব বক্তৃতা করছেন শিক্ষা-শিক্ষক-শিক্ষাদান ইত্যাদি নিয়ে।

- তাতে তোর বিগড়ে যাবার কী হলো ? ভালোই তো হচ্ছিল। গলির মোড়ে সাধারণত এমন টপিক নিয়ে তো আলোচনা হয় না ! এগুলো তো স্কুল কলেজে হয়ে থাকে।

- তাইতো বলছি।
- তা'লে তুই বিগড়ালি কেন ? বরং বিগড়ে না গিয়ে তোর বোঝা উচিত ছিল উন্নয়ন এখন গলিমুখী। দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে।

- ঠিক। সেটাই বলছিলাম। আর বেশিদিন বাকি নেই।
- কী হবে ?
- দেখবি, কিছুদিন পরে মুদির দোকানেই প্যাকেট ভর্তি 'শিক্ষা' কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।

- তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে ! তুই হয়তো বা জানিস না, মুদির দোকান না হলেও, এমন বেশ কিছু দোকান চালু আছে- যেখানে সত্যিই প্যাকেট ভর্তি 'শিক্ষা' পাওয়া যায়।

- মানে ?! এ তুই কী বলছিস ?! প্যাকেটে শিক্ষা পাওয়া যায় ?  কী রকম  ?
- মানে খুব সোজা। বলতে পারিস, মুড়ির মতন।
- মুড়ির মতন ?!
- হ্যাঁ, আরেকটু মিহি করে যদি বলি, তবে বলব, ছাতুর মতন। চিবোতেও হয় না। জাস্ট ... ডাস্ট।ডাস্ট-শিক্ষা! জল দিয়ে গুলে, গিলে ফেললেই হল।

- তাই নাকি ?!
- বিলকুল। কিন্তু সেখানে একটাই শর্ত - ফেলো কড়ি, খাও বড়ি, ধরো ছড়ি।

- বাহ্ ! কী অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে তো ! অনেকটা তোর মতোই তিনিও বলছিলেন চেঁচিয়ে-শিক্ষাদান-
শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে।

- অ্যাই শোন, আমি কিন্তু চেঁচাচ্ছি না মোটেও। বরং খুব মিহি করে বলছি।

- আসলে কি জানিস, ঐ 'শিক্ষাদান' শব্দটার মধ্যেই মনে হয় কিছু একটা গন্ডগোল আছে।

- মানে ?! বুঝতে পারলাম না তোর কথা !
- আমার কী মনে হয় জানিস ? শিক্ষা, মোটেও দানের বিষয় নয়। শিক্ষা শুধুই গ্রহণের বিষয়। অর্থাৎ শিক্ষা শুধু গ্রহণযোগ্য। দানযোগ্য নয়। শিক্ষা দান করা যায় না।

- যাঃ বাবা ! এ আবার কেমন কথা ! কীসব বাজে বকছিস ?! গ্রহণ থাকলে তো - দানও থাকবে। দান ছাড়া গ্রহণ কী করে হবে ?
- না, সেটা শুধু বস্তুর ক্ষেত্রেই খাটে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়। তবে এটাও ঠিক যে শিক্ষা এখন বস্তুই। জাস্ট কমোডিটি । পণ্য ।

- অ্যাই দ্যাখ, তুই কিন্তু আবার বেলাইন হয়ে যাচ্ছিস।

- আমি মোটেই বে-লাইন হচ্ছি না।
- তবে এসব কী বলছিস তুই ?! যুগ যুগ ধরে শিক্ষাদান নিয়ে কত কথা হয়ে গেল। আর আজ কিনা তুই বলছিস ....

- শোন, আমি শুধু একটা সোজা কথা বলছি - মানুষের পক্ষে মানুষকে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। যদি সত্যিই সম্ভব হতো- তবে এতো যুগ পরে আমাদের এই হাল হতো না। এ নিয়ে মানুষ মানুষকে দোষারোপ করত না, আপশোসও করত না।

- মানে ? ঠিক কী বলতে চাইছিস তুই ?!

