Saturday, December 25, 2021
সম্পাদকীয়
বছরের শেষ সংখ্যা। ভুল, ভ্রান্তি, সংশোধন, সংযোজ প্রতিটি বছরই হয়। এ যাত্রা অনন্তকালের এক শাশ্বত যাত্রা। আমরা উন্নীত হতে হতে উন্নত হই। আমাদের কোনোকিছুর অন্ত নেই।
শেষের শেষদিকে মনন স্রোতের সংখ্যা এটি। ক্ষুদ্র পরিসরে এ আয়োজনের ভুল অনেক ভ্রান্তি কম। এ ছাড়া প্রতিশ্রতি দেওয়ার মতো সম্পাদকের কিছু নেই। মানবতারা জয়ী হোক। মনন স্রোতকে সামাজিক দায়বদ্ধতায় এভাবেই সবাই সহযোগিতা করবন, এই আশা রাখছি। নতুন বছর সবার জীবনে সুখ সমৃদ্ধি ও আনন্দ বয়ে আনুক।
শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা!
বিনম্র
জয় দেবনাথ
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
মনন স্রোত, ত্রিপুরা
Friday, December 24, 2021
সঞ্জয় দত্ত
পরিক্রমণ
প্রতিনিয়ত ঋতুরাজ হেঁসে হেঁসে চলছে,
তাঁর বাহনগুলো ও আমার মন একসাথে হাঁটছে না।
ক্রমশ একাকী হয়ে ভাবছি...
কেন প্রখর তেজ?
কেন বর্ষাবরন অনুষ্ঠান?
কেন এত সাজগোজ?
কেন পূর্বাভাস?
কেন এত কষ্ট!কেন কেঁদে কেঁদে ফেটে পরে ডালিম?
কোকিল কন্ঠি সুরের মুগ্ধতায় কেন হয় চেহারার পরিবর্তন?
আহা!
এরই মাঝে একঝাঁক চিত্রশিল্পী
কতো ছবি এঁকে দিয়ে গেছে আমায়,
এসবের মায়া আমার ক্লান্তিকে মেরে ফেলেছে।
আমি ভীষণভাবে ঋণী তাদের কাছে..
দিপিকা রায়
প্রয়োজন
ক্ষুদার্ত শহরে ঘৃণ্য ডাস্টবিন টা ও
একসময় অমৃত হয়ে ওঠে।
শান্ত শহরে উঁকি দেওয়া
কুড়ি গুলো ছিটানো জঞ্জালে,
স্বপ্ন বুনে।
অভাবের বোঝায় খালি পকেটে,
শুধু লাঞ্ছনার ভিড়।
সুপ্ত চাহিদাগুলো আটকে যায়,
কিছু সময়ের পরিক্রমায়।
বিষন্ন মুখে অবসানের হাসি
ক্ষিদে নিবারনের সামান্য মাত্র।
ভাগ্য বিচারে ললাট রেখা,
হস্তরেখা, ধুলোয় মুছে
আনন্দস্ফুর্তি নর্দমায় বাড়তে থাকে।
শূন্য হস্তে ভিক্ষার ঝুলি,
পান্তায় দিন ফুরায়।
চোখে ঘুম কাটে,
আবারও ভোরের ক্ষুদা নিবারণে।
শুকিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট গাছে,
বাঁচতে চায় কলি গুলো।
অবহেলিত ভিড়ে হাঁটতে চায়,
দিনের শেষে সেই ভালোবাসায়।
সৃজিতা নন্দী
সুখের কোলাহল
একদিন আমার সমস্ত সুখের কোলাহল তোমাকে সঁপে দেব।
বিধ্বংসী ঝড় তৈরি করে দূরত্বের বেড়াজাল,
ফিরে না পাওয়াটা মেনে নিতে হয় সময়ের সাথে সাথে।
শূণ্যতা অধিক কথা বলে।
ভেঙে যাওয়া মানুষের সহ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
আর্তনাদের চিৎকার সে শুনতে পায় না।
একসময়ে সেই মানুষের পূর্ণতা নিজের চোখে দেখি!
পাশে আমি কে মুছে ঘর বেঁধেছে অন্যজনের সাথে।
সরল সুদে হিসেব নিকেশ করে রেখেছি...
