Monday, December 24, 2018
দুলাল চক্রবর্তী
প্রতীক্ষায়
সারাদিনের পরিশ্রমে অবসন্ন
এ দেহ,
ক্লান্তি সারা দেহমনে
তবু ঘুম নেই দুচোখে।
নিশীথ রাত!
অন্ধকার রাতে বিচিএ সব শব্দ,
কখনো ভেসে আসে
ঝিঝি পোকার ডাক
কখনো বা ডাকছে পেঁচা।
ঘরে শুধু টিক টিক শব্দ
ঘড়িটা বলছে একটু একটু করে
সময়টা যাচ্ছে চলে।
অবসন্ন দেহটা
এপাশ ওপাশ করে,
যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে।
দুচোখের পাতাগুলি দুর্বল নয়
ওরা খুব সবল।
দেহ মনের সাথে ওদের
নেই কোন সঙ্গতি!
ওরা চলছে ওদের পথে
আমি জেগে একা।
দুচোখে ঘুম নেই,
ঘড়ির শব্দের সাথে
শুধু প্রহর গোনা।
কখন ভোর হবে?
আরেকটা সুপ্রভাত।
শেষ হবে জীবনের আরেকটা
কর্মক্লান্ত দিন।
দুয়ারে দাঁড়িয়ে রবো একা!
Sunday, December 23, 2018
সম্পাদকীয়
"আপনি যে বিষয়টি অনুসন্ধান করছেন তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সম্ভবত মননস্রোতের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় অথবা আপনি ভুলভাবে অনুসন্ধান করছেন। অনুগ্রহ করে আপনার অনুসন্ধান বিষয়টি সম্বন্ধে নিশ্চিত হোন।" এই জাতীয় কথা মননস্রোতের ওয়েবসাইটে বিগত সংখ্যায় লক্ষ্য করা গেছে। সাথে একজন কবির লেখায় আরেকজন কবির ছবি দেখা গেছে। বিষয়টার জন্য আমি প্রথমে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি, সাথে এটাও জানাচ্ছি যে এটা পুরোপুরি সার্বারের সমস্যার জন্য হয়েছে।
সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে একটি পত্রিকা বর্তমানে আলোচনাধীন কোন বিষয়ের উপরে পত্রিকার কি মতামত তা পাঠকের কাছে প্রকাশ করে। সেজন্যই প্রত্যেকটা লিটল ম্যাগাজিনে আলাদা একটি সম্পাদকীয় পাতা তৈরী করা হয়, মননস্রোতের এবারের সংখ্যাটা বিশেষ সময়োপযোগী বলে মনে করি, কারণ প্রত্যেকটা লেখায় সম্প্রীতির ভাব, গঠনমূলক আলোচনা, এবং সতন্ত্র কয়েকটি ভাবনা ফুটে উঠেছে। মননস্রোত এই ধরনের লেখা প্রকাশ করতে পেরে সার্থকতা অনুভব করছে। আমরা নতুন একটি বিভাগ তৈরী করবো পাঠকের জন্য। সেখানে পাঠকদের পরামর্শ, মতামত সবকিছুই প্রকাশ করা হবে। সেজন্য প্রিয় পাঠকদের সক্রিয়তা কামনা করছি। এ বিভাগটি ওপেন এডিটোরিয়াল পাতার নীচেই পাওয়া যাবে।
পরিশেষে যাঁরা এই সংখ্যায় লিখে মননস্রোতকে সমৃদ্ধ করেছেন,সকলকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। প্রতিমাসে প্রকাশ করতে গিয়ে মননস্রোতকে বাস্তব কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। মননস্রোতে যারা শ্রম প্রদান করেন সকলেই তরুণ প্রজন্মের। ভুলত্রুটি থাকতেই থাকে। সকল ভুলত্রুটির দায়ভার আমারই। আশা করবো মার্জনাপ্রাপ্ত হবো। সকলের সুস্থতা কামনা করছি।
জয় হিন্দ
শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা-সহ
জয় দেবনাথ
সম্পাদক
মননস্রোত
Saturday, December 22, 2018
দীপক দাস
বই ও বইমেলা - (শেষ পর্ব)
