কিছু কথা ছিল
নিলা আর রুদ্র বছর দুয়েক হল তাদের বিয়ে হয়েছে । ওদের বিয়েটা ছিল লাভ ম্যারেজ । তিন বছর জমিয়ে প্রেম করে এরপর বিয়ে টা করল। নিলার বাড়ির মানুষের কিছুটা অমত ছিল ঠিকই। কিন্তু কথায় আছে না , "ভালোবাসার সামনে সবাইকে একদিন হার মানতেই হয়"। তেমনি নিলার পরিবার কে ও তাদের ভালোবাসার সামনে হার মেনে রুদ্র কে জামাই হিসেবে মানতেই হল।
রুদ্র একটা প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকরি করে। এই কাজের সূত্রে রুদ্র কে বাইরে বাইরেই থাকতে হয়। আগে একা থাকতে হতো, রান্নাবান্না ও একাই করতে হতো। কিন্তু এখন সাথে নিলা আছে। দুইজনে মিলে তাদের এই ছোট্ট সংসার টা ভালোভাবেই গুছিয়ে নিল।বিয়ের আগে যেমন ওদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা ছিল তেমনি বিয়ের পর ভালোবাসা টা গভীর থেকেও আরও গভীরতম হয়ে উঠলো।
একদিন সকালে নিলা দেখলো রুদ্র অফিসে যায় নি।
নিলা - কি হল আজ অফিস যাবে না।
রুদ্র- না আজ শরীর টা একটু খারাপ লাগছে। তাই আজ অফিসে যাচ্ছি না।
নিলা- এ মাঃ কি হল তোমার? জ্বর হয়েছে নাকি?
রুদ্র- আরে না জ্বর না। এমনি শরীর টা একটু মেজমেজ করছে। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
নিলা- আচ্ছা, তাহলে আমি চা আর ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। তুমি খেয়ে একটু বিশ্রাম করো।
নিলা রুদ্রের জন্য চা আর ডিম টোস্ট আনলো। ডিম টোস্ট ওর খুব পছন্দের।
নিলা - এই নাও, ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে একটু বিশ্রাম করো।
রুদ্র ব্রেকফাস্ট করে রুমে চলে গেল।
সেদিন নিলার একটু কেমন জানি মনে হল। কারণ , আজ পর্যন্ত কোনোদিন রুদ্র নিলা কে একা রেখে ব্রেকফাস্ট করেনি , একসাথেই করতো সবসময়। নিলার হাজার টা কাজ থাকলেও রুদ্র একটা বাইট হলেও নিলাকে খাইয়ে দিত । কিন্তু আজ রুদ্র একবারও জিজ্ঞেসা করলো না!
নিলা ভাবছে, হয়তো ওর শরীর খারাপ তার জন্য জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে। এইসব ভাবনায় নিলা বেশি পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে।
দুপুর দু টো রুদ্র স্নান সেরে জানালার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে।
আর এইদিকে নিলা সব কাজ সেরে, দুপুরের খাবারটা নিয়ে এল।
নিলা- এই শুনছো ! টেবিলে খাবার টা দিয়েছি এসে খেয়ে নেও। আমি রান্নাঘরের কাজটা সেরে খাবো। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।
এই কথা বলার পর নিলা রান্না ঘরে চলে গেল। নিলার কথা যেন রুদ্র শুনতেই পাই নি। সে আপন মনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
প্রায় আধ ঘন্টা পর নিলা রান্না ঘর থেকে আসলো।
এসে দেখলো,
নিলা - কি গো ,, এই শুনছো!
রুদ্র- হ্যা বলো। কি হয়েছে?
নিলা- সেটা তো আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, কি হয়েছে তোমার?
রুদ্র- আমার আবার কি হবে?
নিলা- তাহলে, টেবিলে যে খাবার টা আমি আধ ঘন্টা আগে রেখে গিয়েছিলাম, তোমাকে বারবার বলেছি খেয়ে নিতে। তুমি খাও নি কেন?