একদিন আমার সমস্ত সুখের কোলাহল তোমাকে সঁপে দেব।
পান্থ দাস
পলাশ
ওফ্ আজ আবার সেই সোমবার, আবার সেই একঘেয়েমি জীবন ৷ আমি পলাশ ৷ জীবন ভেলায় ভাসতে ভাসতে অসংখ্য প্রতিকূলতার বাধা অমান্য করে আমি একজন বাধ্য নাবিক ৷ বয়সটা কম হলেও দায়িত্বের ভারটা কম নয় যদিও ৷ কৌশরেই আমার মাথার উপরের বটবৃক্ষটাও আর ছায়া দেয় না ৷ আছি সুখেই তবে, নেই যেন কোন অনুকূলতা ৷ মনের সমুদ্র স্রোত অনবরত উঠা নামা করতেই থাকে ৷
উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্বেও চাকুরি পাওয়ার জন্য এখনো আমি অপেক্ষায় আছি ৷ গৃহশিক্ষকতা করেছি কিছু বছর, তবে মনো সন্তুষ্টি পাইনি খুঁজে ৷ সর্বসন্তুষ্ট পাই একমাত্র মায়ের কাছে আসলে ৷
সত্যিই ২৫ বছর থেকে ৩০ বছর বয়স মানব জীবনের সবচেয়ে অনুভূতিপূর্ণ বয়স, না থাকা যায় সুখে আর না থাকা যায় দুঃখে ৷ অনুভূতিগুলি যেন এখন আর ডানা মেলতে চায় না, সময়ের সাথে সাথে সব অনুভূতি যেন প্রায় নিষ্প্রাণ ৷
ভাগ্যকরে জীবন পথে কিছু মানুষ পেয়েছি, বন্ধু বলে পরিচয় দেইনা তাদের ৷ তাঁরা আসলে বন্ধু রূপে আমার পরিবার ৷ তবে, একাকী ঠিক খেয়া বেয়ে যাচ্ছি হারিয়ে, অনন্য না ভোলা পথের দিশে ৷
মৌসুমি গোয়ালা
পার্বতীয়া তটিনী
পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসে স্রোতস্বিনীরা,
আপন প্রবাহে প্রবাহিণী 'মনু', 'গোমতী',
'ধলাই', 'ফেনী ' কিংবা 'জুরি'।
পার্বত্য ত্রিপুরার অসংখ্য মানুষের নিত্যদিনের
সঙ্গী 'দেও', 'মুহুরী।
কখনও বা উত্তাল তরঙ্গে 'বিজয়' চলেছে সমুজ্জ্বল ধ্বজা বয়ে,
কখনও বা উপনদীর তকমায় তৃপ্ত দূরন্ত 'লঙ্গাই'।
পার্শ্ব সঙ্গিনী সর্পিল পথ ধরে ছুটে চলে 'খোয়াই'।
রাজধানীর মুকুট শতাব্দী প্রাচীন 'হাওড়া'-
সহজ সরল বাহ্যিক আড়ম্বরহীন,
বর্ষারাণীর কোমল সোহাগের নীরব প্রতিক্ষা ক্ষীনকায়ার।
অত:পর কল্লোলিত পর্বতকন্যারা প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ বিমোহিত করে মিশে যায় দয়িতের বুকে।
মোহাজির হুসেইন চৌধুরী
উপেক্ষা
জানিস! এখন আমার জন্য কেউ আর
অপেক্ষা করেনা
আমার যারা --- আগে আমাকে না পেলে
দারুণ মর্মাহত হত তারা
সব 'সময়' হয়ে গেছে
দ্রুত ধাবমান স্রোতস্বিনীর মতো
এখন আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনা
মন খারাপের চিত্র মুখে এঁকে
পাশ কেটে চলে যায়
যেন হাতের নাগালে এলে বিনষ্ট হবে
এক একটি পল মহামুল্যবান।
আমি একা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি
সুনসান রাস্তা একমুঠো ধূলো ছিটিয়ে
ঢেকে রাখে আমার প্রলাপজনিত গান।
গৌতম মজুমদার
ভিক্ষাবৃত্তি
চাইনি কৃষি,চাইনি শিল্প
চাইনি স্বাস্থ্য শিক্ষা,
ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে লয়ে
করছি এখন ভিক্ষা ।
দোরে দোরে ভিক্ষে করে
জুটছেনা আর কিছু,
দারিদ্রতার কড়াল গ্রাসটা
ছুটছে পিছু পিছু।
যার গৃহে যাই বলছে সবাই
"আজকে ফিরে যান",
হাতটা তুলে ঠুকলে কপাল
বুক করে খান খান।
কল কারখানা সবই বন্ধ
নেইকো উৎপাদন,
হন্যে হয়ে ঘুরছে বেকার
চাকরি নেই তেমন।
নেইকো কাজ,নেইকো চাষ
নেইকো ব্যাবসা বানিজ্য,
মুখ খুলে আজ বলছে সবাই
হচ্ছে না আর সহ্য ।
ক্লান্ত দেহে গৃহে ফিরে
হিসেব কষি দিনের,
মিলছেনা আর আগের মত
হচ্ছে পাহাড় ঋণের ।
গঙ্গা সাহা
উপেক্ষা
এখন আর কিছু যায় আসে না,
কে আমায় নিয়ে কি ভাবলো ,
বা কি ভাবছে,
কিংবা কে আমায় গুরুত্ব দিল,
না গুরুত্ব দিলো না।
সে সব আর গায়ে মাখি না।
জীবনটা একান্তই আমার,
আমি কি করবো, কি না করবো,
সেটা একান্তই থাকুক না হয়,
আমার ব্যক্তিগত।
অযথা দুমুখো মানুষের জ্ঞান,
এখন আর সহ্য হয় না।
যাদের মুখে এক আর মনে আরেক।
ওদের কথা শুনলেই কেমন যেন
শরীরে খুব অসস্তি হয়।
তবুও বারংবার মুখোমুখি হতে হয়,
ওই না দেখতে চাওয়া মানুষগুলোরি।
হয়তো এটাই জীবন।
তাইতো এই সব কিছুই উপেক্ষা করে,
এগিয়ে যেতে চাই জীবনের বাকি পথ।
সৈকত মজুমদার
নষ্ট জীবন
আমার অযথা লেখা সব কবিতা
আজ তোমায় উৎসর্গ করলাম
জানি তোমার জীবনে হয়তো
আমার কোনো মূল্য নেই, আর
সব সময় যা চাই তা কখনোই পাই না,
এভাবেই কেটেছে শৈশব থেকে কৈশোর।
তেত্রিশটা বসন্ত পেরিয়ে আজ
আমি একা, একেলা মন
আমার নষ্ট জীবন !!
