Friday, July 30, 2021

সজীব পাল

এখানে মৃত্যু আমার
------------------------------


সূর্যটা অস্ত গেলেই বুকটা কেমন যেন স্বজন হারানোর শোকের মতন কাতর হয়ে আসে আজকাল। শুষ্ক বুকে একটা মৃদু বাতাস বয়ে চলে দীর্ঘক্ষণ। আর এই বাতাসে মিশে আছে কত গোপন অসুখ। প্রতিদিনের অসুখের ভেতর বেঁচে আছি কিনা মরে গেছি, তা নিয়ে দারুণ দ্বিধায় আছি। 

গতকাল সন্ধ্যায় ছাদের উপর বসে ছিলাম বন্ধু সুশীলের সাথে। বলে রাখি আমাদের বাড়ির ছাদ নয়, সুশীলের বাড়ির ছাদ। জয় গোস্বামীর ভাষায় বললে, আমি হলাম নুনে ভাতের মানুষ। মাথা গোজার মতো একটা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর থাকলেও বৃষ্টি বাদলের দিন বড্ড কষ্ট দেয়। 
ছাদ থেকে সুধাংশুবাবুর উঠানের মৃত জাম গাছটা দেখা যায়। আজ প্রায় গাছটা এক বছরের মতো এইভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে। কিসের জোরে এমন দাঁড়িয়ে আছে বুঝি না। মানুষের মতো গাছও বোধহয় মায়ার দাস। মাটির মায়া গাছ ছেড়েছে, কিন্তু গাছের মায়া মাটি ছাড়েনি। এই পৃথিবী যাকে একবার আপন করেছে তাকে কাঁদিয়েছে বহুবার। আর এই কান্নার মাঝেই 'মায়া' নামক জঘন্য সুন্দর শব্দটি জড়িত।
আমি সুশীলকে বললাম, "আচ্ছা সুশীল সুধাংশু জ্যাঠু গাছটা কাটছে না কেনরে ? "

" কিভাবে কাটবে! "

" কিভাবে কাটবে মানে, করাতিদের টাকা দিলে তো একদিনেই কেটে দেয়! "

" সেটাই তো। জানিস গতরোববারে বাবা জ্যাঠুকে বাজার করে দিয়েছে! "

" কেন? কেন ?ওনার ছেলে না বিদেশ থাকে? "

 ওইদিন সুশীলের মুখে কথাটা শোনার পর আমার হৃদয়ের প্রতিটা রক্তনালী যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছি ওইদিন। সারারাত এতটুকু ঘুম হয়নি। সংসার জুড়ে বিস্তৃত সহস্র দুঃখের খরস্রোত। এই স্রোতে যে পড়েছে সে পেয়েছে সমস্ত জীবন জুড়ে কেবল যন্ত্রণা। 
সুধাংশুবাবুর ছেলে শিবম বিদেশে কঠিন রোগে ভুগছিলেন, কিন্তু বাড়িতে জানায়নি। শুধু বাবা না খেয়ে মরবে বলে রোগ নিয়ে পরিশ্রম করেছে অক্লান্ত। 

আহারে সন্তান, বাবাকে দুবেলা যদি ক্ষুধায় রেখে নিজের চিকিৎসা করাতো আজ এই শেষকালে লোকটা দুবেলা ভাত খেয়ে মরতে পারতো। এবং সন্তান শোকে প্রতিদিন বুক ভাঙতো না। কে জানবে সন্তান হারানোর বেদনা যে কত কঠিন! 