প্রবন্ধটি শেষ হয়ে আসছে । শেষ করার আগে উদ্যোক্তাদের একটি পরামর্শ দিতে চাই । এই বই মেলা প্রাঙ্গনে এমন শিশু কি আসেনি থাকে তার বাবা একটি বই কিনে দেয় নি , এমন কিশোর কি আসেনি যে রামের সুমতি পড়েনি । এমন যুবক কি পাওয়া যাবে না যে আনন্দমঠের ' ভরানন্দের' নাম শোনেনি । এমন প্রেমিক বা প্রেমিকা কি পাওয়া যাবে না যে 'বনলতা সেন ' বা 'কেউ কথা রাখেনি ' পড়েনি এমন বৃদ্ধ কী নেই যে গীতবিতান চায় অথচ কিনতে পারছে না । তাদের কী একটি করে বই উপহার দেওয়া যায় না ? আসুন না তাদের একটি করে বই উপহার দিই।
চুপি চুপি একটা কথা বলে রাখি -আগেই বলা যেত - তখন মনে ছিল না কিন্তু এটা না লিখলে প্রবন্ধটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হঠাৎ একদিন এক বন্ধুর বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম হুমায়ুন আহমদের ঔপন্যাস সমগ্র । আমি আবার বিস্মিত আমার কথায় হারিয়ে যায়।
এ আমি কী পড়েছি ! এভাবে সাহিত্য লেখা যায় এই বই আনন্দ ভাষায় অবর্ণনীয় । প্রতিটি উপন্যাস পড়ছি মনে হচ্ছে আমি কোনো তীর্থ থেকে স্নান করে উঠলাম মন পবিত্রতায় ভরে যায়। লেখক যেন পবিত্র মানুষ সৃষ্টি করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। সার্থক আমার উপন্যাস পর্বে।
উপসংহারে পাঠকদের জানাচ্ছি, অবশ্য যদি কেউ পাঠ করে আমার যা বলতে ইচ্ছে করছে - তবে অন্যের থেকে ধার নিয়ে ।
আমার চোখের পাতা
মাঝে মাঝেই জড়িয়ে আসে আর
এই যে আমি ধূলোর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি,
এই ধূলোর মধ্যেই আমার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। আমি শুনতে পাই ছায়াচ্ছন্ন এই পথের ধারে মন্দিরে বাজছে ঘন্টা। আমি বুঝতে পারি
পিছনের ওই ছায়ার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে আমার আপন জনেরা আর আমার বুকের মধ্যেও তখন বিদায় বেলার ঘন্টা বেজে ওঠে। আমার তখন ঘুম পেয়ে যায়, আমার ভারী ঘুম পেয়ে যায় ।
সোনালী রায় বাগচী
বিষ
দু একটা ঘুম নেমে এসেছিল
সুচতুর ভেল্কি নিয়ে ।
স্বপ্নের আনাচে কানাচে তারা
গুঁজে দিয়েছিল মৃত্যুর ধারাপাত ।
জীবনের সহজলভ্য গাণিতিক সূত্রগুলি
সেদিন থেকেই দিশেহারা ।
কিছু ঘুম ছুঁয়ে গেছিলো
নদীর উজান স্রোতে ভেসে আসা
কচুরিপানা শব্দমালাকেও ।
দিকভ্রান্ত সেইসব শব্দেরা
এখন এলোমেলো আঁকিবুকি কাটে ব্যর্থতার সিলমোহর এঁটে ।
কয়েকটা ঘুম শান্ত করেছিল ,
রক্তের লাভা স্রোতকে ।
প্রাত্যহিক ব্যস্ততার খোলসে
নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে ,
লাভা এখন দিব্যি শীতঘুমে ।
এভাবেই হয়তো হ্যামলিনের বাঁশির সুরে
রক্তের প্রতিটা ফোঁটা
হিমোগ্লোবিন হারিয়ে পরিণত হয়
কেবলই এক ম্যাড়ম্যাড়ে সাদা পিচ্ছিল তরলে ।
কখনো না ভাঙা সব ঘুমেরা
অস্থিতে অস্থিতে বাসা বাঁধে
খুব গোপন ষড়যন্ত্রের মতো ।
বুক ছুঁয়ে যাওয়া হিমেল হাওয়ায়
এখন তাই সেই ঘুমের এন্টিডোট খুঁজি ।
Friday, December 21, 2018
সুদীপ্তা দেবনাথ
জেগে উঠো - জাগ্রত হও
হে নারী-জেগে উঠো
ঘুমিও না আর-গন্তব্য বহুদূর
গুটিসুটি মেরে ঘোমটার আড়ালে আর বাঁচা নয়!!
