আলমগীর মাসুদের দুটি অণুগল্প
১. দোজখের দারুণ হিসাব
আমার সকল প্রার্থনার ফল আমার মায়ের জন্য। মা যেনো পায়—আমার সোয়াব সবটুকু। একদিন সকাল সকাল এক জোড়া কানের দুল আমি খোলে নিয়েছি মায়ের! বিধবা মা’কে আরেকবার আমি আমার চোখ দিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ এবার দেখলাম, মায়ের কান দুটি দারুণ শূন্য শূন্য!
আমি জানি বিশ্বাস শব্দটা দারুণ অসত্য বর্তমান পৃথিবীর ঘরে। তবু আমি সত্যি দেখেছি, মায়ের কানে আঙুল রাখতেই আমার বুক আর কলিজা কেঁপেছিলো সেদিন। পাছে বিধবা মা’কে একবারও আন্দাজ করতে দিইনি আমার—মুহূর্তের সে মিথ্যা অভিনয়। মাথা নুয়ে আসলেও বাবার কাছেই শিখেছি, নারীদের সামনে পুরুষকে সবসময় সিংহের চরিত্রে থাকতে হয়! অথচ অপরাধের ঘ্রাণ ঢাকতে ঢাকনা হিসেবে ওইদুটি ধুল-ই সেদিন সিংহ হয়েছিলো আমার। আর আমি ছিলাম মায়ের সামনে সামান্য একটি বিড়াল।
বাবার কাছে সিংহের চরিত্র শিখলেও মা’কে কিছুই দিইনি কখনো। তবে দারুণ আশ্চর্য তিনটি মনেরাখার স্মৃতি পুষে রেখেছি। যেমন, পৃথিবীতে আমাকে আনতে দেহের সঙ্গে লড়াই! আমার মুখে একদিন মাগি শব্দটি শোনা! আর হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার গায়ের কাপড়টার মতো কানদুটিকেও আমি সাদা করে দিয়েছি মায়ের!
আমি জানি, আমার প্রার্থনার ফল এজীবনে অর্ধেকও জমা হয়নি। আমি জানি, সোয়াবের পূর্ণকাজ আমার এখনও শুরুই হয়নি। আমি নিশ্চিত, একাল পরকাল কোনোকালেই আমি মায়ের কাজে আসিনি! অতএব আমার শেষ প্রার্থনা, ঈশ্বর যেনো আমাকে দোজখের বাসিন্দা বানায়। আর আমার মা’কে রাখুক বেহেস্তে।
২. রামঠাকুর আশ্রমে একদিন
প্রেমটা এক বা দুই বছরের বেশি কখনোই টিকে না আমার। বলা যায়, আমিই রাখি না। ১২ সালের শুরুর দিকে সায়েরা নামের এক টেনে পড়ুয়া মেয়ের সাথে আমার প্রেম হয়। আবেগী মেয়েটার সবকিছুই আমার ভালো লাগতো। শুধু ভালো লাগতো না, কথায় কথায় সেভ করার তাগিদটা।
সরকারি নামকরণ এক শহীদ সড়কের গোলচত্বরে আমাকে দাঁড় করিয়ে হাতে গুঁজে দেয়, পাঁচ শ টাকার একটি মুজিবমার্কা নোট। বললাম, 'এটা কেনো?'
সায়েরা হুকুম দিয়েই জানান দিলো, 'বিকালে দেখা করবা রামঠাকুর আশ্রমের ফুলবাগানটিতে।' সাথে আরো বলে দিলো সে, 'সেলুন থেকে মুখ পরিস্কার করে আসবা।'
মুজিবমার্কা নোটটি বারকয়েক তাকে সাধলেও নেয়নি! অগত্যা রিকশাওয়ালাকে বললাম, 'মামা যা।'
একটা বিয়ার খেয়ে, শহরের অমরবাবুর দোকান থেকে বাকি টাকার চকলেট নিলাম প্রেমিকার সে টাকায়। ঠাকুরের কৃপায় রামঠাকুর আশ্রমটিতে পুজোর ফুল সবসময় দারুণ ফোটে। আজও বাগানে অনেক ফুলের দেখা। সেভহীন চেহারায় সারার হাতে পেকেটটি দিয়ে বললাম, 'ভালোবাসার মানুষকে গিফট করলে সবার আগে ঠাকুরজি খুশি হয়। তাই এই চকলেটগুলো তোমার জন্য নিয়ে আসলাম।'
চকলেটসহ পেকেটটি মাটিতে ফেলে সারা দ্রুত পায়ে চলে যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে বলেই দিলো, 'তুমি আর আমার সাথে কখনোই যোগাযোগ করবা না।'
'হাহাহা...'
মুহূর্তে রামঠাকুর আশ্রমের মূর্তিটাকে অসহায় শিশুর মতোই মনে হলো আমার। কারণ দেশের বহু মন্দিরে আমার প্রেম খাঁটি হলেও, সেবার-ই প্রথম সায়েরা চলে গেলো কোনো এক পবিত্র স্থান থেকে। আর রামঠাকুর আশ্রমের মূর্তিটা তখনও তাকিয়ে ছিলো— আমার হাসিমাখা মুখের দিকে।
No comments:
Post a Comment