Saturday, April 29, 2023

সান্তা দেবনাথ

লাল বেনারসি

উঠানে তখন ভাদ্র মাসের প্রখর রোদ। ফকফকা সোনালী আলো। কাঁঠাল গাছের পাতার সুন্দর নকশা করে পড়ছে রোদ। তখনো দু তিনটে কাক ডেকে যাচ্ছে। অথচ সুমতি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। চারদিকে এত আলো কিন্তু সুমতির দুচোখে শুধুই অন্ধকার। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলল সুভাষ বাড়ি এসে  'সুমতি সুৃমতি...' বলে ডাকছে কারোর কোনো সাড়া নেই। ঘরে ডুকতেই দেখল মেঝেতে সুমতি শুয়ে আছে। সুভাষ একটু হেসে বলল' কি সুমতি এতো ডাকলাম শুনতেই পেলে না। এই বলে সে সুমতিকে ছুয়ে অবাক হয়ে গেল,শরীর সাপের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। মুখটা ঘোরালে দেখতে  পেল ঠোঁটের কোণে লালারস ঝরে পরে শুকিয়ে আছে। আর বুঝতে বাকি রইল না।

   সুভাষের চোখের সামনে ভাসতে লাগল বারো বছর আগের অগ্রহায়ণ মাসে সে একটি সুন্দরী কন্যাকে দেখতে যায়। লাল টকটকে শাড়ি পড়ে কন্যাটি পানের বাটা হাতে সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথম দেখাতেই সুভাষ ও তার মায়ের সুমতিকে বেশ ভালো লেগে যায়। সুমতি বউ হয়ে যখন প্রথম শ্বশুর বাড়ি আসে তখন পাড়া পরসি সবাই সুভাসের মায়ের পছন্দের বেশ প্রশংসা করে। একজন প্রতিবেশী বলেন' সুভাষের বউ যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী প্রতিমা।' আর একজন বলেন ' এ পাড়াতে এ বউকে টেক্কা দেবে এমন বউ আর একটা আছে?'তা শুনে সুভাষের মায়ের গর্বে বুক ভরে যায়।তিনি বউমার খুব খাতির যত্ন করেন।কিন্তু এত সুখ সুমতির কপালে সয় নি।সুমতির জরায়ুতে টিউমার অপারেশন হওয়ার ফলে সে বাচ্চা হওয়ার ক্ষমতা হারায়। তারপর থেকে সুভাষের মা তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেন।সুমতি ও বলেছিল।কিন্তু সুভাষ বিয়ে করতে রাজি হয়নি।সুভাষ সুমতিকে বলে ' দেখো সুমতি কত বাচ্চা মাতৃহীন পিতৃহীন রাস্তায় অনাথ আশ্রমে বড় হয়ে উঠছে। তাদের থেকে তো আমরা একটা বাচ্চা নিয়ে আসতে পারি।সুমতি এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সুভাষের মা রাজি হননি।তিনি বলেন 'আমি আমার নিজের নাতি নাতনি চাই, আমার বংশধর চাই। ওসব চালচুলোহীন রাস্তার ছেলে মেয়ে এনে আমার বাড়িতে ফেলবে। আমি বেঁচে থাকতে তা হচ্ছে না বাপু।' সুতরাং এ প্রস্তাব এখানেই চাপা পরে যায়।
 
    তারপর কয়েক বছর পর হঠাৎ সুভাষের বদলির অর্ডার আসে। আগরতলা থেকে বদলি হয়ে যায় মনুতে।সুভাষ তার সাথে সুমতিকেও নিয়ে যেতে চায়,সুমতি যেতে রাজি হয়নি।সুভাষ চলে যায় সুমতি সদর দরজা পর্যন্ত স্বামীকে এগিয়ে দেয়। যতটুক পর্যন্ত গাড়ি দেখা যায় সুমতি তাকিয়ে থাকে। গাড়ি চলে গেলে সুমতি নীরবে চোখের জল মুছে। তার স্বামীর সাথে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। যেদিন সুভাষ খেতে বসে মাকে বলছিল ' মা আমার তো মনুতে বদলি হয়ে গিয়েছে, ভাবছি তোমাকে আর সুমতিকে নিয়ে যাব।আর আমি সেখানে ঘর ভাড়া ও নিয়েছি। তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।' তখন সুভাষের মা বলেন ' না বাবু আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি না।এখানে ঘর বাড়ি ফেলে ওখানে গিয়ে আমি থাকতে পারব না।তোমরাই বরং যাও।' সুভাষ বলে ' আমরা ওখানে থাকব আর তুমি এখানে একা থাকবে। যদি তোমার অসুখ বিসুখ হয় কে দেখবে।' মা বলল ' আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি থাকতে পারব।' এত বলার পরও তিনি রাজি হননি। সুভাষ উঠে চলে যায়। সুমতি এটো থালা বাটি নিয়ে যায়। শাশুড়ি সুমতিকে ডেকে বলে ' দেখো বউমা, বাবু তোমাকে নিয়ে যাবে বলছে তুমি কিন্তু আবার চলে যেও না।তুমি তো আর আমাদের বংশধর দিতে পারবে না।আজ এতবছর ধরে বলছি বিয়ে কর করলো না। তোমার কাছে থাকলে তোমার মায়া কাটাতে পারবে না। এখন কিছু দিন তোমার থেকে দূরে থাকলে তোমার মায়া কাটাতে পারবে। পুরুষ মানুষ তো একা থাকলে মন পরিবর্তন হবে।' সুমতি মৃদুস্বরে বলে ' ঠিক আছে।' তারপর সে সুভাষকে বলেছে ' মা বয়স্ক মানুষ ওনাকে ছেড়ে যেতে আমার মন মানছে না। তাছাড়া তুমি তো প্রতি শনি রবিবারে আসবেই। এখন তুমি একাই যাও।

   শনিবার দিন সুভাষের আসার কথা। সুমতি সকাল থেকে সুভাষ যা যা খেতে ভালোবাসে সব কিছুই রান্না করেছে। কিন্তু সেদিন সুভাষ আসে নি। সন্ধ্যা সময় সুমতিকে ফোন করে বলে ' সরি, আজ আসতে পারছি না  জরুরি কাজে আটকে গেছি কাল আসবো।' এই বলে সুভাষ ফোন রেখে দিল। সুমতির চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে পরে। তা দেখে শাশুড়ি মনে মনে খুশি হয় ভাবে ' ছেলের মন ফিরেছে।' সুমতিও যেন সুভাষের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে। সে ভাবে হয়তো তার খারাপ লাগবে ভেবে সুভাষ আর দ্বিতীয় বিয়ে করে নি। সেদিন রাতে আর সুমতির ঘুম আসে নি। পরের দিন সকালে সুমতি ঘরে থাকা ইঁদুর মারার ঔষধ খেয়ে সুভাষের জীবন থেকে চিরতরে সরে যায়।
   
   সুমতিকে লাল বেনারসি পড়িয়ে, পায়ে আলতা,  সিঁথিতে লাল সিঁদুর পড়িয়ে দেয় সুভাষ। সে সুমতির দিকে তাকিয়ে থাকে ভাবে ' এ যেন সেই ১৫ বছরের বালিকা সুমতি আজ আবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। তার সত্যি কারের শ্বশুর বাড়ি। যেখান থেকে সে আর কখনো ফিরে আসবে না, কেউ ফিরে না সে ও ফিরবে না। যেমন ভাবে সুমতি এবাড়িতে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে যাচ্ছে। কোথাও কোনো পিছুটান নেই। সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...