রুদ্র- ওঃ সেই কথা। আমি তখন শুনতে পাই নি। ঠিক আছে এখন খেয়ে নিচ্ছি।
রুদ্র খাবার টেবিলে সামনে গেল, চেয়ারে বসে খাবার টা মুখে দিতেই,
নিলা - 'দাঁড়াও। '
রুদ্র- আবার কি হল! এতক্ষণ বলছো খাবার খাই নি কেন, আর এখন খেতে যাবো তো বারণ করছো।
নিলা - তোমার কি হয়েছে গো ! বলো না আমায়।
তুমি এমন করছো কেন?
রুদ্র- আচ্ছা ঝামেলা তো। খেলেও দোষ, না খেলেও দোষ!
নিলা - তুমি ঠান্ডা খাবার কখনো পছন্দ করো না।খাবার একটু ঠান্ডা হলে সারা ঘর মাথায় তুলে নিতে। আর আজ এই ঠান্ডা খাবার কিভাবে খেয়ে নিচ্ছ তুমি।
রুদ্র - না মানে,,, খাবার এতটা ও ঠান্ডা হয় নি যে খেতে পারবো না। আর তুমি আবার গরম করে আনবে তাই ভাবলাম খেয়েই নেই।
নিলা - খাবার টা দাও, আমি গরম করে আনি।
নিলা খাবার টা গরম করে রুদ্র কে দিল। এরপর রুদ্র খাবার খেয়ে দেয়ে রুমে শুতে চলে গেল। নিলা খাবার টেবিলের সামনেই বসে কি কি যেন ভাবছে!
রাত ৮ টা । রুদ্র নিলাকে ডাক দেয়।
রুদ্র- নিলা এই নিলা শুনো একটু।
নিলা- হ্যাঁ বলো। কি হয়েছে !
রুদ্র - বলছিলাম আমি রাতে খাবো না । তুমি খেয়ে নিয়ো ।
নিলা- কিন্তু কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ডক্তর ডাকবো?
রুদ্র- না না শরীর খারাপ লাগছে না। এমনি ক্ষিধে নেই। তাই খাবো না।
নিলা- ক্ষিধে নেই বললেই কি হবে! তোমার পছন্দের পনির রান্না করছি একটু খেয়ে নিয়ও ।
রুদ্র- দেখো নিলা বিরক্ত করো না। একবার বলছি তো খাবো না। বারবার জোড় করছো কেন ! এখন যাও। আমার কিছু কাজ করতে হবে।
এই বলে রুদ্র তার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরলো। আর নিলা চোখে জল নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল। নিলা এখন খুব চিন্তায় পরেছে। রুদ্রর কি হয়েছে। এত বছরে রুদ্র কোনোদিন ওর সাথে এমনভাবে কথা বলে নি। কিন্তু আজ কি হল!
রাতে নিলা কিছু রান্নাও করলো না। আর না খেয়ে ঘুমিয়ে পরলো। হঠাৎ মাঝরাতে নিলার ঘুম ভেঙে যায়। তখন বাজে রাত ১ টা। নিলার ঘুম ভাঙতেই দেখে রুদ্র এখনও ঘুমায় নি। এত রাতেও মোবাইলে কি যেন করছে । আর একা একাই মুচকি হাসছে।
নিলা- এই,, কি গো। তুমি এখনও ঘুমাও নি। কি করছো এতক্ষণ ধরে?