তুমি সৃষ্টিশীল
তুমি জন্ম দিতে জানো
তুমি মহীয়সী
কদমে কদম মেলাও-তুমি সহচরী
প্রতিদ্বন্দিতায় সামিল হও
খুলে ফেলো ভয়ের আভরণ
ভয়কে পেরিয়ে এলে অনিবার্য জয়।
তুমি কেঁদো না! কাঁদলে ভেঙে যাবে
যে ভেঙেছে, সে মিলিয়েছে স্রোতে
দুঃখে দুঃখী হইওনা অট্টহাস্যে উড়িয়ে দাও
প্রাণ খুলে হাসো হাসতে যাচ্ছ ভুলে!
কতকাল বাঁচনি এবার তাই বাঁচো।
যেখানে সেখানে বিলিওনা নিজেকে......
নারী!!
তুমি নিজেই জানো না নিজে কতটা দামী
এ জগৎ সংসার খা-খা তুমি ছাড়া
তুমি মা- তুমি মেয়ে- তুমিই সহধর্মিনী
তুমি পুরুষের শক্তি
স্রষ্টার সর্বোত্তম সৃষ্টি
তুমি দৈবশক্তি নারী।
তৈরি করো নিজেকে
তুমি পুরুষের চেয়ে কম নও
তুমি পেরেছো- তুমি পারো
তোমায় পরতেই হবে;;
গুটিয়ে নয় গুছিয়ে নাও নিজেকে
দোদুল্যমান চলা নয়
লক্ষ্য হবে স্থির
সম্মান করো আগে নিজেকে তবেই তো
অন্যে করবে সম্মান
বলার আগে ভাববে দশবার।
আয়নার সামনে দাঁড়াও-
হও নিজের মুখোমুখি
নির্ভীক কণ্ঠে বলো-
আমি নারী-আমি পারি
জেগে উঠো-জাগ্রত হও নারী।
শৌভিক বাগচী
অর্ধেক
আধখানা সকাল
অজস্র আঁকিবুকি গায়ে ,রোদমাখলো
আধখানা দুপুর
ছায়ায় হারিয়ে
মায়া বাড়ালো .
আধখানা বিকেল
এই মাত্র স্নান সেরে
আকাশ বিছিয়ে দিলো
আধখানা রাত
বসন খুলে ,বসলো
আদিম শাখায় ....
আধখানা প্রাণ
গড়িয়ে গেলো
অন্ধকারে ...
বাকি অর্ধেক
থেকে গেলো দূরে
নরম কুয়াশায় .....
কে যেন দিলো ডাক
বলে উঠলো
'এই আমি '
আমার আমি = অর্ধেক
বাকিটা পর্ণমোচী
কেবল ঝরেই চলেছে।
Thursday, December 20, 2018
দেবশ্রিতা চৌধুরী
অবচেতন
বিমূর্ত ভাবনারা নক্সী কাঁথার
শৈল্পিক বুননে অস্ফূট থেকে
স্ফূটতায় আসতে চাইলে
ভেতর ভেতর একটা অপার্থিব
অপারঙ্গমতার অনুভূতি ঝড়ের
বেগে পরিপাটি নিটোল মূর্ততা
তছনছ করে দেয়।
জাগরূক স্বপ্ন এক ঝটকায়
পারিপার্শ্বিক ভালোবাসার সব
আয়োজন সাজিয়ে হাতছানির
কলাকৌশলে মূল্যায়নে হাজির।
তবুও অবচেতন ডেকে ফেরে
বিমূর্তের অসমাপ্ত নক্সী কাঁথার
রংমিলান্তি সূঁচের ফোঁড়ে।
Wednesday, December 19, 2018
গোবিন্দ ধর
নদীশরীর
প্রতিবার বন্যা আসে,পলি পড়ে
এক একটি জন্মদিন গতিমুখ বদলে দেয়
সেই যে ঢেউ ছলাৎছল জীবন
এক একবার বন্যা এসে পাড় ভাঙ্গে
বদলে নেয় শরীর।
বন্যায় শরীর ডুবে গেলে অদৃশ মাছগুলো
বেরিয়ে পড়ে স্বাধীনজলে
তখন সাঁতার কাটে।কাটতে কাটতে পাখনায়
অসুখ লাগে।ক্লান্ত লেজ পাখনা
আঁশসহ জলেই ডুবে যায়।
জলজ জীবন জলেই শেষ এই বন্যা ভয়াবহ।
শরীরের পলিতে নতুন চারা ভালো লাগে
তরতর বেড়ে ওঠে চরায়।
শরীর নদীর মতো পলি জল আর মাছের চক্রব্যুহে
অভিমুন্যের মতো জলবন্দী।
কল্যাণব্রত বসাক
প্যাকেট নবান্ন
অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা দ্বাদশী।এমন দিনে 'নতুন খাওয়া' হবে। বাড়ির সকলেই মুখিয়ে থাকতাম।নতুন হাঁড়িতে নতুন চালের ভাত। মিষ্টান্ন হবে, পিঠা হবে। হাবে'তো বটে। নতুন চাল তো এমনি এমনি ঘরে আসেনা। সে কি পরিশ্রমরে বাবা।
তিন সাড়ে তিন মাস আগে থেকে কাজ শুরু হয়।
জালা বিচনা তৈরি করা
--জালা বিচনা কী বাবা ?
