Wednesday, December 19, 2018

কল্যাণব্রত বসাক

প্যাকেট নবান্ন

অগ্রহায়ণ মাসের  শুক্লা দ্বাদশী।এমন দিনে 'নতুন খাওয়া' হবে। বাড়ির সকলেই মুখিয়ে থাকতাম।নতুন হাঁড়িতে নতুন চালের ভাত। মিষ্টান্ন হবে, পিঠা হবে। হাবে'তো বটে। নতুন চাল তো এমনি এমনি ঘরে আসেনা। সে কি পরিশ্রমরে বাবা।

তিন সাড়ে তিন মাস আগে থেকে কাজ শুরু হয়।
জালা বিচনা তৈরি করা
--জালা বিচনা কী বাবা ?
** তোদের বইতে যাকে বীজতলা বলে।
ঐ একই সময়ে বীজধান  চটের বস্তায় ভরে পুকুরে  একরাত ভিজিয়ে এনে খাঁচি তে....
-- খাঁচি  কী বাবা?
** ধুর ছাই। এত প্রশ্ন করিস কেন!
ধমকে উঠলাম মেয়ে কে।
বললাম**  খাঁচি  হলো  বাঁশের তৈরি একটা বড় পাত্র। দেখতে বড়  সস প্যানের মতো।
তাতে ঢেলে
উপরে কলাপাতা , শুকনো চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে
রাখতে হতো।
ক'দিন বাদেই ক্যরট.... বলছি বলছি ;ক্যরট  মানে অঙ্কুর আসত। সেই বীজধান বীজতলায় ছিটিয়ে দিয়ে কিছু দিন অপেক্ষা।
এদিকে  জমি নাল ....মানে তৈরি করা। অন্তত চার চাষ দেওয়া হতো।  দুটো গরুর কাঁধে নাঙল বেঁধে জমিতে হাল চাষ। মাটির সোঁদা  গন্ধ।
আমরা তখন ছোট। একটা এলুমিনিয়ামের গামলায় মোটা মোটা ভাত,সঙ্গে কড়া ঝালের 'শুটকির মরিচ', ডাল, একটুকরো কলাপায় পেঁচিয়ে 'ডিমের বরা' নিয়ে, থালা দিয়ে ঢেকে,  গামছা দিয়ে গিঁট দিয়ে হতে ঝুলিয়ে ক্ষেতে নিয়ে যেতাম। সঙ্গে থাকতো কাঁসের ঘটিতে এক ঘটি জল।
বাবা ভাতের গামলাটা নিয়ে খেতে  বসতেন ক্ষেতের আল'এ। বাবা যখন খাচ্ছেন, আমি ততক্ষনে হাল দেওয়া জমিতে মাগুর, সিং, পুঁটি মাছ ধরার চেষ্টা করতাম। থেকে থেকে বাবা ডেকে  আমাকে দু-গ্রাস ভাত খাইয়ে দিতেন।...উঃ কি ঝাল রে বাবা। ব্রাহ্ম তালু কেঁপে উঠত।
তারপর রোযা দিয়ে প্রায় মাস তিনেক অপেক্ষা।
ধান পেকে  যখন সোলালি রঙ ধরে, রোদের তখন রঙ হয় হলুদ ধোয়া জলের মতো,স্বভাব হয় আদুরে।
গোবিন্দ ভোগ, টিলক কচুরি, ঘিয়জ  বিন্নি ধান ।মাঠেই দারুন সুঘ্রাণ বেরুত। পাকা ধান কেটে এনে উঠোনের উত্তরপূর্ব কোন ধানের পাড়া দেওয়া হতো। উঠোনের মাঝখানে খুঁটি পুঁতে গরুদিতে মাড়িয়ে  নিয়ে ধান আর খর আলাদা করে নেওয়া হতো।
তারও পরে ঝাড়াই-বাছাই করে ,রোদে শুকিয়ে, বাজার থেকে মেশিনে ভাঙিয়ে যে দিন নতুন চাল বাড়িতে আনা হত, সে দিন  ঠাম্মা, মা উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি দিয়ে ঘরে তুলতেন।
এর পর কুলগুরুর  অনুমতি নিয়ে......
--- বাবা  কুলগুরু কী?   মেয়ে জিজ্ঞেস করলো।
বললাম , ভক্তির পুরোন একটা আইটেম। আমার ঠাকুদ্দার আমলে ছিল।
....পাজি পুঁথি দেখে নতুন খাওয়ার দিন ঠিক হয়।
ঠাকুদ্দার কছে শুনেছি, আমরা নাকি কৃষ্ণমন্ত্রী সাধুর বংশ। অতএব নতুন খেতে হলে বৈষ্ণব নিমন্ত্রন করতে হবে।
বাবা  কাকা এমনকি দু এক জন প্রতিবেশী সহ আগের দিন খাঁচি ভর্তি করে কাঁচা সবজি কিনে
আনতো। মা, ঠাম্মা , পিসি, প্রতিবেশী মহিলারা  হাত বটি দিয়ে তরকারি কূটত। বাটনা বাটত।
  পরদিন সকালবেলা থেকে নিমন্ত্রিত অতিথির আসতে শুরু হয়। একে একে বৈষ্ণবরা  আসতে থাকেন।
বৈষ্ণবদের  পরনে লুঙ্গিরমতো করে সাদা থান। বৈষ্ণবীরাও তাই। গলায় তুলসীর মালা। কপালে তিলক অতি বৈষ্ণবীয় ভাবে  নাক পর্যন্ত টানা। বৈষ্ণব হলেও মূলত কৃষিজীবী।  মাঠে ঘটে ক্ষেতেই সারাদিন কাটে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত  কাদার ছোপ। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ পায়ে কাদার ছোপ ঢাকতে খাঁটি সর্ষের তেলের মসৃন প্রলেপ। রাক্ষুসে  ফাটা গোড়ালি। চেপ্টা পায়ের পাতা।