রুদ্র- ক..... ই কিছু না তো। এমনি ঘুম আসছিল না। তাই মোবাইল দেখছিলাম। শেষ মোবাইল দেখা। চলো ঘুমিয়ে পরি।
এই বলে রুদ্র মোবাইল টা রেখে ঘুমিয়ে পরে । আর নিলার মনে কেমন যেন এক সন্দেহ বাঁসা বাঁধতে থাকে। এই ক বছরে নিলা কোনোদিন ওকে সন্দেহ করে নি, কিন্তু আজ কেন জানি নিলার মনে এই সন্দেহের সৃষ্টি। নিলা মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পরলো।
পরের দিন রবিবার। প্রায় রবিবারে নিলা আর রুদ্র বাইরে ঘুরতে যায়। আর দুপুরের খাবারটাও তারা দুইজন বাইরেই খায়। আজ সকালে নিলার উঠতে অনেকটা দেরী হয়ে গেল। অন্যদিন রুদ্রর অফিস থাকে বলে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে।আজ রবিবার, তাই একটু দেরী করে উঠলো। প্রায় নয় টা বাজে নিলার ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে দেখে রুদ্র ঘরে নেই। নিলা তো চিন্তায় পরে গেল এত সকাল সকাল ও কোথায় গেল। এরপর নিলা রুদ্র কে ফোন করে।
রুদ্র- হ্যালো।
নিলা- তুমি কোথায়?
রুদ্র- এই তো আমি অফিসে। তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডাক দিলাম না।
নিলা- আজ না রবিবার! রবিবারে কোন অফিস খোলা থাকে!
রুদ্র- না, সাইটের কিছু কাজ ছিল। তাই আসতে হল।
নিলা- তুমি বাড়ি ফিরবে কখন?
রুদ্র- এখনও বলতে পারছি না। হয়তো রাত হতে পারে।
নিলা- কি! তোমার রাত হবে? রবিবারে না আমরা ঘুরতে যাই !
রুদ্র- কিন্তু আজ তো হবে না। কাজের অনেক চাপ। এখন আমি রাখছি পরে ফোন করবো।
নিলা- এই শোনো। হ্যা.... লো। হ্যালো।
রুদ্র ততক্ষণে ফোন টা কেটে দিয়েছে।
নিলা খাটে বসে কান্না করছে।সে একা একাই বিরবির করছে, -
নিলা - 'হঠাৎ করে রুদ্র এমন করছে কেন ?' 'তাহলে কি ওর জীবনে অন্য কেউ! '
না না ছি ছি এইসব আমি কি ভাবছি! রুদ্র আমাকে খুব ভালোবাসে। ও এমন কাজ করতেই পারে না।
এইসব ভাবতে ভাবতে নিলা আজ কোনো রান্না করেনি। সারাদিনে যেই মানুষ টা অনেকবার ফোন করতো সে আজ সারাটা দিন চলে গেল কিন্তু একটা ফোনও করল না ! নিলা ফোন করেছিল কিন্তু রিসিভ করে নি ।
যাইহোক
রুদ্র যেহেতু রাতে আসবে বলেছে তো একবারে রাতেই নিলা রুদ্রের পছন্দের পনির রান্না করবে।
সন্ধ্যা সাত টা নিলা রান্না টা বসিয়ে দিল। নিলা জানে রুদ্রর বাড়ি ফিরতে প্রায় সাড়ে সাত টা বা আট টা বেজে যায়। তাই তাড়াতাড়ি নিলা রান্না টা বসিয়ে দিল। রাত আট টা নিলার রান্না শেষ। কিন্তু রুদ্র এখনও বাড়ি ফিরলো না। রাত ৯ টা, এখনও ওর কোনো পাত্তা নেই। নিলা রুদ্র কে ফোন করছে কিন্তু ফোনটা রিসিভ করলো না।
ঠিক রাত দশ টা , হঠাৎ ঘরের বেল বাজলো । নিলা দৌড়ে গিয়ে দরজা টা খুলে দিল ।
নিলা- কি গো তোমার আসতে এত দেরী হল যে। কতবার তোমায় ফোন করেছি। একটা বার তো রিসিভ করতে পারতে?