** তোদের বইতে যাকে বীজতলা বলে।
ঐ একই সময়ে বীজধান চটের বস্তায় ভরে পুকুরে একরাত ভিজিয়ে এনে খাঁচি তে....
-- খাঁচি কী বাবা?
** ধুর ছাই। এত প্রশ্ন করিস কেন!
ধমকে উঠলাম মেয়ে কে।
বললাম** খাঁচি হলো বাঁশের তৈরি একটা বড় পাত্র। দেখতে বড় সস প্যানের মতো।
তাতে ঢেলে
উপরে কলাপাতা , শুকনো চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে
রাখতে হতো।
ক'দিন বাদেই ক্যরট.... বলছি বলছি ;ক্যরট মানে অঙ্কুর আসত। সেই বীজধান বীজতলায় ছিটিয়ে দিয়ে কিছু দিন অপেক্ষা।
এদিকে জমি নাল ....মানে তৈরি করা। অন্তত চার চাষ দেওয়া হতো। দুটো গরুর কাঁধে নাঙল বেঁধে জমিতে হাল চাষ। মাটির সোঁদা গন্ধ।
আমরা তখন ছোট। একটা এলুমিনিয়ামের গামলায় মোটা মোটা ভাত,সঙ্গে কড়া ঝালের 'শুটকির মরিচ', ডাল, একটুকরো কলাপায় পেঁচিয়ে 'ডিমের বরা' নিয়ে, থালা দিয়ে ঢেকে, গামছা দিয়ে গিঁট দিয়ে হতে ঝুলিয়ে ক্ষেতে নিয়ে যেতাম। সঙ্গে থাকতো কাঁসের ঘটিতে এক ঘটি জল।
বাবা ভাতের গামলাটা নিয়ে খেতে বসতেন ক্ষেতের আল'এ। বাবা যখন খাচ্ছেন, আমি ততক্ষনে হাল দেওয়া জমিতে মাগুর, সিং, পুঁটি মাছ ধরার চেষ্টা করতাম। থেকে থেকে বাবা ডেকে আমাকে দু-গ্রাস ভাত খাইয়ে দিতেন।...উঃ কি ঝাল রে বাবা। ব্রাহ্ম তালু কেঁপে উঠত।
তারপর রোযা দিয়ে প্রায় মাস তিনেক অপেক্ষা।
ধান পেকে যখন সোলালি রঙ ধরে, রোদের তখন রঙ হয় হলুদ ধোয়া জলের মতো,স্বভাব হয় আদুরে।
গোবিন্দ ভোগ, টিলক কচুরি, ঘিয়জ বিন্নি ধান ।মাঠেই দারুন সুঘ্রাণ বেরুত। পাকা ধান কেটে এনে উঠোনের উত্তরপূর্ব কোন ধানের পাড়া দেওয়া হতো। উঠোনের মাঝখানে খুঁটি পুঁতে গরুদিতে মাড়িয়ে নিয়ে ধান আর খর আলাদা করে নেওয়া হতো।
তারও পরে ঝাড়াই-বাছাই করে ,রোদে শুকিয়ে, বাজার থেকে মেশিনে ভাঙিয়ে যে দিন নতুন চাল বাড়িতে আনা হত, সে দিন ঠাম্মা, মা উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি দিয়ে ঘরে তুলতেন।
এর পর কুলগুরুর অনুমতি নিয়ে......
