Friday, September 30, 2022

ড. সমীর ভাদুরী

মা আসার আগেই মা চলে গেলেন
................................................
                        
শিউলি বিছানো পথে এসেছে শরৎ। শরৎ মানেই মায়ের আগমনী বার্তা। প্রতি বছর এই কয়েকটা দিনের অপেক্ষায় দিন কাটে। মা আসবে আনন্দের ধারা চারিদিকে। সবাই সবার মতো করে এই কয়েকটা দিন আনন্দ উৎসবে মেতে থাকেন। আমারো প্রতিটি বছর আনন্দেই কাটতো। তবে এই প্রথম পুজো যেখানে আমার আনন্দের ছন্দপতন। আজ বিরাট শূন্যতা এক মা হারা গৃহে। গত পাঁচ মার্চ আমার অরুণাচল প্রদেশের কর্মক্ষেত্রে আমার বাবা মায়ের প্রথম পদার্পণ। আনন্দে গল্পে হাসি খুশিতে প্রমোদ ভ্রমনে সময়  কি করে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না!! পহেলা বৈশাখ,তারপর মায়ের জন্মদিন সব আনন্দ সময় কেটেছে আমাদের সুন্দরভাবে।শ্রী শ্রী দাদামণি ত্রিপুরা ভ্রমনে আসবেন তাই বাড়িতে আসতেই হবে। তবে মা কথা দিয়েছিলো আমরা যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি আসবো আমাদের সঙ্গে আবার আসবে। এতোটা ঠিক ছিল,বাড়িতে আসার কয়েকদিন পর এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমে আসে আমাদের পরিবারের উপর । গত ২৯ এপ্রিল রাত্রি বেলা মায়ের ব্রেন স্ট্রোক হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে উদয়পুর হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসক, নার্স এবং পরিবারের সবার অনেক চেষ্টার পর ও অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই দেখে জি বি পি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ও চিকিৎসক, নার্স  বিশেষ করে আমাদের গুরু ভ্রাতা সঞ্জয় দার (নার্স )আপ্রাণ চেষ্টা সহযোগিতা সব ব্যর্থ করে আমার মা গত ১লা মে আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে গেছেন। "মা " এই পবিত্র শব্দের ব্যাখ্যা করার মতো শব্দ আমার কাছে নেই। আমার মা মানেই একটা মিষ্টি মাখা পবিত্র অমলিন প্রাণ খোলা হাসি। যেই হাসি সব ভুলিয়ে দেয়।আমার সেই ছোটবেলা থেকেই সকাল বেলা ঘুম ভাঙতো  গুন গুন রবীন্দ্র গানের সুরে, কখনো বা হে মোর চিত্ত, পুন্য তীর্থে জাগোরে ধীরে আবৃত্তি আবহে, কখনো বা কান্ডারী হুশিয়ার বা কোনো ব্রতচারী গান আরো কতো কী!!গানের জগতে প্রবেশ মায়ের হাত ধরেই। কতো প্রোগ্রামে নিয়ে যেতো ছোটবেলায় গানের পরীক্ষায় নিয়ে যেতো।রান্না ঘরে রান্না করতেন আমি আর দিদি চট বিছিয়ে বসে বসে পড়তাম।ছোটবেলা থেকেই মা যখন ঠাকুর পুজো দেওয়ার সময় গীতা পাঠ করতেন মায়ের কণ্ঠে শুনে শুনে গীতার শ্লোক মুখস্থ হয়ে যেতো মায়ের সঙ্গে বসে বসে শ্লোক বলতে থাকতাম তার বিনিময়ে মায়ের স্নেহের হাত মাথা বুলিয়ে দিতো। আমার মা খুব ভালো খেলতেন চন্দ্রপুর স্কুলে পড়াকালীন অনেক খেলাতে অংশগ্রহণ করতেন একবার ন্যাশনালে খেলার সুযোগ পেয়ে ও পারিবারিক বাঁধার কারণে যেতে পারেন নি। রকমারি হাতের কাজ জানতেন। আমার আর দিদির শীতের পোশাক সব নিজের হাতে বানিয়ে আমাদের উপহার দিতেন। রাখি বন্ধনের সময় আমার রাখি কিনতে হতোনা মা নিজের হাতে উল দিয়ে রাখি বানিয়ে দিতেন।ঘরের সাজ সজ্জা থেকে শুরু করে ডোর ম্যাট টা পর্যন্ত নিজের হাতে বানানো। সব স্মৃতি ঘরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে।সব কিছুতেই মায়ের ছোঁয়া।শুধু মা নেই।আমার মায়ের হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। আমার সব নোট দিদির সব নোট রাত জেগে বসে বসে লিখতেন। বাংলা রচনা প্রবন্ধ খুব সুন্দর করে লিখে দিতেন।মায়ের কাছে পড়া শিখে বলা বা লেখা আমার এক অভ্যাস ছিল নয়তো মনে হতো পড়াটা ঠিক হয়নি।অনেক ছেলে মেয়েকে মা পড়িয়েছেন কখনো পারিশ্রমিক নেয়নি ।মা বলতেন ভোর বেলা উঠে পড়া খুব ভালো তাই ভোর বেলা জাগিয়ে দিতেন পড়ার জন্য।আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম আমাদের গ্রামের সব বন্ধুরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম আবার ছুটি হলে একসঙ্গে আসতাম। কখনোই মা বাবারা বিশেষ দরকার বা কারণ ছাড়া যেতেন না। স্কুলের দিদিমনি স্যার রা সবসময় ই বলতেন মা যেনো একদিন স্কুলে আসেন। অনেকের মা স্কুলে যেতো কিন্তু আমার মা কখনোই যেতোনা তাই বলে আমার একটু অভিমান হতো মায়ের উপর। তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষাতে প্রথম হয়েছিলাম সেদিন আমার মা স্কুলে গিয়েছিলো আমি জানতাম না মা আসবে। হঠাৎ দেখে ভীষণ আনন্দে মা কে জড়িয়ে ধরি। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রামের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা ও জড়িয়ে ধরে মাকে। মা সবার মাথায় সমান ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। সবাই এই দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তারা ও মায়ের কাছে পড়তো। সব দিদিমনি স্যার এই দৃশ্য দেখে মায়ের প্রতি আরো শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।আমার মায়ের একটা প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল কোথাও কখনো বিশেষ করে মেয়েদের উপর কোনো নির্যাতন দেখলে প্রতিবাদ করতেন।বাড়িতে নিজের হাতে লাগানো ফুল গাছ, লাউ গাছ, বেগুন গাছ, আরো কতো গাছ সবাই যেনো কাঁদছে মায়ের জন্য। শ্রী শ্রী বাবামনির লিখিত গ্রন্থ অখণ্ড সংহিতা প্রথম খন্ডের প্রথম পাতা থেকে চতুরবিংশ খন্ডের শেষ পাতা একবার নয় বহুবার পড়া হয়ে গেছে। রামায়ণ অনেকবার পড়া। মহাভারত ছিলোনা ঘরে আমি কলেজে পড়ার সময় ছাত্র পড়িয়ে প্রথম উপার্জনে মহাভারত কিনে দিয়েছিলাম সেই মহাভারত ও কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে।সব সময় পুজো দেওয়ার সময় বলতেন যেনো শাঁখা সিঁদুরে মৃত্যু হয়।বাবাকে সবসময় বলতেন আমি তোমার আগেই যাবো!!সেই কথাই সত্যি হলো।খুব ভালো লুডু খেলতেন হারানো খুব কষ্ট ছিল। বাইশ কবির পদ্মপুরাণ মুখস্থ ছিল।প্রতিদিন পত্রিকা পড়তেন আর কখনো আমার আর্টিকেল প্রকাশিত হলে ফোন করে বলতেন বাবু তোমার লেখাটা খুব সুন্দর হইসে। ফেইসবুকে ও কোনো পোস্ট করলেই বলতো আজ আমি দেখেছি তোমার পোস্ট। ইউটিউবে নানা ধরনের ভিডিও দেখে কতো কিছু জিজ্ঞেস করতো!!আমার মা চাহিদা বিলাসিতা চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে ছিলেন।এক সহজ সরল সুন্দর পবিত্র ঈশ্বরময় জীবন কাটিয়ে গেছেন।সকালে ঘুম থেকে উঠে মা বাবাকে প্রণাম করা মায়ের স্নেহের হাত আশীর্বাদের হাত মাথায় পেলে মনে হতো এ এক রক্ষা কবচ। সেই স্নেহের হাত আর মাথায় উঠবেনা। মা ছাড়া এক মুহূর্ত ভাবা অসম্ভব। মা তোমাকে ছাড়া আমরা কি করে থাকবো!! আমরা কেউ ভালো নেই মা।বিরাট শুন্যতা আজ আমাদের মনে গৃহে সব জায়গায়।আর কখনো মা মাখা গন্ধ পাবোনা,মায়ের আঁচল, মায়ের হাতের কোমল স্পর্শ,মায়ের স্নেহ আদর ভালোবাসা পাবোনা, মায়ের ফোন আসবে না আর কখনো, মায়ের হাতের রান্না, লক্ষী পুজোর স্পেশাল আল্পনা সব স্মৃতি হয়ে গেলো !!এই অভাব কখনো পূরণ হবে না।আমি আর দিদি খুব কষ্টে আছি মা!! বাবা আরো বেশী কষ্টে আছে সুখে দুঃখের জীবন সাথী একজন প্রকৃত বন্ধু হারিয়েছেন ।এইবারের দুর্গা পুজো হবে আমার সেই শৈশব থেকে মায়ের সঙ্গে কাটানো পুজো মুহূর্ত। এইবার না হয় সুন্দর স্মৃতি ভাবনায় পুজো কাটবে আমার। মা তুমি স্বরূপানন্দ ধামে ভালো থেকো। পুনর্জন্ম বলে কিছু যদি থাকে আমার একটাই প্রার্থনা আমি যেনো আবার তোমার সন্তান হিসেবেই আসি তোমাকে আবার মা রূপেই যেনো পাই। পৃথিবীর সব মায়েরা সুস্থ থাকুক ভালো থাকুক এই প্রার্থনা।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...