রুদ্র- আরে কাজের একটু চাপ ছিল তাই দেরী হয়ে গেছে। আর তোমার কলটা ও দেখতে পাই নি।
নিলা- ঠিক আছে। আমি খাবার গরম করছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।
রুদ্র- নিলা শোনো। বলছি যে, আজ আর খাবো না ক্ষিধে নেই।
নিলা- ক্ষিধে নেই মানে? কালও তো খেলে না, সকালে ও না খেয়ে চলে গেলে। এখন বলছো ক্ষিধে নেই! আজ তোমার পছন্দের পনির রান্না করেছি। অল্প একটু খেয়ে নাও।
রুদ্র- না গো। অফিসে অনেক দেরী হয়েছিল তো, তাই আমি বাইরে খেয়ে নিয়েছি।
নিলা- ওঃ তুমি বাইরে খেয়েছো? এইদিকে সারাদিন আমি না খেয়ে তোমার জন্য বসে আছি। কখন তুমি আসবে আর এক সাথে খাবো। এখন বলছো বাইরে খেয়ে নিয়েছো ।
ঠিক আছে।
রুদ্র- তুমি সারাদিন না খেয়ে কেন ছিলে। আমি তো বলেছিলাম আমার আসতে দেরী হবে।
নিলা- হ্যাঁ বলেছিলে তো। কিন্তু এইটা তো বলো নি যে তুমি রাতে বাইরে থেকে খেয়ে ফিরবে।
রুদ্র- আচ্ছা এখন এইসব ছাড়ো। যাও, খেয়ে শুয়ে পরো।
নিলা- হুমম।
এই কথা বলে রুদ্র রুমে চলে যায় । আর নিলা মন খারাপ করে ড্রইংরুমে বসে আছে। প্রায় এক ঘন্টা পর নিলা রুমে গেল। গিয়ে দেখে রুদ্র আবার মোবাইলে কি যেন দেখছে। নিলার সন্দেহ টা আরও গভীর হতে থাকে।
নিলা- এই শোনছো। কি গো।
রুদ্র- হ্যাঁ বলো।
নিলা- তুমি এখনও ঘুমাও নি। এত রাতে মোবাইলে কি করছো!
রুদ্র- কিছু না। একটু কাজ করছিলাম।
নিলা- আগে তো তোমার মোবাইলে তেমন কোনো কাজ থাকতো না। তবে এই দুইদিন ধরে দেখছি মোবাইলে অনেক বেশিই কাজ থাকে।
রুদ্র- তুমি কি বলতে চাও? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে না বলে সরাসরি বলো।
নিলা- না কিছু না। ঠিক আছে, তাহলে তুমি তোমার কাজ করো। আমি ঘুমাই।
রুদ্র- ঠিক আছে।
নিলার চোখের কোনে জলের ঢেউ। মন টা ও কেমন যেন উথাল পাথাল করছে। দু চোখে ঘুম নেই। নিলা কিছুক্ষণ পর পর ঘাড় টা ঘুরিয়ে শুধু রুদ্র কে দেখছে। ও যেন মোবাইলে একদম ডুবে আছে। নিলা কিছু বলতেও পারছে না, সইতেও পারছে না। যাইহোক অনেক অস্থিরতার পর দু চোখের পাতা এক করলো নিলা।
প্রায় কুড়ি, পঁচিশ দিন এইভাবেই নিলা আর রুদ্রর সংসার টা চলতে থাকে। রুদ্র সকালে কোনোভাবে নাকে মুখে কিছু দিয়ে বেরিয়ে যায়। আবার অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। কখনো তো রাত এগারো টা ও বেজে যায় বাড়ি ফিরতে। মাঝে মাঝে রুদ্রর ভালো লাগলে রাতের খাবার খেয়ে নিত। এরপর সেই মোবাইলে রাতের পর রাত ডুবে থাকতো। নিলা কিছু বললে ও কেমন যেন শুনেও না শুনার মতো করে থাকতো। নিলা বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে।
কিন্তু একদিন যখন নিলা দেখলো রাত দু টো বাজে তখনও রুদ্র ঘুমাই নি। মোবাইলে কার সাথে জানি ব্যাস্ত। তখন নিলার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। রাতে কোনো ঝামেলা করলো না। পরেরদিন রীতিমতো রুদ্র অফিসে গেল। রাত দশ টায় রুদ্র বাড়ি ফিরল। রুদ্র রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাটে বসল।
নিলা- নিশ্চয় বাইরে থেকে খেয়ে এসেছো? তাই না?