--- বাবা কুলগুরু কী? মেয়ে জিজ্ঞেস করলো।
বললাম , ভক্তির পুরোন একটা আইটেম। আমার ঠাকুদ্দার আমলে ছিল।
....পাজি পুঁথি দেখে নতুন খাওয়ার দিন ঠিক হয়।
ঠাকুদ্দার কছে শুনেছি, আমরা নাকি কৃষ্ণমন্ত্রী সাধুর বংশ। অতএব নতুন খেতে হলে বৈষ্ণব নিমন্ত্রন করতে হবে।
বাবা কাকা এমনকি দু এক জন প্রতিবেশী সহ আগের দিন খাঁচি ভর্তি করে কাঁচা সবজি কিনে
আনতো। মা, ঠাম্মা , পিসি, প্রতিবেশী মহিলারা হাত বটি দিয়ে তরকারি কূটত। বাটনা বাটত।
পরদিন সকালবেলা থেকে নিমন্ত্রিত অতিথির আসতে শুরু হয়। একে একে বৈষ্ণবরা আসতে থাকেন।
বৈষ্ণবদের পরনে লুঙ্গিরমতো করে সাদা থান। বৈষ্ণবীরাও তাই। গলায় তুলসীর মালা। কপালে তিলক অতি বৈষ্ণবীয় ভাবে নাক পর্যন্ত টানা। বৈষ্ণব হলেও মূলত কৃষিজীবী। মাঠে ঘটে ক্ষেতেই সারাদিন কাটে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত কাদার ছোপ। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ পায়ে কাদার ছোপ ঢাকতে খাঁটি সর্ষের তেলের মসৃন প্রলেপ। রাক্ষুসে ফাটা গোড়ালি। চেপ্টা পায়ের পাতা।
এদিকে কাঠের চুলায় রান্না বসে গেছে। পাড়ার মধ্য বয়েসী কয়েক জন মহিলা বিনা পারিশ্রমিকের রাঁধুনি। বরাদ্ধ পর্যাপ্ত পান,সুপারি আর একটু সাদাপাতা। ওতেই খুশি। ও হ্যাঁ স্থূল রসিকতা চলতো ওঁদের মধ্যে। কিছু গেঁয়ো সম্পর্কের কথা; শরীরের অঙ্গভঙ্গি, কারো বা পোয়াতি হওয়ার ব্যাপারে, বা স্বাদের অনুষ্ঠানের কথা। এসব ছিল গ্রাম্য বিনোদন।
হেমন্তের বেলা। তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যাচ্ছে। এগারোটার মধ্যে অন্ন-ব্যন্ঞ্জন তৈরি। গোঁসাইরা লাইন করে লম্বা টুলে বসে পড়েন। ওঁদের পা ধুইয়ে দেয় গৃহস্ত। বড়রা ভক্তি ভরে টুক করে একটু চরণামৃত খেয়ে নেয়, মাথায় ঘষে।
হাত ঢুলি আর কাঁসা, কর্তাল নিয়ে সুরেলা কীর্তন।
এদিকে আমরা গোবরে লেপা উঠোনে সারি দিয়ে কলাপাতা বিছিয়ে পাত পেরে দিতাম। কাসের ঘটি আর স্টিলের গ্লাস হাতে নিয়ে তৈরি থাকতাম নিমন্ত্রিত দের জল খাওয়াতে।
হরি ধ্বনি, বৈষ্ণবীয় জয় ধ্বনি শেষে নিমন্ত্রিত দের মধ্যে অন্ন ব্যঞ্জন মানে প্রসাদ দেওয়া হত।
কাকা তদারকি করতেন, কারো কিছু আর লাগবে কিনা, কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। বাবা জিজ্ঞেস করতেন বয়স্কদের রান্না কেমন হয়েছে,ইত্যাদি।
একটা গামছা কাঁধে নিয়ে বাবা দাঁড়াতেন মুখ ধোওয়ার জায়গায়, থালায় পান, পাঁচ নং বিড়ি নিয়ে। এর পর শেষ হতো আপ্যায়ন।
.............
মেযের পীড়াপীড়িতে রাজি হলাম....নবান্ন হবে এবার বাড়িতে।
গৃহিণীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। স্থির হলো সব।
ঘরের বাইরে এক পাশে গর্ত করে চুলা(উনুন) বানাল এক প্রতিবেশী বয়স্কার সহায়তায়। কিছু কাঠ জোগাড় হল। কলাপাতা কাটা হল বেশ কিছু।নিমন্ত্রন হল জনা কয়েক। আগের দিন সবজি বাজার করলাম মেয়েকে সাথে নিয়ে। দুটো ব্যাগের মধ্যে একটা ওর হাতে দিলাম। বললাম অংশগ্রহণ কর। সবজি বাজার বাড়িতে রেখে ফের বে হলাম।চাল নিতে হবে।
কিছুক্ষন পরে বাজার থেকে এসে বাইকটা বাইরে রেখে, যেমন করে বাবা পরম ভক্তিভরে নতুন চালের 'খাঁচি' মাথায় নিয়ে আসতেন তেমনি 'কিচেন খাজনা' র চালের পঁচিশ কেজির প্যাকেটটা মাথায় তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে মেয়ে হা হা হা করে আনন্দে হেসে ডেকে উঠল....
