ঝড়ের পরে
যেন সত্যযুগের কোনো দেবতার এ'যুগে মর্ত্যে অবতরণ। প্রশস্ত কপাল ঘিরে কেশবহুল বৃদ্ধ রংভার, টিকালো নাক, গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, ফর্সা, দীর্ঘদেহী, এমনকি হাত-পায়ের আঙুলগুলিও যেন ঈশ্বর অতিযত্নে তৈরি করেছেন। সত্তরের অধিক বয়সের এক উজ্জ্বল, টানটান ব্যক্তিত্ব। গুরুকুলের প্রধান আচার্য। পরণে সাদা ধুতি, সাদা উত্তরীয়। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী, মিতবাক্ এবং স্পষ্টভাষী। অথচ আশ্রমের এমনকি স্থানীয় মানুষের সমস্যায়ও তিনি সবার পাশে থাকেন। তাই ভয়ে নয়, সবাই ভালোবেসে শ্রদ্ধা করেন মানুষটাকে।
ভোর সাড়ে পাঁচটা। শয়নকক্ষের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে অপলক দৃষ্টি।
গতকাল প্রায় মধ্যরাতে প্রকৃতি শালীনতাবোধ হারিয়েছিল। ঝোড়ো বাতাস চিরে মুষলধারে বৃষ্টি নাকি মুষলধার বৃষ্টি চিরে মনের গতিতে ঝড়...কী ঘটেছিল তা নিয়ে যেন দ্বন্দ্ব লাগে মনে মনে। সাজানো বাগান, সুরেলা পথ, জলতরঙ্গের জলাধার, প্রবল তান্ডবের আঘাতে এফোঁড়ওফোঁড়, তছনছ। কোনো গানের সুর, তাল বা কথার কোনো একটি এলোমেলো হলে যেমনটি হয়! প্রধানাচার্য চিন্তামগ্ন। প্রকৃতি আর নারীমনের বিস্তর সাদৃশ্য আছে বৈকি।
তেইশ বছর আগে যে এসে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেয়েছিল, "আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়..." ফিরে গিয়েছিল কিছু দিন পর এমনই কোনো ঝড়বাদল মাথায় করে। রেখে গেল এক অমলিন ও সুমধুর ঋতুরঙ্গের গীতিআলেখ্য। সেই থেকে কেবল প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা।
গতরাতের প্রকৃতির নাছোড় খামখেয়ালির ছাপ এখনও সর্বত্র সুস্পষ্ট। আকাশ বাতাস এখনও থমথমে। নাহহহ্...আর আসবে না। 'ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়' এ প্রবাদ মাঝে মধ্যে মিথ্যে হলে নিরুপায় হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই মাথা নেড়ে প্রশ্ন করেন, 'ভিন্ন কেউ নাই?'
"কই গো...দোর খোলো!"
মুহূর্ত আগের গুরুগম্ভীর মানুষটির মুখে চকিতে সরল শিশুর মতো বাৎসল্য ফুটে ওঠে। যেন অজান্তে অচেতনে তার মনের মেঘলা আকাশে ফাটল ধরে। আলোকবর্ষ দূরের আলোর তরঙ্গ খেলে সারা অঙ্গে। ছুট্টে গিয়ে নিজেই আশ্রমের দরজা খোলে। দৌড়ে আসে বছর চারেকের ফুটন্ত সূর্যমুখীর কুঁড়ি। ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয়তমর কোলে। আবেগে বিহ্বল, আত্মহারা আর্য কণ্ঠে তখন শব্দের মূর্ছনা...
"আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের 'পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত পাখির গান
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ..."
No comments:
Post a Comment