রুদ্র- হ্যাঁ মানে,,,, কাজ ছিল তো তাই একেবারে খেয়েই ফিরলাম।
নিলা- আচ্ছা। ভালো কথা। তবে তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।
রুদ্র- হ্যাঁ বলো। কি কথা।
নিলা- তুমি কি মোবাইল টা রাখবে? না হয় আমি এখনি এটা ভেঙে দেবো।
রুদ্র- আরে বাবা কি হয়েছে এত রাগ দেখাচ্ছো কেন? ঠিক আছে, নাও মোবাইল রাখলাম। এইবার বলো কি বলবে।
নিলা- তোমার কি হয়েছে এইটাই জানতে চাই !
রুদ্র- আমার আবার কি হবে! আমি তো ভালোই আছি।
নিলা- তুমি হয়তো ভালো আছো। কিন্তু আমি ভালো নেই।
রুদ্র- কেন? তোমার শরীর খারাপ?
নিলা- না শরীর না। শরীর খারাপ হলে সেটা সময়মতো ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু মনের আঘাত কখনো কোনো ঔষধে ঠিক হয় না।
রুদ্র- ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সোজাসুজি বলো কি হয়েছে।
নিলা- আচ্ছা আমার ভালোবাসায় কি কমতি ছিল বলো তো? আজ প্রায় এক মাস ধরে তুমি আমার সাথে ঠিক করে কথা বলছো না। আমাকে ছাড়া যেই মানুষটা এক কাপ চা ও মুখে দিতো না, সে এখন প্রতি রাতে বাইরে ডিনার করে বাড়ি ফিরে। প্রত্যেক দিন যেই মানুষ টা কিছুক্ষণ পর পর আমায় ফোন দিত। এখন দিনে একবারও তার ফোন আসে না। রাতে আমায় জড়িয়ে না ধরে ঘুমালে যার ঘুম আসতো না, সে এখন রাতের পর রাত মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। এইসবের মানে টা একটু বুঝিয়ে বলবে?
রুদ্র- আরে এইসব ছোটখাটো জিনিস কে এত বড়ো করছো কেন? এই কয়েকদিন কাজে ব্যস্ত আমি তাই এমন হচ্ছে।
নিলা- কিসের ব্যস্ততা তোমার? এই দুই বছরে এত ব্যস্ত কখনও তো দেখি নি। এখন খুব ব্যস্ত না ! মাঝ রাতে মোবাইল দেখে দেখে হাসো। এইটা তোমার ব্যস্ত?
রুদ্র- নিলা তুমি ভুল বুঝছো আমায়।
নিলা- না আমি একদম ভুল বুঝছি না। আমি আর পারছি না। বিশ্বাস করো তোমার এই ব্যবহার আমি আর নিতে পারছি না। তুমি যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমাকে মুক্তি দিয়ে যাও।
রুদ্র- পাগল হয়ে গেলে নাকি? কি সব ফালতু বলছো!
