Sunday, May 29, 2022

অনুপম রায়

একটি শ্মশান বিক্রির গল্প

'দুই নাম্বারি কথাডি না কইলে কিতা সমস্যা হইতো কাকা? টাকাডা তো ফিরত দিবার কথা। না দিয়া উড়াল মারলেন কেরে কাকা? মাইয়াডার বিয়ার লাগি টাকাডা জমাইছিলাম আমরা বৌ -জামাই মিল্লা। আম্নেরে দিলাম ভরসা কইরা। হেই ভরসারে বাঁশ বানাইয়া আমার মাথায় মারলেন ক্যান, পরেশ কাকা?'

কথাগুলো বলতে বলতে রঞ্জিতের চোখ ভিজে গেছে। কোনো এক শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের আইনের বশে চিৎকার করে কাঁদতে পারেনি সেদিন। পথেঘাটে চলার সময় হাসপাতাল কিংবা স্কুলের সামনে লেখা থাকে ১০০ মিটারের মধ্যে উচ্চমাত্রায় শব্দ সৃষ্টি  করবেন না। অথচ রঞ্জিত খোলা আকাশের নীচে বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েও কাঁদতে পারেনি। কাঁদতে না পারাটা রঞ্জিতের মত ছেলেদের একটা ট্রেডমার্ক যা সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে।

পরেশ কাকা রঞ্জিতের একই গ্রামের লোক। শীর্ণ দেহ,শুকনো চেহারা সমেত বড় বড় চোখ নিয়ে কাকা একটা সাম্রাজ্য পেতেছেন সততার। কেউ পরেশ কাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি কোনোদিন। মানুষটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা হয় সকলের। গ্রামের যত ঝামেলা তা মীমাংসা করেন পরেশ কাকা। অথচ পরেশ কাকার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা মরা মাছ ভাঙা নৌকার মত। চলে যাচ্ছে। চলে গেলেই হয়। সেই আশায় রেখেছে জীবনের কাছে। বাড়তি কোনো কিচ্ছু চায়নি কিংবা আবেদন করেনি। ঘরে উনার স্ত্রী আছেন। সন্তান বলতে উনার চাষাবাদের ফসল যা কেটে কেটে বিক্রি করে তারপর পেট চালান। আগেকার সময় অভাবের তাড়নায় সন্তান বিক্রি করে দিত পিতামাতা। সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন এখনকার কৃষকরা। তবে উনার স্ত্রী পতিব্রতা। কোনোদিন পরেশ কাকাকে ফেলে জল ছাড়া কিছুই খেতেন না। সংসারের যত সুখ-দুঃখ প্রোডাক্ট হিসেবে আসত সেগুলো ভাগ করে নিতেন দুজন মিলে।

তবে বিগত ছয়মাস ধরে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে টানাটানি চলছে কাকিমার। কি হয়েছে বুঝতে পারছেন না। দিনে অনেকবার প্রসাব হয়। সবজি কাটার সময় সামান্য কেটে গেলেও সহজে সুস্থ হন না। আমরা সহজেই ভেবে বলে দিতে পারি এসব ডায়াবেটিস রোগীর লক্ষণ। কিন্তু সেসব কাকিমা বোঝেন না। কাকাকেও কিছু বলেন না কখনো। শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাকা কিছু বললেই চুপ করিয়ে দেন। কাজের ঘোরে থাকেন। তার মাঝখানে। জপ করেন সংসার নামের বীজমন্ত্র। সংসার ঘোরে কোনো এক বাউল কবি যদি গান গাইতেন তবে এভাবেই গাইতেন

'সংসারেতে যত জ্বালা,বাকি সবই ফুলের মালা
তবুও সেই মায়া আমায় ছাড়েনা।
হাজার মানুষ এক ঘরেতে,ঘর বাঁধিলাম সংসারেতে
সংসার ভোলা মানুষ সংসার চায়না। 

কতখানে মন চলেছে,কত নদী বাঁধ ভেঙেছে
দেশের জল দেশ ছেড়েছে ভাসানে;
সাজে নবীন সাজে বুড়া,কত কালের কত মরা
সবাই মিলে সংসার ছাড়ি শ্মশানে। 
 
সংসারেতে যত জ্বালা,বাকি সব ফুলের মালা
তবুও সেই মায়া আমার ছাড়েনা।
হাজার মানুষ এক ঘরেতে,ঘর বাঁধিলাম সংসারেতে
সংসার ভোলা মানুষ সংসার চায়না। 

আজও ভুলি কাঁদাকাঁদি,মনজমিতে ঘরটা বাঁধি
সেই ঘরেতে সংসার ডাকি আনমনে;
আন্ধারে ডুবে যাবো,প্রভু তোমায় কবে পাবো?
তুমি দিলে সংসার আমায় কোন মনে?