  রাতের খাবার খেয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট ধরালাম। সুশীল সিগারেট খায় না। কিন্তু জোড় করলে বারণ করে না। যাক, আজকে আর টান দিতে বলিনি। কে জানে মনে মনে খুঁজছে কি না। 
আচ্ছা সুশীলের সম্পর্কে একটু বলে নিই।সুশীল একজন পুলিশের লোক। আমার সব বন্ধুরা প্রায় বিজনেস করে দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। কারোর সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। সুশীলই একমাত্র বন্ধুত্বের মায়া ছাড়তে পারেনি। সে অন্যদের মতো ভুলে গেলে আমাকে না খেয়েই মরতে হতো। সে আমাকে একজন দক্ষ বেকার বলে। কেন বলে তা জানি না। আমি কোনোদিন সফল নামক বস্তুটির স্পর্শ পাইনি। সারাটা জীবন অন্যের উপর নির্ভর করে চলেছি। 

শহরাঞ্চলে রাত্রি যত গভীর হয় নিজেকে তত খুঁজে পাওয়া যায়। নিস্তব্ধ গাঢ় অন্ধকার জানে কোন মানুষটা বিষাদ নদীর মাঝি। 

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত হেঁটেছি। আর খুঁজে গেছি এই আমাকেই। সাদাত হোসাইন কি এই রাতকেই বলেছে, " আমাকে হারাতে দিলে নিখুঁজ বিজ্ঞপ্তিতে চেয়ে যাবে তোমার শহর। " যাই হোক আজকাল মানুষ বড্ড একা হয়ে যাচ্ছে। 

সুশীলের বাড়ি থেকে ফেরার পথে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেদিন। পাঠকদের সেটা না বললে জীবনের একটা বড় অংশ বাদ পড়ে যাবে। 
সোনামুড়া আমার বাড়ি। মানুষ যখন বিষাক্ত হয়ে যায় তখন সে নীল রূপ ধারণ করে। আমিও সে-ই বিষাক্ত মানুষ, তাই নিজেই নাম দিয়েছি নীল। হ্যা আমার নাম নীল , নীলদ্বীপ কুমার। 
বিশালগড় পেড়িয়ে একে একে সমস্ত প্যাসেঞ্জার নেমে যাচ্ছে। মিনিট কয়েকের  মধ্যে সমস্ত বাস শূন্য। শুধু আমি একা। হঠাৎ যুক্তিহীন ভয় গ্রাস করলো আমার জ্ঞানহীন মস্তিষ্ককে। 
মনে হলো যেন ড্রাইভার পর্যন্ত নেই। জানি পাঠক আমাকে পাগল ভাবছে। কিন্তু এমনটাই হয়েছে আমার সাথে। পৃথিবীর কিছু ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। শুধু প্রত্যক্ষ ব্যক্তি ছাড়া কেউর কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। 
সময় সম্ভবত রাত নয়টার কাছাকাছি। আমি অজ্ঞাত ভাবেই বললাম, কেউ লাইটটা একটু জ্বালান  প্লিজ। অনেকবার বললাম কিন্তু কেউ জ্বালায়নি। আরো মিনিট কয়েক পরে, আমার সামনে রোগা পাতলা মতো একজন তরুন দাঁড়িয়ে। আমি স্পষ্ট চিনতে পারলাম। এই সুধাংশুবাবুর ছেলে। আমার সমস্ত শরীর শিহরণ দিয়ে উঠলো। যার অনেক আগেই মৃত্যু হয়ে গেছে সে কেন ফিরে আসবে এখন! 

তরুণটি মৃদু ভারি কণ্ঠে বললেন, " নীল, আমাকে চিনতে পারছো? "

আমার কপালে ঘাম। শরীর কাঁপছে। বললাম, " আপনে তো মরে গেছেন! "

" হ্যাঁ মরে গেছি! কিন্তু বাবার জন্য ফিরে এসেছি। বাবা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, ভীষণ! আপনে আমার বাবাকে একা ফেলে চলে এসেছেন? বাবাকে বাঁচান, প্লিজ বাঁচান বাবাকে! "

আমার চোখ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। কণ্ঠ ও তরুণটি পলকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আর আমার অবচেতন মন আমাকে বলে যাচ্ছে, ' বাবাদের বাঁচাও। বাবারা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে! "
                                 

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...