নিলা- আমি ফালতু বলছি না। আমি ডিভোর্স চাই। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তুমি যেখানে খুশি যাও।
রুদ্র নিলার পাশে গিয়ে হাতটা ধরলো।
নিলা - এই আমায় ছোঁবে না তুমি। দূরে থাকো আমার থেকে।
রুদ্র- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দূরেই আছি। কিন্তু ডিভোর্সের কথা বলবে না প্লিজ। তুমি আমায় ভুল বুঝছো ।
নিলা- 'আমি আর কিছু শুনতে চাই না। আমি কাল বাড়ি চলে যাবো। '
এই বলে নিলা খাটের উপর থেকে বালিশ টা নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এল।
রুদ্র- নিলা, এই নিলা,, শোনো আমার কথা। নিলা,,,,,
নিলা কোনো কথায় শুনলো না। ড্রইংরুমে এসে মেঝেতে শুয়ে পরলো। নিলার চোখে ঘুম নেই। শুধুই কাঁদছে।
রাত বারো টা। রুদ্র নিলার কাছে এল।
নিলা- তুমি এখানে কেন? আমাকে একদম ছোঁবে না। যাও এখান থেকে তুমি।
রুদ্র - আচ্ছা আমি চলে যাবো কিন্তু তোমাকে কিছু দেখানোর আছে। দেখিয়ে চলে যাবো।
নিলা- না আমি কিছু দেখবো না। যাও তুমি।
রুদ্র- দেখবে না মানে কি। দেখতে তো তোমাকে হবেই।
এই কথা বলে জোর করে রুদ্র নিলাকে কোলে তুলে নিল।
নিলা- এই ছাড়ো বলছি আমায়। ছাড়ো।
রুদ্র- না ছাড়বো না। একদম চুপ থাকো।
এরপর রুদ্র নিলাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে গেল। নিলা রুমে গিয়ে দেখে। মিটমিট করে চারদিকে আলো জ্বলছে। বিছানাটা গোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে সাজানো। আর টেবিলের উপর কি সুন্দর একখানা কেক । অবশ্য কেক টা একদমই ছোটো, কিন্তু যে সুন্দর ভাবে কেকটা কে সাজানো হয়েছে, সেটা অনেক বড়ো কেক কেও হার মানায়।
নিলা তো এইসব দেখে অবাক। কিছুই বুঝতে পারছে না।
রুদ্র- শুভ বিবাহবার্ষিকী আমার মিষ্টি সোনা।
নিলার চোখ দিয়ে জল পরছে। কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না।
রুদ্র- এই পাগলি বউ আমার কাঁদছো কেন। আজ আমাদের বিয়ের তিন বছর পূরণ হল। ভুলে গেলে?
নিলা চুপ করে আছে। শুধু চোখ দিয়ে জল পরছে।
রুদ্র- এইবার কান্না বন্ধ করো। আর তোমার মনে যত প্রশ্ন আছে আমি সব উত্তর দেবো। আগে কেক টা কাটি চলো।
এরপর নিলা আর রুদ্র মিলে কেক টা কাটলো।
রুদ্র- নিলা চোখ বন্ধ করো।
নিলা- কেন?
রুদ্র- আরে বাবা চোখ টা বন্ধ করোই না । একটা সারপ্রাইজ আছে।
নিলা - কী সারপ্রাইজ?
রুদ্র- আগে চোখ বন্ধ করো, তারপর সারপ্রাইজ।
নিলা চোখ বন্ধ করলো।
রুদ্র তার পকেট থেকে কি যেন একটা বের করলো।
রুদ্র- এইবার চোখ খোলো ।
নিলা চোখ খোলে দেখে হাঁটু গেড়ে রুদ্র বসে আছে আর তার হাতে একটা হিরের আংটি। এইসব দেখে নিলা কাঁদছে । রুদ্র নিলার হাত ধরে আংটি টা পরিয়ে দিল। এবং নিলার হাতে একটা চুমু দিল।
নিলা রুদ্র কে জড়িয়ে ধরে।
নিলা- আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও ।