আলমগীর কবীর
সফলতা যখন বিফল হয়।
হঠাৎ করে কখনো কোনো কিছু পাওয়া যায়না
কিছু পেতে হলে তার পেছনে পরিশ্রম দিতে হয়।
সেই পরিশ্রম অনুযায়ী তুমি কিছু ফলের ভাগীদার হও।
মনে রেখো আজ তুমি যে ফল ভুগ করছো
এটা কখনোই তোমার ছিলনা!
এটা ধারাবাহিক ভাবে আজ তোমার হাতে এসেছে।
তাই তুমি নিজেকে মহান ভাবার কিছু নেই।
হয়তো একদিন সেই একই পক্রিয়ায়
আমিও তোমার থেকে উপরে চলে যেতে পারি।
সফলতায় কখনো শুধু ব্যক্তিগত ভূমিকা থাকেনা।
এর পেছনে তোমার চারপাশে থাকা জরবস্তুুগুলিরও অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে।
তারা চলতে পারেনা, কথা বলতে পারেনা বলে,
তোমার সফলতায় তাদের ভূমিকা নেই ভাবাটা,
তোমার সবচেয়ে বড় বোকামি।
তাই তোমার সফলতার পেছনে যাদের ভূমিকা রয়েছে,
তাদের পাওনাটুকু দিতে পারো বা না পারো-
কিন্তুু কখনো তাদের অবহেলা, বা অপমান করোনা।
সজীব কুমার পাল
স্মৃতির চিঠি
এখন আমার মৃত্যুর মাস চলছে
দীর্ঘ বছর হয় কোনো রোদ্দুরের গন্ধ পাইনি!
বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে জীবন, যে জীবন ছিল আমার।
নীল, তুই কি জানিস
এখন আমি ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন প্রাণী মাত্র?
বন্ধু, মনে আছে
আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমরা শিশু ছিলাম?
আমাদের উঠুন জুড়ে ছিল দোয়েল পাখি ,
সেগুন পাতার ঘর,
ঠাকুরমার শেখানো কাঠাল পাতার কাফ,
এবং মায়ের নামে আমাদের সেই ছোট্ট পুতুল?
মনে আছে তোর নীল,
সেই পতুলটা একদিন খুঁজে না পেয়ে
তুই আর আমি কেমন দিশেহারা হয়েছিলাম?
নীল,
জীবন আমাকে যা দিয়েছে তার ঢের নিয়েছে,
নয়তো আজ দেখ
পতুলটার মতো মা যে কোথায় হারিয়ে গেল!
আমার এখন নিষ্ঠুর মৃত্যুর মাস চলছে নীল, মৃত্যুর মাস।
কৈশোরে শুকনো পাতা সিক্ত করে
যে বসন্ত এসেছিল আমাদের জীবনে,
যে বসন্ত দিয়েছিল উন্মাদনা এবং অশান্তি!
তখন আমরা পেয়েছিলাম তীব্র জঘন্য সুখ।
হ্যাঁ নীল, আমি সেই চঞ্চল বর্ষার কথাই বলছি।
প্রথম তাকে তুই দেখেছিলি মাধবীলতার আড়ালে,
এবং বলেছিলি, 'মেয়েটাকে বেশ মানাবে আমাদের সাথে! '
হ্যাঁ নীল, হ্যাঁ! আমরা এইভাবেই একের ভেতর দুই হারাতাম!
সহজ সরল বালিকাটিও একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল,
তাকে আমরা আর কেউই খুঁজিনি।
এইভাবেই হারাতে হারাতে আমরা বড়ো হলাম ,
বড়ো হতে হতে সব হারালাম।
কিন্তু নীল,
তুই কেন হারালি?
আমার ভাই হারালো, আমার মা হারালো, আমার বাবা হারালো,
শৈশব, কৈশোর সব সব হারালো।
কিন্তু তুই কেন হারালি?
বন্ধু! বন্ধু সে তো আজন্ম সাথী ,
আজ তোর কাছে আমি নেই
কিন্তু আমার কাছে তুই আছিস।
তাইতো গোপনে-নির্জনে লিখছি স্মৃতির চিঠি, স্মৃতির চিঠি।
লিটন শব্দকর
নিবিড়ে ২৯
সাদা চালের গুঁড়োয় কোজাগরী আলপনায়
বকেয়া জাগরণে বহতা স্বত্তার ম্রিয়মাণ নদী
আশ্বিনের ধানের সোনালী রঙ ছুঁয়ে বলেছে
এসো আজ ভাগ করে নিই রোদ শুশ্রূষাটুকু
অপ্রতুল চন্দ্রাভা মাখানো অভিমানের জলে।
তোমার মুঠোফোন আর আমার দুর্গোৎসবে
যখন নদীটির বুকে কোমরে জমেছিল ভ্রান্তি
রিংটোনে জমছিলো আড়চোখ যথেচ্ছাচার,
এখনও আছে নদী শুধু আমরা অন্যরকমই।
অভিজিৎ রায়
মা দুই টাকা দাও
ছোট বেলায় মনে আছে দু টাকার কথা?