- আসলে কি জানিস, আমরা সবসময় ভুল করেই ভাবি - আমরা কিছু দিচ্ছি ... অন্যকে । এই দিচ্ছি, সেই দিচ্ছি, শিক্ষা দিচ্ছি, আরো কত কিছু দিচ্ছি - ইত্যাদি। আসলে এই ভাবনাতেই  একটা মস্ত ভুল রয়েছে।

- কেমন ? 
- হ্যাঁ । আসলে যুগ যুগ ধরে এত শিক্ষা পেয়েও আমরা এই শিক্ষায় আজও শিক্ষিত হতে পারলাম না যে - যা কিছু আমরা হাতিয়ে নিচ্ছি- নিজের মনে করে, সেগুলো কিছুই আমাদের নয়। সবই...প্রকৃতির। ......অথচ চেয়ে দ্যাখ, প্রকৃতির এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই !

- তাতে কী হলো ?! প্রকৃতির মাথা থাকলে তো- মাথা ব্যথা হবে! না কি ?

- তুই নিজেও ভালো জানিস, যে বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছি, তাতে মাথা আর লেজের কী সম্পর্ক।

- তা বুঝলাম। কিন্তু তোর কথা মতো -শিক্ষা যদি শুধু গ্রহণ করার বিষয়ই হয়, দানের বিষয় না হয়, তবে তো শিক্ষক শব্দটার কোনো মানেই থাকে না।

- কেন থাকবে না ? আছে। অবশ্যই আছে। তিনি তো পথ দেখাবেন। কিন্তু সেই পথ চলতে গিয়ে পথিক কী দেখবেন, কী শুনবেন, কী ধরবেন, কী নেবেন, কী বুঝবেন - এসব একান্তই তার নিজের বিষয়। এটা কেউ তাকে শিখিয়ে দিতে পারে না।

- কিন্তু আজকাল তো দেখছি, যে কেউই একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষাদান করতে থাকেন ! কী দিতে হবে , কীভাবে দিতে হবে , ইত্যাদি। ....এটা তবে কী ?

- শিক্ষার হদ্দমুদ্দ । শিক্ষার নাম করে কিছু পুরোনো পদ্ধতি বা ধার করা বিষয় উগলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। ঐ ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষার বিষয়টি অধরাই থেকে যায়। সস্তার বাজিমাত হয়। প্রকৃত - অধরাই থাকে । তাতে অবশ্য একশ্রেণির লাভই  হয়।

- তুই যে ঐ বারবার প্রকৃত-প্রকৃত বলছিস, সেটা আসলেই কী....বল দেখি।

- সেটা ....জাস্ট ইউনিক। মৌলিক, স্বতন্ত্র। এর মানে, শিক্ষাটা তখনই প্রকৃত, যখন সেটা প্রত্যেকের জন্যই স্বতন্ত্র, ভিন্নভাবে অর্থবহ।

- যাঃ বাবা ! তবে তো দেখছি,তোর কথা মতো-
এককোটি মানুষের শিক্ষার জন্য এককোটি স্কুলের দরকার !!
- মোটেও না। স্কুল দিয়ে শুধু কিছু নিয়ম বা পদ্ধতি চালু হয় মাত্র। এগুলোও আবার কারো কারো নিজস্ব। এতে শিক্ষা আর কতটুকু হয় ? যদিও বা কিছু হয়- সেটা জাস্ট - সিন্ধুতে বিন্দুর মতো !

- সব গুলিয়ে যাচ্ছে। একটুখানি জল মিশিয়ে তরল করে বল না শুনি। তবে বুজতে পারব।

-অ্যাই দ্যাখ, যেখানে জল কিছুতেই মেশানো যায় না সেখানেও জল মেশাতে বলছিস !
- তবে উপায়টা কী ?