রুদ্র- এই পাগলি আজকে এত সুন্দর রাতটা কি কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দেবে! অবশ্য তুমি কিন্তু আমাকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানালে না।
নিলা- শুভ বিবাহবার্ষিকী আমার পাগল বর।
রুদ্র- আচ্ছা আমি বুঝি পাগল? পাগলামি তো তুমি করেছো । আর পাগল বলছো আমায়।
নিলা- আমাকে ক্ষমা করে দাও । সরি ।
রুদ্র- আরে হয়েছে বাবা চুপ করো তো এইবার।
নিলা- আচ্ছা আমাকে এইবার সবকিছু বলবে।
রুদ্র- কি বলবো তোমায়। এই কয়েকটা দিন অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কিছু করার ছিল না। তোমার মনে আছে, বিয়ের আগে একদিন কথায় কথায় তুমি আমাকে বলেছিলে , তোমাকে একটা হিরের আংটি দিতে।
নিলা- আমি এখন একদম সিউর তুমি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছো। তুমিও ভালো করে জানো ওইদিন আমাদের সব বন্ধুদের মাঝে মজা করতে করতে বলেছিলাম তোমায়।
রুদ্র- আমি জানি তুমি মজা করেছিলে। কিন্তু আমারও ইচ্ছে হয় নিজের বউ কে ভালো একটা উপহার দিতে। আর বিয়ের আগেও কোনোদিন তুমি আমার কাছে কিছু চাও নি। এমনকি বিয়ের পরেও একটা শাড়ি পর্যন্ত আমার কাছে চাইলে না তুমি।
নিলা- চাওয়ার কি আছে। তুমি তো না চাইতেই আমার মনের কথা বুঝে নাও। কিছু বলার আগেই আমার জিনিস আমার সামনে থাকে।
রুদ্র- আচ্ছা এখন কত ঢং। একটু আগে ডিভোর্স চাই ডিভোর্স চাই, মুক্তি চাই বলে চেঁচিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছিলে। আর এখন কি রোমান্টিক।
নিলা - এই আন্দোলন এখনও শেষ হয়নি। আগে বলো মাঝরাতে মোবাইলে কার সাথে কথা বলছিলে।
রুদ্র - তোমার কপাল। আমি মাঝরাতে কারোর সাথে কথা বলিনি , বুঝেছো !
বিয়ের আগে তোমার মুখ থেকে হিরের আংটির কথা শুনে ভেবেছিলাম বিয়ের পর দেবো। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি দুটো সংসার চালাতে আমি এইভাবে হিমসিম খাবো। এরমধ্যে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। আর ছোট ভাই কে হাত খরচের জন্য কিছু টাকা দিতে হয়। আবার এইদিকে আমাদের সংসার। সবই তো তুমি জানো। এইসব কিছুর পর হাতে যা টাকা থাকে সেটা জমিয়ে তোমার জন্য আংটি কিনতে কিনতে আমি তো বুড়ো হয়ে যাবে। আর এইবার তোমার জন্মদিনেও কিছু দিতে পারিনি । আর তুমি একটা সুতো পর্যন্ত চাইলে না আমার কাছে। তখনই আমি মনে মনে ঠিক করলাম এইবার আমাদের বিবাহবার্ষিকী তে তোমায় আমি হিরের আংটি দেবো।
একদিন অফিসে কাজ করছিলাম। তখন হঠাৎ স্যার আমাকে ডাকলো। ডেকে বলল নতুন একটা প্রজেক্ট এসেছে। এই প্রজেক্ট টা একমাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। আর এরজন্য অফিস থেকে আমার সেলারির পাশে এক্সট্রা টাকা দেবে। কিন্তু দিন, রাত পরিশ্রম করতে হবে। আমি কিছু না বুঝে রাজি হয়ে গেলাম। ভাবলাম একমাস পর আমাদের বিবাহবার্ষিকী। তার মাঝে টাকা জমিয়ে তোমার জন্য আংটি ও কিনতে পারবো। তাই আমি ওভারটাইম কাজ করা শুরু করি। সকালে তাড়াতাড়ি চলে যাই রাতে ওভারটাইম কাজ করে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। এই প্রজেক্টের জন্য রবিবারেও আমার এক্সট্রা কাজ করতে হয়েছে। আর সারাদিন কাজের জন্য তোমার আংটি টা সিলেক্ট করতে পারি না। তাই রাতে বসে বসে দেখি কোন আংটি টা তোমার জন্য বেস্ট হবে।