স্কুলে যাওয়ার সময় বলতাম
মা দুই টাকা দাও না গো
স্কুলে গেলে আসার সময় লোপ না কেক খাবো।
মা বলতো প্রতিদিন টাকা কোথায় পাবো
তোর বাবা কত কষ্ট করে উপার্জন করছে
আর তুই টাকা নষ্ট করছিস?
দুই টাকার সাথে আর কিছু দিলে চাল আনতে পারবো
সবাই মিলে একসাথে খেতে পারবো।
দেখ তারপর ও তুই যদি বায়না করস টাকা আমি দেবো
না মা লাগবে না আমরা টাকা সবাই মিলে একসাথে ভাত খাবো
আমি লোপ কেক খাব না মা কিছু বল না বাবাকে ।
এমনিতে মিথ্যা কথা বললাম আমি তোমাকে।
চুখের জল এসে যায় এখন
আজ যখন হাতে অনেক টাকা
কিন্ত মায়ের সেই ভালবাসা টুকু
আজ যেন অনেক ফাঁকা
কথায় কথায় বলে তোর মত ছেলে জন্ম দিয়ে ভুল করেছি
একটা মেয়েকে জন্ম দিয়ে শান্তি পেয়েছি।
আজও বুঝলাম না মা আমার প্রতি কেন এমন ব্যাবহার?
হয়তো বা বড় হয়ে উচিৎ কথা বলতে গিয়ে হচ্ছে আমার প্রতি অবিচার।
এখনো মনে পড়ে সেই স্কুলে যাবার সময় বিস্কুটের কথা
বলতে পারি না কাউকে মা লাগে মনে শুধু ব্যাথা।
তবুও প্রার্থানা করি মা ঠাকুরের কাছে
জীবনের শেষ লগ্নে হলেও যেন নিজের ভুল
চুখে ভাসে।
মিঠুন দেবনাথ
জীবন যেন আলেয়া
অজানা এক সপ্নের ভীরে,
গেছি আমি হারিয়ে।
আলো ভেবে করেছি মস্ত বড় ভূল,
আলেয়ার পিছনে হাত বাড়িয়ে।
কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার,
কোথাও আবার দুঃসপ্নের আনাগোনা।
সপ্ন ভেবে যাকে রেখেছি বুকে আগলে,
অচিরেই দুঃসপ্ন হয়ে করল চুরমার ...
মনের সব প্রিয় ভাবনা।
তরী ভেবে করেছিলাম ভর,
তটিনী পারাবার ত্বরে।
তরী যেন চায় না চলতে,
বাধা হয়ে অজানা বালি চরে।
আশায় আশায় বুক বাঁধি,
হয়ত জীবন চলবে জীবনের শ্রোতে।
প্রতিনিয়ত জীবন করছে জীবনের সাথে খেলা,
উন্মত্ত হয়ে আছে জীবন কে হারাতে।
বিধাতা ও আজ যেন বন্ধ করে আছে দুটি আখি,
ভাগ্যদেবী চলে গেছে অনেক দূর।
বার বার ভাগ্য যে দিতে চায় ফাঁকি।
মরুর বুকে আছি বসে,
যদি হয় এক পশলা বৃষ্টি।
আকাশে চলে সহশ্র মেঘের আনাগোনা,
কিন্তু এক বিন্দু জলকনার উপর ও পরেনী দৃষ্টি।
সময় বদলে যায় সময়ের সাথে,
আমি কিন্তু সেই একই আছি....
নিজেকে বদলানোর কিছুই ছিল না,
এই দুই হাতের রেখাতে।
দুলাল চক্রবর্তী
সাদা কাগজের পাতা
যেদিন আমি চলে যাবো চিরতরে
এ পৃথিবী ছেড়ে
চোখে যদি জল আসে কভু,
হৃদয়টা যদি ভারাক্রান্ত হয়
তাই বেদনার ভিক্ষা ভন্ড নিয়ে যাবো আমি ।
নিঙারিয়া নেবো আমি হৃদয় যন্ত্রনা
মন থেকে মুছে ফেলো সব
অতীতের স্মৃতি।
যে পথে চলতে গিয়ে
হেরে গেছি বারবার !
পান্থশালার দরজা তো বন্ধ অনেক আগেই
দিকভ্রান্ত পথিকটা
শুধু পথ খুঁজে মরছিলো
দু'দণ্ড বিশ্রামের আশায়।
আজ সেই বিশ্রাম পেলো
চিরতরে ধরণীর বুকে।
জাগাতে যেও না তাকে
এই ঘুম আর ভাঙবে না কোনদিন।
কি অছিলায় জাগাবে তারে ?
সে যে আজ চির নিদ্রিত!
অতীতের ডাইরি থেকে ছিঁড়ে ফেলো
সাদা কাগজের এই
দাগ না লাগা পাতাটা।
না লেখা থাকুক শেষ অধ্যায়!
