Sunday, January 29, 2023

কবি ভবানী বিশ্বাসের লোকজগদ্য

চৈত্র সংক্রান্তি

চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ পরব। এই দিনটার জন্য আমরা একটা বছর অপেক্ষায় থাকি। পরবের আগের দিনটাকে বলা হারুবিষু বা ফুলবিষু। এই দিন ফুল তোলা হয় বলেই দিনটা ফুলবিষু নামে পরিচিত বলে শোনা যায়। 

বাঙালিদের সাধারণত বছরে কমপক্ষে দুবার
বাড়িঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র ধুয়ে মুছে পরিস্কার করতে হয়। সেটা হচ্ছে দুর্গাপূজা আর পরবের সময়। সুতরাং চৈত্র মাসে আমাদের কাজের শেষ নেই। ফুলবিষুর দিন পর্যন্ত আমাদের যাবতীয় টুকটাক কাজ চলতেই থাকে। 

ওইদিন বিকালে জাঁক কাটা হয়। প্রায় সব গাছের শাখা/পাতা সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ঔষধি গাছ যেমন বিষকাডালি, বাসক, নিম পাতা ইত্যাদি অবশ্যই থাকবে। পাঁচ বা সাতরকমের কাঁটা গাছ যেমন আনারস, মন কাটা, ভেদ গাছ.. ইত্যাদি। 


ওইদিন রাত জেগে সাধারণত বাড়ির ছোটরা মা বোনেরা মালা গাঁথার কাজ করে।এই মালার জন্য আকন্দ, হাঁড়িয়া, কাঠগোলাপ নানারকম ফুল ব্যবহার করা হয়। যেগুলো কিনা নিতান্তই অবহেলায় রাস্তার ধারে, টিলার পাশে, পুকুরের পারে বেড়ে ওঠে,আমার মনে হয় ওই ফুলগুলো এই মালা গাঁথার জন্যই অপেক্ষা করে। 

ওইদিন বিকালে বা সন্ধ্যায় বাড়ির মহিলারা সবাই খইয়ের নাড়ু বানায়। সবাই মিলে মন্ত্রের মতো বলে-
"মহাদেবের বাণ বান্ধিয়ের,বছরের বাণ বান্ধিয়ের, টেয়া বান্ধিয়ের, হইসা বান্ধিয়ের, ঘর বান্ধিয়ের, দুয়ার বান্ধিয়ের, সুখ বান্ধিয়ের, আনন্দ বান্ধিয়ের,হোলা বান্ধিয়ের,বউ বান্ধিয়ের,ঝি বান্ধিয়ের, জামাই বান্ধিয়ের.... বছরের বাণ বান্ধিয়ের"। খইয়ের ছাতুর নাড়ু বানানোর সময় এই কথাগুলো বলেন। 

 পরবদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রথম জাঁকে আগুন দেওয়া হয়। জাঁকের আগুনের ধোঁয়া সবাই গায়ে লাগাতো। আর সবাই বলতাম- " যাক যাক যাক, আমার বাড়ির রোগশোক, দুঃখ দুর্দশা, মশামাছি খারাপ যতসব বাইরই যাক। আইয়োক আইয়োক আইয়োক বিদ্যাবুদ্ধি, ধনদৌলত, সুখশান্তি, সব আমার বাড়িত আইয়োক"। শুনেছি এই ধোঁয়া গায়ে লাগালে রোগশোক কম হয়। জানি না এর ফল আদৌ কিছু হয় কিনা! পূর্বপুরুষরা বলে এসেছে, আমরাও তা পালন করছি। অনেকটা পরম্পরার মত। 

এরপর সকালবেলা নদী থেকে জল আনতে হয়। আমরা নদীকে বলি গঙ্গা। সকালবেলা বাড়ির বড়রা বলে গঙ্গার জল আনতে অর্থাৎ নদীর জল। সঙ্গে লাগে আমের পল্লব। 

উঠোনের মধ্যে অল্প একটু জায়গা গোবর দিয়ে লেপা হয়। সেখানে ধুপকাঠি মোমবাতি জ্বালানো হয়। ( যাদের গরু আছে তারা ঘুম থেকে উঠে গরু ঘরের দরজায় ধুপকাঠি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়)। 

এবার গাটগিলা প্রস্তুত পর্ব শুরু হয়। ( গাটগিলা এক ধরনের লতানো গাছের বীজ। দেখতে অনেকটা সিমের বীজের মতো। এর ভিতরে অনেকগুলো বীজ থাকে)। এই বীজের ভিতরের অংশ নিয়ে সঙ্গে নিমপাতা, কাচা হলুদ, শষ্য, শষ্যের তেল সব দিয়ে পিড়ির( বিয়ের সময় বর কনে বসার জন্য ব্যবহৃত)মধ্যে বাটা হয়। 

এই ফাঁকে রাস্তায়(বাড়িতে প্রবেশের মুখে)গোবর ও ফুল(সাধারণত হলকা ফুল) দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়। কেউ কেউ ফুলবিষুর দিন দেয় আবার কেউ পরব দিন দেয়। 
এটা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। বাড়ির সকলের মঙ্গলের জন্য দেওয়া হয়। নতুন বছর যাতে পুরোনো শুভ সম্পদগুলিকে নিয়ে না যায় এবং বাড়িতে যাতে কোনো খারাপ প্রভাব ঢুকতে না পারে। এই বাঁধটি শুধুমাত্র গোবর দিয়েই দেওয়া হয়। গোবরকে বিষ্ণুর অংশ ভাবা হয় আর বিষ্ণু হচ্ছেন আমাদের শুদ্ধতার দেবতা। 

