Thursday, January 24, 2019

দীপক দাস

হায় বার্ধক্য

কুরু পান্ডবের যুদ্ধ শেষ । চারদিকে মৃত্যুর হাহাকার , কত স্ত্রী তার বীর স্বামীকে হারিয়েছে। কত মানুষ যে তার বীর সন্তান হারিয়েছে , কত বোন যে তার ভাইকে হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই । চতুর্দিকে নারীকন্ঠের বিলান , সমস্ত আকাশ বাতাস  ভারী হয়ে আছে । এই সময়ে হস্তিনাপুরে আবির্ভাব ঘটে ব্যাসদেবের। এ দৃশ্য দেখে তিনি ঋষি হয়েও  তাঁর  মন বেদনা ভরে ওঠে । তিনি সবাইকে  আলৌকিক এক প্রস্তাব দেন ।তিনি বলেন আগামী দিন ভোরে সবাই সরমূ  নদীতে পবিত্র মনে স্নান করে উঠলে দেখবে তোমাদের সব প্রিয়জনরা সরমূ নদী থেকে  নতুন প্রাণ নিয়ে উঠে আসবে তোমাদের সাথে মিলনের জন্য , তবে এই মিলনের স্থায়িত্ব শুধুমাত্র একটি দিনের জন্য , সবার ব্যাকুল দৃষ্টি ব্যাসদেবের  দিকে। তিনি শান্ত সমাহিত স্নিগ্ধ স্বরে সবাইকে বলেন তোমরা সবাই মনে প্রানে  তোমাদের প্রিয়জনদের সাথে মিলনের জন্য প্রস্তুত হও। মৃত্যু জীবনের অঙ্গ , তবু তোমরা যে সুযোগ পাচ্ছো তা গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত হও, হস্তিনাপুরে সবাই সে মুহূর্তে যে যেভাবে ছিল গভীর ধ্যানে বসে পড়ল। কায়োমনোবাক্যে  তারা তাদের প্রিয়জনদের ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়ল । দিন শেষ হল , রাত পার হয়ে গেল । ভোর হল ওরা সবাই ধ্যানে মগ্ন, অবস্থা থেকে সরমূতে স্নান করে উঠল , আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে ওরা দেখল,ওদের সব প্রিয়জনেরা সরমূ থেকে উঠে আসছে । কিন্তু পাগলের মতো দৌড়ে জড়িয়ে ধরল কর্ণকে । গান্ধারীকে ঘিরে শ্বতপুত্র। তিনি তাদের শিরে হাত বুলাচ্ছেন । অভাবনীয়,অচিন্তনীয়,অনবর্চনীয় , অলৌকিক এক অবস্থা সরমূ নদীর তীরে । সূর্য উঠছে কারো সেইদিকে আজ নজর নেই সবাই ব্যস্ত  তার প্রিয়জনকে নিয়ে । দিন কেটে যাচ্ছে, সবাই  অবিস্ময়ে দেখল সূর্য পশ্চিম দিকে টলছে।অস্তগামী  সূর্যের মৃদু আলো সমস্ত জগত প্লাবিত  হয়ে আছে । যোদ্ধারা  সব উঠে দাঁড়ালো । বিদায় আলিঙ্গন দিয়ে সবাই  সরমূ নদীর দিকে  অগ্রসর হতে থাকল । পিছনে পড়ে রইল সকল মৃতপ্রায় জীবিত মানুষ । ঋষি বেদব্যাস ওদের শান্ত হতে বললেন  ওরা শান্ত সমাহিত চিত্তে আমোঘ নিয়মকে মেনে নিল ।

এতো দীর্ঘ ভূমিকা যে কথাটি বলার জন্য তা হল গত ২৭.০৮.২০১৮ তারিখে বিলোনিয়া টাউন হলে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের দক্ষিণ জেলা ভিত্তিক সম্মেলন যাই।সেখানে টাউনে হলের সামনে শত শত অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের দেখে মনে ভীষণ আঘাত লাগে ।  বয়সের ভারে নত,ভাঙাচোরা চেহারা , কোনো দামী কাপড়েও ঢাকা যাচ্ছে না  চেহারার জীর্ণতা এদের দেখে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।  এ বয়সী লোকদের প্রতিদিন দেখে, তবে একসাথে  এতগুলি লোককে আর দেখা হয়নি  সম্মেলন অন্য বয়সী লোক নেই । আমি আমার পাশের বন্ধুকে বললাম এই যে  লোকগুলো দেখছিস এদের সবার  সাথে   আমিও  প্রায় একই সময়ে ধূলার এই ধূলিতে জন্ম নিই। আবার সময় এসেছে প্রায় একই সময়ে চলে যাওয়ার ।