রূপালী মান্না
আলুবীজ
আজ সকাল ১০ টা ৩০ এর দিকে বাড়ির যাবতীয় কাজ সেরে নিয়ে ছাদে বসে আলুবীজ কাটছিলাম।
শশুরমশাই এসে বলে গেলেন - চোখে চোখে কাটবে। চোখে চোখে কথার অর্থ হলো প্রতিটা কল অনুযায়ী পিস পিস করতে।
প্রতিটি চোখে চোখে আলুবীজ কাটতে কাটতে মানুষের জীবনের সাথে এর অসাধারণ মিল পেলাম। কিছু ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে খাতা পেনটা আনলাম। নইলে ভুলে যাবো।
ছোট্ট ছোট্ট আলুবীজগুলোর গা ভর্তি স্বপ্ন অর্থাৎ কল। প্রতিটি কলকে আমি টুকরো টুকরো করে দিচ্ছি যেভাবে একজন মানুষের স্বপ্নকে তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি টুকরো টুকরো করে দেয়। কারণ ফসল ফলাতে গেলে যেমন আলুবীজটাকে টুকরো টুকরো হতে হবে তেমনি স্বপ্নটা পরিপূর্ন করতে গেলে ব্যক্তিকে আঘাতে আঘাতে খাঁটি, পরিশুদ্ধ হতে হয়।
টুকরো আলুবীজগুলো কে নিয়ে চাষী জমিকে চাষযোগ্য করে চাষ করে। আড়াই থেকে তিন মাস জল, সার, চাপান, আগাছানাশক, প্রয়োজনীয় শ্রমিক ব্যয় করে একটা পূর্ণাঙ্গ আলুগাছে পরিণত করে। ঠিক যেরকম আমাদের স্বপ্নের পিছনে আমরা প্রয়োজনীয় শ্রম, অর্থ, সময় দিয়ে থাকি আরকি ! বারবার ভেঙে পরেও যেমন উঠে দাঁড়ায়।
আলুগাছটিতে আলু ধরার ঠিক আগের মুহূর্তে যদি জেদি কোনো নিম্নচাপ এসে তছনছ করে দেয়, তাহলে ?
তাহলে দাদন নিয়ে আলুচাষ করা চাষী অনেক সময় আত্মহত্যা করে , এ খবর আমরা খবরের কাগজে বহুবার পড়েছি ।
একটা আড়াই মাসের ফসলকে কেন্দ্র করে যদি চাষীর জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে , তাহলে সেই ছোট্ট থেকে স্বপ্নবীজ বপন করে আসা ছেলেটার বা মেয়েটার মনের অবস্থা ঠিক কী হয় বুঝতে পারো তোমরা ?
অর্ধেন্দু ভৌমিক
লজ্জা
লজ্জা নিবারণে কাপড় পড়া
হয়তো বা শেখা হয়েছিল কোনদিন
মনে পড়ে না, আজও উলঙ্গ সেজে
নিজেকে সভ্য দাবি করি !
আমার সভ্যতা
উৎরাই পথ কংক্রিট আগলে...
মানুষ হয়ে হৃদয়ে
ছারপোকা পোষ মানি...
বিনয় শীল
প্রজাপতি
প্রজাপতি প্রজাপতি
ফুরফুর করে ইতিউতি
উড়ছো আকাশ কূলে।
চিত্র রাঙ্গা পাখা মেলি
দলে দলে খেলা খেলি
ঘুরছো ফুলে ফুলে।।
লাল নীল হলুদ সাদা
জবা জুঁই টগর গাঁদা
সবার কাছে যাও।
পাপড়ি পরে পা রেখে
পুষ্পরেণু গায়ে মেখে
ফুলের মধু খাও।।
মধু খেয়ে তৃপ্ত মনে
লক্ষ্য এখন অন্য বনে
ছুটছো এঁকে-বেঁকে।
ঝাঁকে ঝাঁকে নামছো আবার
স্বপ্ন শুধু মধু খাবার
পুষ্প কানন দেখে ।।
প্রজাপতি প্রজাপতি
দেখতে বড় কোমলমতি
একটু সঙ্গ দেবে?
রঙিন ডানায় ভর করে
উড়তে ইচ্ছা আকাশ পরে
আমায় সাথে নেবে ?
অভীককুমার দে
এক্কই তালে
ছা-র, ও ছা-র...
যেন্নে যেন্নে শিকাই দিছেন
আন্ডাঅ চিল্লাইছি গলা হাডাই
ব্যেকে মিলি এক্কই তালে,
নঅ বুজি
নঅ হুনি
নঅ জানি
চিল্লাইতে কন হোয়াদ ?
আগে যেই হরেঅ হেই
আজাইর্গ্যা হরিশ্রম...
আরিগ্গা চলকেট দেন থাইকলে,
মিডা কম অইলেই অইবো;
চুইতাম...
আগেরগুন চুইতে চুইতে
এক্কারে মিডা অই গেছিগোই;
হিম্বায় ধরের অন !