- আচ্ছা, তোর মনে আছে ? সুনির্মল বসুর সেই কবিতাটি ? "সবার আমি ছাত্র" ?
- আছে।

- স্যার কিন্তু আমাদের সেটা মুখস্থ করিয়ে শেখাননি। স্যার পড়তেন। আমরা শুনতাম। তাতে প্রতিটি শব্দ তার যথার্থ মানে নিয়ে আমাদের অনুভবে ধরা দিত। বলতে পারিস - মরমে পৌঁছে যেত।

- তাইতো ! সেটা তো শুনে শুনেই শিখেছিলাম।

- হ্যাঁ। "আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে / কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে।"
- আবার -  "নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম আপন বেগে চলতে।"

- দ্যাখ, এখানে ইঙ্গিত আছে, কিন্তু আদেশ নেই। বলা আছে, চলন আছে, গমন আছে, গতি আছে, আশা আছে । কিন্তু হতাশা নেই। স্বার্থপরতা নেই । কেড়ে নেওয়া নেই। ইচ্ছে পূরণের ইচ্ছে আছে। কিন্তু যাতনা নেই। শৃঙ্খলার নামে - শৃঙ্খল নেই।

- একদম। তবে কি তুই এখন ভোটাভুটি করতে যাচ্ছিস ?
- কিসের জন্য ?
- গণতন্ত্রের স্বার্থে।
- গণতন্ত্র ?!
- বাহ্ রে ! তুই কি এটাও জানিস না যে, গণতন্ত্র শব্দটা উচ্চারণ না করে এখন পিঁপড়েরাও মুখে অন্ন তোলে না ! ওদেরকেও এখন গণতন্ত্রের মানে জানতে হয়।
- এত্তসব জানি না।
- কিন্তু তোকে তো জানতে হবে। তোকে বুঝতে হবে, যেভাবে বোঝা উচিত ঠিক সেভাবে।

- শিক্ষা দিচ্ছিস ?

- আরে নাহ্ ! কিন্তু তোকে বুঝতে হবে, কোনদিকে পাল্লা ভারী - শিক্ষাদানের পক্ষে, নাকি শিক্ষাগ্রহণের পক্ষে !

- আবার ঝামেলা করছিস !

- দেখবি শিক্ষাদানের লাইনটাই বড় হয়ে গেছে। ঐখানেই ভিড় বেশি। আর অন্যপক্ষে, মানে ঐ শিক্ষাগ্রহণের লাইনে দাঁড়িয়ে তোর তখন জামানত জব্দ হবে।

- হোক জামানত জব্দ। তবুও আমি শিক্ষাগ্রহণের স্বার্থেই শিক্ষাদান নিয়ে ঘাটাঘাটি করা ছাড়ছি না।

- দেখিস ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আবার ঘাট হয়ে যাস্ না যেন !
- কী বললি ?
- না, বলছিলাম - রবি ঠাকুরের "তোতা কাহিনী"র তোতার কথাটা মনে রাখিস। আর অনিয়ম, অনাচার আর অনাসৃষ্টির মাঝেও বেঁচে থাকার শ্বাসটুকু জিইয়ে রাখিস । নয়তো .......

- নয়তো কী ?
- নয়তো বিপদ হতে পারে।
- কেমন ?
- হয়তোবা রবিঠাকুর আবার জেগে ওঠে এসে জিগ্যেস করতে পারেন -
বলতো দেখি, আমার এই পঙতির গূঢ় অর্থটা কী ?

   " আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি
     রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি ?
     শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার
        নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।"

বিজিত খুব বিমর্ষ হয়ে রণিতের দিকে  চেয়ে বলল,
বুঝলি, দূঃখ একটাই - যখনই কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে অনেক দূর এগিয়ে যাই - দেখি, গুরুদেব যেন শেষ কথাটি বলে দিয়ে চুপটি করে বসে আছেন !!

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...