--মা দেখো কান্ড , বাবা নতুন চাল এনেছে দাদুর মতো করে।
আমি ধুপ করে বস্তাটা নামিয়ে মাত্রই পাশের ঘরে চলে গেলাম। গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিলাম।
মেয়ে কে বললাম ...
sorry আসার সময় চোখে কি যে পড়েছে।
উমাশঙ্কর রায়
জীবন থেকে ধার নেওয়া
সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র নবীন ইদানীং গভীর পড়াশুনায় ব্যস্ত।তার আগ্রহ বা পড়াশুনার বিষয়টিও বেশ অভিনব। অর্থাৎ সিঁড়ি।
ছোটো বেলায় সুকান্তের ' সিঁড়ি ' কবিতাটি তার মনে বেশ দাগ কেটেছিল। সেই থেকে তার মাথায় 'সিঁড়ি' জাঁকিয়ে বসেছে।
এত বিষয় থাকতে গবেষণার জন্য সিঁড়িতে তার কেন এত উৎসাহ - এ কথা জানতে চাইলে সে গম্ভীর হয়ে বলল, সিঁড়িই সব। একটি সমাজের বিকাশ, তার গতি প্রকৃতি আসলে ঐ সমাজের বিভিন্ন ইমারতে গড়ে ওঠা সিঁড়ির মধ্যেই নিহিত আছে।তাই সিঁড়ির প্রকৃতি বা ধরন জানতে পারলেই - প্রতিটি সমাজের আসল রূপ, এমনকী ঐ সমাজের মানুষেরও আসল প্রকৃতি জানা সম্ভব।
উরি বাস্ ! বললাম, এ কী করে সম্ভব ?!
নবীন বলল, সম্ভব। কারণ - সিঁড়ি হল উন্নতির প্রতীক।অন্যদিকে ভেবে দেখলে - সমাজের প্রতিটি মানুষই তার জীবনে উন্নতি চায়।তাই তাকে জীবনে কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো অবস্থায় - সিঁড়িতে পা রাখতেই হয়।
আবার অন্যদিকে সিঁড়ি বিষয়টা বিশ্বজনীনও বটে। সাড়া বিশ্বজুড়েই - এই সমাজ সংসারে ঘরে বাইরে - বাড়িঘরে - হাটে ঘাটে সিঁড়ির অস্তিত্ব আছে। গঠনের দিক থেকে এরা প্রায় একই রকম।যেমন বিশ্ব জুড়ে মানুষের গড়ন।সারা বিশ্বেই সিঁড়িগুলোও তেমনি দেখতে প্রায় একরকম।
কিন্তু তা হলেও তাদের মধ্যে আবার শ্রেণিভেদ আছে।ধনী দরিদ্র আছে।কোথাও দেখবে মার্বেলের সিঁড়ি । কোথাও আবার মাটির। কোনো সিঁড়ি মসৃন। কোনোটা পিচ্ছিল। কোনোটা আবার খসখসে। কোনো সিঁড়ি সোজা। কোনো সিঁড়ি বাঁকা।কোনোটা কাঁচা।কোনোটা আবার পাকা।কোনোটা সরু, লিকলিকে অথবা প্রশস্ত। কোনোটা আবার লম্বা অথবা ছোটো - ইত্যাদি।
এ সমাজের অন্যান্য নিয়মের মতই খেটে খাওয়া মানুষেরা সিঁড়ি তৈরি করছে।সেই সিঁড়ি বেয়ে দিব্যি উঠে যাচ্ছে অন্যরা। যারা উঠছে, তারা প্রায় কেউই সিঁড়ি বানাচ্ছে না।আর যারা বানাচ্ছে তারা অনেকেই বংশ পরম্পরায় বানিয়েই যাচ্ছে। অন্যরা এই সিঁড়ি দিয়ে ছুটছে।উঠছে।
খুব ভালো হত যদি এই সিঁড়ি বেয়ে সবাই একসঙ্গে উপরে উঠে যেতে পারতো।কিন্তু তা যে হচ্ছে না। তাই নানা নামের - নানাবিধ লাইন ! সেই লাইনে আছে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, কখনো বা মারামারি। এরফলে এই সিঁড়ির কারণেই আবার আমাদের এই সমাজে উথ্থান বা পতনের আরেক ইতিহাস তৈরি হচ্ছে !
