কৃষ্ণগহ্বরে
পড়ন্ত রোদে আসামআগরতলা লাইফলাইন নবীনছড়ার বুকে ডোরাকাটা অজগরের মতো শুয়ে আছে।পাশে গ্রামসেবককেন্দ্রের কোয়ার্টারের বারান্দায় একটা চেয়ারে পাঁচের মতো বসে আছে গৌতম।বিএলডাব্লিউ সে। মোবাইলে একটি কন্ঠ বেজে উঠেছে, -- - - সব পাকা করে রেখেছি। আগামীকালই আমাকে - - অন্যতায় মহিলাকমিশন--।গৌতমের ত্রিভুবনে সুনামী উঠেছে।সে এখন কাকে কী বলবে? স্ত্রী স্বেতা ও আত্মজ কৌস্তুবের মুখোমুখি কি করে দাড়াবে? আত্মহনন ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।জয়পরাজয় নয়, মাথার ভেতর গুমড়ে ওঠছে কালনিশিডাক।
হাতের মোবাইলটা ঢিল মারে জাতীয় সড়কে। আগরতলা থেকে গৌহাটিগামী যমদুতগুলো তার বিগড়ে যাওয়া মগজে গনধোলাই দিতে দিতে ছুটে চলেছে কামরূপের দিকে। স্বেতা,কৌস্তব-ওরা যেন এই মুহূর্তে মঙ্গলের অধিবাসী।ইচ্ছে করলেও তাদের কাছে যাওয়া যাবে না।আঙুলের ডগা থেকে একটা তীব্র যন্ত্রণা মাথা অবধি - হুল ফুটাচ্ছে।
স্বেতার সাথে বিয়ের পর ফিরাযাত্রায় দেখা হয়েছিল তার তুতোশালিকা এনার্জির সাথে।প্রথম দর্শনেই এনার্জি গৌতমকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিলো়।রাতে সে গৌতমের সাথে শুতে গিয়ে স্বেতাকে বলেছিলো-দিদি ওখানে শুলে জামাইবাবু ডিসটার্ব করবে নাতো? স্বেতাও রহস্যময়ীর মতো বলেছিলো-একদিন না হয় ডিসটার্ব করেই ফেললো! আর কোন কথা বাড়ায়নি এনার্জি ।শুয়েই লেপের নীচে গৌতমকে জড়িয়ে ধরেছিলো।একটি পা তুলে দিয়েছিল তার প্রোস্টেটের উপর।রাতে এনার্জিকে ডিসটার্ব নয়, এনার্জির ডিসটার্বেই সারারাত ঘুমোতে পারেনি সে। তারপর দেও জুড়ি লঙ্গাই বেয়ে অনেকজল গড়িয়ে গেছে।
নারীনেত্রী এনার্জির সাথে ঘটনাচক্রে ফের দেখা - দামছড়াতে।আর বাইকে চেপে দশরথদেব সেতু পেরিয়ে - - কানমুনের উদোমপ্রকৃতির কোলে। ।এনার্জির এনলার্জবাহু উপেক্ষা করতে পারেনি গৌতম।তার মাঝে এমন একটা আদিম উচ্ছাস আছে যা স্বেতার মাঝে নেই।শরীরি বিভঙ্গে - - যেন আগুনের গোলা।সোনামী উঠে আসলো জঙ্গলের গভীরে।পুরোটা সময় তার মাথার ফুসেওঠা চুলগুলি টেনেহিঁচড়ে দিতে লাগল গৌতম!আর এনার্জির গলা থেকে উঠতে লাগলো শনিপুজোর কাসির আওয়াজ-তোমাকে ছাড়া আর একমুহুর্তও বাঁচতে পারবো না ---একটা বিহিত কর সোনা--একটা বিহিত - - !
মাসছয় কেটে গেছে। এনার্জির ডাকে আর সাড়া দিতে সাহস করেনি গৌতম।অনেক কল এসেছে।কোন না কোন ছুতোয় এড়িয়ে গেছে।বুঝেছে, আর দেখা করা ঠিক হবে না। স্বেতা বোন হলেও এনার্জি তাকে সহ্য করতে পারে না।স্বেতার প্রসঙ্গ তুললেই বলে,-আমাদের মাঝে কোন তৃতীয়উপস্থিতি আমার পছন্দ নয়, কথাটা--মনে থাকে যেন!
আজ রোববার।বাড়ি যাবার কথা।গৌতম কি বাড়ি যাবে? নিজেকে এই মুহূর্তে প্রেতাত্মা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না।তার শরীরটা হালকা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাতাসে উড়ছে।কোথাও ভর মিলছে না।যেন গাড়ি চলছে।হেডলাইটের তীর্যকআলো একটার পর একটা অন্ধকারপর্দা ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে ।মাথাটা ভীষণ ভারী। দমবন্ধ হয়ে আসছে।পৃথিবী থেকে মেঘ উবে যাচ্ছে।বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। আশমানজমিন খাঁ খাঁ করছে। তার অন্তিমযাত্রা যেন মহাকাশের কোন কৃষ্ণগহ্বরের দিকে।যেখানে গেলে আর কিছু থাকবে না,স্থানকাল আবৃত হয়ে হারিয়ে যাবে।
চোখের সামনে ফুটে উঠেছে একটি অপুর্ব কদমবৃক্ষ।তার মতোই দুখি।তাকে নেশার মতো ডাকছে- আয় বুকে আয়,দুজনে গলাগলি করি।সে বলছে - এত উঁচুতে কী করে তোমার গলায় আসি প্রিয়।-হাতের দড়িটা গলায় বেঁধে উপরের দিকে ছুড়ে দে।আর আমি এক লহমায় তোকে - - - জড়িয়ে নেবো।
সহসা তার সম্ভিত ফিরে আসে। একটি পাতাগোখড়ো তাকে পেছিয়ে কানের কাছে হিস হিস করে বলছে,-আত্মহনন নয়, আত্মনিবেদন ছাড়া তোর কাছে আর কোন পথ খোলা নেই।তুই এখুনি বাড়ি ফিরে যা। একমাত্র শ্বেতাই পারবে এই চরমসন্ধিক্ষণে - মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বরপথ থেকে-- তুলে এনে নীলগ্রহের ধূলিতে বৃষ্টির আঘ্রাণ জাগাতে।
No comments:
Post a Comment