আর মাঝরাতে আমাকে যে মোবাইল ঘাটতে দেখতে ওইটা আমি আমাদের প্রজেক্টের প্ল্যান টা দেখতাম। ল্যাপটপে দেখলে তোমার যদি ঘুম ভেঙে যায় ।
কিন্তু এইসবের মাঝে তোমার প্রতি আমি খেয়াল রাখতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো ।
নিলা - তুমি ক্ষমা চাইছো কেন? ক্ষমাপ্রার্থী তো আমি। জীবনেও যাকে সন্দেহ করিনি আজ তার প্রতি সন্দেহ কেন যে মনে এল । ক্ষমা করে দাও আমায় ।
রুদ্র- আচ্ছা, আমার মিষ্টি বউ হয়েছে । আর তাছাড়া তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম হয়তো আমিও এমনই ভাবতাম। আসলে আমার ছোট্ট সংসার টা কে যেভাবে তুমি সাজিয়েছো, তাই তোমার জন্য ভালো একটা উপহার কিনবো ভেবে ভেবে তোমার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। খেয়ালও রাখতে পারিনি নি তোমায়। কিন্তু এখন একদম পুরোপুরি খেয়াল রাখবো।
নিলা- আচ্ছা তাই বুঝি?
কিন্তু আমার একটা কথা আছে।
রুদ্র- আবার কি কথা! সবই তো বললাম।
নিলা- তুমি কখন এত সুন্দর করে সবকিছু সাজিয়েছো? সারাক্ষণ তো আমিই ছিলাম তোমার সাথে।
রুদ্র- এই যে মুক্তি চাই মুক্তি চাই আন্দোলন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে। তখন সাজিয়েছি। কেক টা বড়ো আনতে পারিনি। এতক্ষণ রাখবো কোথায়। তাই ছোট্ট একটা কেক আনলাম।
এই কথা শোনার পর নিলা রুদ্র কে জড়িয়ে ধরলো।
রুদ্র- আজ রাত টা কি এইভাবে জড়িয়ে ধরেই কাটিয়ে দেবে নাকি।
নিলা- আচ্ছা তো আমার মিষ্টি বরের কি চাই শুনি।
রুদ্র- একটা চুমু তো দিতে পারো? এমনিতে বিবাহবার্ষিকী তে ভালো ভাবে শুভেচ্ছাও জানালে না। আর এখন একটা চুমু ও দিচ্ছ না।
নিলা - ওঃ আমার বরের চুমু লাগবে?
এইকথা বলার পর রুদ্র নিলা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
নিলা - এই ছাড়ো বলছি ধরবে না আমায় ।
রুদ্র - আমার বউ কে আমি ধরেছি। তোমার কি?
এই বলে রুদ্র নিলার কপালে একটা চুমু দিল। নিলার চোখ বন্ধ।
রুদ্র- চোখ টা বন্ধ করলে কেন?
এখন আমার চুমু টা কোথায়।
নিলা রুদ্র কে গালে আলতো করে একটা চুমু দিল।
রুদ্র- আমি এখনও বাচ্চা তো। গালে চুমু দিয়েছো বাচ্চাদের মতো।
নিলা - হে তুমি বাচ্চাই ।
রুদ্র - তবে রে,, এইদিকে এসো দেখাচ্ছি , আমি যে বাচ্চা।
এই বলে রুদ্র নিলার হাতে ধরলো
নিলা আস্তে আস্তে রুদ্র দিকে এগোতে থাকে। নিলার কোমল ঠোঁট রুদ্রর ঠোঁটে আলতো করে স্পর্শ করলো।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা রাত। মনে হচ্ছিল পূর্ণিমার জোৎস্নায় প্রকৃতিও যেন নিলা আর রুদ্রের মতো প্রেমলিলায় মগ্ন হয়ে উঠলো।
No comments:
Post a Comment