নবীন এ নিয়ে খুব ভাবছে।
কে কোথায় ছুটছে, কে কোথায় যাচ্ছে, কে কোন্ সিঁড়িতে - কখন, কিভাবে পা রাখছে - এ নিয়ে নবীনের গবেষণাটা ইদানীং বেশ জমে উঠেছে।
নবীনের কথায় - এই সিঁড়ির প্রকৃতি বিশ্লেষণেই হয়তো একদিন জানা যাবে আমাদের সমাজের ভবিষ্যত !
দীপায়ন মজুমদার
ক্ষতি নেই
ক্ষতি নেই
ভাঙ্গা খেলনাটার পাশে বসে মনের দ্বন্দ মেটানোই
ক্ষতি নেই
হেরে যাওয়া প্রেমিকের মন ভোলানোয়
ক্ষতি নেই
আমার এ দু'হাত ছেড়ে অন্য হাত ধরলে
ক্ষতি নেই
আমার বুকে পাথর রেখে অন্যকে ভালোবাসলে
ক্ষতি নেই
প্রশ্নের উত্তরে হোক আর একটা প্রশ্ন
ক্ষতি নেই
মেনে নেব সবই;
শুধু তোমারি জন্য ।
Tuesday, December 18, 2018
সঞ্জীব দে
প্রহেলিকা
এক বুক আশা নিয়ে নতুন, জীবন নৌকায়
পা রেখেছিল প্রহেলিকা
শ্যাওলা জড়ানো সংসার , হাওয়া জড়িয়ে
একটু দাঁড়াতে চায়, চোখে শস্যেফুল--
রক্ত জমাট হতে হতে কালচে শরীর!
রাত গাঢ় হলে স্বপ্নরা ডানা মেলে
প্রভাত কিরণে আবার স্বপ্নাশ্রু শুকিয়ে যায়,,
লাভার মত টকবক করে ফুটে উঠে ব্যাথিত শব্দ!
আগুন! আগুন! আগুন!
এক নিস্তব্ধ সকালে দুটি নিস্পলক চোখ
আর ঠোঁটের কোনে চির ব্যঙ্গ্যার্থক হাসি
একের পর এক প্রশ্ন প্রসব করে !
মৌনতার মিছিলে
লজ্জায় মাথা নত করে মানুষ মানুষের মিছিলে !
Monday, December 17, 2018
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
১. হিমঘর
অঘ্রাণবিধূর কুয়াশাপিয়ানো, তোমার করুণ মূর্ছনায় আমাকে কাঁদিও ৷
কোমল ঝরনার স্বচ্ছ গভীরের নুড়ির চলন যেন দিকভুল
করে থমকে যায়
২. নোঙর
সামনে খ্রিস্টমাস ৷
দিঘল ছায়ার গীর্জা মূক হয়ে আছে
ঝাউবনের পাশে ৷
বাতাস হিমস্নান মিশিয়ে পথ খুলে রেখেছে
কুমারী মেরির জন্যে ৷
ভালোবাসাভর্তি একটা নৌকো
সহসাই নোঙর করার কথা
দুখি মানুষ সব, পারে এসে দাঁড়াও
Sunday, December 16, 2018
সংগীতা শীল
বিধাতা
জীবন যে কোনো এক অচেনা দেশের পথে ছুঁটে বেড়ায়,
ছুটে চলা দিগন্তহারা পথিকের মন।
কেউ কিছু সুখের আলিঙ্গনে,
কেউবা দুঃখের অশ্রুজল নিয়ে নীরবে।
কখনো বিষাদ সুর স্পন্দনের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ভরা।
কারো দুচোখে শব্দহীন কান্না
বেদনাসিক্ত জলগুলো আপনজন হারানোর শূন্যতার বুকে বয়ে চলে!
এইতো এক দৃশ্য বিধানের জগত!
কে বোঝে কার অনুভূতি?
তবুও তো আমরা বেঁচে আছি
আশা-নিরাশার পথ চেয়ে
সুখ-দুঃখের পাথিব ভরা সময় নিয়ে।
এই তো জীবন আমাদের!
বিধাতা!
কেন তুমি মাঝে মাঝে এত নিষ্ঠুর হও!