এদিকে কাঠের চুলায়  রান্না বসে গেছে। পাড়ার মধ্য বয়েসী কয়েক জন মহিলা বিনা পারিশ্রমিকের রাঁধুনি। বরাদ্ধ পর্যাপ্ত পান,সুপারি আর একটু  সাদাপাতা। ওতেই খুশি। ও হ্যাঁ স্থূল রসিকতা চলতো ওঁদের মধ্যে। কিছু গেঁয়ো সম্পর্কের কথা; শরীরের অঙ্গভঙ্গি, কারো বা পোয়াতি হওয়ার ব্যাপারে, বা স্বাদের অনুষ্ঠানের কথা। এসব ছিল গ্রাম্য বিনোদন।
হেমন্তের বেলা। তাড়াতাড়ি  গড়িয়ে যাচ্ছে। এগারোটার মধ্যে অন্ন-ব্যন্ঞ্জন তৈরি। গোঁসাইরা লাইন করে লম্বা টুলে বসে পড়েন। ওঁদের পা ধুইয়ে দেয় গৃহস্ত। বড়রা ভক্তি ভরে টুক করে একটু চরণামৃত খেয়ে নেয়, মাথায় ঘষে।
হাত ঢুলি আর কাঁসা, কর্তাল নিয়ে সুরেলা কীর্তন।
এদিকে আমরা গোবরে লেপা উঠোনে সারি দিয়ে কলাপাতা বিছিয়ে পাত পেরে দিতাম।  কাসের ঘটি আর স্টিলের গ্লাস হাতে নিয়ে তৈরি থাকতাম নিমন্ত্রিত দের জল খাওয়াতে।
হরি ধ্বনি, বৈষ্ণবীয় জয় ধ্বনি শেষে নিমন্ত্রিত দের মধ্যে অন্ন ব্যঞ্জন মানে প্রসাদ দেওয়া হত।
কাকা তদারকি করতেন, কারো কিছু আর লাগবে কিনা, কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। বাবা জিজ্ঞেস করতেন বয়স্কদের রান্না কেমন হয়েছে,ইত্যাদি।
একটা গামছা কাঁধে নিয়ে বাবা দাঁড়াতেন মুখ ধোওয়ার জায়গায়, থালায় পান, পাঁচ নং বিড়ি নিয়ে। এর পর  শেষ হতো আপ্যায়ন।
.............
মেযের পীড়াপীড়িতে রাজি হলাম....নবান্ন হবে এবার বাড়িতে।
গৃহিণীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। স্থির হলো সব।
ঘরের বাইরে এক পাশে গর্ত করে চুলা(উনুন) বানাল এক প্রতিবেশী বয়স্কার সহায়তায়। কিছু কাঠ জোগাড় হল।  কলাপাতা কাটা হল বেশ কিছু।নিমন্ত্রন হল জনা কয়েক। আগের দিন সবজি বাজার করলাম মেয়েকে সাথে নিয়ে। দুটো ব্যাগের মধ্যে একটা ওর হাতে দিলাম। বললাম অংশগ্রহণ কর। সবজি বাজার বাড়িতে রেখে ফের বে হলাম।চাল নিতে হবে।
কিছুক্ষন পরে বাজার থেকে এসে বাইকটা বাইরে রেখে,  যেমন করে বাবা পরম ভক্তিভরে  নতুন চালের  'খাঁচি'  মাথায়  নিয়ে  আসতেন তেমনি 'কিচেন খাজনা' র চালের পঁচিশ কেজির প্যাকেটটা মাথায় তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে   মেয়ে  হা হা হা করে আনন্দে হেসে ডেকে উঠল....
--মা  দেখো কান্ড , বাবা  নতুন চাল এনেছে  দাদুর মতো করে।
আমি ধুপ করে বস্তাটা  নামিয়ে মাত্রই পাশের ঘরে চলে গেলাম। গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিলাম।
মেয়ে কে বললাম ...
sorry আসার সময় চোখে কি যে পড়েছে।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...