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
ত্রিপুরারাজ্যে অতি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি সাধনার ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির তারই একটা উজ্জ্বল উদাহরণ । ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানেও বহু কালীমন্দির রয়েছে এবং নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে আসছে । এক কথায় সারা ত্রিপুরা রাজ্যকেই শক্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজ্যের পিলাক, মাতাবাড়ি, বক্সনগর,এবং ঊনকোটির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লক্ষ্য করলেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।
এ রাজ্যের পাশাপাশি সাব্রুমেও শক্তি চর্চা হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তিক শতাব্দীপ্রাচীন মহকুমা শহর সাব্রুম । তারপরই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা শহর রামগড় । মাঝখানে সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে বয়ে চলেছে ফেনী নদী । সাব্রুম শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ফেনীনদীর পাড়ে রয়েছে প্রাচীন কালীমন্দির । এই মন্দিরটি দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত। খুবই জাগ্রত এই দেবী । সাব্রুমের আপামর জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন । দেবী এখানে 'দক্ষিণাকালী' নামে পূজিতা হয়ে আসছেন । রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম সম্ভবত 'দক্ষিণাকালী' ।স্থানীয় জনগণের কাছে এটাও ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর ন্যায় এক পীঠস্থানের মতো । এই মন্দিরে নিত্য দেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে এই কালীবাড়িতে প্রত্যেক অমাবস্যায় দেবী কালিকার পুজোসহ মেলা ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা-অর্চনাও হয়ে থাকে । বহু বছর যাবত এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে । এককথায় বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার জনগণের গভীর শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন দেবী দৈত্যেশ্বরী কালীমাতা । এই দেবীকে কেন্দ্র করে বহু অলৌকিক কাহিনি সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে । এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে গণেশ চক্রবর্তী, লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন প্রমুখগণসহ আরো অনেকে অনুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ।
দেবী দৈত্যেশ্বরী মন্দির ও তার সৃষ্টিকাল সম্বন্ধে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে । কেউ কেউ বলেন এই পাথরের বিগ্রহটি সাব্রুমের পশ্চিমপ্রান্তের গ্রাম দৌলবাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দৈত্যছরাতে পাওয়া যায় । সেখান থেকে হাতি দিয়ে তুলে এখানে আনা হয় । দৈত্যছরা থেকে পাওয়া যায় বলে এই বিগ্রহের নাম হয়েছে দৈত্যেশ্বরী । আবার একটা অংশের মত হল এই পাথরপ্রতিমাকে সাব্রুম শহরের পূর্বদিকে কিছু দূরের একটি ছরার পাড়ের পাহাড়ের একটি গুহার মধ্যে এই বিগ্রহটি ছিল । সেখান থেকে নৌকাযোগে তুলে এনে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই কাহিনিটিরই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে একদল বলে থাকেন যে, এই বিগ্রহটি শিলাছড়িস্থিত শিলাগুহাথেকে রাজকর্মচারীরা তুলে নৌকা করে এনে এখানে স্থাপন করেন । এই মন্দিরের পাশেই ছিল রাজার তহশিল কাছারি । যা এখনও বর্তমান । যাই হোক, এ সমস্ত কিংবদন্তী বা লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে এই মন্দিরের সৃষ্টির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যোগাযোগ অবশ্যই ছিল ।
এবারে আসা যাক, এই মন্দিরের সৃষ্টির ঐতিহাসিক সূত্রটির সন্ধানে । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসসম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থটির নাম রাজমালা । এই রাজমালার প্রথম লহরের শুরুতে ত্রিপুরার আদিযুগের রাজাদের একটি তালিকা রয়েছে । এই তালিকার পঁয়তাল্লিশতম রাজা হলেন দৈত্য । তাঁর পিতা ছিলেন চিত্ররথ । সুশীলা নাম্নী মহিষীর গর্ভে যথাক্রমে চিত্রায়ুধ, চিত্রযোধি ও দৈত্য নামে তিন রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন । দৈত্যের বড়ো দুইভাইয়ের মৃত্যু হলে দৈত্য রাজা হন । রাজমালা প্রথম লহর ( যযাতি হইতে মহামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ )-এ গ্রন্থারম্ভের পরই দৈত্য খন্ডের শুরুতে রয়েছে―
দ্রুহ্যু বংশে দৈত্য রাজা কিরাত নগর ।
অনেক সহস্র বর্ষ হইল অমর ।।
বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল ।
ত্রিবেগেতে জন্ম নাম ত্রিপুর রাখিল ।।