রণজিৎ রায়
বিশ্বপ্রেম
কারও দেশপ্রেম সত্যিই বড়ো অদ্ভুত
ভিনগ্রহে শিলাবৃষ্টি হলেই
লেপের তলায় হুহু করে কাঁপে
নিজের দেশে আগুন জ্বালিয়ে অন্যের মাতৃভূমিতে
গভীর ওমের প্রত্যাশায় থাকে।
কারও দেশপ্রেম আরও মনোমুগ্ধকর
রাজপথ থেকে গলিপথে এনে
কান ফুঁতে একান্তে বীজমন্তর ঢালে
প্রাণভরে অক্সিজেন খেতে বলে
বাতাস ফেরি করে বেড়াবে--
কার্বন, ভিটামিন আর ক্যাল সিয়াম
আধুনিক চিকিৎসা বর্জন করে
লিঙ্গে খাঁটি গাওয়া ঘি ঢালবে।
দেশভক্তি নিয়ে কাউকে সন্দেহ হলেই
মুহূর্তেই বিদেশে চালান করে দেবে
সবাই মিলে খোল করতাল বাজিয়ে মাতৃবন্দনা করবে
দারিদ্র্য আর রোগ লেজ গুটিয়ে
উন্নয়ন অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে।
সুমন পাটারী
অহংকার
ধরো, আমি লিখলাম 'ম'
একটি আ-কার যোগ করতে পেরে
গর্বে ভরে উঠলো বুক
বিশ্বাস হয়নি?
ভাবো, তোমার কয়েক প্রজন্ম আগে
রোদ থেকে ফিরে আসা চাষার শুকনো গলা
যখন নিঃশ্বাসের মতো সাবলীল স্রোতে
মা বলতে চাইলো,
কিংবা আধুনিক যুগের মতো
মোবাইল পরিসেবাহীন চিঠিপত্রের সময়ে যখন
ভীন্ন শহরে পাঠরত কোনো ছাত্রকে বলা হলো
তোমার বাড়িতে চিঠি লিখতে হলে তোমার মা কে
আগে অন্য একটি ভাষা শেখাতে হবে
ভাবো সেই ছেলেগুলো চিঠি লিখতে বসে কেমন
ঘায়েল সিংহের মতো ফুঁসছিলো
দেখতে পাচ্ছো, ছেলেগুলো এখন চিঠির কাগজে
কলমের নিব ভেঙে লাফিয়ে উঠেছে,
ঘর থেকে ঝড় বেরিয়ে পড়ছে
সব চূড়মার করে দেবে
কেরোসিনের স্টোভে ডাল ফুটছে
ভাতের মার গালা হয়নি, দরজা খোলা
এসে পড়েছে রাজপথে
দলে দলে মায়ের ছেলেরা বাড়ি না গিয়ে
পায়ে পা মিলিয়েছে
লাঙল ফেলে উঠে এসেছে চাষা
মা, ভাত, প্রেম, দিক্ষা বলে তারা রাজপথে
চিৎকার করে জানান দিচ্ছিলো
মায়ের অবহেলা মানা যাবে না।
ভাবো, রাজপথ তখন কেমন গর্বে লাফিয়ে উঠেছিলো দামাল ছেলেদের পেয়ে
পাখি পাখালি চিৎকার করছে ক্রোধফাঁটা উল্লাসে
জনতার স্রোত থেমে আছে সবাই দেখছে
ছেলেগুলোর সাহস,
ঠিক তখন মুখে কালো কাপড় বাঁধা কিছু বোবা লাল চোখ, তাদের সুখ নেই শোক নেই,
রাইফেল তুলে গুলি চালাতে লাগলো
মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লো মাটির কোলে
তাজা রক্তে ধুয়ে গেলো শুকনো পাতা
সময় ধীর হয়ে গেলো,
ছেলেগুলি আস্তে আস্তে হাতের আঙুলে
লাল কালি মেখে রাজপথে লিখে দিয়ে গেলো
মায়ের কাছে শেষ চিঠি।
আগুন লেগে উঠলো দিকে দিকে
সবাই মা মা বলে উঠলো
ভাবো, কেন গর্ব হবে না আমার!
কেন অহংকার হবে না আমার!
উর্মি সাহা
মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...
-
আজ আশ্বিনের শেষ কার্তিকের শুরু এই দিনটা বিশেষ ভাবে বিশেষ, বাংলার এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। জানি না বাংলার বাইরেও এইভাবে বিশেষ হয়ে উঠেছে কিন...
-
মূক ফেনীর মুখর পাঁচালি একটি বহুল প্রচারিত বাংলা প্রবাদ ‘ভাগের মা গঙ্গা পায়না’ ৷ প্রবাদটির মধ্য দিয়ে মায়ের অসহায়ত্বের যন্ত্রণাটিই ব্যক্ত হয়ে...