এবার গাটগিলা মাখানো হয় গরুর গায়ে। সঙ্গে গরুকে মালা পড়ানো হয়। স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিবা(বেত) বানাতে হয়। এই বেত শুধুমাত্র ভাটফুলগাছ আর পিছলা গাছ দিয়ে তৈরি করা হয়। 

সাধারণত বাড়ির পুরুষরা গরুকে স্নান করাতে নিয়ে যায়। গাটগিলা দিয়ে গরুকে স্নান করানো হয়।

এই গাটগিলা দিয়ে সবাই ওইদিন স্নান করে।  পরবে সুগন্ধযুক্ত গাটগিলা দিয়ে স্নান করা যেন গঙ্গায় স্নানের মতোই পবিত্র। 


স্নান সেরে বাড়ি এসে তিতা পাতা অর্থাৎ থানকুনি পাতা বা নিমপাতা খাওয়া হয়। তারপর যে যার সামর্থ অনুযায়ী নতুন জামা কাপড় পরে ঘরের দরজায়, ঠাকুর ঘরে, বান্ধের ঘটে, পূর্বপুরুষদের মন্ডপে এবং যাবতীয় কৃষি সামগ্রী যেমন- কোদাল,লাঙল,দা ইত্যাদিতে গত দিনের তৈরি করা মালা দেয়। 

এবার শত্রু নিধনের পালা ( হত্তর উড়ানি)। বাড়ির রাস্তার মাথায় কাঁচি দিয়ে মাটিতে একটা ঘর এঁকে মাঝখানে আম রেখে উবু হয়ে দু-পায়ের নিচ দিয়ে এক কোপদিয়ে আমটাকে দু-টুকরো করার চেষ্টা করা হয়। 


এবার সবাই মিলে বাড়িতে খই, মুড়ি, নাড়ু, নারিকেল, দুধ, দই, কলা, চিনি, গুড় ইত্যাদি মেখে খাওয়া হয়।এই খাবারটাই মূলত পরবের বিশেষত্ব।এটা খাবার নয় যেন  অমৃত। 

খাবার পর আর যেন বিশ্রাম নেই। পাচন রান্নার জন্য যাবতীয় সব্জি তৈরি করতে হবে। এর জন্য স্পেশাল হচ্ছে কাঁচা কাঁঠাল।সঙ্গে 'তারাকাট্টুস' অবশ্যই থাকবে হবে।আমাদের গ্রামের অনেকেই কৃষিজীবী। যার ফলে খেতের ফসল এক পরিবার অপর পরিবারকে ভাগ করে দেয়। সবাই মিলে আনন্দ করে কাটাকুটি করে। এটা হচ্ছে একতা, সৌভাতৃত্ব বা পরস্পরের সাথে পরস্পরের মিল। এই বোধটা সকলের থাকা আবশ্যক। সংকীর্নতায় প্রকৃত আনন্দ নেই। 
যাইহোক, যাবতীয় সব্জি দিয়ে পাচন রান্না করা হয়। তারপর ডেকে ডেকে সবাইকে খাওয়ানো হয়। এটা আমাদের আনন্দ। সবাইকে দিয়ে খাওয়ার আনন্দই যেন পরম সুখ। যা আমাদের পূর্বপুরুষরা শিখিয়েছেন। 

সন্ধ্যায় চড়কগাছ ঘোরানো হয়। পাড়ার প্রত্যেক মহিলা বা মায়েরা চড়কগাছে ধানদূর্বা, তেল সিঁদুর, কলা, ডিম, ধুপকাঠি মোমবাতি ইত্যাদি দেওয়া হয়। ডিম দিয়ে ঠাকুর মানানো হয়। মানানো মানে হচ্ছে ঠাকুরকে ডাকা।এই ডিম আবার চড়কের মধ্যে এবং চড়কগাছের গোড়ায় দেওয়া হয়। ডিমের পিচ্ছিলতার কারণে যাতে চড়কটা গাছের ভিতরে ঢুকতে সুবিধা হয়।গাছ লাগানো হলে মহাদেবের মুর্তি মাথায় নিয়ে সাতবার প্রদক্ষিণ করা হয়।

উলুধ্বনিতে ঢাকের আওয়াজে চারিদিক যেন আনন্দে মাতাল হয়ে যায়। চৈত্রের হালকা দাবদাহ সঙ্গে দক্ষিনের হাওয়ায় পরিবেশটা মাতোয়ারা করে তোলে। 
এইভাবেই প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে আমাদের চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ পরব।

No comments:

Post a Comment

উর্মি সাহা

মন ব্যাথা . বক্রের মত বেঁকে গেছে আমার জিহ্বা৷ আর কথা আসে না! শুনি শেষ প্রার্থনা নয়তো বেজে ওঠা গির্জা ঘণ্টা। তবু দেখি যন্ত্রণা... যদি কোনো হ...