গাছের সবুজ পাতাও একদিন বৃদ্ধ হয়ে হলুদ হয়ে যায়।  কিন্তু বার্ধক্যের মানুষকে অবয়সের যে বিবৃতি ঘটে তা তো গাছের পাতায় ফুটে উঠে না।  অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে ও এ পরিবর্তন  অতটা দৃষ্টিকটুূ নয় যতটা মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

তবে বার্ধক্য কেন?রবার্ট ব্রাউনি বলেছেন
    Grow old alone with me
The best is  yep to be
The best of little for which the first  as made
Our times are in his hands who said " a whole planned  youth shows but half
Truth God , see all not be  afraid "

'আমার সঙ্গে বুড়ো হবে এসো / সবচেয়ে সেরা তা এখনও বাকি /জীবনের শেষ যার জন্য  প্রথমটা তৈরি হয়েছিল/ আমাদের সব সময় তাঁর হাতে/ যিনি বলেন আমি একটা গোটা জিনিস নকসা করেছি/ যৌবন তার মাত্র অর্ধেক প্রকাশ করে / ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখো ,সর্বদা দেখো / ভয় পেয়ো না।"
 
কবিতাটি পড়ে মনে বল খুঁজে পেলাম। তাইতো অন্য জীবনের সাথে মানুষের সাথে যা কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে । মানুষের মধ্যে চেতনা আছে চৈতন্য আছে মানুষই খুঁজে এ জীবন কীসের  জন্য?
এই জীবন নিয়ে কী করবো? এ জীবন নিয়ে কী করতে হয়- মানুষের এই অনন্ত খোঁজার বিরুম নেই  । কর্মবহুল  জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে এ খোঁজা চলতে থাকে । একটি যেন অনেকটা মাঠের গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার মত। আমি এখন দর্শক । দর্শকের দৃষ্টি নিয়ে ফেলে আসা জীবনকে দেখছি আর ভাবছি আমি যেখানে ফিরে যাব , সেখানে কী শূন্য হাতে ফিরে যাব? আমার জন্য দয়াময় ঈশ্বর  কীভাবে অপেক্ষা করছে ফেলে আসা নানা ভুলের জন্য অনুতাপ হচ্ছে । এও ভাবছি আরো যে কিছু দিন এই পৃথিবীতে আছি তাকে স্বার্থকতর  করে কীভাবে তুলব?
তাই তো জড়িয়ে ধরতে চাইছি মানুষকে নানা কাজের মধ্যে দিয়ে ,

তবুও এই জরাজীর্ণ চেহারা কে মেনে নিতে পারছি না  । মহাভারতে পুরু যেমন পিতার জরা ভার নিজে গ্রহন করেছিল সেরকম 'পুরুর'
দেখা কলিযুগে  সম্ভব নয় । যদি ঋষি বেদব্যাসের দেখা পেতাম বলতাম আচার্যদের অনন্ত  একটি দিনের জন্য পুরাতন যৌবনকে ফিরিয়ে দিন, যার একবার যৌবন দেখি নিজের যৌবনকে। হায়রে আশা!



পরিচিতিঃ-
------------------
লেখক দীপক দাসের জন্ম ১৯৫৩সালে বাংলাদেশের ফেনীতে। ১৯৬৩ সালে তিনি ভারতে আসেন। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমায় স্কুল জীবন শেষ করে তিনি ১৯৭২সালে বি কম বিভাগে এমবিবি কলেজ থেকে গ্রেজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করে ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ। দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে তিনি অবসরে। অবসর সময়ে লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চাই করেন। রাজ্যের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখেন। তিনি কবি,  প্রাবন্ধিক এবং বাচিক শিল্পীও। চাকুরী জীবনে ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক কল্যাণে তার বহুমুখী প্রচেষ্টা ও ভূমিকা ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...