সংসারেতে যত জ্বালা,বাকি সব ফুলের মালা
তবুও সেই মায়া আমার ছাড়েনা
হাজার মানুষ এক ঘরেতে,ঘর বাঁধিলাম সংসারেতে
সংসার ভোলা মানুষ সংসার চায়না। '


একদিন হঠাৎ করেই কাকিমা খুব অসুস্থ হয়ে যান। হাঁটতে লাগলেই ভেঙে যায় তার শরীর। অবস্থার অবনতি দেখে কাকা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন টাকাকড়ি ছাড়া। কাকা সম্ভবত জানতেন না এসব কাগজ ছাড়া কাগজও পাওয়া যায়না। হাসপাতালে পৌঁছে টাকার জন্য রঞ্জিতকে খবর দিলেন কাকা। রঞ্জিতকে কাকা সন্তান ভাবেন। রঞ্জিতের মা বাবা নেই। মা বাবার চেহারাও মনে নেই। আয়নায় নিজেকে দেখে মনে করে এটাই তার বাবা-মা'র ফেলে যাওয়া একমাত্র স্মৃতি। পরেশ কাকার কথা রঞ্জিত কখনো অমান্য করেনা। রঞ্জিতের ঘরে তখন ষোলটি হাজার টাকা আছে। ঘরের আরেকটি কোণে একটি মেয়ে আছে বিবাহযোগ্যা। বিবাহের কারণে এই টাকা ঘরের ভেতর আজ অনেকবছর ধরে সুরক্ষিত। সেই টাকা এনে কাকাকে দিলেন। চিকিৎসা হল যতটুকু করা গেল। কাকা বললেন টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দেবেন তাড়াতাড়ি।একদিন খুব ভোরে কাকা খুব জোরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। আমাদের মধ্যে সবার জানাজানি হয়ে গেল কাকিমা সেরে গেছেন। কাকিমার শেষ কাজের জন্য সব ব্যবস্থা হল। বন্দোবস্ত হল শ্মশানের স্থান। বটগাছের পাশে। অনেক পুরোনো গাছ। এই বটগাছ আজ কতবছর ধরে মৃত্যু দেখে যাচ্ছে কেউ জানেনা। তার পাতায় পাতায় হিসাব লেখা আছে যা কেউ পড়তে পারেনা। কাকিমা সবসময় কাকাকে বলতেন বিয়ে করে আমি যেমন তোমার ঘাড়ে চড়েছি, ভূত হয়েও আমি তোমার ঘাড়ে চড়বো। সেই ভূত সম্ভবত কাকিমার নিথর দেহ যা চারজনের কাঁধের উপরে; হরিবোল হরিবোল করে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে। এই দেহের ভেতরে কোনো প্রাণ নাই, স্পর্শকাতর অনুভব নাই,ডাকাডাকি নাই, কাপড় টেনে শরীর ঢাকার কোনো আকাঙ্খা নাই সেই বেঁচে থাকার মত। এসব ভাবলেই ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। মনে হয় দুঃখ সমেত ট্রেন চলে যায় এই প্ল্যাটফর্ম থেকে আরেক প্ল্যাটফর্মে। 

সময় নিয়ে সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ হল। কাকা বসে আছেন কাকিমার আগুনের পাশে। সংসারের শেষ উত্তাপটুকু কুড়িয়ে নিচ্ছেন বুকে। দুঃখ কাঁধে করে যে যার যার ঘরে চলে গেলেন।
পরেরদিন সকালে আবার শ্মশানে গেল গ্রামের লোকজন । চারিদিকে কেমন একটা ভারী বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে তখন।সাথে রঞ্জিতও গেল। আজকেও একটি নতুন শরীর পোড়ানো হবে। পোড়ানো হবে তার শরীর নামের চিহ্ন। বটগাছের নীচে রঞ্জিত নীরবতা নিয়ে বসে থাকল। আকাশকে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পেলনা।পরেশ কাকা নামের মানুষটা চলে গেল সাথে ষোলো হাজার টাকার সাথে আয়োজনমত বিয়ে দেওয়ার স্বপ্নটাও। গ্রামের লোকজন মিলে পরেশ কাকার শেষকৃত্য সম্পূর্ণ করল। দুঃখের মত নিত্য সঙ্গী আর পরেশ কাকার স্মৃতি নিয়ে রঞ্জিত ছাড়া বাকিরা যার যার মত করে রওনা হল। চিতার ধোঁয়া আকাশের বুকে নকশা করে হারিয়ে গেল পরেশ কাকার মত।

'একলা একটি বটগাছ,একটি খোলা আকাশ, দুই দুইটি সদ্যোজাত চিতা, চিতার প্রতি অজস্র অভিযোগ নিয়ে পাশে বসে থাকা রঞ্জিত' দৃশ্যটি স্বয়ং ঈশ্বরের কাছেও বেদনাদায়ক।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...