রাজা দৈত্যের সময়কাল থেকে রাজমালা প্রথম লহরের বর্ণনা শুরু । এই দৈত্য ছিলেন কালিকাদেবীর উপাসক । রাজ্যের প্রবীন গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী তাঁর 'ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ' একদা দৈত্যআশ্রম সন্নিহিত গভীর অরণ্যে ভ্রমণকালে এক মন্দির দেখিলেন । মন্দিরস্থিতা কালিকা দেবীর সশস্ত্র মূর্তি দর্শন করিয়া দৈত্যের মনে ক্ষত্রিয়তেজ জাগিল । দেবীর অর্চনা করিয়া নিষ্ঠার সহিত অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন পারদর্শিতা অর্জন করি এবং মায়ের আ । অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করিয়া এবং মায়ের আশীর্বাদ লইয়া তিনি পিতৃরাজ্যে প্রত্যাবর্তন পূর্বক পাত্র-মিত্র সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন।' এখানে ধারণা করা যায় যে, রাজা দৈত্য অরণ্যস্থিত যে দেবীর অর্চনা করে রাজধানীতে ফিরেছিলেন তিনিই এই দেবী দৈত্যেশ্বরী। এছাড়া মহারাজা রামমাণিক্যের পুত্র রত্নমাণিক্যের (১৬৮২–১৭১২ )দুই মাতুল দৈত্যনারয়ণ ও বলীভীমনারায়ণ নবীন রাজাকে রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন ।বলীভীম নারায়ণ মতাই জোলাইবাড়ি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন । রাজ্যের দক্ষিণ অংশ দেখাশুনা করতেন দৈত্যনারায়ণ । দৈত্যনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর নাম অনুসারে এই দেবীর নাম দৈত্যেশ্বরী হয়েছে বলে মনে করা হয় । বহু বহু প্রাচীনকালে এই সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল অরণ্যসংকুল ছিল । পরবর্তী রাজন্যকুল তাঁদের পূর্বজবংশধরের সাধনাস্থল ও দেবী সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন বলেই পরবর্তী পুরুষেরা তার সন্ধান করে বিগ্রহটি উদ্ধার করেন । অমরমাণিক্যের ( ১৫৭৭–১৫৮৫ )সময়ে এই রাজ্যের দক্ষিণ অংশ মগদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল । তারাও এই দেবীবিগ্রহটি সরিয়ে গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে পারে । অনেকে বলেন মগগণ এই দেবীর পূজা করতেন । এই মন্দিরের ব্যয়নির্বাহসংক্রান্ত হিসাবের একটি পুরানো চিরকূটে চাঁদাদাতা হিসাবে মগ পুরুষ ও নারী ভক্তের নাম পাওয়া যায় । ( তথ্যসূত্র : মন্দিরের প্রথম পুরোহিতের বংশধর তপন চক্রবর্তী, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ) ।
এবিষয়ে রাজ্যের বিশিষ্ট কবি লোকসংস্কৃতি গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে,'এ অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ এলাকা ডাকাত বা মগ দস্যুদের আস্তানা ছিল । এই দস্যুদের পূজিতা দেবী হিসাবে 'দৈস্যেশ্বরী' নামকরণ হতে পারে । এই দৈস্যেশ্বরীই রাজপুরুষ কর্তৃক উদ্ধার হওয়ার পর সংস্কৃতায়িত হয়ে 'দৈত্যেশ্বরী' হয়েছে । এছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত বাংলাভাষায় ( নোয়াখালি ) দৈত্যকে দৈস্য উচ্চারণ করা হয় । যেমন, ব্রহ্মদৈত্যকে বলা হয় ব্রহ্মদৈস্য । কাজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দৈত্য শব্দটিই আসছে দেবীর নামকরণে উৎসরূপে ।' (সাব্রুমের দেবী দৈত্যেশ্বরীর ইতিহাস –অশোকানন্দ রায়বর্ধন ) । গবেষণার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভক্তের কাছে নামে কি আসে যায় । মা তো মা । ভক্তের আকুল প্রার্থনার স্থল । তাঁর চরণপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের হৃদয় ।
যতদূর জানা যায়,উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মন্দিরে পূজার্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সাব্রুমের সম্ভ্রান্ত ব্যানার্জী পরিবার ( রাজ্যের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী কালিপদ ব্যানার্জীর পূর্বপুরুষ ) । এই বাড়ির এক কালীভক্ত সদস্য সতীশ ব্যানার্জী এই মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি । এই মাতৃমন্দির ও মাতৃসাধক সতীশ ব্যানার্জীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সাব্রুমে । উনিশ শতকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব সময়কালে সারা বাংলাদেশ জুড়েই মাতৃসাধনার জোয়ার এসেছিল । তার প্রভাব সাব্রুমেও পড়ে ।
সাব্রুম অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ হলেও ভারতভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ( ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯ ) সাব্রুমের জনগণের ওপারের রামগড়ের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি । এখানকার মানুষ রামগড় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেন । রামগড়ের অনেক ব্যবসায়ীর জমিজমাও ছিল এখানে । তাঁরাও ব্যবসাসূত্রে সাব্রুমে অবস্থান করতেন । দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে তাঁদেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল । দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ির প্রথম পুরোহিত চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর পৌত্র বর্তমানে সাব্রুম শহরের বর্ষিয়ান বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাজলক্ষ্মী গেস্ট হাউসের মালিক শ্রীতপন চক্রবর্তী মহোদয়ের কাছে রক্ষিত তাঁর কাকা হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে লেখা তাঁদের বংশপরিচয় থেকে জানা যায় যে, ১৮৮৫ সালে রামগড়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিরীশচন্দ্র দাস অর্থাৎ গিরীশ মহাজন ( সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের সদ্যবিজয়ী জনপ্রতিনিধি দীপক দাস মহোদয়ের ঠাকুরদাদা ) সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজার্চনা করার জন্য তাঁর আদিনিবাস নোয়াখালির আন্ধারমাণিক গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীকে সাব্রুম নিয়ে আসেন । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, সে সময়টা ছিল মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) আমল ।
চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর চার সন্তান । যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রথম সন্তান যোগেন্দ্র চক্রবর্তী ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন তাঁর কর্মস্থল ছিল খোয়াইতে । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী দেশের বাড়ি নোয়াখালির আন্ধারমাণিকে আসাযাওয়া করে পর্যায়ক্রমে এইমন্দিরে পূজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন এই মন্দিরে দেবীর পূজার্চনা করে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ,শনিবার, কার্তিকী অমবস্যার রাত ৪-৩০ মিনিটে সাব্রুমে পরলোক গমন করেন । তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী মায়ের মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পান । দীর্ঘদিন মায়ের সেবার্চনা করার পর ১৯৬২ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন । তারপর কিছুদিন মায়ের মন্দিরে পুজো করেন উপেন্দ্র চক্রবর্তী । এরপর আবার চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মন্দিরের দায়িত্বে আসেন । হরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরে বর্তমান পুরোহিত অজিত চক্রবর্তীর বাবা শিবশংকর চক্র বর্তী দায়িত্বে আসেন । তাঁরাই বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত মায়ের মন্দিরে পুজো করে আসছেন । ( তথ্যসূত্র : সুব্রত চক্রবর্তী, সাব্রুম ) ।
রাজন্য আমলে রাজা বা রাজপুরুষেরা মন্দির সংলগ্ন তহশিলী কাছারিতে খাজনা আদায় বা পুণ্যাহের জন্য এলে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়েই তাঁদের কাজ শুরু করতেন । রাজার আমল থেকে এই পুজো চলে আসছে কিন্তু এই মন্দিরের কোনরকম রাজানুকুল্য বা সরকারি বরাদ্দ আজ অবধি নেই । পুরোহিতদেরও কোনো মাসোহারা বরাদ্দ নেই । একসময়ে মন্দিরের সামনে ও পেছনের সামান্য ভূমিতে খেতকৃষি করে তাঁরা সংসার চালাতেন । মন্দির কমিটি তাঁদের সামান্য মাসোহারা বরাদ্দ করেন । য়ন্দিরটিও ছোট্ট একটি চারচালা ঘর ছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল পুরোহিতের আবাস । আর ভক্তদের দানদক্ষিণায় তাঁদের সংসার চলে । মন্দিরেরও নিজস্ব কোনো স্থায়ী তহবিল নেই । ভক্তবৃন্দের আর্থিক অনুদানে মায়ের মন্দিরের সব ব্যয় নির্বাহ হয় ।
রাজন্য আমল ও তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে দীর্ঘদিন মন্দিরের উত্তরদিকের নাতিউচ্চ টিলাটিতে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । বর্তমানে এটি সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় । তার সামনের পুকুরটি 'কালীপুকুর নামে পরিচিত । মন্দিরের কালিকাবিগ্রহ একখন্ড পাথরবিশেষ । শ্রদ্ধেয় তপন চক্রবর্তী মহোদয় আলাপচারিতায় জানিয়েছেন এই বিগ্রহ মাটির নীচে অনেকখানি প্রোথিত আছে । লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই বিগ্রহ পূর্বে আরো ছোটো ছিল । ধীরে ধীরে বিগ্রহের উচ্চতা বেড়ে বর্তমান আকার নিয়েছে ।
দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িত । একসময় রাস্তাঘাট দুর্গম থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে যেতেন পুজো দেওয়া কিংবা মানত রক্ষার জন্য । পরবর্তীসময়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তার মাধ্যমে যাতায়াত করতেন । কিন্তু যাঁরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল তাঁদের জন্য দৈত্যেশ্বরী মা একমাত্র আশ্রয়স্থল । শক্তিতীর্থভূমি । মা তো জগজ্জননী । ভক্তগণ এখানেই মায়ের চরণে ভক্তি নিবেদন করেন । এই মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিচিত্তে পুজো, মানত করেন । বিয়ের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে এবং বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে বিয়েবাড়ির সবাই এই মন্দিরে এসে প্রণাম করার রেওয়াজ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত । জাগ্রত দৈত্যেশ্বরী মাকে বালিকাবেশে গভীর রাতে মন্দিরচত্বরে পরিভ্রমন করতে দেখেছেন বলে দাবি করেন অনেক ভক্ত । এই মায়ের মন্দিরের খ্যাতি এতদূর বিস্তৃত যে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ্যের বাইরে ও বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে মায়ের দর্শন করতে আসেন ।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলাশাসক থাকাকালীন সময়ে মাণিকলাল গঙ্গোপাধ্যায় মায়ের বাড়ির উন্নয়নের জন্য অর্থবরাদ্দ করেছিলেন । শোনা যায় তিনি মায়ের বিগ্রহের দুই নয়ন স্বর্ণ দিয়ে নির্মান করে দিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই মায়ের মন্দিরের বর্তমান মন্দির ও প্রাঙ্গনের সামনের দিকে অবস্থিত শিবমন্দিরটি ছাড়া লক্ষণযোগ্য তেমন কাজ হয়নি ।
সাব্রুমে ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু নির্মানের পর মহকুমার বাইরে থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ দৈত্যেশ্বরী মন্দির দর্শনের জন্য আসেন । ফলে এই মন্দিরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে । এখানে এসে তাঁরা মন্দির চত্বরে বিশ্রাম করেন ও পুজো দেন । এই সুপ্রাচীন মন্দিরকে ভক্তমন্ডলী ও পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ্যে অতি সত্বরই সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া আবশ্যক ।
Subscribe to:
Posts (Atom)
উর্মি সাহা
মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...
-
আজ আশ্বিনের শেষ কার্তিকের শুরু এই দিনটা বিশেষ ভাবে বিশেষ, বাংলার এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। জানি না বাংলার বাইরেও এইভাবে বিশেষ হয়ে উঠেছে কিন...
-
মূক ফেনীর মুখর পাঁচালি একটি বহুল প্রচারিত বাংলা প্রবাদ ‘ভাগের মা গঙ্গা পায়না’ ৷ প্রবাদটির মধ্য দিয়ে মায়ের অসহায়ত্বের যন্ত্রণাটিই ব্যক্ত হয়ে...